কাজী রাফি
কথাশিল্পী
অফিসের নিত্যনৈমিত্তিক কাজ শেষে সন্ধ্যায় কোনো একটা বই পড়তে অরোরা ভালোবাসে। অরিত্রের কাছ থেকে নেয়া কাহলিল জিব্রানের ‘দ্য প্রোফেট‘ পড়া শেষ করে কী এক আপ্লুত আবেগে অরোরা দুইদিন পর এক সন্ধ্যায় তার সাথে দেখা করার জন্য সে পা বাড়াল। অরিত্রের দুই ঘরের একতলা বাসাটার ভেতর অন্ধকার। প্রবেশপথের রোয়াকে একটামাত্র বাতি জ্বালানো। কাছে এসে অরোরা মূল দরজায় ধাক্কা দিতেই তা আলতো করে খুলে গেল। সে ভাবল, বিকেলে হয়তো ঘুমিয়ে গিয়ে আর ওঠে নি অরিত্র। সে পরিকল্পনা করল, ঘরের ভেতর প্রবেশ না করে বাসার সামনে কার্পেটের ন্যায় ঘাসঢাকা চত্বরে টাঙানো দোলনায় বসে সে অরিত্র ঘুম থেকে না ওঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। দোলনায় দোল খেতে খেতে অরোরা মাত্র পাঠ করা গ্রন্থটার বাণীসম বাক্যগুলো মনে মনে আওড়াতে থাকে -বলা বাহুল্য গ্রন্থটি পুরো মুখস্ত না থাকায়, ভুলে যাওয়া লাইনগুলো বাদ দিয়ে চলল তার প্রিয় পংক্তিগুলো আউড়ে চলা।
‘ভালোবাসা যদি ডাকে, তার পিছু যেয়ো / যখন প্রেমের ডানা তোমাকে আলিঙ্গন করবে, বাধা দিয়ো না / ঋতুহীন সে জগতে যাও যেখানে হাসবে, কিন্তু যে হাসি শুধু হাসি নয়; / কাঁদবে তুমি, যে কান্না শুধু তোমার অশ্রু নয়। / যখন ভালোবাসবে, বলো না যেন ‘আমার অন্তরে ঈশ্বর‘/ বরং এ কথাই বলো, ‘ঈশ্বরের অন্তরে আমি‘ / নিজেকে পূর্ণ করে তোলা ছাড়া ভালোবাসার আর কোনো প্রত্যাশা নেই।‘
মনে মনে আবৃত্তি থামাল অরোরা। তার কেন যেন মনে হলো অরিত্র বাসায় নেই। কিন্তু এ-ও তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো যে, অরিত্রের মতো নির্ভেজাল আর নীরিহ চরিত্রের একজন তরুণ তাকে না বলেই একা একা বাইরে চলে যাবে। তাহলে? অরোরা ঠিক ভেবে পেল না কিছুই। শেষে তার মনে হলো, না অরিত্র নিশ্চিত ঘুমাচ্ছে। সুতরাং আত্মবিশ্বাসের সাথে সে মনে মনে পুনরায় আবৃত্তি করে চলল,
‘তোমাদের দুজনের মিলিত সত্তার মাঝে / থাকে যেন কিছুটা ব্যবধান / দুয়ের মাঝখানে যেখানে / নৃত্য করবে স্বর্গের হাওয়া অমলিন। / মনে যদি চায় পরস্পরকে রুটি দিয়ো আর নিয়ো / কিন্তু একখণ্ড রুটি থেকে দুজনে একসাথে খেয়ো না। / বীণার তন্ত্রী যেমন স্বতন্ত্র থেকেও একসাথে / বেজে ওঠে কোনো এক সুরের মুর্ছনায়। / হৃদয় দান করো কিন্তু গচ্ছিত রেখো না কারো হাতে / কেবল জীবনের হাতই ধারণ করতে পারে যুগল হৃদয়। / একসাথে দাঁড়াও, তবু নৈকট্যকে প্রাধান্য দিয়ো না / মন্দিরের স্তম্ভসারি যেমন দাঁড়িয়ে থাকে নির্দিষ্ট দূরত্বে; / ওক আর সাইপ্রাস বৃক্ষরা / একে অন্যের ছায়ায়, বাড়ে না।‘
