কাজী রাফি
কথাশিল্পী

কাজী রাফি
জন্ম – ২২ নভেম্বর, ১৯৭৫, বগুড়ায়।
মানুষ ও তাদের যাপিত জীবন এবং প্রকৃতি দেখার প্রয়োজনে ঘুরেছেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। চাকরির প্রয়োজনে আফ্রিকায় বাস করেছেন দুই বছরের অধিক সময় এবং আফ্রিকার প্রকৃতি-সংস্কৃতি, তাদের প্রান্তিক মানুষের যাপিত জীবনকে দেখেছেন খুবই কাছ থেকে। আফ্রিকার পটভূমিতে লেখা ‘ধূসর স্বপ্নের সাসান্দ্রা’ তাঁর প্রথম উপন্যাস। এই উপন্যাসেই কালি ও কলম পুরস্কার লাভ করেছেন তিনি; তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ, ১১ টি উপন্যাস এবং ৬ টি ছোট গল্পগ্রন্থ সবই পাঠক প্রিয়তায় প্রথম সারিতে। তাঁর লেখা ‘ত্রিমোহিনী’ উপন্যাসকে মহাকাব্যিক অ্যাখ্যা দিয়েছেন কিংবদন্তী ছোট গল্পকার হাসান আজিজুল হক ।
পুরস্কার, এইচএসবিসি কালি ও কলম পুরস্কার -২০১০, এমএস ক্রিয়েশন সম্মাননা -২০১০, নির্ণয় স্বর্ণপদক-২০১৩, এসএম রাহী পদক ২০১৯
ওয়েবসাইট

ঢাকা বিমানবন্দরের লাউঞ্জে ঢুকতেই অরিত্রের মতো এত বড় এক ছেলেকে যেভাবে তার মা জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিল, তা দেখে অরোরার চোখ ছলছল করে উঠল। অরিত্রও মাকে পেয়ে যেন কৈশোর আবেগে ভেসে যাচ্ছে। অরোরা দেখল, তার বাবাও ব্যবধানে থেকেও এমন করে রুমাল দিয়ে চোখের কোণ মুছছেন যেন তিনি তার চোখে পড়া কোনো এক পোকা সামলাতে ব্যস্ত। অরিত্র তার বাবা-মায়ের সাথে অরোরার পরিচয় করিয়ে দেবার আগেই ফারহা অরণি অরোরাকে এমন করে স্নেহ করলেন যে, অরোরার মনে হলো, অনেকদিন পর সে-ও তার বড় আপন আর চেনা মানুষদের কাছে এসেছে। অরণি অরোরার গালে হাত ছুঁয়ে চুমু দিলেন। তার কাঁধে-মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। স্নেহের এই ধরণ অরোরার আত্মার ভেতর গিয়ে এক আনন্দমুখর পৃথিবীকে উদ্ভাসিত করল।
কিন্তু অরিত্রের বাবা-মায়ের স্নেহ পেয়ে কেন যেন অরোরার আবার ইচ্ছা করল নিজের প্রথম জীবনটাকে, ঠিক তার শৈশবে ফিরে যেতে। তাহলেই সে তার বাবার অতীত ঐতিহ্য আর সমৃদ্ধির মাতৃভূমিতে; যে ভূমিকে যুগের পর যুগ ‘যুদ্ধ‘ নামের উঁইপোকা খেয়ে ফেলেছে, সেখানে যেত না। মায়ের মুখটা মনে পড়ল। মনে পড়ল বাবার জীবনের শেষ মুহূর্তটুকু। কী চরম হতাশা আর নিজের নির্বুদ্ধিতায় মেয়ে এবং স্ত্রীকে তালেবানদের হাতে বন্দীবস্থায় রেখে তিনি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছিলেন। বাবার ভয়ংকর ভাষাহীন আক্রোশ তার চোখ-মুখ থেকে মৃত্যুভীতি এমনকি তার যন্ত্রণাও হয়তো কেড়ে নিয়েছিল ।
