কাজী রাফি
কথাশিল্পী
শারিরীকভাবে নারীরা দুর্বল বলে শক্তির ভিন্নতর এক উৎস তারা খুঁজে নেয় । অভিনয় তার অন্যতম একটি ধরণ। মাতোমার সাথে হাসিমুখে কফি পান করতে করতেই সে তার পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করল। আর সেদিনই সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত দীর্ঘ এক বয়ান লিখল সে। অরিত্রকে রক্ষা করতে মি. মাতোমা বেনিনকে যে ষাট হাজার ডলারের অযাচিত সুবিধা দিয়েছেন তার বিষদ প্রমাণাদিসহ মি. মাতোমা যে কোনোদিন তাকে শারিরীকভাবে লাঞ্ছিত করতে পারে এমন ভীতির অনেকগুলো কারণও সে তার মেইলে উল্লেখ করল। রেফারেন্স হিসেবে অরিত্রের পাঠানো আর্থিক প্রতিবেদনটিতে অরিত্র স্বাক্ষর করতে যে অসম্মতি জানিয়েছে, কর্তৃপক্ষকে তা খতিয়ে দেখার অনুরোধ জানাল অরোরা।
প্রতিবেদনটি লেখার সময় তার বার বার অরিত্রের বিনয়ী চেহারা আর মায়াকাড়া চোখ দুটোর কথা মনে পড়ছিল। এবং আশ্চর্যজনকভাবে প্রায় সাথে সাথে তার মনে পড়ছিল জীবনের অন্তিম লগ্নে তার বাবার অসহায় মুখটার কথ। তালেবান কর্তা যে রাতে কিশোরী অরোরাকে ধর্ষণ শেষে তার নখ কেটে অরোরাকে নিজ-ভোগের জন্য চিহ্নিত করেছিল –মনে পড়ছিল সেই ভয়াল আর বিভৎস রাতটার কথা।
জনমানবহীন পাহাড়ি এক উপত্যকা। কাঠ আর ছন দিয়ে নির্মিত এক এতিমখানা ছাড়া আশপাশের উঁচু উঁচু পাহাড়চূড়াতেও কোনো বসতির লক্ষণ নেই। এতিমখানাটি ‘এতিম‘ শব্দের আড়ালে বস্তুত তালেবানদের কিশোরী ধর্ষণাগার। এতিমখানার চারপাশে পাহাড়ের কোলে কোলে শুধু ভীতি আর বিষন্নতা। এই বিষন্নতার মাঝেও করুণ আর বেদনার্ত এক সুর ভেসে আসছে। মরিয়মের চিকন কণ্ঠ হতে সেই সুর ছড়িয়ে পড়ছে পাহাড় ছেড়ে আরো দূরে আকাশের পথে। সেই বিষন্ন বেদনার গান মানবের আদি উৎসস্থল থেকে, হারিয়ে যাওয়া অযুত মানবাত্মার না পাওয়ার ভাষা হয়ে, পৃথিবীর বিস্তীর্ণ প্রান্তর জুড়ে স্রষ্টার মহামান্বিত চাঁদের আলোর নিচে তাদের অসহায়ত্বের যাতনা হয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে মানবের শেষ পরিণতি অথবা মহাকালের পায়ের তলায় পতিত এক ধ্বংসপ্রাপ্ত মানবগ্রহের দিকে।
[hfe_template id=’81’]
জনমানবহীন পাহাড়ি এক উপত্যকায় কাটানো তার সেইসব ভয়াল আর বিভৎস রাতগুলো যতবার মনে পড়ে ততবার অজান্তে অরোরার চোখ ভেজা ভেজা হয়ে ওঠে। তার আত্মায় জেগে থাকা মরিয়মের সেই করুণ আর বিষন্ন স্বরটা বিশ্বের তাবৎ শিল্পীর সমবেত কণ্ঠে ধ্বনিত হতে থাকে হিন্দুকুশ থেকে হিমালয় হয়ে আল্পস পর্বতের শৃঙ্গে। যেন পাখি, বৃক্ষলতা, রাতের ঝিঁঝি পোকা, ভূমির গহবরে বাস করা সব কীট আর পতঙ্গ, জলের সব প্লাঙ্কটন তালেবানদের হাতে ধর্ষিতা এবং এক পা কেটে নেয়া মরিয়ম আর অরোরার মতো অগনিত কিশোরীর কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে স্রষ্টার কাছে নালিশের জন্য একই তানে নিনাদিত করে চলছে মহাবিশ্বের সকল প্রান্তর।