প্রায়ান্ধকারে দৃষ্টি অভিযোজিত হয়ে এলে অরোরা মগ্ন হয়ে আকাশের পানে তাকাল। দেখল, দক্ষিণ থেকে মেঘগুলো দ্রুত উত্তরের দিকে বয়ে চলছে। তার মনে এবার সত্যিই আশংকা দানা বাঁধল। অরিত্র কি তাহলে খুব অসুস্থ? প্রশ্নটা মনে আসামাত্র কোনো দ্বিধা ছাড়াই অরোরা অরিত্রের কামরার সামনে এসে পুনরায় দরজাতে আলতো ধাক্কা দিল। আস্তে খুলে গেল দরজাটা। সে হাতড়ে হাতড়ে আলো জ্বালিয়ে দিলো। আশ্চর্য, অরিত্র তার কক্ষে নেই! অরোরা কক্ষটার চারদিকে তাকাল। পরিপাটি করে গোছানো ঘরটায় শুধু একটা জিনিসেরই প্রাচুর্য। আর তা হলো, বই আর বই। টেবিলে অর্ধ পড়া এক বইয়ের মাঝে বুক মার্কার। তার পাশে একটা কলম আর কিছু লেখার জন্য ইটালির সরবরাহ এবং বাঁধাই করা ভারি এক খাতা। অরোরা সন্তর্পণে খাতার পাতা উল্টাল এবং অরিত্র তার প্রতিদিনের অনুভূতি লিখে রেখেছে ভেবে তার চোখের কোণ উচ্ছল হয়ে উঠল।
[hfe_template id=’81’]
অরোরা তার পড়ার টেবিলে বসে পড়ল। খাতার প্রথম পৃষ্ঠা উল্টিয়ে অরোরার চোখ কপালে উঠল, প্রতিদিনের দিনলিপি নয়; অরিত্র তাকে সম্বোধন করে চিঠি লিখেছে! আর দুই পাতার মাঝখানে একটা পুরাতন বিবর্ণ পাতা। বাংলায় লেখা বলে অরোরা তার আদ্যপান্ত না বুঝলেও বাক্যগুলোর গঠন-সামঞ্জস্য দেখে সে ধরেই নিল তা একটি কবিতা। ইংরেজিতে লেখা চিঠিটা পড়তে গিয়ে বিষয়টা তার কাছে পরিস্কার হলো। সেই বিবর্ণ পাতাটারই অনুবাদ করেছে অরিত্র। চেয়ারটা টেনে টেবিলে মনোযোগি ছাত্রীর বেশে সে সোজা হয়ে বসে চিঠিটা পড়া আরম্ভ করল-
প্রিয় অরোরা,
আমার দেশে এখন শীত পড়বে। এমনি এক হেমন্তে জন্মেছিলাম বলেই কিনা জানি না, এই সময়টা এলেই আধো-চেতন আর জাগরণে এমনকি স্বপ্নে কী এক বোধ এসে আমাকে আনমনা করে। মানুষের জীবনে অনুভূতিময় সময়ের ডানা ধরে কতবারই বা আর এমন উপলব্ধি ফিরে ফিরে আসে? হাজার বছর ধরে কত হেমন্ত আসবে, সব হেমন্তকে এভাবে তো আর দেখা হবে না। ‘কবি’ নামের এক উপন্যাসে ঔপন্যাসিক লিখেছিলেন, ‘এই খেদ মোর মনে মনে / ভালোবেসে মিটল না আশ-কুলাল না এ জীবনে। / হায়! জীবন এত ছোট কেনে! / এ ভুবনে?‘
তবু যা পেয়েছি তাই-ই বা কম কী! কুয়াশার আস্তরণ নিয়ে জেগে ওঠা বঙ্গভূমির অনন্য এক প্রকৃতিতে আমি জন্মেছিলাম এ কি কম পাওয়া, বলো! শীত এলেই নৈসর্গিক সব ভাবনা এসে আমাকে আনমনা করে। আশ্চর্য! সময়ের ভেতরে লুকিয়ে থাকা এই উপলব্ধিরকালেই তোমার সাথে আমার দেখা। কেন যেন মনে হচ্ছে শীতের এই শুকতারা, শুকিয়ে আসা খাল-বিলের শৈবালকে সাক্ষি রেখে আমাকেও হয়তো কোনো এক শীতেই এখান থেকে চলে যেতে হবে।