অরোরা তার বিষন্ন কালো পাপড়ির নিচে আনন্দভেজা চোখে স্নিগ্ধতা ফুটিয়ে অরণির গালে গাল ছোয়াল। তার কাঁধে হাত রেখে মুখে স্মিত হাসি ফুটিয়ে বলল, “আই‘ম অরোরা।“
চিবুকে ছোট্ট এক লাল তিল অরণির। হাসলে তার চিবুকের এই তিলটাও যেন হাসে। তখন তার হাসিতে পরিপূর্ণ মুখটা আরো উজ্জ্বল দেখায়। নাম শোনার পর অরণি অরোরার হাত ধরে ইংরেজিতে বললেন, “এই কয়দিন তোমার সাথে আমাদের ইংরেজিতে কথা বলতে হবে ভেবে আমি চিন্তিত। অরিত্র আর ওর বাবার মতো আমি তো ইংরেজিতে অত পাকা নই, মা। যাহোক, তোমার কথা আমার ছেলের মুখ থেকে অনেক শুনেছি। তুমি তো আমার মেয়ে। অরণির মেয়ে ‘অরোরা‘।“
কথাকটা বলেই তিনি অরিত্রের বাবা চয়ন রাহমানকে বললেন, “দ্যাখো না, আমার পাশে ওকে ঠিক আমারই মেয়ের মতো লাগছে, তাই না চয়ন? যদিও সে আমার চেয়ে একটু লম্বা…“
আশ্চর্য, পাকা নয় বলেও অরণি কেমন দ্বিধাহীনভাবে অনর্গল ইংরেজিতেই কথাগুলো বলছে ভেবে অরোরা অবাক হলো। বুঝল, বদান্যতা দেখানো বাঙালি সংস্কৃতিরই এক অংশ হয়তো। তাহলে তা নিঃসন্দেহে সমৃদ্ধ এক সংস্কৃতি। কিন্তু অরণির সামান্য এই কথাটায় অরোরার এবার সত্যিই নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। মনে পড়ল, খাল-পাহাড়ের পাদদেশে তার বাবার সেই প্রাসাদটা যেখানে সে শেষবার তার মাকে দেখেছে। অরোরার স্মৃতিপটে ভেসে উঠল, আলখেল্লা পরিহিত অস্ত্রধারী দুজন মানুষ তার মাকে টেনে হিচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। তারা কোথায় তার মাকে নিয়ে গিয়েছে আজো তার কোনো হদিস জানে না সে। বাবাকে চোখের সামনে সে খুন হতে দেখেছে বলে বাবার আত্মার সাথে নিজের আত্মাকে মিলিয়ে এক ধরণের প্রবোধ তার মন মানে। কিন্তু, অনেক বছর আগে মাকে ওভাবে হারিয়ে তার অস্তিত্বকে জানতে চাওয়ার জন্য ভেতরের অদম্য ইচ্ছাকে গলা টিপে টিপে মারতে মারতে অরোরা নিজের কাছেও মরে গিয়েছিল। কী এক বেদনায় সেই দিনের অনুভূতি তার অন্তরাত্মায় আজ আবার এসে ভিড় করল।
[hfe_template id=’81’]
তার চোখের কোণ চকচক করে উঠল। অরণির মাঝে নিজের মাকে আকুল হয়ে সে খুঁজে ফিরল। নিজের মাকে নিয়ে সারাক্ষণ কিছু প্রশ্ন ঘোরপাক খায়। তিনি কি এখনো বেঁচে আছেন? না কি, তিনি এখন আফগানিস্তানের কোনো এক বৃদ্ধাশ্রমে ? এই প্রশ্নগুলো তার মনের মাঝে বাস করে তাকে কুঁরে কুঁরে খেয়ে যে চিরন্তন যন্ত্রনার ক্ষত তৈরি করেছে তা কখনো কাউকে বলে সে তার মনের ভার লাঘব করতে পারে নি। অরণিকে পেয়ে তার যন্ত্রনাকাতর অন্ধকার হৃদয়ে একরাশ আলো ফুটল। অরোরার মনে হলো, মুখ ফুটে সে তার জীবনের দুঃখময় অতীতকে তুলে না ধরতে পারলেও, তার বিষন্ন কালো পাপড়ি দিয়ে আবৃত নেত্রের ভাষা আবিস্কারের মানুষ সে পেয়ে গিয়েছে। কেন এমন মনে হলো, তা সে জানে না। শুধু নিজের আবেগকে আড়াল করতে সে অরণির কাঁধে মাথা লুকাল।
