শহরের এক প্রান্তে অরিত্রদের বাসায় দুপুরের পর পৌঁছে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল অরোরা। রাস্তায় এত অগনন যানবাহন অথবা মানুষের ভিড় দেখে তার চোখ অভ্যস্ত নয়। অরণি তাকে তার জন্য সাজিয়ে রাখা দোতলার কক্ষটা দেখিয়ে দিতেই সে নিজের হাত ব্যাগ ফেলে এক দৌড়ে স্নানঘরে ঢুকল। মাঝপথে একবার নাস্তা করে প্রচুর পানি পান করে সে কী ভুলটাই না করেছিল! সামনে আর মাত্র একশ কি.মি. পথ জানার পর সে ধরেই নিয়েছিল পথটুকু পাড়ি দিতে হয়তো দেড় ঘণ্টা লাগবে। কিন্তু লাগল, পাঁচ ঘণ্টা!
বাথরুম থেকে বের হয়ে সে তার জন্য বরাদ্দকৃত দোতলার কক্ষটা ভালো করে দেখল। পড়ার টেবিলে তাজা গোলাপ আর অর্কিড। সাথে ঘাসফুল দিয়ে তোড়া বানিয়ে তা ফুলদানিতে সুন্দর করে বিছিয়ে রাখা। বেশ বড় কামরাটার খাটটা একটু নিচু। দক্ষিণের দেয়ালের পুরো পর্দা সরিয়ে দিল অরোরা এবং খুশি হলো যে, দেয়ালটা গ্লাস দিয়ে নির্মিত এবং বাসাটার ঠিক বামপাশে একটা পুকুর। সেই পুকুরের টলটল জলে গাছ-পালার ফাঁক-ফোকর থেকে ছড়িয়ে পড়া আলোক-রশ্মির খেলা দেখে সে অরিত্রের কবি মননের একটি উৎসের সন্ধান পেল।
গ্লাসের দরজা খুলে বগেনভিলার নুয়ে থাকা ফুলের সমারোহ দিয়ে পরিপূর্ণ বড় পরিসরের বারান্দাটা অরোরার প্রাণে ভালো লাগার আবেশ ছড়িয়ে দিল। এতক্ষণে সে নিচু করে বানানো খাটের মর্মটা বুঝল। খাট থেকে নিশ্চয় জোছনালোকিত আকাশ দেখার জন্য এই ব্যবস্থা। বারান্দায় বসার জন্য দুটা চেয়ার। অরোরা মুখোমুখি রাখা দুটি চেয়ার দেখে আরো বুঝল, এখানে বসে অরিত্রের বাবা-মা হয়তো আড্ডা দেন। কী কথা বলেন তারা? সারাজীবন একসাথে বাস করা দুই মানুষ নতুন নতুন আর কী কথা বলেন? নাকি তাদের পুরাতন কথাগুলোর মাঝেই তারা ছড়িয়ে রাখেন আগামি কোনো নতুন দিনের নতুনতর কোনো স্বপ্ন? তার নিজের বাবা-মা বেঁচে থাকলে এমন এক বারান্দায় বসে কী গল্প করতে পারতেন অথবা করতেন? অরোরার জীবন তারা কী স্বপ্ন বুঁনতেন?
