অরোরার আঙুল – ০৩

কাজী রাফি

কথাশিল্পী

সেদিন সকালে অরিত্র অরোরার অফিসে জরুরি এক ফাইল নিয়ে ছুটল । তার অফিসের প্রবেশপথেই সে অরোরাকে পেয়ে গেল। অফিসে প্রবেশপথের ডানপাশে, দেয়ালে এক পোস্টার সেঁটে দিতে গলদঘর্ম অরোরা তাকে দেখে স্মিত হেসে বলল, “অফিসার আমাকে একটু সাহায্য করতে পারো, প্লিজ।“

অরোরার অনুরোধে তারা দুজনে মিলে পোস্টারটা পেরেক দিয়ে দেয়ালে আটকিয়ে দিল। তারপর অরিত্র মনোযোগ দিয়ে পোস্টারটা পড়া শুরু করল। সেখানে লেখা, ‘Please Don’t SMOKE in my office. I love to be in LOVE than smoking and you won’t find me Screwing in your office.’ পোস্টারটায় পড়ে সে লাজুক হয়ে উঠেও বিস্ময়ের সাথে অরিত্র এই প্রথম খেয়াল করল, অরোরার ডান হাতের মধ্যমা নামের সবচেয়ে লম্বা আঙুলটিতে কিসের যেন গভীর এক লম্বা কাটা দাগ।

‘কারো হাতে এমন দাগ থাকতেই পারে –এ নিয়ে অবাক হওয়া কেন?‘ কথাগুলো নিজেকে বলেও অরিত্র শান্ত হলো না। বরং অনিন্দ্য সুন্দর এই আঙুলগুলোর মাঝে ডান হাতের মধ্যমা তাকে যেন কিসের এক রহস্যময়তার কথা বলল। অরিত্রের অকারণেই মনে হলো, অরোরার আঙুলে এই কাটা দাগের মাঝে কোনো এক দুঃখময় অতীত রহস্য লুকিয়ে আছে। সেই অতীত থেকে সারাক্ষণ পালিয়ে বাঁচতেই অরোরা তার বাইরের খোলসে এক লাগামহীন স্বাধীনতার বেপরোয়া ভাব বজায় রাখে। অরোরার আঙুলের কাটা দাগটুকুর রহস্য নিয়ে বিচিত্র ভাবনায় ডুবে থাকা অরিত্রকে অরোরা মনোযোগ দিয়ে দেখল। অরোরার চোখে চোখ পড়ে তার চোখে-মুখে লাজুক এক অভিব্যক্তি ফুটে উঠতেই অরোরা তাকে বলল, “তুমি জানো, আমি খুব কমই ড্রিঙ্কস করি। কারণ আমি জীবনটাকে পুরোপুরি উপলব্ধি করতে চাই। আমি আটলান্টিকের পাশে দাঁড়িয়ে এর নিস্তরঙ্গ ঢেউয়ের ভেতর যে অনবদ্যতা তা শুধু কান দিয়ে নয়, হৃদয় আর অন্তর দিয়ে তা আকণ্ঠ পান করতে চাই। সকালের প্রথম সূর্য ওঠায় যে বর্ণচ্ছটা তার রঙে আপ্লুত হতে চাই। অরিত্র, আমি আসলে অতীতের যা কিছু গ্লানি অথবা সমাজে চলমান পঙ্কিলতা, তার সবকিছু ভুলে থাকতে চাই।“

অরিত্র কিছুটা অবাক হয়ে অপার মুগ্ধতায় লাস্যময়ীর চোখে শ্রদ্ধাভরে চোখ রাখল। সে মিষ্টি করে হেসে তাকে তার অফিসে নিয়ে গিয়ে বসাল। বাইরের কফি মেকার থেকে কফি বানিয়ে তার দিকে তা এগিয়ে দিয়ে বলল, “আমার কথাগুলো তোমার বিশ্বাস হয় নি, তাই না?“

[hfe_template id=’81’]

 অরিত্র তাকে বলল, “না, তা ঠিক নয়, আমি বরং … “

 কফি কাপে দ্রুত চুমুক দিয়ে কাপটা রেখে অরোরাই আবার বলল, “তুমি জানো, পুরুষের মুখে আর শরীরে সিগারেট অথবা মদের গন্ধ লেগে থাকা কত আনস্মার্ট একটা ব্যাপার, তোমরা; পুরুষরা যদি তা বুঝতে!“