অরোরাকে নিয়ে অরণি কারের পেছনে নিজের বামপাশে আর চয়ন রাহমানকে তার ডানে রেখে নিজে মাঝখানে বসলেন। গাড়িতে ওঠার পর চয়ন রাহমান অরোরার সাথে প্রথম কথোপকথন শুরু করলেন। তাদের আলাপচারিতা শুনতে শুনতে চালকের পাশে বসা অরিত্র মুখ ঘুরিয়ে বলল, “তোমরা মনে হয় ভুলেই গেলে যে, সামনে আমিও আছি…“
চয়ন তার সাথে গলা মেলালেন, “মেয়েরা তার বাবাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসলেও মায়েরা ঘরের বাইরে বাস করা মেয়ের জন্যই সব স্নেহ সঞ্চিত করে রাখে। তারা মনে করে, বাইরে থাকাই ছেলেদের কাজ।“
অরণি বললেন, “ঠিক তাই। এমন যোগ্য মেয়ে পৃথিবীজুড়ে কয়জন বাবা-মায়ের আছে বলো! ভুলে যেয়ো না যে, অরোরা, অরিত্রের বস…“
অরোরা লজ্জা পেয়ে অরণিকে ঠিক কী সম্বোধনে সম্বোধন করবে তার হদিস না পেয়ে, শেষে অরণি যেহেতু তাকে মেয়ে বলছেন তা ভেবে দ্বিধাহীন কণ্ঠে তাকে ‘মা‘ সম্বোধন করে বলল, “না, মা। তেমন কিছু নয়। আমরা দুজনেই একই ধরণের কাজ করি। আমি হয়তো কিছুদিন আগে সংস্থাটিতে যোগদান করেছি তাই…“
অরণিকে ‘মা‘ ডেকে কেমন এক শিহরণে আপ্লুত হলো অরোরা। কতকাল সে ‘মা‘ শব্দটা ব্যবহার করে নি। অথচ, ভোর রাতে বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর থেকে সে ‘মা‘, ‘মা‘ শব্দের মমত্বের আঁচলে স্থান-কাল এমনকি নিজের বয়সটুকু ভুলে গিয়ে এক কিশোরী অরোরা হয়ে গেল। সেই কিশোরী যার হৃদয়ে স্বপ্নের কলকল প্রবাহ ছিল। সেই কিশোরী অরোরা যে তখনো নিষ্ঠুর শব্দের সাথে পরিচিত হয়ে ওঠে নি। আজ অরণিকে মা ডাকার পর তার আত্মা পরিতৃপ্ত হলো। তার মনে হলো, মায়ের আত্মাটাই অরণি নামের এক নারীর মাঝে ভর করে তার পাশে বসে আছে। আর সে ফিরে পেয়েছে তার স্বপ্নময় সব অনুভূতি! ভালো লাগার এমন ঘোরের মাঝে সে প্রায় ভাষাহীন হয়ে নিজের কোমল ডান হাতটা অরণির বাম হাতের মাঝে একে অন্যকে জড়িয়ে থাকতে দেখল। ঠিক তখনই মেয়েদের বয়স নিয়ে প্রশ্ন করতে হয় না জেনেও বোকার মতো জিজ্ঞাসা করে বসলেন, “মা, তোমাকে কিন্তু আমার অরিত্রের চেয়ে বয়সে ছোটই মনে হচ্ছে। তোমার জন্ম কত সালে?“