চুপ করে বারান্দাটায় দাঁড়িয়ে এইসব ভাবনা নিয়ে সে যখন নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত তখন ঘরের ভেতরে প্রবেশের জন্য অরিত্র দরজায় খটখট শব্দ করছে। অরোরা দ্রুত ফিরে এসে দরজা খুলে দিতেই অরিত্র অরোরার স্যুটকেস নিয়ে ভেতর প্রবেশ করেই বলল, “আর ইউ কম্ফোর্টাবল ম্যাম? উফ! সেই বিমানবন্দর থেকে তোমার এই ভারি ব্যাগ টানতে টানতে… কী আছে এর মধ্যে বলো তো?“
অরোরা অরিত্রকে তার নাক টেনে দিয়ে দুষ্টুমিভরা কণ্ঠে বলল, “বয়স-চোর! আমার বয়সে ছোটর ভাণ ধরে বেশ আছ আর বিল্লির মতো ম্যাও, ম্যাও করে সারাক্ষণ ‘ম্যাম‘, ‘ম্যাম‘ প্যাঁচাল পাড়ছো। বাবা-মা‘র সামনে আমাকে বুড়ি প্রমাণ করতে যদি আর ম্যাও, ম্যাও করো, তাহলে আমি ঠিক ঠিক তোমাকে লেফট-রাইট করাব, বুঝেছেন স্যার?“
[hfe_template id=’81’]
এই অচেনা অরোরাকে বড় চেনা লাগল তার। যেন কত যুগ যুগ ধরে এই বাড়িতে বাস করেও অরিত্র তার দেখা পায় নি। অরোরার মুখে বাবা-মা শব্দ অরিত্রকে মনে করিয়ে দিল খুব সাধারণ এক কথা। আর তা হলো, প্রতিদিন সূর্য ওঠে। মাঝে মাঝে চাঁদ তার রূপালি স্নিগ্ধ আলোয় ভরে রাখে এই বাড়ি আর তার আশেপাশের সবুজ ভূমিকে। অরোরাকে আজ তার সেই প্রতিদিনের চেনা সূর্যোদয়ের ভোর আর জোছনায় ভেসে যাওয়া বাংলার প্রান্তরের মতো খুব চেনা আর আপন মনে হলো। সে মুগ্ধ হয়ে অরোরার দিকে তাকিয়েই আছে দেখে অরোরা তার চোখের সামনে ডান হাত দুলিয়ে বলল, “এই যে মি. অরিত্র, নিজের ম্যাডামের দিকে অমন করে তাকিয়ে থেকে আপনি জাতিসংঘের আইন লঙ্ঘন করছেন…“
অরোরার কথা শেষ হতে না হতে অরণি এসে বলল, “মা, তুমি তাড়াতাড়ি গোসল সেরে নাও। আমি টেবিলে খাবার দিতে বলেছি।“
তিনি চলে গেলে অরোরা অরিত্রকে বলল, “কয়েক হাজার কি.মি. দূরত্বে আমদের জন্ম। অথচ দিনটা এক ছিল, আর আমার নামটার অংশও তুমি চুরি করেছ।“
“আমি কেন চুরি করব, এই কথাটা আমিও তোমাকে বলতে পারি। এই চুরির দায়টা আমার নয়, দাঁড়াও মাকে বলছি…“
“নো, নো, অরিত্র। ডোণ্ট টেল ইট টু হার, প্লিজ… আচ্ছা বলো তো তোমার জন্ম বারো নভেম্বর কয়টার সময় হয়েছিল?“
“সকাল এগারোটা তেতাল্লিশ মিনিটে… । বাবার ডায়েরিতে এই সময়টা উল্লেখ করা আছে।“
অরিত্রের মুখে তার জন্ম সময়টা শুনে চমকে উঠল অরোরা। তার পারিবারিক ইতিহাস-পুঞ্জিতে লেখা তার জন্মতারিখের লিপিবদ্ধের কথায় উল্লেখ আছে, ‘অরোরা জন্মেছে এক পরিস্কার নীলাকাশের নিচে আলো-ঝলমল দিনের পূর্বাহ্ণে। সে জন্মেছে সকাল এগারোটা তেতাল্লিশ মিনিটে…।‘ নিজের বিস্মিত ভাব কাটিয়ে সে দ্রুত মোবাইলে কী যেন দেখে নিয়ে অরিত্রকে বলল, “ওহ, গড! ইউ আর সিনিয়র টু মি বাই এক্সাটলি টুয়েলভ আওয়ারস! আমেরিকার যে শহরে আমার জন্ম তার সাথে এ দেশের গ্রিনিচ মান সময়ের বারো ঘণ্টা তফাত।“
