স্বর্ণপামসহ বিশ্বের অনেক সেরা পুরস্কারজয়ী ইরানি চলচ্চিত্রকার আব্বাস কিয়ারোস্তামি। তাঁর ‘দ্য টেস্ট অব চেরি’, ক্লোজআপ’, ‘সার্টিফায়েড কপি’র মতো অসাধারণ সব চলচ্চিত্র নির্মাণের কারণে চলচ্চিত্রবোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের মনে তিনি সম্মানের আসন পেতে বসে আাছেন।
কিয়ারোস্তামির প্রয়াণের পর অস্কারজয়ী ইরানি চলচ্চিত্রকার আসগর ফরহাদি বলেন, ‘কিয়ারোস্তামি শুধুই একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা ছিলেন না, তিনি একজন আধুনিক মরমি কবিও ছিলেন। চলচ্চিত্রে ও ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন মরমি। তিনি অন্যদের জন্য পথ তৈরি করে গেছেন। শুধু চলচ্চিত্র জগৎই একজন মহান নির্মাতাকে হারাল না, পুরো পৃথিবীই একজন সত্যিকার মহান মানুষকে হারাল।’
কিয়ারোস্তামি তাঁর স্বদেশে ততোখানি পূজিত ছিলেন না। এ প্রসঙ্গে আরেকজন খ্যাতিমান ইরানি পরিচালক মোহসেন মাখমালবাফ বলেছেন, “পুরো পৃথিবীই তাঁর অসাধারণ কাজের কথা জানে, কিন্তু নিজের দেশে তা পুরোপুরি পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়নি। কিয়ারোস্তামির মাধ্যমেই ইরানি ছবি আন্তর্জাতিক সুনাম পেয়েছে। কিন্তু ইরানে তাঁর ছবিগুলোর প্রদর্শনী সেভাবে হয়নি। তিনি চলচ্চিত্রের ভাষা পরিবর্তন করে দিয়েছিলেন, হলিউডি ছবির তুলনায় চলচ্চিত্রকে মানবিক করে তুলেছেন। তিনি ছিলেন জীবনীশক্তিসম্পন্ন একজন মানুষ। তিনি জীবনকে ভালোবাসতেন এবং তাঁর চলচ্চিত্রে জীবনেরই জয়গান গেয়েছেন, তাই মৃত্যুর সঙ্গে তাঁকে মেলানো যায় না। তাঁর মৃত্যুকে মানা যায় না।”
কিয়ারোস্তামি ১৯৪০ সালের ২২ জুন ইরানের তেহরানে জন্মগ্রহণ করেন। তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি পড়াশোনা করেছেন। বিষয় ছিল চারুকলা। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করার পর তিনি গ্রাফিক ডিজাইনার হিসেবে কাজ শুরু করেন। চিত্রকর, নকশাবিদ ও অঙ্কনবিদ হিসেবে ষাটের দশক থেকে বিভিন্ন বিজ্ঞাপন সংস্থায় কাজ করেন। ১৯৬২ থেকে ১৯৬৬ সালের মধ্যে তিনি ইরানের টেলিভিশনের জন্য প্রায় ১৫০টি বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাণ করেছিলেন। এই দশকের শেষের দিকে সিনেমার নাম ও ক্রেডিট ডিজাইন শুরু করেন এবং শিশুতোষ গ্রন্থের প্রচ্ছদ আঁকতে শুরু করেন। একজন চিত্রশিল্পীর এই পথে এগিয়ে যাওয়া অনেকটা সত্যজিৎ রায়ের কথা মনে করিয়ে দেয়। সত্যজিৎও পেশাজীবন শুরু করেছিলেন অঙ্কনবিদ ও শিশুতোষ গ্রন্থ ও সাময়িকীর প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে। কিয়ারোস্তামি মাসুদ কিমিয়াই এর গুরুত্বপূর্ণ সিনেমা