ভয়াল সেইসব রাতগুলোর কথা মনে হলেই অরোরার চোখের সামনে ভেসে ওঠে, কালো লোমশে মুখ-বুক ভর্তি এক ভল্লুক-দানব তাকে ধর্ষণোদ্যোত… যতই সে কাঁদছে ততই উল্লোসিত হয়ে উঠছে সেই দানব। চোখের সামনে আজ আবার ভেসে উঠছে – দুর্ভেদ্য এক পাহাড়গুলোর মাঝে ভাঙাচোরা সেই কুঁড়েঘর। ঘরগুলোর মাথার ওপর অসংখ্য তালিমারা সামিয়ানার ছাদ। এই ঘরগুলো নিয়েই গড়ে উঠেছে শিশুদের এতিমখানার নামে তালেবানদের গোপন বাসনা চরিতার্থের বেশ্যালয়। তালেবানদের অপশাসনের কারণে যে পরিবারগুলো ভিখারি হয়ে গিয়েছে, শরীয়া আইন না মানার কারণে অথবা তাদের নির্দেশিত শরিয়া সম্মত জীবন-যাপন না করার কারণে যাদের বাবা-মা তালেবানদের হাতে নিহত হয়েছেন, বস্তুত তাদের কন্যা-সন্তানদের নিয়ে এই এতিমখানা নামের নরককুন্ড!
অরোরার সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছে মরিয়াম নামের মাত্র চৌদ্দ বছরের মেয়েটাকে। ধর্ষিত হওয়ার প্রাক্কালে সে এক তালেবান নেতাকে লাথি মেরেছিল বলে ধর্ষণ শেষে যার পা রামদা দিয়ে কেটে নেওয়া হয়েছিল। তালেবানদের হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়ে পা সেরে ওঠার পর প্রতিনিয়ত ধর্ষিত হওয়াই ছিল যার নিয়তি। ক্ষুধার কারণে এই জীবন-ব্যবস্থাকে মেনে নেওয়া ছাড়া মরিয়মের মতো অসহায় এবং তাদের হাতে বন্দী কিশোরীদের আর কিছুই করার থাকে না ।
এক পা নিয়েই মরিয়ম বিকেলে পাহাড়ের পাদদেশে খেলার সময় কেমন শিশুসুলভতায় মেতে উঠত! স্মৃতিগুলো চলচ্চিত্রের দৃশ্যকল্পের ন্যায় অরোরার মানসপটে ভেসে উঠছে। ভেজা ভেজা চোখের অশ্রু শুকিয়ে এসেও পুনরায় তার নেত্রপল্লব ভিজে যাচ্ছে। চোখের সামনে থেকে দৃশ্যগুলো সরানোর জন্য রাতের খাবার খেয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে একটা বই খুলে তার মধ্যে মগ্ন হওয়ার চেষ্টা করল অরোরা। কিন্তু কিছুক্ষণ পর সে নিজেই আবিস্কার করল যে, বইটা তার বুকের ওপর পড়ে আছে। তার মানসপটে তখন ভাসছে- কাঠের চারপায়ার ওপর দণ্ডায়মান এক চৌকি আর তালেবানদের লেবাসের মতোই লম্বা সলতেওয়ালা সেই চেরাগ। তাদের শাসনামলে দেশ-উন্নয়নের মহান প্রতীক এই চেরাগের মৃদু আলোয় তালেবান-কর্তা একটানে ছিঁড়ে ফেলেছে অরোরার শরীরের সব পোষাক। অরোরা তার গালে কষে এক থাপ্পড় বসাচ্ছে। তার শাস্তি হিসেবে কয়েকজন তালেবান সৈনিক লম্বা ধারালো চাকু আর কাঠের গুড়ি যোগাড় করেছে । ধর্ষণ শেষেই ওরা এই কাঠের গুড়িতে অরোরার হাতটা রেখে তা কেটে নেবে ; তারপর হয়তো কাটবে তার শরীরের নারীসুলভ কোনো অঙ্গ … হয়তো তাকেই তারা কেটে দ্বিখন্ডিত করবে।