অরিত্র কী বলবে তার কোনো ভাষা খুঁজে পেল না। ভাষাহীন চোখে তার মুখপানে কিছুক্ষণ তাকিয়ে আছে দেখে অরোরা এবার বলল, “আমরা দুজনই বৃশ্চিক। দ্য এক্সট্রিমিস্ট!“
“তুমি রাশি বিশ্বাস করো। আর বৃশ্চিকরা কেন চরমপন্থি হতে যাবে?“
“হ্যা, বিশ্বাস করি। তারা চরমপন্থি কারণ, তাদের ঘৃণা করা অথবা ভালোবাসার ধরণে প্রচণ্ডতা আছে। তাদের চরিত্রে মধ্যপন্থা বলে কিছু নেই। আমি আমার অভিসন্দর্ভের জন্য আসলেই ভালো এক গিনিপিগ পেয়েছি।“
অরণি এসে তখনো দুজনকে এমন ভঙ্গিতে আলাপচারিতা করতে দেখল যে তার মনে হলো, দুজন ঝগড়া করছে। তিনি অরিত্রকে ধমক দিলেন, “উফ, অরিত্র। তুই না নিজে গোসল করছিস, না অরোরাকে গোসল করতে দিচ্ছিস।“
অরিত্র কিছু বলার আগে অরোরা অরণির হাত ধরে অরিত্রের বিরুদ্ধে নালিশ করল, “মা, ও আমাকে ‘ম্যাম‘ ডেকে ডেকে আপনার সামনে বুড়ি প্রমাণ করার চেষ্টা করলেও ঘটনা হচ্ছে, আমার চেয়ে সে বয়সে ঠিক বারো ঘণ্টার বড়! বাংলাদেশে না এলে আমি এসব টেরই পেতাম না…“
[hfe_template id=’81’]
“তাই? বাহ, কী অদ্ভুত সব ব্যাপার তোমার আর অরিত্রের মাঝে যে লুকানো! খুব ভালো হয়েছে মা… জেনে খুব ভালো লাগছে। এখন তুমি আর সময় নষ্ট করো না। গোসল সেরে খাবার টেবিলে চলে এসো।“
অরণির মুখে এই ‘খুব ভালো হওয়াটা‘ আসলে কী এবং কেন অরোরা তা বুঝতে পারল না। সে অরিত্রের ওপর এক হাত নিয়েছে ভেবে, অরণি চলে যাওয়ামাত্র মিষ্টি করে হাসল। দুঃখী এই মেয়েটার চরিত্রের এই হাসি, এই চপলতা আর উচ্ছলতা, তাদের এই বাড়িতে আসার পর প্রাণ পেয়েছে ভেবে ভালো লাগায় মন ভরে গেল অরিত্রের। তবু এই ঝগড়া নামের ভালো লাগার পর্বকে জিইয়ে রাখতেই সে অরোরাকে বলল, “আমার ঘর, আমার মা –সব দখল করে বেশ পাট নিচ্ছ, না? আমিও বলে রাখছি, এই বারান্দার বগেনভিলার ডাল-পাতা ধরে অন্ধকার রাতে ভূতগুলো এসে যখন উলুধ্বনি দেবে, তখন দেখব এই বয়স-চোরা ছাড়া তোমার কেমন লাগে!“
“বাহ, খুবই ভালো কথা। তোমার ভূতগুলো কি সব নারী? তা তোমার নারী ভূতগুলোকে রাতে আমার কাছে আসতে বলো, প্লিজ। আমি তাদের শেখাব, শরীর ছাড়াই কীভাবে অদৃশ্য হয়ে যেতে হয় এবং বগেনভিলার ডাল-পালার সাহায্য ছাড়াই তোমার ঘরে ঢুকে যেতে হয়। অদৃশ্য হওয়ার শক্তি না থাকলে দৃশ্যমান জগতকে তো দখল করা যায় না। বোকা সব ভূত!“
কথাগুলো বলতে বলতে অরোরা স্যূটকেস থেকে সন্তর্পণে তার পোষাকগুলোর সাথে অন্তর্বাস খুঁজতে গিয়ে থমকে গেল। আরক্তিম লাজুক মুখে বলল, “তুমি এখন দয়া করে প্রস্থান করতে পারো।“