 তার ভাবনাগুলো তার মুখ হয়ে বুদবুদ হয়ে ঝরেই চলছে, “মানুষের অনুভূতির কেন্দ্রবিন্দু তো প্রথমত তার মাথা তারপর পুরো শরীর। তো সেই মাথাটা যদি সিগারেটের আর তামাকের ধোঁয়ায় ভরে রাখো, লিভারটাকে মদ গিলে গিলে পঁচিয়ে ফেলো, যদি ড্রাগস নিয়ে অনুভূতি পরিবহনের স্নায়ুগুলো অকেজো করে ফেলো –তাহলে শিশিরভেজা একটা সকালের আনন্দ, মেঘলা আকাশে ঢেকে থাকা মহান আটলান্টিকের ভাষা কীভাবে বুঝবে, বলো! এসব বোঝার প্রথম শর্ত হলো, মাদকাসক্ত (সিগারেট খাওয়াও অরোরার দৃষ্টিতে মাদকাসক্তি) না হয়ে স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ উপহার এই আমাদের মননকে ধরে রাখা। নারীকে সুন্দর একটা মন নিয়ে যে ভালোবাসতে হয় –আজকাল তো তোমরা সেটাও ভুলে গেছ!“

এই হলো অরোরা! তবু এভাবে নিজেকে প্রকাশ করে অরোরা যেন আসলে নিজেকে লুকিয়ে রাখার এক মহৎ ভান ধরে আছে। কিন্তু এই বিদেশ বিঁভূইয়ে এসে অরোরার সাথে পরিচিত হওয়ার পর এবং তার কারণেই নতুন পরিবেশ-পরিস্থিতির সাথে দ্রুত অভিযোজিত হওয়ার প্রেরণা পাওয়া অরিত্র তার মধ্যমা নামের সুন্দর আঙুলে লম্বা এক কাটা দাগের রহস্য নিয়ে আনমনে অনেক কিছুই কল্পনা করে। শুধু তার মনে হয়, অরোরার আঙুলের নিচ থেকে ওপর পর্যন্ত কাটা এই দাগটুকুতে লুকিয়ে আছে তার জীবনের দুঃখময় কোনো অধ্যায়। একান্ত বেদনার সেই জীবন অধ্যায়টুকু অরোরার বিস্ময়কর সৌন্দর্যের কাজল আঁকানো চোখ দুটিতে আশ্রয় নিয়ে বিষন্ন আর ভেজা ভেজা পাপড়ির মাঝে লুকিয়ে থাকে।

অরোরার আঙুলের এই কাটা দাগটুকুর মাঝে লুকানো অপার কোনো রহস্য জানার অদম্য আগ্রহই অরিত্রকে উল্টা অরোরার সামনে ভাষাহীন করে ফেলে। প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে জেগে বাইরের প্রকৃতির দিকে সে মুগ্ধ আর মগ্ন হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। আশ্চর্য! এই নির্জন প্রকৃতির অনন্য সৌন্দর্য আর আটলান্টিকের গর্জনের সাথে অবারিত নীলাকাশ আর নির্জন পথটার পানে তাকালে ছোটবেলায় দেখা মুভি অব দ্য উইকে দেখা নাম ভুলে যাওয়া কোনো এক চলচ্চিত্রের নায়িকার আজো অপেক্ষার লগ্নটা ভেসে ওঠে। প্রিয়জনকে বিদায় জানানোর জন্য দরজার চৌকাঠে হেলান দিয়ে আজো যেন তিনি অপেক্ষায় আছেন। তার লম্বা, সুন্দর আঙুলগুলোতে অপেক্ষার বেদনার ভাষা। নায়িকার সেই আঙুলগুলো ক্রমশ অরোরার আঙুল হয়ে যায়। ডানহাতের মধ্যমায় দীর্ঘ এক আঁচড়ের দাগ নিয়ে অরোরাই যেন ‘মুভি অব দ্য উইকের সেই নায়িকার মতো ‘অপেক্ষা’ শব্দকে অভিব্যক্তিতে ধারণ করে দরজার চৌকাঠে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আজো।

না, সে আর অপেক্ষা করবে না। কাজে ব্যস্ত অরোরার অলস মুহূর্তে যখন ওর চোখগুলোতে অলসতার কাছে বিনীত লজ্জা তাকে আরো বিনয়ী করে তোলে তখনই সে অরোরাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করবে।

[hfe_template id=’81’]