তুমি হয়তো এ কথা শুনে হাসবে যে, আমি কখনো আমার মাতৃভূমির বাইরে বাস করিনি। অচেনা এ দেশে এসেই তাই আমি বিষণ্ণ হয়ে উঠেছিলাম। বিমানবন্দর থেকে নতুন কর্মস্থলে আসার পথে ভেবেছিলাম, কিছুদিনের মধ্যে কাজে ইস্তফা দিয়ে আমাকে হয়তো দেশে, আমার মা‘র কাছে ফিরে যেতে হবে। আমার দেশের নদী, ধানক্ষেতে ভরা শিশিরভেজা সবুজ মাঠ, এমনকি একটা ফিঙে অথবা দোয়েলের লেজ নাচানো আনন্দ-লগ্ন দেখার জন্য আমি তখনই পাগল হয়ে উঠছিলাম। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমার জন্য নির্ধারিত এই আবাসস্থলে এসে তোমাকে দেখে আমি থমকে গেলাম।
তোমাকে দেখেই আমার মনে হলো, আমার ছোটবেলায় দেখা এবং নাম ভুলে যাওয়া কোনো এক চলচ্চিত্রের নায়িকার আজো অপেক্ষার লগ্নটা ঠিক তোমার কাছে এসে বসে আছে। প্রিয়জনকে বিদায় জানানোর জন্য দরজার চৌকাঠে হেলান দিয়ে সে-ই তুমিই আজো যেন অপেক্ষায় আছো। তোমার লম্বা, সুন্দর আঙুলগুলোতে অপেক্ষার বেদনার ভাষাটা আমার যে বড় চেনা, অরোরা। এমন কেন হলো বলো, তোমাকে দেখেই কেন আমার মনে হলো যে, তুমি আমার অনেকদিনের চেনা! আরো অদ্ভুত ব্যাপার যে, তোমাকে দেখে জীবনান্দিক ঢঙে (জীবনানন্দ দাশ নামে আমাদের অসামান্য এক কবি আছেন) আমার কৈশোরে লেখা অসংখ্য এলেবেলের মাঝখান থেকে একটা কবিতা খুঁজে বের করার জন্য সেই রাতেই আমার ব্যাগ-স্যুটকেস থেকে সব কাগজ, দিনলিপি, পাণ্ডুলিপি বের করেছিলাম। কারণ কী, জানো? কোনো একদিন দেশ ছেড়ে যাবার কষ্টের অনুভূতি নিয়ে কবিতাটা লেখার সময়ই আমার কেন যেন মনে হয়ছিল; দেশ ছাড়ার কষ্টে একদিন এমনি অনুভূতিতে বিষন্ন হতে হবে। কিন্তু দেশ ছেড়ে যাওয়ার বেদনা থেকে লেখা হলেও সেই আঠারো বছর বয়সে কবিতাটা লেখার সময় আমার তরুণ মননে যে কল্পনারীর মুখচ্ছবি ভেসে উঠেছিল, তার সাথে তোমার কোথায় যেন অদ্ভুত এক মিল! এখানে এসে তোমাকে দেখেই আমার ভেতর থেকে একটা প্রশ্ন উঁকি দিয়েছিল, ‘তুমি এখানে!‘
শুনবে সেই অ-কবিতা । কবিতা না হয়ে ওঠা সেই কবিতাটার অনুবাদ হয়তো এমন-
একদিন তোমায় ছেড়ে চলে যাব দূরে
গানহীন পাখিদের দেশে
একদিন নক্ষত্রহীন কুয়াশার আঁধারে,
পথহীন পথিকের বেশে!
তোমায় ছেড়ে অনেক দূরে…
একদিন তোমায় ছেড়ে সেই চোরাবালিতে
চোখে নামা বৃষ্টির নদী কটিদেশে,
বালিয়াড়ির খাড়িতে,যূঁথচারি ঈশ্বরী নারীর বেশে
তোমায় ছেড়ে অনেক দূরে।
একদিন তোমায় ছেড়ে ঘর বাঁধব বালি জলে,
মকর-ক্রান্তির বলয়ে, অবয়বহীন নদীর মতো
হাত পেতে রবে বন্দী মরুভূমি।
একদিন সুরের বেদনায় টলমল
নদীর বাঁকে দাঁড়িয়ে,যুক্তিহীন বৃক্ষের মতো
প্রশ্ন করব ঈশ্বরী নারীকে
এনে দিতে পারো কি আমার প্রিয়াকে?
শাওনের মতো মেঘ চুল তার
ধূসর মৃত্তিকার বেণিতে লুকিয়ে রাখে শঙ্খ সে।
ব-দ্বীপের বক্র ভঙ্গিতে গহন কুয়াশা চোখ তার
পৃথিবীর নীলাভতম সবুজ বাংলাকে লুকায় সে গোপনে!