ফুল-স্লিভ শার্টের ওপর ওড়না পরে নিচতলার খাবার টেবিলে এসে বসল অরোরা। মাত্র গোসল সারা অরোরার স্নিগ্ধতায় এই বাগানঘেরা বাড়িটা যেন হাসোজ্জ্বল আর ঝলমলে হয়ে উঠেছে। খাবার টেবিলে থরে সাজানো খাবার দেখে সে ভয়ই পেল। বিমানবন্দরে অরোরা আর অরিত্রকে নিতে যাওয়ার আগে গত সারাটা দিন ধরে অরণি রান্নার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। আজ কয়েকঘণ্টার মধ্যে কয়েক ধরণের ভর্তা, শাক, ডাল, ছোট মাছের চচ্চড়ি, বড় মাছের দো-পেয়াজু, গলদা চিংড়ি, সব ধরণের মাংসের রেসিপি, আচার-চাটনি দিয়ে টেবিল ভরিয়ে ফেলেছেন তিনি। সে আড়চোখে অরিত্রের দিকে তাকিয়ে তাকে ফিসফিস করে বলল, “এত খাবার! তোমার ভুত্নীগুলোকে ডাকলে ভালো হতো।“
“ডোন্ট ফরগেট, দে কাম অ্যাট নাইট।“
চয়ন রাহমান এসে অরিত্রের পাশে বসায় তাদের কথা বন্ধ হলো। তিনি অরোরাকে বললেন, “তুমি ঠিক আছ তো, মা। এই গ্রামে তোমার হয়তো ভালো লাগবে না।“
“কী বলেন, অ্যাঙ্কেল। নিরিবিলি এই বাড়িতে এসে আমার খুব ভালো লাগছে। ভেতরে এত বড় বাগান, বাইরে পুকুর আর দূরে সবুজের কার্পেট দিয়ে ঢাকা প্রান্তর। আমার তো ইচ্ছা করছে, অরিত্র আমাদের কর্মস্থলে গিয়ে আমার কাজগুলোও সামলাক, আর আমি এখানেই আপনাদের কাছে থেকে যাই। আচ্ছা, মাঠে একেবারে সবুজ ঘাসের মতো ওগুলো কী?“
“ধানক্ষেত। কাল বিকেলে তোমাকে মাঠে নিয়ে যাব। তার আগে সকালে পুকুরে বড়শি ফেলে আমরা মাছ ধরব।“
“ওয়াও, ব্যাপারটা দারুণ হবে।“
অরিত্র খুব তৃপ্তি সহকারে খেতে খেতে বলল, “বাবা, অরোরা একটা অভিসন্দর্ভ প্রস্তুত করছে। বিষয় হচ্ছে, ‘দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণ ও প্রকরণ‘। আমার মনে হয়, এই বিষয়টা নিয়ে কাজ করার আগে আমাদের সভ্যতা এবং প্রাচীন সংস্কৃতি নিয়ে তার জানা উচিৎ। সেজন্য আমি ভাবছি, পুরো একটা দিন তাকে নিয়ে আমরা পুণ্ড্র-সভ্যতার এলাকাগুলো দেখাতে নিয়ে যাব।“
“শুধু দেখালে কাজ হবে না। তাকে প্রতিটা স্থানের অতীত ইতিহাসের সঠিক বর্ণনা না দিলে সে উৎসের সন্ধান পাবে না। আমাদের প্রাচীন শিল্পকর্মে যে টেরাকাটার মহত্ত্ব তা আয়ত্ব করতে কত শিল্প-মন লাগে আর সেই শিল্পী সত্তাকে বাস্তবে রূপ দিতে কত শত বছরের সভ্যতার পরম্পরা প্রয়োজন- আমি বিশ্বাস করি অরোরা মা, মৃতপাত্রে তোলা টেরাকাটাগুলো দেখলে তা আন্দাজ করতে পারবে। কিন্তু একদিনে তো পুণ্ড্র সভ্যতার কিছুই জানা হবে না।“
“ঠিক আছে, তাহলে আমরা দুইদিন সময় নেব। তবে তোমাকে আমাদের সাথে থাকতে হবে।“
“হ্যা, আমি অবশ্যই তোমাদের সাথে থাকব।“
খেতে খেতে অরোরা বলল, “খাবারের এই অনন্য স্বাদ রপ্ত করতেও জাতি হিসাবে অনেক সভ্য হতে হয়। রান্নাকে এ দেশের নারীরা শিল্পের পর্যায়ে নিতে পেরেছে হয়তো সেই সভ্যতার আঁচল থেকেই।“
“বাহ, তুমি খুব ভালো বলেছ, মা।“
