কাজী রাফি,
কথাশিল্পী
অরোরার আঙুলের কাটা দাগ নিয়ে অরিত্রের অতি আগ্রহের ফলাফল এই দাঁড়াল –অরোরা তার টেবিলে একদিন এক ফাইলে চোখ রেখে চমকে উঠল। অবেক্ষাধীন কর্তা হিসেবে অরিত্রের চাকরি-সংক্রান্ত রিপোর্টে অ্যারোন মাতোমা অরিত্রকে ‘অযোগ্য’ বলে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে পাঠানোর জন্য নথিতে স্বাক্ষর করে অরোরার কাছে পাঠিয়েছেন। অর্থ বিভাগের অন্য যে কোনো একজন কর্মকর্তা মাতোমার সাথে একমত পোষণ করে স্বাক্ষর করলেই অরিত্র চাকরি হারাবে। অরোরা ফাইলটা বন্ধ করে মাতোমার অফিসের দিকে পা বাড়াতেই দেখল, অরিত্র তার অফিসের দিকে এগিয়ে আসছে। অরোরার দিকে তাকিয়ে অরিত্র ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। বাইশ ডিগ্রিতে রাখা এয়ার কুলারের তাপমাত্রাতেও অরোরার কপালে কেন বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে সে বুঝল না। অরোরার স্থির হওয়ার চেষ্টা করল, “কিছু বলবে, অরিত্র ?“
অরোরার রাগান্বিত মূর্তির সামনে সে ভয় পেয়ে বলল, “সরি ম্যাম, আমি না হয় পরে আসি।“
“না, এখনোই বলো।“
“বেনিন আর্মির জ্বালানি-খাতের হিসেবে ষাট হাজার ডলারের বড় এক গড়মিল খুঁজে পেয়েছি। তবু মি. মাতোমা ষাট হাজার ডলার রাইট অফ করে নিউইয়র্কে পাঠানোর জন্য প্রতিবেদন তৈরি করতে বলছেন।“
“তাতে সমস্যা কী? অর্থ বিভাগের প্রধান হিসাবে তিনি তো কিছু অর্থ; বিশেষত যে অর্থ আত্মসাত করা হয়নি অথচ যার হিসাব মিলছে না, তা মওকুফের ক্ষমতা রাখেন…“
অরিত্র ফাইল খুলে অরোরাকে দেখাল। অর্থ বিভাগের প্রধান হিসেবে তিনি কোন কোন খাতে অর্থ মওকুফের ক্ষমতা রাখেন তার ধারা দেখিয়ে বলল, “তিনি একসাথে এক খাত থেকে পাঁচ হাজার ডলার রাইট-অফ করতে পারেন। তাছাড়া যে ক্ষেত্রে বেনিনকে অর্থের এই দায়ভার থেকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে –আইন তা অনুমোদন করে না।“
অরিত্রের কথায় অরোরার বিষন্ন-বিরক্ত চোখে যেন একটু আলো জ্বলল। তবু সে রূঢ় কন্ঠে অরিত্রকে বলল, “সব নথিগুলো আমাকে দাও। আমি তার চূড়ান্ত স্বাক্ষরিত প্রতিবেদনের সাথে এই নথিগুলো সদর দফতরে পাঠিয়ে দেব। কিন্তু তুমি প্রতিবেদনের কোথাও স্বাক্ষর করবে না।“
[hfe_template id=’81’]
“তিনি স্বাক্ষর করতে বললে?“
“বিভাগীয় প্রধান শুধু তার মেইল অ্যাকাউন্ট থেকে প্রতিবেদনটি পাঠাবেন -এখানে নিয়মটা এমনই। আর যার মেইল অ্যাকাউন্ট থেকে যা কিছুই পাঠানো হোক, তার জন্য সদর দফতরে তাকেই জবাবদিহি করতে হবে।“
কথাগুলো বলে অরিত্রের কাছ থেকে নথিগুলো নিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ল অরোরা।
সে মাতোমার অফিসে ঢুকতেই তিনি চেয়ার কাঁপিয়ে উঠে অরোরার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। অরোরার দুধ-আলতা রঙের সুন্দর আর নরম আঙুলগুলো মাতোমার খসখসে হস্তি হাতের মাঝে হারিয়ে গেল। অরোরা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে একটা চেয়ার টেনে মাতোরার টেবিলের সামনে বসে পড়ল। ফাইলটা তার টেবিলে রেখে বলল, “মি. অরিত্রের অদক্ষতা সংক্রান্ত কোনো প্রমাণ অথবা কাগজপত্র ছাড়াই আমরা কি তাকে ‘অযোগ্য‘ বলতে পারি? কিছুদিন আগে যখন সে শিক্ষানবিশ কর্তা হিসাবে সকল বিভাগের কর্তার চেয়ে অনেক ভালো ফলাফল অর্জন করেছে।“