অরিত্র আর কিছু লেখে নি। তার জন্য এমন স্নিগ্ধ অনুভূতি ধারণ করা এই চিঠির লেখককে তার এক নিষ্পাপ কিশোর মনে হতে লাগল। কিন্তু কারো সাথে কোনোদিন প্রেম না করেও, কোনোদিন কোনো পুরুষের বাহুলগ্না না হয়েও নিজের ভেতর সারাক্ষণ এক অপবিত্র অনুভূতি বয়ে বেড়ানো অরোরা, অরিত্রের এই কৈশোর অনুভূতির বিপরীতে নিজের কৈশোর বয়সটাকে দারুণভাবে আজ ফিরে পেতে চাইল। অরিত্রের মতো সে-ও যদি পারত এমন আবেগধোয়া অনুভূতি নিয়ে বাঁচতে! অরোরার মন খারাপ হয়ে গেল। তার চোখের কোণ ভেজা ভেজা হয়ে গেল। তবু, এভাবে এখন চোখের কোণ ভেজা ভেজা করতেই হয়তো তার ইচ্ছা হলো। অরিত্রের পরের লেখাগুলো পড়ার নেশায় সে এক উন্মুখতা নিয়ে আনমনে নিজের ঘরে ফিরে এল।
[hfe_template id=’81’]
মাতোমার মাতম কথাতেই সীমাবদ্ধ। অরিত্র কয়েকদিন ধরে সন্ধ্যায় অফিসে গিয়ে মান-সম্মানের ভয়ে গভীরভাবে অর্থ বিভাগের সকল অতীত কর্মকান্ড, নতুন-পুরাতন সব নথি ঘেঁটে ঘেঁটে অধ্যয়ন করল। এসব করতে গিয়ে এই বিভাগের অসংখ্য ত্রুটি তার চোখে পড়ল। মাতোমা, ‘আজ কাজ আছে, কাল একটু বাইরে যেতে হবে অথবা একটু পরে আসছি তারপর তোমার কষ্টিপাথরে তোমার পরীক্ষা হবে’ –ইত্যাদি আবোল-তাবোল কথা বলে সন্ধ্যাটা আসলে নাইট-ক্লাব আর মদ নিয়েই কাটায়। তবু একদিন সন্ধ্যায় সে সত্যিই দেখতে এল, অরিত্র অফিসে আসছে কি না। সেই সন্ধ্যায়ই মাতোমার প্রশ্নের ধরণ দেখে অরিত্র বুঝল, চাকরি সংক্রান্ত ব্যাপার নিয়ে মানুষটার খুব বেশি মাথাব্যথা নেই। অনেক জটিল বিষয়ের সমাধান তিনি ভুলে গিয়েছেন। তিনি আসলে অরোরাকে কব্জা করার কৌশল নিয়ে এত ভাবেন যে, অর্থনীতির এসব জটিলতা তার আর ভালো লাগে না। সুতরাং কষ্টিপাথরে অরিত্রের পরীক্ষা নিতে এসে তিনি যখন টের পেলেন, তার দুর্বলতা অরিত্র টের পাচ্ছে, তখন তিনি তার অধীনস্ত সামান্য এক অবেক্ষাধীন কর্তার ওপর মনে মনে রুষ্টই হলেন না, তাকে সরানোর জন্য পথ-বিপথ সব নিয়ে ভাবতে থাকলেন।
প্রতিরাতে অরিত্র একটু একটু করে তার অনুভূতি লেখে আর অরোরা তা পড়ার জন্য মুখিয়ে থাকে। সন্ধ্যা হলেই চুপি চুপি সে অরিত্রের কামরায় এসে তার দিনলিপি আর অরোরাকে লেখা চিঠির অন্তরালে তার একান্ত অনুভবমালা পড়ে যায়। অরিত্রের লেখাগুলো অরোরার কাছে তার অন্তর্লোককে ক্রমশ স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর করে তোলে। অরিত্র যাকে বলে অ-কবিতা অথবা এলেবেলে কোনো চিঠি, সেই লেখাগুলোই অরোরার ভেতরে কেমন এক নতুন নতুন বোধের অনুরণন তোলে। অরিত্রের সংগ্রহে থাকা সব বই, তার গোছানো একান্ত এই ঘরের অনন্য এক জগত অরোরার কাছে কয়েকদিনেই কত আপন হয়েছে! আর তা হয়তো এই কারণে যে, এই ঘরে অরিত্রের নৈসর্গিক ভাবনা আর অনুভূতির বাস। এই ঘরেই কেউ একজন তাকে ভেবে ভেবে চিঠি লেখে, তার আঙুলে কাটা সামান্য এক দাগের মাঝেও মানবিক আর্তি খুঁজে বেড়ায়। সুতরাং এই ঘর অরোরার কাছেও নিত্য এক ভালোলাগার অনুষঙ্গ হয়ে উঠল। কী ঘোরের মাঝে সন্ধ্যার প্রত্যাশায় অরোরার অফিসের সময় কেটে যায়। আর প্রতি সন্ধ্যায় সে অরিত্রের ঘরে এসে তার লেখা চিঠিগুলো বার বার পড়ে যায়।