জানালা থেকে চোখ ফেরায় সে। নির্জন পথটার ঘোর কাটিয়ে আড়মোড়া ভাঙতেই মনে হয়; অরোরা তার প্রশ্নের প্রত্যুত্তরে এমন করে হাসবে –যেন তার মানে হলো, অরোরা তাকে বলবে- ‘তুমি এটুকু জানো না? কেন কারো আঙুলে গভীর এক আঁচড়ের দাগ থাকতে পারে, বলো তো?‘ অরিত্র আমতা আমতা করবে – ‘আঙুলটা কেটে গিয়েছিল হয়তো… কিন্তু …’ বাস্তবে ঘটল উল্টা ঘটনা। সেদিন অন্য বিভাগের অধিকাংশ স্টাফদের সাথে তার বিভাগের অ্যারোন মাতোমা বৈঠক নিয়ে ব্যস্ত থাকায় অফিস এলাকা একেবারেই ফাঁকা ছিল। একটা ফাইল হাতে নিয়ে অরিত্র অরোরার সামনে গিয়ে বসল। অরোরা গভীর মনোযোগে কম্পিউটারে কাজ করছিল। কাজটা শেষ করে সে তার সামনে বসে থাকা অরিত্রকে বলল, “সরি, আমাদের অর্থ সংক্রান্ত প্রতিবেদনটা পাঠাচ্ছিলাম।“

“আমি তাহলে পরে আসি,ম্যাম।“

“না, কাজটা শেষ করলাম। নিউইয়র্কে মেইল করেছি। প্রায় নির্ভুল প্রতিবেদনটা প্রস্তুত করার জন্য তোমাকে অনেক ধন্যবাদ অরিত্র। এখন বেশ হালকা লাগছে। এ সময় এসে বরং ভালো করেছ।“

অরিত্র আগ-পিছ কিছু চিন্তা না করেই হঠাৎ তাকে প্রশ্ন করল, “তোমার আঙুলের এই কাটা দাগ! আমি জানি, আঙুলটা কেটে গিয়েছিল হয়তো, কিন্তু…?“

অরিত্রের প্রশ্নে সে সত্যিই হাসল না। অরিত্রের কল্পনার সাথে সম্পূরক প্রশ্ন করতে গিয়েও অরিত্রের ‘কিন্তু’ শব্দটা যেন অরোরাকে আনমনা করে দিল। অরোরার চোখের মণি সংকোচিত হয়ে এল। একসময় তার ঠোঁট দুটো কাঁপল থরথর। অরোরার আবেগ অপ্রস্তুত করল তাকে। অফিসে এসে এমন ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ তোলায় নিজের ওপর নিজেই সে বিরক্ত হলো। অরোরার অভিব্যক্তিতে ঝরে পড়া কষ্টের ভাষা অরিত্রকে বিহবল করে তুলল। প্রশ্নটা করার গ্লানিবোধ থেকে বাঁচতে কী করা উচিৎ তা সে ভেবে না পেয়ে শুধু বলল, “সরি ম্যাম। তোমাকে এভাবে প্রশ্নটা করা হয়তো আমার ঠিক হয় নি। আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত।“

অরিত্রের কথায় রুমাল দিয়ে চোখের কোণ মুছে অরোরা স্মিত হেসে বলল, “ইটস ওকে। দুঃখিত হওয়ার মতো তুমি কিছু করো নি। হ্যাঁ, তোমাকে আমি একদিন সেই গল্পও হয়তো বলব।“

শেষের বাক্যটা বলার সময় অরোরার শব্দগুলো মন্থর গতিতে আর অস্ফুট স্বরে প্রক্ষিপ্ত হলো। তার দুই ঠোঁটের কোণ আবার একটু কাঁপল। কিছুক্ষণ পর ধাতস্ত হয়ে, সব অভিব্যক্তি ঝেড়ে ফেলে হঠাৎ চনমনে হয়ে উঠল অরোরা। বলল, “ইট‘স অ্যা ব্রেক টাইম। কফি? ওকে, অরিত্র ? চলো, বারান্দায় বসে আমরা কফি পান করি।“