মাতোমা অরোরার কথাগুলো শান্ত ভঙ্গিতে শুনলেন । অরোরাকে বিস্মিত করে মাতোমার কালো-মোটা ওষ্ঠদ্বয় থেকে এক দৈত্যাকৃতি শয়তানের জিঘাংসা ঝরে পড়ল, “সে সবচেয়ে ভালো ফলাফল করেছে কেন না, সে শুধু তোমার বিভাগের একজন সদস্য তাই-ই নয়, বরং তুমি সন্ধ্যায় তার ঘরে যাও! চাকরির প্রাথমিক দিনগুলোতে অফিস বাদ দিয়ে সিনিয়র সহকর্মীর সাথে আবেগ-ঘন পরিবেশ তৈরি করতে পারাটা যার বিরাট যোগ্যতা – আমার কাছে সে অযোগ্য।“
“সন্ধ্যায় আমি তার ঘরে যাই, এটা নিজ চোখে দেখেও কি তাহলে আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন আমাকে শুধু চেখে দেখার আশায়, মি. মাতোমা?“
অরোরা সেদিন আর কথা বাড়ায় নি। মাতোমার বিস্মিত চোখের দিকে তাকিয়ে সে আরো শক্ত কথা তাকে শোনাতে যাচ্ছিল, কিন্তু অরিত্রের পেশার নিরাপত্তার কথা ভেবে সে নিজেকে সংযত করল এবং দ্রুত তার অফিস ত্যাগ করে সে নিজের অফিসে এসে মাতোমার সাথে একমত পোষণ না করে অরিত্রের চাকরি-সংক্রান্ত নথিতে ‘যোগ্য‘ শব্দটায় টিক চিহ্ন দিয়ে সে তার পাশে স্বাক্ষর করল। ফাইলটা নিয়ে পুনরায় মাতোমার অফিসে গিয়ে তা তার টেবিলে ফেলে ফিরে আসার জন্য ঘুরে দাঁড়ালো অরোরা। মাতোমা তার শরীর কাঁপিয়ে নিজের আসন থেকে তড়িঘড়ি করে উঠে এসে তার পথ আগলে গমগমে গলায় বললেন, “উই মে হ্যাভ ডিফারেন্স ইন থটস , বাট নট ফর কফি আই থিংক । লেটস হ্যাভ কফি…“
অরোরা তার কথায় মনে মনে তাকে বিভ্রান্ত করার এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইল না। সে ভালো করেই জানে, পরিস্থিতি ঘোলাটে আর ধোয়াশাময় করার জন্য বিভ্রান্তির সুযোগ গ্রহণ করতে হয়। পৃথিবীতে যত দখল, যত যুদ্ধ, বিরাট কোনো সুযোগ সৃষ্টির চেষ্টা সবই ঘটেছে বিভ্রান্তির অন্তরালে। সুতরাং অরোরা মাতোমার কথায় মোটেও ভ্রুক্ষেপ না করার ভাণ করে সামনের পথে পা বাড়াতে বাড়াতে বলল, “ইফ ইয়োর প্রোপোজাল গেটস অ্যা লাইট উই‘ল হ্যাভ লটস অব স্কোপ অব হাভিং কফি টুগেদার ইন মুনলিট নাইটস…“
মাতোমা এ কথায় মনে মনে এত খুশি হলেন যে, নিজেকে এখনোই অরোরার বরের স্থানে কল্পনা করে তিনি তার অভিমানি হবু স্ত্রীর চলে যাওয়ার পথপানে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলেন।

কাজী রাফি
জন্ম – ২২ নভেম্বর, ১৯৭৫, বগুড়ায়।
মানুষ ও তাদের যাপিত জীবন এবং প্রকৃতি দেখার প্রয়োজনে ঘুরেছেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। চাকরির প্রয়োজনে আফ্রিকায় বাস করেছেন দুই বছরের অধিক সময় এবং আফ্রিকার প্রকৃতি-সংস্কৃতি, তাদের প্রান্তিক মানুষের যাপিত জীবনকে দেখেছেন খুবই কাছ থেকে। আফ্রিকার পটভূমিতে লেখা ‘ধূসর স্বপ্নের সাসান্দ্রা’ তাঁর প্রথম উপন্যাস। এই উপন্যাসেই কালি ও কলম পুরস্কার লাভ করেছেন তিনি; তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ, ১১ টি উপন্যাস এবং ৬ টি ছোট গল্পগ্রন্থ সবই পাঠক প্রিয়তায় প্রথম সারিতে। তাঁর লেখা ‘ত্রিমোহিনী’ উপন্যাসকে মহাকাব্যিক অ্যাখ্যা দিয়েছেন কিংবদন্তী ছোট গল্পকার হাসান আজিজুল হক ।
পুরস্কার, এইচএসবিসি কালি ও কলম পুরস্কার -২০১০, এমএস ক্রিয়েশন সম্মাননা -২০১০, নির্ণয় স্বর্ণপদক-২০১৩, এসএম রাহী পদক ২০১৯
ওয়েবসাইট