কিন্তু পর পর এক সপ্তাহ এভাবে কেটে যাবার পর অরোরার মনে নতুন করে প্রশ্নটা দানা বাঁধল, ‘অরিত্র সন্ধ্যায় কোথায় যায়?‘ সুতরাং এক সন্ধ্যায় সে সিদ্ধান্ত নিল যে, আজ অরিত্র না আসা পর্যন্ত এই ঘর ছেড়ে সে যাবে না। বার বার চিঠিগুলো পড়া শেষ করে, সে একটা বই খুলে বসল। কিন্তু বইয়ের পাতায় তার মন টিকল না। কী ভেবে অরোরা এক বালিশ আর চাদর নিয়ে সোফার হাতলের সাথে বালিশটা আড়াআড়ি রেখে সেখানে নিজের পা দুটি গুটিশুটি করে জড়িয়ে নিল। তারপর চাদর দিয়ে নিজের শরীরটা ঢেকে শুয়ে পড়ল।
অন্যদিকে মি. মাতোমা একসাথে অরোরা আর অরিত্রকে অন্তরঙ্গ অবস্থায় আড্ডারত অবস্থায় দেখার পর থেকে অরোরাকে একটা বিষয় স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয়ার জন্য মনে মনে বেপরোয়া হয়ে উঠছিলেন। তার সেই আকাঙ্খা আরো প্রবল হয়ে উঠল যখন তিনি অরোরার বাবুর্চি এবং পরিচারককে অফিসে ডেকে অরোরা-অরিত্র নিয়ে প্রশ্ন করলেন, “তোমার কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো?“
“না স্যার, আমি ঠিক আছি।“
“অন্য সব বিভাগের কর্তাদের পরিচারকদের আমাদের নিজস্ব গঠিত তহবিল থেকে বেতন বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়া হয়েছে, অথচ তোমার ম্যাডাম তোমার বেতন বাড়ানোর জন্য তালিকাভূক্ত কর্মচারীদের তালিকায় তোমার নামটাও রাখেন নি।“
“স্যার, তিনি আমাকে নিজের বেতন থেকে মাস শেষে ভালো বকশিস দেন। স্যার আমাকে বলেছেন, তার আর অরিত্র স্যারের রান্না একত্রে করতে। তাতে আমার আয়টা আরো বাড়বে…“
“অরোরা আর অরিত্র কি একসাথে ডিনার করে? “
“হ্যা, তারা একসাথে শুধু রাতের খাবারের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।“
“কবে এমন সিদ্ধান্ত হলো?“
“আজ রাত থেকেই তারা একসাথে খাবেন।“
“এর আগে কোনোদিন একসাথে…“
[hfe_template id=’81’]
একে একে সব তথ্য জানার পর মাতোমা সিদ্ধান্ত নিলেন যে, খোলাখুলিভাবেই তিনি অরোরাকে তার মনের কথা ব্যক্ত করবেন। তিনি আজ স্পষ্ট বুঝলেন, এতদিন তার অধীনস্ত এই কর্তাকে উদারতা দেখিয়ে, নিজের জীবনের রোমাঞ্চকর গল্প শুনিয়ে, তার ছাত্র জীবনের অবিস্মণীয় এবং প্রতিভাময় অর্জনের ফিরিস্তি দিয়ে অরোরার মনে কোনো প্রভাব ফেলতে তিনি সক্ষম হন নি। সুতরাং তিনি মনে মনে স্থির করলেন যে, আজ সন্ধ্যাতেই অরিত্রকে নতুন নতুন জটিল কাজের মধ্যে ডুবিয়ে রেখে তিনি অরোরাকে গিয়ে বলবেন, “অরোরা তুমি কি জানো আমি কতটা পছন্দ করি তোমাকে? আর সেই জন্য আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তুমি লিভ-টুগেদার-এ রাজি না হলে আমি তোমাকে বিয়ে করতে প্রস্তুত।“