কফি নিয়ে অরোরা বাইরের বারান্দায় গিয়ে বসল। সাত তলার এই বারান্দা থেকে আটলান্টিক দেখা যায়। অরোরা যেন নিজকে লুকাতেই তার অফিসের অবসর কাটানোর এই একান্ত স্থানে তাকে নিয়ে এল। আটলান্টিকের দিকে মুখ করে তারা বেতের সোফাটায় বসল। অরোরার চোখে দোল খাওয়া এক সমুদ্র যেন দুমড়ে-মুচড়ে ওঠানামা করছে । তবু স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কফির কাপে চুমুক দিয়ে সে অরিত্রকে তার করা ‘তোমার আঙুলের এই কাটা দাগ! আমি জানি, আঙুলটা কেটে গিয়েছিল হয়তো, কিন্তু…?’ প্রশ্নটার রেশ ধরে পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘কিন্তু’ …

“কী বলো ?“

“না থাক। আমি তোমার ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ তুলে তোমাকে হয়তো স্মৃতিপ্রবণ করে তুলেছি।“

অরোরা এবার যেন আরো একটু ধাক্কা খেলো। মাথা ঘুরিয়ে অরিত্রের দিকে দৃষ্টি ফেরাল সে। বিষন্ন বিনয়ী এই চাহনি অরিত্রের বুকের মাঝে পুনরায় হাহাকার তুলল। সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট পরিহিত অরোরা একেবারেই তার শূন্য দূরত্বে। তার ত্বক-চুলে মেশানো অনন্য সৌরভ কেমন এক ঘোরের মাঝে যেন কোনো প্রাচীন এক অনুভবের কাছে নিয়ে তাকে অবশ করে ফেলছিল। এত কাছ থেকে মা ছাড়া কোনো নারীকে সে কখনোই দেখে নি। এত নিঁখুত এবং অবর্ণনীয় সৌন্দর্যের কোনো নারীর চোখে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা কত কঠিন তা জীবনে প্রথম অনুভব করল অরিত্র। হৃদয় পুড়ে যায় আর ভেতরে কী যেন হয়! অরোরার পাতলা লাল-টুকটুক ঠোঁটদ্বয় অরিত্রের প্রশ্নের উত্তরটুকু দেয়ার যেন কোনো উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না। তবু তার কাঁপা কাঁপা ঠোঁটের ফাঁক গলে অস্ফুট স্বর ঝরে পড়ল, “স্মৃতিপ্রবণ! আমার আঙুলের আঁচড়ের দাগ দেখে তুমি কীভাবে বুঝতে পারলে এর সাথে আমার জীবনের স্মৃতিপ্রবণতা জড়ানো? “

[hfe_template id=’81’]

সে অরোরার দৃষ্টি থেকে চোখ ফেরাতে চাইল। অনন্য সুন্দরী কোনো নারীর বিষণ্ণ আর মায়াবী চোখটায় যখন হাজার প্রশ্নের তোলপাড় আকুতি তার পাপড়ি পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়, তার চোখ থেকে মনে হয় আর দৃষ্টি অথবা মন কোনোটাই ফেরানো যায় না। অরোরা-অরিত্র ভাষাহীন হয়ে একে অন্যের চাহনির আরো গভীরে দুজনেরই প্রশ্নের সমীকরণ খুঁজে ফিরল। ধাতস্থ হয়ে অরোরা অরিত্রের প্রশ্নের উত্তর গুছিয়ে নিচ্ছিল- “আমার বাবা একজন আফগান। মা রুমানিয়ান। আমেরিকান এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় এই জুটি একে অন্যকে ভালোবেসে ঘর বাঁধেন। আমার জন্মের কয়েক বছর পর বাবার মাথায় কী এক ভূত চাপল। তিনি আমার শৈশব-কৈশোরকে আফগানিস্তানের কৃষ্টি-সংস্কৃতি এবং সভ্যতায় সমৃদ্ধ করতে মরিয়া হয়ে উঠলেন। সোভিয়েত বাহিনী কাবুল ছাড়ার কারণেই হয়তো তার মাথায় এই চিন্তা বেশি করে চেপেছিল। তালেবানদের হাতে দেশ শাসিত হচ্ছে। মা ভয়ংকর হয়ে ওঠা আফগানিস্তানে ফিরে যেতে চাইছিলেন না ।“

কফি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল। সেদিকে দুজনের কারো ভ্রুক্ষেপ নেই। অরোরার ফিসফিস স্বরে বলা কথাগুলো প্রাণ পাবার আগেই তাদের অর্থ বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা, যিনি উগান্ডার একজন নাগরিক, মি. অ্যারোন মাতোমা বৈঠক শেষ করে এসে তাদের সামনে হাজির হলেন। বিশালাকৃতি মানুষটি তার শরীর কাঁপিয়ে হাসার চেষ্টা করে গমগমে গলায় বললেন, “ইউ আর হেয়ার! বাট দিজ ইজ অ্যান অফিস টাইম। হাউএভার ক্যান আই বি অ্যা পার্ট অব ইয়োর ডিসকাশান, প্লিজ।“