স্মৃতিগুলো তার মানসপটে যত ভাসছে, অরোরার ছলছল চোখ ছাপিয়ে ততই যেন প্রতিশোধ নেওয়ার তার অন্তরে আকাঙ্খা দাউদাউ করে জ্বলছে। তার এই স্পৃহার পেছনে কারণ থাকলেও ফলাফল শুধু মানসিক পীড়নে আক্রান্ত হওয়া –ব্যাপারটা স্পষ্ট উপলব্ধি করেও অরোরা মনে মনে তাদের অভিসম্পাত দিতেই থাকে।
অরিত্রকে নিয়ে অসম্পন্ন প্রতিবেদনটি সম্পন্ন করার জন্য বিছানা থেকে উঠে পুনরায় টেবিলে বসল সে। তার ভেতরে তালেবানদের প্রতি তীব্র ঘৃণাটুকু এখন মাতোমার বিপক্ষে কাজে লাগাতেই যেন তার ল্যাপটপের কি-প্যাডে অরোরার হাতের আঙুল সচল হয়ে উঠছে। অরোরার আঙুলের কাটা দাগ দীর্ঘদিনের ব্যবধানে গভীর এক আঁচড়ের দাগ হয়ে গেছে। তার জীবনে প্রথম দেখা তরুণ অরিত্র যার চোখ অরোরার আঙুলের এই দাগটা দেখে কেমন মায়াবী হয়ে ওঠে। নাকি অরোরার আঙুলের গভীর কাটা এই দাগটা দেখে অরিত্রের নীরিহ গভীর চোখেও কৌতূহল জাগে এই জন্য যে, এই আঙুল ভয়ংকর এক শরীরী সৌন্দর্যের প্রতীক বলে মনে হয় তার কাছে? পুরুষ জাতটার প্রতি সহজে বিশ্বাস জাগে না অরোরার ।
তবু, অরিত্রের চোখ তা বলে না বলেই তার মনে হয়। অরিত্র ছাড়া কোনোদিন কেউ জানতে চায় নি অরোরার আঙুলে আজীবন সঙ্গী এই লম্বা দাগের করুণ ইতিহাস! কেন অরিত্রের মনে হয়, অরোরার এই দাগটুকু শুধু দাগ নয়? এই চিহ্নের সাথে অরোরার যে ভয়ংকর স্মৃতি লুকানো তা সে কীভাবে বুঝতে পারে – ভেবে তার বিস্ময়ের সীমা থাকে না। শুধু মনে হয় অরিত্রের মাঝে মানবিক গভীর কোনো আবেগ লুকিয়ে আছে। যার অন্তর্যামী চোখ দুটোতে স্রষ্টা এত মায়া দিয়েছেন অরোরা তাকে হারাতে চায় না।
[hfe_template id=’81’]
প্রতিবেদনটি মেইল করে অরোরা এক কাপ চা বানিয়ে তারপর আটলান্টিকের গর্জন শোনার জন্য ছাদ-ঘরের বারান্দায় গিয়ে দক্ষিণমুখী হয়ে সে বসল। এখন তার নিজেকে বেশ নির্ভার লাগছে। মেইলটা পাঠানোর পর থেকে এক ধরণের তৃপ্তিবোধের সাথে সে তার সঙ্গীকেও যেন আপন করে ফিরে পেয়েছে। সেই সঙ্গী আর কেউ নয়, আটলান্টিকের ঢেউয়ের নিনাদিত গর্জন। এই গর্জন যেন মরিয়মের কণ্ঠের সুর হয়ে আকুল-অপার তানের সমবেত সংগিত হয়ে ছড়িয়ে যায় অসীম জলের পারাপার থেকে আসমান পেরিয়ে অতঃপর তার আত্মার কাছে।