পরিকল্পনাটা করার সাথে সাথে তার নিজের স্ত্রী এবং সন্তানদের কথা মনে এল বটে তবে অরোরা এ বিষয়ে জানতে আগ্রহী হবে কি না – এ সংক্রান্ত সন্দেহ ছাড়া আর কিছু নয়। পরিকল্পনা মোতাবেক সন্ধ্যায় তিনি অরিত্রকে অফিসে ব্যস্ত রেখে অরোরার বাংলোয় গিয়ে উপস্থিত হলেন। ছাদ-ঘরে উঠতে উঠতে তিনি পরিচারককে বললেন, “তোমার স্যারকে বলো, আমি তার সাথে কথা বলতে চাই।“
“কিন্তু স্যার, স্যার তো বাংলোতে নেই।“
“কোথায় গিয়েছে সে?“
“আমি ঠিক জানি না।“
মাতোমা হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, “গাড়ি তো পার্কিংয়েই দেখছি… হেঁটে হেঁটে একজন মানুষ কতদূর যেতে পারে? ইউ আর অ্যা ব্লাডি স্কাউন্ড্রেল। বলো, কোথায় তোমার ম্যাডাম?“
পরিচারক ভয় পাওয়া গলায় বলল, “স্যার, তিনি মনে হয় অরিত্র স্যারের বাংলোর দিকে গিয়েছেন।“
মাতোমার চোখ কপালে উঠল। তাহলে, অরিত্র কি তার মনের কথা টের পেল? তাই সে মাতোমার দেয়া শক্ত কাজগুলোকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বাসায় এসে অরোরাকে ডেকে…। নাহ, তিনি আর এসব নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট করতে চান না। নীরিহ হলেও মাতোমার মনে হয়, এই তরুণের চোখ সব যেন পড়ে ফেলে। সে কি এখন অরোরার সাথে? মাতোমা আর কিছু ভাবতে চাইলেন না। তিনি অরিত্রের সাথে অরোরার মেলামেশা পাকাপোক্ত হওয়ার আগে ব্যাপারটার ইতি ঘটাতে চান। দ্রুত হেঁটে তিনি অরিত্রের বাংলোয় এলেন। কিন্তু বাংলোর একটিমাত্র বাতি জ্বলা দেখে তার মনে সন্দেহ আরো বেড়ে গেল। দরজা ঠেলে তিনি বাংলোর ভেতরে প্রবেশ করলেন। দেখলেন, অরিত্রের ঘরের দরজা খোলা এবং সেখান থেকে মৃদু আলো ভেসে আসছে। তার হাতের মুষ্ঠি শক্ত হয়ে গেল এবং তিনি দ্বিধা ছাড়াই তার পরাজয়োণ্মুখ মুহূর্তকে বাঁচানোর তাগিদে সব কাণ্ডজ্ঞানের মাথা খেয়ে অরিত্রের ঘরে প্রবেশ করে প্রথমেই বিছানায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন। শূণ্য বিছানা থেকে অচিরেই সোফায় ঘুমন্ত অরোরাকে আবিস্কার করে তার চোখ চকচক করে উঠল।
মৃদু শব্দে আধো-ঘুম, আধো জাগরণ থেকে অরোরার স্নায়ু সজাগ হয়ে উঠল। অরোরা ধরেই নিল অরিত্র ঘরে প্রবেশ করছে। সুতরাং সে চোখ দুটো আরো ভালোভাবে বন্ধ করে ঘুমানোর ভাণ করল। মাতোমা সন্তর্পণে তার পাশে এসে বসল। চোখ বন্ধ রেখেও অরোরা টের পেল, এ অরিত্র নয়। অরিত্রের নিঃশ্বাসে ফণা নেই। তার গায়ের গন্ধ এমন আপদ সংকেতবাহী নয়। অরোরার ত্বকের স্নায়ুতন্ত্র সজাগ হয়ে উঠল। সব নারীদের ক্ষারীয় ত্বকের স্নায়ু হয়তো মস্তিষ্কের সমান আবেগ-সংবাহীতন্তুতে পরিপূর্ণ। প্রিয় পুরুষকে গ্রহণে আর অপ্রিয়কে বর্জনে মাথার আগে তার ত্বকই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে। এই নৈসর্গিক ক্ষমতা হয়তো তার প্রতিরক্ষা আর অভিযোজনে একান্ত প্রয়োজন। অরোরার শরীরে হাতের স্পর্শ পরার আগেই সে লাফ দিয়ে উঠে সোজা হয়ে বসল। অরিত্রের মুখায়ববের চিত্র ধারণকারী তার মস্তিষ্কের কোষ তার বদলে মাতোমা দেখায় চমকে উঠলেও, ত্বকের স্নায়ুগুলো প্রতিরক্ষার জন্য সংকোচন নীতিতে প্রস্তুত থাকায় তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে লুকানো লোমগুলো শিউরে উঠল না। অরোরা হেসে বলল, “মি. মাতোমা, ইউ আর হেয়ার!“