মাতোমার কথায় কিছুক্ষণ চুপ করে তার দিকে তাকিয়ে থাকল অরোরা। তার অভিব্যক্তিতে বিরক্তি স্পষ্ট। সংস্থাটিতে চাকরি করতে আসার পর গত এক বছর ধরে অর্থ বিভাগের প্রধান এই কর্তার কাছ থেকে নিজেকে নিরাপদ রাখতে তাকে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে হয়েছে। প্রথম থেকেই বিশালদেহী এই মানুষটা তার জন্য এক মনোস্তাত্ত্বিক ঝুঁকি বলে অরোরা বদলির কথা ভেবেও সেই চিন্তা থেকে ফিরে এসেছে। অরোরার মনে হয়েছে এখান থেকে অন্যত্র বদলি হয়ে যাওয়া তার জন্য এক ধরণের পরাজয়। জীবনে আর পরাজিত হতে চায় না বলে, সকল পরিস্থিতি মোকাবেলা করার এক জেদ থেকেই মি. মাতোমার সাথে এক বছর ধরে সে মনোস্তাত্ত্বিক এই যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। অরোরা উঠে দাঁড়াল। নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল, “দিজ ইজ অ্যান অফিস টাইম, স্যার। কথাগুলো বলেই অরোরা হনহন করে তার অফিসের উদ্দেশে হাঁটা শুরু করল। তার দেখাদেখি, এই মুহূর্তে ঠিক কী করা উচিৎ ভেবে না পেয়ে অরিত্র মাতোমার মুখের দিকে বিভ্রান্ত দৃষ্টি রাখল। মাতোমার অগ্নিশর্মা মুখ দেখে সে চলে যেতে নিচ্ছিল। কিন্তু তিনি অরিত্রকে থামালেন এবং দাঁত খিটমিটিয়ে বললেন, “একজন নবাগত হয়ে যদি এখনই ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খেতে যাও, তাহলে মনে রেখো, আরো ভালোভাবে ঘাস খাওয়ানোর জন্য তোমাকে আমি সাহারা মরুভূমিতে বদলি করে দেব। ঘাস ভেবে সেখানে বালি খাবে…। আজ সন্ধ্যায় ফাইলপত্র নিয়ে আমার অফিসে আসবে। মনে হচ্ছে, এতদিনে কাজের বদলে মেয়ে-পটানো বেশ শিখেছ।“

অরিত্র লোকটাকে ঘৃণা করতে গিয়েও নিজেকে সংবরণ করল। বিনয়ের সাথে বলল, “ওকে, স্যার। “

“হ্যা, শুধু আজ নয়; প্রতিদিন সন্ধ্যায় তুমি সদর দফতর থেকে বরাদ্দকৃত বাজেটের খুঁটিনাটি বিষয়ের ওপর সংক্ষিপ্ত বিবরণী প্রস্তুত করে আমার কাছে উপস্থাপন করবে এবং পরবর্তী করণীয় নিয়ে আমার কাছ থেকে প্রয়োজনীয় ধারণা নেবে। আমি চাই তুমি একজন চৌকষ আর মর্যাদাসম্পন্ন কর্তা হয়ে ওঠো।“

“ধন্যবাদ মি. মাতোমা।“

“আর কোনো সিদ্ধান্তের জন্য অরোরার কাছে নয়, আমার কাছে আসবে। একজন অবেক্ষাধীন কর্তা (সুপারভাইজার) হিসাবে আমার কাছ থেকে ‘যোগ্যতার সনদপত্র‘ না পাওয়া পর্যন্ত তোমার চাকরি নিশ্চিত নয় – কথাটা ভুলবে না আশা করি।“

কথাগুলো অরিত্রের মনে খচখচ করে বাজল। তবু সংযম না হারিয়ে সে বলল, “আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশ থেকে অতিমাত্রায় যোগ্য না হলে এই সংস্থা কখনোই এখানে আমাকে নিয়োগ দিত না, স্যার। তবু, আপনার কথাগুলো আমার মনে থাকবে এবং আজ সন্ধ্যায় আমি অফিসে আসব।“