একটু পরেই শুরু হলো টিপটিপ বৃষ্টি। সেই বৃষ্টি ক্রমাগত বাড়তে বাড়তে তীব্রতর হয়ে উঠল। প্রলয়ংকরী বৃষ্টির শব্দ এই মধ্যরাতে গলাধঃকরণ করেছে আটলান্টিকের আর্তনাদ। অরোরা মাঝে মাঝেই এই ছাদ-ঘরে এসে নিজের জীবনের আর্তনাদগুলো সাগর-ঢেউয়ের মাঝে ছড়িয়ে, বিলিয়ে দেয়। কখনো জোছনালোক আর কখনো অন্ধকারে কাঠ নির্মিত এই ছাদ ঘরটা তার বড় আপন হয়ে ওঠে। আজ নিকষ-কালো অন্ধকারে বৃষ্টির ঝাপটা আর নিনাদ তার সেই আর্তনাদে মিশে কী আকুলভাবে নিসংগ করে তুলছে তাকে।
অরোরা মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল, এমনি কোনো এক বৃষ্টি-নিনাদিত অসীম আঁধারে এই ছাদ-ঘরটায় বসে সে তার আঙুলের কাটা দাগের রহস্যটুকু অরিত্রকে শোনাবে। তবে তার আগে তার ইচ্ছা অরিত্রকে আরো একটু ভালো করেই যাচাই করে নেয়া। তার সাথে এক লম্বা সফর করে অরোরা তার বৈশিষ্ট্যের দৃঢ়তা নিয়ে নিশ্চিত হতে চায়। নড়বড়ে চরিত্রের মানুষকে সে নিজের জীবনে স্বাগত জানাতে চায় না। অরোরা জানে, তার অতীতকে মেনে নেয়ার জন্য কেমন অবারিত আর উদার চিত্তের তরুণ তার কাম্য। যে তরুণ তার হাত ধরে পাশাপাশি পথ চলার সময় বর্তমানের অরোরার চোখে চোখ রাখে। যে তরুণ শরীরের চেয়ে তার সত্তাকে ভালোবাসবে। যার মনে হবে, এই জন্মে অরোরাকে পেয়েও যেন তাকে পুরোটা পাওয়া হলো না। অরোরার জন্য এই পৃথিবীতে বার বার ফিরে আসতে না পারলেও যে তরুণ তার আত্মার সাথে বিচরণ করবে আটলান্টিকের প্রান্তর হয়ে হিমালয়ের চূড়ায়, জোছনা-প্লাবিত সমতলভূমি হয়ে বৃষ্টি-মুখরিত দিনে; দুজন দুজনের উষ্ণতায়।
ছোট্ট এক জীবন নিয়ে বার বার অরোরা জুয়া খেলায় নামতে চায় না।

কাজী রাফি
জন্ম – ২২ নভেম্বর, ১৯৭৫, বগুড়ায়।
মানুষ ও তাদের যাপিত জীবন এবং প্রকৃতি দেখার প্রয়োজনে ঘুরেছেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। চাকরির প্রয়োজনে আফ্রিকায় বাস করেছেন দুই বছরের অধিক সময় এবং আফ্রিকার প্রকৃতি-সংস্কৃতি, তাদের প্রান্তিক মানুষের যাপিত জীবনকে দেখেছেন খুবই কাছ থেকে। আফ্রিকার পটভূমিতে লেখা ‘ধূসর স্বপ্নের সাসান্দ্রা’ তাঁর প্রথম উপন্যাস। এই উপন্যাসেই কালি ও কলম পুরস্কার লাভ করেছেন তিনি; তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ, ১১ টি উপন্যাস এবং ৬ টি ছোট গল্পগ্রন্থ সবই পাঠক প্রিয়তায় প্রথম সারিতে। তাঁর লেখা ‘ত্রিমোহিনী’ উপন্যাসকে মহাকাব্যিক অ্যাখ্যা দিয়েছেন কিংবদন্তী ছোট গল্পকার হাসান আজিজুল হক ।
পুরস্কার, এইচএসবিসি কালি ও কলম পুরস্কার -২০১০, এমএস ক্রিয়েশন সম্মাননা -২০১০, নির্ণয় স্বর্ণপদক-২০১৩, এসএম রাহী পদক ২০১৯
ওয়েবসাইট