“আই‘ম নট, ইউ আর হেয়ার, বিউটিকুইন! আজকাল নারীরাও দেখছি পুরুষের মতো বাঘ হয়ে গিয়েছে। তোমার সমবয়সী এক তরুণের কচি মাংসের চেয়ে আমি কম স্বাদযুক্ত নই…“
“মি. মাতোমা, আপনি সীমা লঙ্ঘন করছেন…“
“হ্যা, আমি সীমা লঙ্ঘন করছি আর আমার অধীনস্তরা দেখছি সীমানার মধ্যে অসীম হয়ে গিয়েছে!“
“আপনার বল্গাহীন নোংরা ভাবনা থামালে আমি খুশি হবো, স্যার। এখানে আমি বই নিতে আর পড়তে এসেছিলাম।“
“বই বুঝি আমার কাছে নেই! তুমি তো আবার প্রকাশ্য দিবালোকে প্রচারপত্র টাঙিয়ে রেখেছ যে, ভালোবাসাবাসি করতে তুমি ভালোবাস। আর জলে নেমে কুমির ছাড়া অন্য কারো সাথে খাতির করলে দুজনই যে কুমিরের পেটে যায়, আশা করি তা নতুন করে তোমাকে শেখানোর দরকার নেই। যা হোক, আজ আমি জোরপূর্বক কোনো দৃশ্যের অবতারণা করব না অথবা এ ব্যাপারে আমি কোনো গুজব ছড়াব না যদি তুমি আমাকে বিয়ে করতে সম্মত হও…“
বুকের কাছে চাদরটা শক্ত করে আকড়ে ধরে থাকা অরোরার ত্বক তার তাপমাত্রা কমিয়ে দিয়ে বাড়িয়ে দিয়েছে বুকের দহন। অরোরা তার কাছ থেকে আপাতত বাঁচার জন্য, বিয়ের ব্যাপারে ভেবে-চিন্তে পরে তার সিদ্ধান্ত জানানোর কথা ভাবল। অরোরার ত্বক না মাথা কোন সংকেতবাহী স্নায়ুতন্ত্র এমন সিদ্ধান্ত নিল বোঝা গেল না। তবে মাথার কোষগুলো ত্বকের পাঠানো সব সংকেত যাচাই-বাছাই করেই হয়তো বলল, “আমি আপনার ভদ্রজনোচিত প্রস্তাবটি নিয়ে ভাবার জন্য সময় চাইছি।“
মাতোমা থমকে গেলেন। তিনি ধরেই নিয়েছিলেন অরোরা তাকে বাজে কোনো কথা শুনিয়ে দেবে। আর তা করলেই তিনি তাকে এখনই পেতে শারিরীক জোর খাটাবেন। মাতোমা জানেন, অরিত্রের মতো কাঁচা আবেগের তরুণরা নারীর শরীরের কাছাকাছি হওয়ার আগে তাদের আবেগের কাছাকাছি পৌঁছার জন্য অযাচিত সময় নষ্ট করে। নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত এক বইয়ে তিনি এ বিষয় নিয়ে পড়তে গিয়ে জেনেছেন যে, নারীরা আবেগের চেয়ে তার শক্তিমত্তাকে বেশি গুরুত্ব দেয়। কিন্তু হায়, তিনি এই শক্তিমত্তার ‘মানে’টুকু যদি বুঝতেন! সুতরাং অরোরার কথায় তাকে শক্তিমত্তা প্রদর্শনের ভাবনা বাতিল করতে হলো। তিনি তাকে প্রশ্ন করলেন, “কতদিন সময় চাও?“
“দুই বছরের মধ্যে আমার বিয়ের পরিকল্পনা ছিল না। তবু, এক বছর সময় চাইছি।“
“এক বছর! এতদিন কেন?“
“আমার ব্যক্তিগত কিছু সমস্যা আছে…“
“তার আগে আমরা অ্যানগেইজমেন্টটা সেরে ফেলতে পারি এবং একসাথে বাস করতে পারি।“
“না, পারি না… আপনি জানেন না যে এক আফগানের রক্ত আমার শরীরে প্রবাহিত…“
অরোরার এই বাক্যটার সাথে তার ঝলসানো দৃষ্টিতে কী এক বিদ্রোহ দেখে মাতোমার শরীরের দাপাদাপি কেন যেন থেমে হিম হয়ে গেল। তিনি দাঁড়িয়ে ফিরে যাবার আগে শুধু বললেন, “তোমার সাথে বিয়ে হলে আমি নিজেকে সম্মানিত মনে করব।“