অরোরা আরো উপলব্ধি করল, অরিত্রের বাবা-মা তাকে একটু পর পর মায়াভরে ‘মা‘ সম্বোধন করছেন –এও তাদের দীর্ঘকাল ধরে সভ্যতার চর্চায় ডিএনএ-তে প্রোথিত সুকুমারবৃত্তির ফল। তাদের এই মায়া করার ধরণ, এই উদার আতিথেয়তা দীর্ঘদিনের সমৃদ্ধি আর শান্তিপ্রিয়তা ছাড়া একটা জাতি অর্জন করতে পারে না। এসবের কিছুই বলা হলো না। তার জিহবায় ঝালের সাথে অদ্ভুত স্বাদের খাবার অরোরাকে কথা বলতেই দিচ্ছে না। তার ধীরে ধীরে খাওয়ার স্বভাব যেন হঠাৎ উধাও হয়েছে। অরণি তার ছেলে আর অরোরা নামের তার মাত্র মেয়ের স্থান দখল করা মেয়েকে তৃপ্তি সহকারে খেতে দেখে তাদের চেয়ে বেশি তৃপ্ত হচ্ছিলেন। অরোরা বার বার অরণিকে তার রান্নার প্রভূত প্রসংশা করল, “মা, আপনার হাতের রান্না খেয়ে আমার মনে হচ্ছে, ইউরোপিয়ানরা এখনো সভ্য হয়নি। তাদের রান্না এই রান্নার পাশে ‘জঘন্য‘ উপাধি পাওয়ারও যোগ্য নয়।“
অরণি হাসলেন। তিনি অরোরা আর অরিত্রের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তাদের খাবারের তদারকি করছিলেন। এতক্ষণ পর অরোরার খেয়াল হলো যে, অরণি তাদের সাথে খাচ্ছেন না। সে তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে একটা প্লেট এনে তাতে নিজে খাবার উঠাতে গেল। অরণি জিজ্ঞাসা করলেন, “কী করছ, মা?“
“সরি মা, আপনাকে ছাড়াই আমি খেতে শুরু করেছি।“
“বোকা মেয়ে, এতদিন পর অরিত্র, আর জীবনে প্রথম তোমাকে কাছে পেয়েছি। আমি তোমাদের নিজ হাতে না খাওয়ালে একদম শান্তি পাব না, মা। তোমাকে সব খাবারগুলো একটু একটু করে খেতে হবে…“
[hfe_template id=’81’]
অরোরা অবাক হলো। দুজন মেয়ে খাবার নিয়ে রান্নাঘরে যাতায়াত করছে। তবু তিনি খাবেন না! সন্তানের জন্য, প্রিয় মানুষের জন্য কী আশ্চর্যজনক উদারতায় পরিপূর্ণ বাঙালি মায়ের এই অনন্যতা। সে বলল, “আপনি আমাদের সাথে না খেলে আমার অস্বস্তি লাগছে।“
“আমি এখনো গোসল সারি নি, মা। তোমাদের খাইয়ে তারপর গোসল করে খাব। তুমি বসো তো…“
পুরো সময়টুকু অরণি শুধু অরোরার পাশে দাঁড়িয়ে তার খাবারের দিকেই খেয়াল রাখলেন না, মাঝে মাঝে তার মাথার বিস্রস্ত চুলগুলো গুছিয়ে দিলেন। স্নেহভরে তিনি তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
কৈশোরে বাবা-মাকে হারিয়েছে জানার পর অরোরার জন্য কী এক প্রীতি তার জন্মেছে যে, তিনি তার সব মমতা দিয়ে অরোরাকে তার হৃদয়-ক্ষত সারাতে নিজের অজান্তেই এই প্রকাশ্য পক্ষপাত করছেন। অরোরার মনে হলো, এই জীবন কোনো বাঁধাধরা একটা ছকের নিত্য-নৈমিত্তিকতা নয়। এই জীবন বড় মায়াময়। এখানে এসে অরোরার মনে হচ্ছে, এই জীবনটা মায়ার বাঁধন। কিন্তু এমন মায়ার বাঁধনে থাকা মানুষগুলো কীভাবে মরতে পারে? এই মায়ালোক ছেড়ে চিরবিদায় নিতে তাদের কি খুব কষ্ট হয়? নাকি এক জীবনে এই স্নেহ-ভালোবাসার অপার মায়ায় সিক্ত হয়ে এক সার্থক জীবন ছেড়ে, এই জগতকে বিদায় জানানো এই অঞ্চলের মানুষের জন্য সহজ হয়? এই অঞ্চলের সব পরিবার কি এমন মায়ার বন্ধনে জড়াজড়ি করে থাকেন?