কায়সার (১৯৬৯) -এর ক্রেডিট ডিজাইন করেছিলেন। ১৯৬৯ সালে তিনি ‘দ্য সেন্টার ফর দ্য ইন্টেলেকচুয়াল ডেভেলপমেন্ট অব চিলড্রেন অ্যান্ড ইয়ং অ্যাডাল্ট’ প্রতিষ্ঠানে যোগদানের মাধ্যমে তিনি এ প্রতিষ্ঠানটির চলচ্চিত্র বিভাগের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। কিয়ারোস্তামি মুলত তখন থেকেই নিজের চলচ্চিত্রগুলো নির্মাণ করতে শুরু করেন। ১৯৬৯ সালে দারিয়ুশ মেহরুজির বিখ্যাত সিনেমা গব এর মাধ্যমে ইরানী নবতরঙ্গের যাত্রা শুরু হয়। কিয়ারোস্তামি’র প্রথম চলচ্চিত্র ছিল ১২ মিনিটের স্বল্পদৈর্ঘ্য প্রামাণ্য চিত্র ব্রেড এন্ড অ্যালি (১৯৭০)। দোকান থেকে রুটি কিনে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরতে থাকা এক শিশুর সাথে রাস্তায় একটি কুকুরের মোকাবেলার কাহিনি নিয়ে নির্মিত হয় নব্য বাস্তবতাবাদী এই চলচ্চিত্র। এরপর ১৯৭২ সালে নির্মাণ করেন ব্রেকটাইম। এক পর্যায়ে ‘দ্য সেন্টার ফর দ্য ইন্টেলেকচুয়াল ডেভেলপমেন্ট অব চিলড্রেন অ্যান্ড ইয়ং অ্যাডাল্ট’ ইরানের একটি আধুনিক চলচ্চিত্র স্টুডিওতে পরিণত হয়। আব্বাসের পাশাপাশি তারা ইরানের অন্যান্য বিখ্যাত চলচ্চিত্রকারদের সিনেমাও প্রযোজনা করতে শুরু করে।
[hfe_template id=’81’]
২০০৫ সালে গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে কিয়ারোস্তামি বলেছিলেন, “শুরুর দিকে শিশুদের সমস্যা নিয়ে শিশুতোষ চলচ্চিত্রগুলো নির্মাণ করেছি। প্রথমত সেটা ছিল আমার চাকরির একটি অংশ। এই কাজই আমাকে শিল্পী করে তুলেছে।”
কিয়ারোস্তামি তাঁর প্রথম ছবি ‘দ্য রিপোর্ট’ নির্মাণ করেছিলেন ১৯৭৭ সালে। উল্লেখ করতেই হয়, ১৯৯৯ সালে ইরানের বিপ্লবের পর অনেক শিল্পীই দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। অধিকাংশ নির্মাতাই পশ্চিমা দেশগুলোতে চলে যান। কিন্তু আব্বস বিশ্বাস করেন দেশে থাকাটাই তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ভাল সিদ্ধান্ত ছিল। তিনি নিজেই বলেছেন, ইরানে থেকে নিজের জাতীয় পরিচয় ও সত্ত্বা আঁকড়ে থাকার কারণে তার চলচ্চিত্র জীবন মহিমামণ্ডিত হতে পেরেছে। তিনি এ বিষয়ে বলেছিলেন,“মূলোৎপাটিত করে একটি গাছকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে গেলে সে আর ফল দেবে না। অন্তত আপন স্থানে সে যত ভাল ফল দিত নতুন স্থানে তত ভাল দেবে না। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। আমি মনে করি দেশ ছেড়ে গেলে আমার অবস্থা হতো সেই গাছের মত”। কিয়ারোস্তামি নতুন সরকারের কঠোরতার মধ্যেই নিজের কাজ করে গিয়েছেন। তিনি তখন দেশ ছাড়েন নি, ইরানেই থেকে গিয়েছিলেন এবং আশির দশকের শেষ থেকে নব্বইয়ের দশকের শুরু পর্যন্ত তাঁর ট্রিলজি ‘হোয়ার ইজ দ্য ফ্রেন্ডস হোম (১৯৮৭)’, ‘লাইফ অ্যান্ড নাথিং মোর…’ (১৯৯২) ও ‘থ্রু দ্য অলিভ ট্রিজ’ (১৯৯৪) নির্মাণ করেন। এই ট্রিলজি কখনো বাস্তব, কখনো কল্পনার পথ ধরে চলেছে, কখনো বিবরণ, কখনো তথ্য প্রকাশ করতে এগিয়েছে। চলচ্চিত্র নির্মাণের এই বৈচিত্র্যের কারণেই চলচ্চিত্র বোদ্ধাগণ মনে করেন, আব্বাস কিয়ারোস্তামিকে কোনো তকমা দেওয়া সম্ভব নয় কারণ তাঁর সৃষ্টিকে ইচ্ছে করলেই কোনো ছাঁচে ফেলা যায় না।
১৯৯৭ সালে কিয়ারোস্তামি কান চলচ্চিত্র উৎসবে পাম দ’র পুরস্কার অর্জন করেন।‘দ্য টেস্ট অব চেরি’ চলচ্চিত্রের জন্য তাঁকে এই সম্মান প্রদান করা হয়। এই ছবির পর কিয়ারোস্তামির বিচিত্র সব ভাবনা বিচিত্র সব পথে গিয়েছে এবং তিনি যা নির্মাণ করেছেন, তার সব কটিই অর্জন করেছে নতুন নতুন অর্থ। এমনকি এ সময় ‘এবিসি আফ্রিকা’ বা ‘টেন অন টেন’-এর মতো যে তথ্যচিত্রগুলো নির্মাণ করেছেন, তাও ছিল অনন্য। ‘সার্টিফায়েড কপি’, ‘শিরিন’ ও ‘লাইক সামওয়ান ইন লাভ’ চলচ্চিত্রগুলোও স্মরণযোগ্য।
২০১২ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে ‘লাইক সামওয়ান ইন লাভ’চলচ্চিত্রটি যখন প্রদর্শনে যায়, তখন বিখ্যাত ফিল্মমেকার ম্যাগাজিনে তাঁর একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “সিনেমার শুরু আর শেষ আসলে আমাদের একধরনের স্বেচ্ছাচারিতা। ধরুন, এটা একটা নব্বই মিনিটের ফুটবল ম্যাচ। এর বেশিও না, এর কমও না। আমরাই ঠিক করে দিচ্ছি, দর্শক কতক্ষণ থাকবে। সিনেমার বেলায়ও তা-ই। কিন্তু পরিচালকের কিছু দায়বদ্ধতা থেকেই যায়। তাই তাকে গল্প শুরু এবং শেষ করার একটি জায়গা ঠিক করে নিতেই হয়।”
[hfe_template id=’81’]
কিয়রোস্তামির চলচ্চিত্রের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, শিশু চরিত্রের প্রাধান্য, প্রামাণ্য চিত্রের মত সিনেমাটোগ্রাফি, গ্রাম্য এলাকায় শুটিং। বিশেষ করে ব্যক্তিগত গাড়ির ভেতর কথোপকথনে তিনি অনেক সময়ই গাড়ির ভেতর রাখা একটি স্থির ক্যামেরায় চালক এবং যাত্রীর কথোপকথন ধারণ করেছেন। তাঁর চলচ্চিত্রে সমসাময়িক ইরানী কবিতার প্রভাব খুব সহজেই লক্ষ্যণীয়। তিনি নিজের সিনেমার সবকিছুই প্রায় নিজের হাতে করতেন। রচনা, পরিচালনা, চিত্রগ্রহণ, সম্পাদনা, সঙ্গীত ও শব্দ সংযোগ সবকিছুতেই তার একচ্ছত্র প্রভাব থাকতো। মাহমুদ আহমাদিনেজাদ ইরানের ক্ষমতায় আসার পর কিয়ারোস্তামি তার সিনেমার শুটিং ইরানের বাইরে করতেন।
২০১৬ সালের মার্চ মাসে কিয়ারোস্তামির শরীরে ক্যানসার ধরা পড়ে। তিনি প্যারিসে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ২০১৬ সালের ৪ জুলাই তিনি ৭৬ বছর বয়সে ফ্রান্সের প্যারিসে মৃত্যুবরণ করেন।