“আপনার এখন যে স্ত্রী আছে, তার জন্য কেন সম্মানিত বোধ করেন না, স্যার। তিনি দূরে আছেন তাই? নাকি, তার যৌবনে ভাটা পরেছে বলে আর তাকে ভালো লাগছে না? তারুণ্যময় জীবন আর যৌবন প্রাপ্তি পুরুষদের কাছে বেশ সম্মানের বিষয়, না? এভরিবডি ওয়ান্টস টু বি ডক্টর ফস্টাস…“
বস্তুত ডক্টর ফস্টাস কে, তাকে না চিনলেও, মাতোমা আফ্রিকার এই প্যারিস নামে খ্যাত এই রাজধানী শহরে একজন ডক্টর ফস্টাস আছেন ভেবে তাকে চেনার ভাণ করে স্মিত হাসলেন। ফিরে যেতে যেতে তিনি বললেন, “আমি তোমার সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকব।“
মাতোমার দ্রুতপদে চলে যাবার পর, অরোরার দুই চোখের কোণ ভেজা ভেজা হয়ে উঠল। আবার যেন দূর পাহাড়ি এক উপত্যকা থেকে ভেসে আসছে শিশুদের সমবেত সংগীতের কলতানে জেগে ওঠা এক বেদনার সুর। জোছনা-প্লাবিত এক ঘাস-পাথরের নির্জন আর নিঃসঙ্গ চরাচরে, পাহাড়ের উঁচু উঁচু চূড়ায় মৃত্যু আর ধর্ষণভীতি হয়ে এক অজানা রহস্যময়তা আজ আবার অরোরার ভেতরে বেদনার আর্তস্বরের কলতান হয়ে বাজছে। জীবন নিয়ে আবেগি হয়ে উঠার আগে কিশোরী অরোরা মৃত্যুপারের হিমশীতলতা স্পর্শ করে এসেছে বলে, নিজের আত্মাকে নিজের ভেতরে স্পষ্ট করে অনুভব করতে চেয়েছে। নিজের পায়ের নিচে এক শক্ত ভূমি তৈরি করার পর অরিত্র নামের এক তরুণকে বন্ধু করে পেয়ে তার সেই আত্মিক উন্মেষের যাত্রা শুরু হয়েছে ভেবেছিল সে। কিন্তু ভোগবাদি সমাজে ইন্দ্রিয়পরায়ণতার দিকে ধবমানতা যত সহজ, আত্মিক পথের যাত্রা সেই সমাজে ততটাই জটিল। এই সত্য জেনেই অরোরা নিজেকে আড়াল করতে ভোগবাদিতার মুখোস পরে ছিল। হায়, ভোগবাদিতার মুখোসপরা ইন্দ্রিয়পরতন্ত্রতায় অভ্যস্ত সমাজে এমন মুখোসও ইন্দ্রিয়পরায়ণতার প্রতীক বলেই বিবেচিত হয়! বাথরুমে গিয়ে চোখ-মুখে জলের ঝাপটা দিল আরোরা। তারপর বিছানা গুছিয়ে, ঘরটা আগের মতো করে সাজিয়ে রেখে দরজাটা টেনে দিল সে এবং বিষন্ন মনে নিজের বাংলোর দিকে হাঁটা শুরু করল।

কাজী রাফি
জন্ম – ২২ নভেম্বর, ১৯৭৫, বগুড়ায়।
মানুষ ও তাদের যাপিত জীবন এবং প্রকৃতি দেখার প্রয়োজনে ঘুরেছেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। চাকরির প্রয়োজনে আফ্রিকায় বাস করেছেন দুই বছরের অধিক সময় এবং আফ্রিকার প্রকৃতি-সংস্কৃতি, তাদের প্রান্তিক মানুষের যাপিত জীবনকে দেখেছেন খুবই কাছ থেকে। আফ্রিকার পটভূমিতে লেখা ‘ধূসর স্বপ্নের সাসান্দ্রা’ তাঁর প্রথম উপন্যাস। এই উপন্যাসেই কালি ও কলম পুরস্কার লাভ করেছেন তিনি; তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ, ১১ টি উপন্যাস এবং ৬ টি ছোট গল্পগ্রন্থ সবই পাঠক প্রিয়তায় প্রথম সারিতে। তাঁর লেখা ‘ত্রিমোহিনী’ উপন্যাসকে মহাকাব্যিক অ্যাখ্যা দিয়েছেন কিংবদন্তী ছোট গল্পকার হাসান আজিজুল হক ।
পুরস্কার, এইচএসবিসি কালি ও কলম পুরস্কার -২০১০, এমএস ক্রিয়েশন সম্মাননা -২০১০, নির্ণয় স্বর্ণপদক-২০১৩, এসএম রাহী পদক ২০১৯
ওয়েবসাইট