“বেশ। আমি তোমার ভালো চাই বলেই বলছি, মিস অরোরার সাথে মেশামেশি যত এড়িয়ে চলবে ততই তুমি নিরাপদ থাকবে। তুমি হয়তো জানো না, অরোরার হাতে দশ আঙুলের একটা আঙুলে কাটা দাগের মানেটা কী?“

“না, আমি জানি না…“

“এর একটা প্রতিকী অর্থ আছে। আর তা হলো, একসাথে সে দশজন পুরুষকে ঘোরায় তবে একজনকেই শুধু বিছানায় নেয়। তাকে যেদিন থেকে আর ভালো লাগে না, সেদিন থেকে নতুন কোনো পুরুষকে ঘায়েল করতে সে মরিয়া হয়ে ওঠে। এই কথাগুলো আমার বানানো নয় বরং তোমার ম্যাডাম আমাকে নিজেই এসব তথ্য দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন! তাকে এখনাকার স্টাফই শুধু নয় অনেক হর্তা-কর্তা গণ্যমান্য ব্যক্তিরা ‘প্রেম-দেবী’ আখ্যা দিয়েছেন –এই তথ্য তোমার জানা উচিৎ।“

বলেই মাতোমা চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলেন। কিন্তু কী ভেবে আবার দাঁড়ালেন। অরিত্রের মুখোমুখি ফিরে তার নিজস্ব ভঙ্গিতে দাঁত খিটমিটিয়ে প্রায় হুমকি দিলেন, “শোনো মি. ওয়ান অব টেনথ (বাক্যটি দিয়ে তিনি অরিত্রকে অরোরার দশ প্রেমিকের একজন বলে কটাক্ষ করলেন); তুমি সন্ধ্যায় আমার অফিসে বরাদ্দকৃত বাজেটের খুঁটিনাটি বিষয়ের ওপর সংক্ষিপ্ত বিবরণী প্রস্তুত করে আমার কাছে উপস্থাপন করতে আসছ- এই তথ্যটা অরোরার কাছে পুরোপুরি গোপন থাকবে। সে সন্ধ্যায় তোমার খোঁজ করলে তার মুখের ওপর এই বলে স্পষ্ট জবাব দেবে যে, নারী হয়ে কেউ যদি ‘এক ক্ষত-প্রেমিক আর দশ প্রেমের প্রতীক’ নিয়ে যদি গর্ব করতে পারে, তাহলে প্রতিটা সন্ধ্যায় একজন নারীর বাহুলগ্না হয়ে থাকার অধিকার তো তোমার আছেই… কী বলো?“

অরিত্র আনমনে ভাবছিল- পৃথিবীর সকল প্রান্তে ক্ষমতাবান পুরুষদের একই চরিত্র, ঈশ্বরের মতো ভোগ আর পূজা না পেলে তারা বেজার হন!


কাজী রাফি

কথাশিল্পী।
জন্ম – ২২ নভেম্বর, ১৯৭৫, বগুড়ায়।
মানুষ ও তাদের যাপিত জীবন এবং প্রকৃতি দেখার প্রয়োজনে ঘুরেছেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। চাকরির প্রয়োজনে আফ্রিকায় বাস করেছেন দুই বছরের অধিক সময় এবং আফ্রিকার প্রকৃতি-সংস্কৃতি, তাদের প্রান্তিক মানুষের যাপিত জীবনকে দেখেছেন খুবই কাছ থেকে। আফ্রিকার পটভূমিতে লেখা ‘ধূসর স্বপ্নের সাসান্দ্রা’ তাঁর প্রথম উপন্যাস। এই উপন্যাসেই কালি ও কলম পুরস্কার লাভ করেছেন তিনি; তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ, ১১ টি উপন্যাস এবং ৬ টি ছোট গল্পগ্রন্থ সবই পাঠক প্রিয়তায় প্রথম সারিতে। তাঁর লেখা ‘ত্রিমোহিনী’ উপন্যাসকে মহাকাব্যিক অ্যাখ্যা দিয়েছেন কিংবদন্তী ছোট গল্পকার হাসান আজিজুল হক ।
পুরস্কার, এইচএসবিসি কালি ও কলম পুরস্কার -২০১০, এমএস ক্রিয়েশন সম্মাননা -২০১০, নির্ণয় স্বর্ণপদক-২০১৩, এসএম রাহী পদক ২০১৯
ওয়েবসাইট

Please Post Your Comments & Reviews

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected!!
Share via
Copy link
Powered by Social Snap