খাবার শেষ করে ঘরে এসে অরোরা বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। অরোরার ঠিক মনে পড়ে না, কবে সে এমন তৃপ্তির সাথে এত খাবার খেয়েছিল যে, খাবার পর তার হাঁসফাস লাগছিল। বিকেলের এক ফালি রোদ ঘরের মেঝেতে ঢেউয়ের মতো খেলা করছে। বিছানায় শুয়ে সে নির্মল নীলাকাশের পানে তাকাল। অনিন্দ্য সবুজ এক ভূমিকে পাহারারত আকাশটা কি অরিত্র? সে নিজে কি এই অবারিত সবুজ? এই ঘরে, এই বিছানায় শুয়ে কেমন এক স্বপ্নঘোর তার মাঝে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। না, তা হয় না; অরোরার দুঃসহ অতীত এসে তার সে ভাবনায় ছেদ ফেলল। অরণির মতো নারীরা তার ছেলেকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেন। নিজের বাজে আর কলংকময় অতীত নিয়ে তার সেই স্বপ্নকে সে বিভ্রান্ত করতে চায় না। অরিত্রের যে স্ত্রী হবে এই বিছানা তার জন্যই নির্ধারিত থাকুক। সে তো তার স্বপ্নকে সমাধিস্ত করে দিয়েছে, আফগানিস্তানের গুমোট পাহাড়ের পাদদেশে লুকানো আরো গুমোট এবং নিসঃঙ্গ নিষ্ঠুরতার কাছে। এমন বিস্তৃত জনপদ আর সবুজ ভূমিতে জন্মানো কোনো মানসদেবীই অরিত্রের স্ত্রী হোক –মনে মনে সে এই কামনা করল।
অরোরার ভাবনা এখন নদীর মতোই স্রোতস্বিনী। তার ঘুম ঘুম পাচ্ছে। কিন্তু, সে ভাবল; এখন ঘুমালে, নিশ্চিত নিজেকে আজই ভারি ভারি লাগবে। ওজনটাও একটু বাড়বে। বাড়ুক, কার জন্য তোমাকে তোমার এই তরতরে আর ধারালো শরীরটা ধরে রাখতে হবে? মাতোমা তো, মোটাসোটা নারীকেই পছন্দ করবে।
এইসব ভাবতে ভাবতে অরোরা কখন অতল ঘুমে তলিয়ে গেল। আর খাবার শেষ করে অরণি অরোরার ঘরে এসে দেখল, অরোরার বুকের ওপর অরিত্রের ছোটবেলার এক ইংরেজি ছোটগল্পের বই আলতো পড়ে আছে। এই দৃশ্য দেখে তার বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠল। ছোট্ট অরিত্র ঠিক এভাবেই ঘুমাত আর তার বুকের ওপর এভাবেই আলতো পড়ে থাকত কোনো গল্পের বই। অরোরাকে তার এই মুহূর্তে নিজেরই এক সন্তানের প্রতিবিম্ব বলে মনে হলো। একটু একটু শীত পড়েছে। কার্তিকের শীত। তিনি আলমিরা থেকে একটা কাথা বের করে এনে অরোরার পাশে এসে বসলেন। অরিত্রের কৈশোরের সাথে তার যৌবন বয়সের এক-ই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো – অরোরার কপালে আলতো চুমু দিয়ে বইটা সরিয়ে, তার শরীর কাথা দিয়ে মুড়িয়ে দিলেন এবং কী মনে করে একটা বালিশ নিয়ে অরোরার পাশে শুয়ে পড়লেন।
শুয়ে শুয়ে তিনি মুগ্ধ হয়ে অরোরাকে দেখতেই থাকলেন। সংগ্রাম করা মানুষদের বিশেষ মূল্য আছে অরণির কাছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে তার বাবাও শহীদ হয়েছেন। সেই যুদ্ধে মাকেও হারিয়েছেন তিনি। মা-বাবার মৃত্যুর পর কী দুর্বিসহ জীবন কাটাতে হয়েছে অরণিকে তার বেদনা তিনি ভালো করেই জানেন। তিনি অরোরার দিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে, তার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে মনে মনে প্রশ্ন করে চললেন, ‘বাবা-মা মারা যাবার পর তুমি কীভাবে এত ভালো পড়াশোনা চালিয়ে গেলে, মা? কীভাবে তোমাদের দুজনের জন্মক্ষণে মাত্র বারো ঘণ্টার ব্যবধান হলো? কীভাবে তোমাদের দুজনের নামের অনুপ্রাসে একই সুর লুকিয়ে গেল! তবু, ভালো হয়েছে। আমার অরিত্র তো বারো ঘণ্টার বড়। তাকে আমি সারাজীবন তোমার পাশে দেখতে চাই।‘
