অমরার ফুল
ঝর্না রহমান
(মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় নিহত তেইশ বছরের তরুণ, ফ্লাইং অফিসার আয়মান আলী সায়রকে।)
একদিন আমার তলপেটের মসৃণ চামড়া তিরতির করে কেঁপে উঠেছিলো
মা হেসে বলেছিলেন, ওখানে একটা ফুল ফুটছে! গর্ভফুল!
আমি কখনো গর্ভফুল দেখিনি। মা বললেন, ওখান থেকে বেরিয়ে আসবে অমরার ফুল!
ফুলশিশু দেখতে পাবে একদিন! অমনি চামড়ার নিচে নেচে ওঠে ঢেউ!
আমি টের পাই মাতৃমৃণাল মুখে পুরে চোঁ চোঁ করে
পুষ্টিরস টেনে নিচ্ছে দুরন্ত বুভুক্ষু এক আত্মজ কুসুম।
আমি ওর জন্য অমরার আলমারি খুলে সবচেয়ে নরম কম্বল বের করে আনি
কম্বলে স্বপ্নের মত কোমল লোম জমতে থাকতে থাকে,
অমরার ঘুমদোলায় আরামের ওম জমতে থাকে,
জমাট ওমের ভেতর থেকে একদিন জন্ম নেয় অমরার ফুল…..
সেদিনটির কথা খুব মনে পড়ে। সেদিন আমার দেহ জুড়ে
রক্ত ঘাম অশ্রু আর সঞ্জীবনী হৃৎরসের হরিৎ উৎসব!
উদ্বোধনী সংগীতের ধ্বনি শুনে আমি চোখ মেলি
ধাতৃমাতৃহাতে অপরূপ আঁজলায় ফুটে আছে মনকুঁড়ি-দেহফুল-অমরাকুসুম
গাঢ় সবুজ বৃতির আবডালে লুকিয়ে আছে লালঠোঁট কুহক কোরক,
নতুন পাপড়িগুলো তখনও জড়িয়ে আছে ঘুমের ভেতর,
গর্ভফুল-গন্ধভরা ওমের ভেতর,
মনতোষ শিহরিত রোমের ভেতর,
মা বলেন, এই নাও তোমার পরম-পাপড়িঢাকা মর্মকুসুম!
আমি আবার অমরার আলমারি খুলি।
মর্মের মায়ামোড়া পশমিপোশাকে আমার ঘর ভরে উঠতে থাকে
আমার চুম্বনগুলো সুগন্ধী বৃষ্টির মত অবিরল ঝরে পড়ে
আমার স্তন্যধারা থেকে প্রবাহিত হতে থাকে দুগ্ধমধুসুধারস প্রাণদায়ী সেচ
ঘুম আর স্বপ্নের দোকান থেকে তারাফুল কিনে এনে প্রতিদিন আমি এক বাগান সাজাই।
ওকে আমি কানে কানে বলি, বড় হয়ে ওঠো জাদু,
ছুঁয়ে ফেল আকাশ ফুঁড়ে ওঠা আশ্চর্য সব প্রাসাদের চূড়ো,
মৃত্তিকায় মিশে গিয়ে একদিন আমি
আবার তোমাকে ঢেকে রেখে দেবো অমরার ফুলের কৌটোয়।
আচমকা আমার সারা দেহ ভিজে গেল আকাশগঙ্গা ভেঙে পড়া জলে
তারাফুলের বিপণীবিতানে ঘটে গেল আণবিক বিস্ফোরণ
আকাশবাড়ি ছেয়ে গেল অমরার ফুলের বিষাদে
আমার বুক থেকে খসে পড়ে বাজে পোড়া টুকরো টুকরো পশমি পোশাক
কঠিন মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে অমরার কোমল কম্বল…..
এখন আমার দেহের রক্তমাংসহাড়অস্থিমজ্জায় শুধু লবণ স্রবণ
প্রতি কণা দেহকোষ থেকে একটি করে অতল সায়র প্রবাহিত হচ্ছে,
আমার চক্ষুমণি থেকে জন্ম নিচ্ছে অযুত নিযুত অশ্রুনদী,
সৃষ্টির আদিকাল থেকে সঞ্চিত সমস্ত গর্ভযন্ত্রণার স্বেদবিন্দুর অধিকার নিয়েছি আমি দেহে,
অবিরল জলসেচ দিয়ে কঠিন মাটিকে কোমল করে সেইখানে পুঁতে দেবো
আমার আত্মাফুল মরমী দোসর।