চয়নের এই প্রশ্নে অরণি বিব্রত বোধ করে যখন তার উরুতে গোপনে চিমটি কাটছেন তখন অরোরা উত্তর দিচ্ছে, “বারো নভেম্বর ঊনিশ শ তিরাশি…“
অরোরার উত্তর শেষ হওয়ামাত্র অরণি অবাক হয়ে অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, “কী বললে, বারো নভেম্বর ঊনিশ শ তিরাশি?“
“ঠিক তাই।“
তাদের এই কথোপকথন বিস্ময় ভরা চোখে চয়ন শুধু হা করে তাকিয়ে তাকিয়ে শুনছেন। তিনি তখন অরণিকে বলতে শুনলেন, “হায় খোদা, তোমার আর অরিত্রের জন্মদিন দেখি একই!“
[hfe_template id=’81’]
“না তো, অরিত্র তার পাঠানো জীববনাল্লেখ্যে তার জন্ম তারিখ ৩০ ডিসেম্বর উনিশ শ চুরাশি বলে উল্লেখ করেছে।“
“সেটা তার আসল জন্মদিন নয়। ওটা ওর সার্টিফিকেট জন্মতারিখ…“
একজন মানুষের কীভাবে দুইবার জন্ম তারিখ নির্ধারিত হয় তা ভেবে যখন অরোরা বিভ্রান্ত তখন সামনের আসন থেকে এইমাত্র অরোরার জন্মতারিখ জানায় নিজেও বিস্মিত তবু আনন্দিত অরিত্র তাকে এদেশের মানুষের জন্ম তারিখের সাথে সার্টিফিকেট তারিখের মিল না থাকার অসংখ্য কারণ বুঝিয়ে বলল। অরোরা বুঝল, এখান থেকেই এই অঞ্চলের মানুষের মনোস্তাত্ত্বিক জটিলতার শুরু। অরণি গদগদ গলায় বললেন, “খুব ভালো হলো,তোমারা এমন সময় এলে! বারো তারিখ আসতে আর মাত্র পাঁচদিন বাকি। এবার ঘটা করে আমার ছেলে-মেয়ের জন্মদিন পালন করব।“
কী অদ্ভুত ব্যাপার, সবুজ দিগন্ত-বিস্তৃত ধানক্ষেতের দিকে তাকিয়ে অরোরার ভাবনাগুলো পাখনা মেলেই যাচ্ছিল; মোট একুশ দিন ছুটির দশদিন সে অরিত্রের সাথে বাংলাদেশে কাটাবে বলে পরিকল্পনা করেছিল। তার মাঝেই দুজনের জন্মদিন পড়েছে! চয়নের প্রশ্নে অরোরার এইসব ভাবনায় ছেদ পরল, “তোমার বাবা-মা কি রুমানিয়াতে, মা?“
একই সাথে চাকরি করে অরিত্র কখনোই অরোরার কাছে তার ব্যক্তিগত বিষয়গুলো জানতে চায় নি। অরোরার পরিবার নিয়ে কোনো প্রশ্ন কেন তার মাথায় আসে নি, বাবার প্রশ্ন শুনে, এই প্রশ্ন তার নিজের মাঝে ঘোরপাক খাচ্ছিল। কতদিন পর দেখা মাঠভরা সবুজ শস্যক্ষেত, হেমন্ত-ভোরে মৃদু কুয়াশার আস্তরণ পেরিয়ে জেগে ওঠা গ্রামগুলো তাকে মগ্ন করে রেখেছিল। প্রায় মিলিয়ে যাওয়া কুয়াশা বলয় পেরিয়ে যেন গ্রাম নয়, স্বপ্নময় কোনো এক স্থির চিত্র ভেসে আছে। বাবা প্রশ্ন করতেই সে বাইরের প্রকৃতি থেকে তার মনোযোগ অরোরার উত্তর শোনার জন্য নিবিষ্ট করল। কিন্তু অরোরার বদল সে তার মা অরণির কণ্ঠে ধমকের স্বর ঝরে পরতে শুনল। অরণি শাসনের ভঙ্গিতে চয়নকে বলছেন, “শোনো, চয়ন। তুমি এভাবে বোকার মতো প্রশ্ন করবে না। সময় হলে আমরা এমনিতেই তাদের সম্পর্কে জানতে পারব।“