যে প্রাণগুলোর মাঝে রক্তের সঞ্চালন আছে তারা হয়তো আবেশের সময় একই ধরণের রক্তের উষ্ণতা খুঁজে ফেরে। অরণির উষ্ণ স্নেহ অরোরার ঘুমের ঘোরকে গভীর করে দিলেও এই ঘোরের মাঝে তার শরীর সেই উষ্ণতা শনাক্ত করতে ভুল করল না। সে ঘুমের মধ্যেই অরণির বুকের মাঝে মুখ লুকাল।
ঘুম ভাঙার পর অরোরা যার বুকের মাঝে অমন আদুরে ভঙ্গিতে শুয়ে আছে তাকে ঠিক চিনতে পারল না। সে এখন কোথায়, তার পাশে কে শুয়ে আছে চোখ বন্ধ করে এসব ভেবে তার কোনো কিনারা পেল না সে। তার জীবন থেকে গত বিশ বছর সময় হারিয়ে গেছে। বিশ বছর আগের আট বছর বয়সী শিশু অরোরা মনে হচ্ছে নিজেকে। আট বছর পর আর কোনো স্মৃতি স্মরণ করতে পারছে না সে। কিন্তু তার শুধু স্পষ্ট মনে পড়ছে, তার মা-বাবাকে হারানোর সেই দিন। তাহলে সে এ কোন মমতাময়ীর বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে শুয়ে আছে? এ কোন কক্ষ? গুলিতে বাবার মগজ ছিটকে যাওয়ার দৃশ্যটা মনে পড়তেই অরোরার কানে দূর থেকে ভেসে এল মরিয়মের চিকন কণ্ঠস্বর। পাহাড়ের কোল বেয়ে সেই বেদনার্ত কণ্ঠস্বর ছড়িয়ে পড়ছে উঁচু উঁচু পাহাড় চূড়ায়। উঁচু উঁচু চূড়া পেরিয়ে সেই স্বর বাতাসের কম্পাঙ্ক হয়ে ক্রমশ ছড়িয়ে যাচ্ছে আকাশের নীলে। নীলাকাশের প্রান্ত হতে তারা সবুজ এক পটভূমির দেশে ভেসে আসছে যে ভূমির খাদ্যের স্বাদ অতুলনীয়। বাতাসের কম্পাঙ্ক ধরে ধরে সেই স্বরই হঠাৎ তার গত বিশ বছরের স্মৃতিকে জীবন্ত করার আগে তাকে মনে করিয়ে দিল, সে এখন ছুটিতে, অরিত্রের সাথে বাংলাদেশে। সে অরণি নামের এক নারীর মায়া-অরণ্যের সান্নিধ্যে স্মৃতি-বিস্মৃতির অতলে।
অরোরার মাঝে মাঝে এমন হয়। সে ঘুম থেকে উঠে বুঝতে পারে না, এটা সকাল না বিকেল অথবা রাত? ঘুম থেকে উঠে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অরোরা মাঝে মাঝে বুঝতে পারে না, এখন তার কি করতে হবে। কিন্তু আজকের মতো কখনোই পুরো স্মৃতিহীনতায় সে আক্রান্ত হয় নি। তাহলে কি স্বপ্নের কাছে, ভালোবাসার কাছে এলেই এমনটা হয় যে, তার তীব্র প্রত্যাশা স্বপ্নঘোরে তার সব স্মৃতিগুলোকে কোনো এক শূণ্যগর্ভে মিলিয়ে দেয়? ঘুমানোর আগে সে তীব্রভাবে আরো ষোলো বছর আগে ফিরে যেতে চাইছিল। তাহলে বাবার কথায় মাকে সে প্রভাবিত করতে দিত না। আর সে নিশ্চিত, বাবা যতই হৈ-চৈ করুক তার মা আফগানিস্তানে যেতে সম্মত না হলেই তিনিও যেতেন না। তার বাবা পাগলের মতো তার মাকে ভালোবাসতেন। আর বাবার একটা ভুল সিদ্ধান্তই কি না, তাকে সারাজীবনের জন্য কাউকে ভালোবাসার অধিকারটুকু কেড়ে নিয়েছে। তার ক্ষত হৃদয় নিয়ে সাহস করে অরণিকে খুব মন চাইলেও বলতে পারছে না, ‘মা, আমি আর কোথাও ফিরে যেতে চাই না। আমি অরিত্রকে ভালোবেসে ফেলেছি!‘
[hfe_template id=’81’]
অরোরা জেগেও কিছুক্ষণ চুপ করে অরণির বুকে মাথা রেখে ঝিম মেরে থাকল। কিন্তু সে নিজেকে লুকাতে পারল না। আশ্চর্য, অরণি কীভাবে তার মনের কথা টের পায়? অরণি তার মাথার চুলে বিনুনি কাটতে কাটতে বললেন, “বাবা-মায়ের জন্য জন্য কষ্ট হচ্ছে, মা। আমি তো বলেছি, আজ থেকে তুমি আমার মেয়ে। স্রষ্টা নিশ্চয়ই তোমার মার আত্মার কাছে এই বার্তা পৌঁছে দেবেন যে, তোমার জন্য তার হৃদয়ে যত ভালোবাসা ধারণ করা প্রয়োজন তার সবটুকু নিয়ে আমি এতদিন বসে ছিলাম বলে, আমার কোনো মেয়ে হয় নি!“ অরোরা এবার শক্ত করে অরণিকে জড়িয়ে ধরল। বাঁধভাঙা অশ্রুধারা লুকাতে তার শরীরের ভাঁজে ভাঁজের কাঁপনটুকু ছড়িয়ে পড়ল তার সমগ্র শরীরে। কান্না শব্দের সাথে বহুদিন আগে পরিচয় চুকিয়ে ফেলা অরোরা জানে না, অনেক অনেক দিন পর তার এই কান্না, এই স্নেহের বন্ধন তাকে তার কিশোরী অনুভবের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রাথমিক পর্যায় হয়েও তাই-ই হয়তো তার চূড়ান্ত পর্ব। সে তার জীবন থেকে কিশোরী অরোরার পর্বকে, তার জন্মের পর থেকে ষোলো বছর বয়স পর্যন্ত সময়কে বাদ দিয়ে ভাবতে ভালোবাসত। কিন্তু অরিত্রের বাসা থেকে ফিরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত অরিত্রের পরিবারের অপার ভালোবাসা, প্রতিদিনের আনন্দময় সময় কাটানো, এই দেশটার নৈসর্গিকতায় লুকানো কী এক অসাধারণ ক্ষমতা যা প্রকৃতিকে ভালোবাসতে শেখায় – এই সবকিছুর সংস্পর্শ অরোরাকে তার কিশোরী অনুভবের কাছে, তার জীবনের স্বপ্ন দেখার উন্মেষলগ্নের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছে। সে নিজের অজান্তে কেন যেন আবার উদাসীন হতে,কারো জন্য মরে যেতে, গান শুনতে ভালো লাগায় আপ্লুত হতে শিখছে।

কাজী রাফি
কথাশিল্পী
জন্ম – ২২ নভেম্বর, ১৯৭৫, বগুড়ায়।
মানুষ ও তাদের যাপিত জীবন এবং প্রকৃতি দেখার প্রয়োজনে ঘুরেছেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। চাকরির প্রয়োজনে আফ্রিকায় বাস করেছেন দুই বছরের অধিক সময় এবং আফ্রিকার প্রকৃতি-সংস্কৃতি, তাদের প্রান্তিক মানুষের যাপিত জীবনকে দেখেছেন খুবই কাছ থেকে। আফ্রিকার পটভূমিতে লেখা ‘ধূসর স্বপ্নের সাসান্দ্রা’ তাঁর প্রথম উপন্যাস। এই উপন্যাসেই কালি ও কলম পুরস্কার লাভ করেছেন তিনি; তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ, ১১ টি উপন্যাস এবং ৬ টি ছোট গল্পগ্রন্থ সবই পাঠক প্রিয়তায় প্রথম সারিতে। তাঁর লেখা ‘ত্রিমোহিনী’ উপন্যাসকে মহাকাব্যিক অ্যাখ্যা দিয়েছেন কিংবদন্তী ছোট গল্পকার হাসান আজিজুল হক।
পুরস্কার, এইচএসবিসি কালি ও কলম পুরস্কার -২০১০, এমএস ক্রিয়েশন সম্মাননা -২০১০, নির্ণয় স্বর্ণপদক-২০১৩, এসএম রাহী পদক ২০১৯