অরোরা তার বড় বড় চোখ মেলে বলল, “ইটস ওকে, মা। আমার পনেরো বছর বয়সে বাবা মারা গিয়েছেন। আর যেদিন বাবা মারা গিয়েছেন, ঠিক সেদিনই মাকে অপহরণ করা নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, মা কি আজো বেঁচে আছেন কি না আমি তার কিছু জানি না। “
[hfe_template id=’81’]
অরিত্রের বুকের মাঝে ধ্বক করে উঠল। এমন এক দুঃখী মেয়ে তার পাশে বাস করে যে তার দুঃখের কথা কোনোদিন তাকে বলে নি। প্রথম দেখাতেই তার মনে হয়েছিল, কেতাদূরস্ত আর চোখ-ধাঁধানো সৌন্দর্যের অরোরার কোথায় যেন ‘বিষন্ন‘ শব্দ বাস করে। হয়তো তার চাহনিতে। এখন অরোরার বাবা-মায়ের নির্মম পরিণতির কথা জেনে তার মনে হলো, অরোরার হাতের আঙুলের কাটা দাগটাও ঠিক সেদিন থেকেই সে বয়ে বেড়াচ্ছে যেদিন তার বাবা খুন হয়েছেন। অরোরার জন্য বড় মায়া হলো তার। সে পেছন ফিরে তাকানোর মতো শক্তি যেন পাচ্ছে না। যদি, অরোরার চোখে চোখ পড়ে যায়! তবু সে, অরোরার চোখে একবার তাকিয়ে চোখের ভাষায় তাকে সহমর্মিতা জানানোর জন্য পেছনের ঠিক বিপরিত আসনে অরোরাকে দেখার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেও বুঝল, পেছনের আসনের সবাই চুপ হয়ে গিয়েছে।
অরোরার কাছ থেকে তার জীবনের ছোট্ট অথচ সবচেয়ে যাতনাময় পর্বের কথা জেনে সংবেদনশীল মনের অরণির হৃদয় হাহাকার করে উঠল। তিনি আলতো করে অরোরাকে জড়িয়ে নিতেই সে তার কাঁধে পরম নির্ভরতায় মাথা রেখে মনের কথা বলার মতো এক মানুষ পেয়ে তার কাছে আশ্রয় খুঁজে ফিরল। অরিত্র সামনে বিস্তৃত রাস্তাটায় চোখ ফেরাল। গাড়ির সব গ্লাস তোলা। তবু, চাকার প্রচণ্ড গতিময় ছপছপ শব্দ অরোরার জন্য অনবরত বেজে চলা তার কষ্টের ভাষার তান হয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে -রাস্তার পাশে শুকিয়ে আসা খালে, সবুজ দিগন্ত পেরিয়ে আকাশের প্রান্ত সীমানায় ছেড়া ছেড়া কয়েকটা মেঘে। অরণি তখন ফিসফিস করে অরোরাকে বলছেন, “আমিই তো তোমার ‘মা’ রে, মা!“ এই বাক্য শুনে অরোরা নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারল না। চৌদ্দ বছর পর সে প্রথম নিজের ভেতর থেকে দুমড়ে-মুচড়ে আসা কান্নাকে সংবরণ করতে আরো নিবিড় হয়ে অরণির মাঝে হারিয়ে যেতে চাইল। এত বড় এক চাকুরে মেয়ের এমন কাঁচা আর স্নিগ্ধ আবেগ দেখে টলটল অশ্রুতে পূর্ণ হয়ে উঠল অরণির দু চোখ। শাড়ির আঁচল দিয়ে তিনি নিজের চোখ মুছলেন। আর গায়ে ঝোলানো শালটার প্রান্ত দিয়ে অরোরাকে ঢেকে নিয়ে তার ঋজু শরীরটা আরো নিবিড় মায়ায় জড়িয়ে নিলেন।