১
হুমায়ুন আজাদ (১৯৪৭-২০০৪) ঢাকার কামারগাঁয়ে মাতুলালয়ে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। বেড়ে উঠেছিলেন মুন্সিগঞ্জের রাঢ়িখালে। শিক্ষা সমাপান্তে শিক্ষকতাকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুসময় অধ্যাপনা করলেও শেষ পর্যন্ত থিতু হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। মৃত্যুর পূর্বপর্যন্ত তিনি এখানেই ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় ও রাষ্ট্রীয় নানা আচার-অনুষ্ঠান তিনি প্রায়ই পরিত্যাগ করতেন। এসব অনুষ্ঠানের পরিবর্তে তরুণদের সঙ্গে গালগল্প করে সময় কাটাতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। তথাকথিত বিত্তবান বা অভিজাতদের এড়িয়ে চললেও অসহায়ের পাশে ঠিকই দাঁড়াতেন। সাধ্যমত আর্থিক সহায়তাও করতেন। আর দশজনের মতো হুমায়ুন আজাদ অনেকটা সখ করেই লেখালেখির জগতে এসেছিলেন। পিতৃপ্রদত্ত নাম হুমায়ুন কবীর থেকে হয়েছিলেন হুমায়ুন আজাদ। ছাপার অক্ষরে নিজের নাম দেখার সাধ কার না থাকে। ‘কচি কাচার আসর’এ ‘ঘড়ি চলে টিক টিক’ শিরোনামে হুমায়ুন আজাদের একটি নিবন্ধ ছাপা হয়েছিল। সময়ের পরিক্রমায় এই সখটাই একসময়ে দায়িত্বে রূপান্তরিত হয়। হুমায়ুন আজাদ উপলব্ধি করেছিলেন যে, কেবল কচিকাচার আসরে লেখার জন্য তার জন্ম হয়নি। তার বেশকিছু দায়িত্ব-কর্তব্য রয়েছে। অলৌকিক স্টিমার (১৯৭৩) রচনার মধ্যদিয়ে তিনি বড়দের জগতে পদার্পণ করেছিলেন। তাই বলে তিনি কচিকাচা অথবা কিশোর-কিশোরীকে ছেড়ে আসেননি কোনোদিন। বরং জীবনের শেষপ্রান্তে এসে এদেরকে গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। লাল নীল দীপাবলী (১৯৭৬), ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না (১৯৮৫), কতনদী সরোবর বা বাঙলা ভাষার জীবনী (১৯৮৭), আব্বুকে মনে পড়ে (১৯৮৯), বুকপকেটে জোনাকিপোকাসহ (১৯৯৩) দারুণ কিছু কিশোর সাহিত্য রচনা করে গেছেন তিনি। কিশোরদের জন্য রচিত হলেও এসব সাহিত্যকর্ম বড়দেরও কম কাজে লাগে না।
২
প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ কবিতা হলেও কবিতাতেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি তিনি। বরং উপন্যাস, প্রবন্ধনিবন্ধ, সমালোচনা সাহিত্য, ভাষাবিজ্ঞান, কিশোর সাহিত্যসহ বহুমাত্রিকভাবে সাহিত্যের নানাবিধ শাখাপ্রশাখায় নিজেকে মেলে ধরেছিলেন। এই মেলে ধরবার সাহস ও শিল্পসামর্থ্য তাঁর ভেতরে বিদ্যমান ছিল। প্রচলিত গতানুগতিক শিল্পপথে তাঁর আস্থা ছিল না। তিনি নিজেই নিজের পথটি নির্মাণ করে নিয়েছিলেন। এবং সেই পথেই শেষপর্যন্ত নিজেকে ধরে রাখতে পেরেছিলেন। জাগতিক বিষয়আশয় অথবা সহায়সম্পদের দিকে তাঁর মনোযোগ খুব একটা ছিল না। জ্ঞান এবং গ্রন্থকেই তিনি অসীম সম্পদ বিবেচনা করতেন। নতুন নতুন জ্ঞান আহরণে সর্বদা ব্যতিব্যস্ত থাকতেন। এডিনবরায় (স্টকল্যান্ড) উচ্চশিক্ষা (পিএইচডি গবেষণা) শেষে স্বদেশে ফেরার পথে বিপুল সংখ্যক বিদেশি গ্রন্থ সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন।
কি কবিতা কি উপন্যাস, বিষয় বিবেচনার চেয়ে শৈলীনির্মাণেই তিনি অধিকতর গুরুত্ব দিতেন। এই উপস্থাপনাভঙির কারণেই তাঁর নামের আগে ‘প্রথাবিরোধী’ শব্দযুগল জুড়ে দিতে দেখা যায়। গাড়িবাড়ি, বিত্তবৈভব, লালনীল প্রেয়সীর চেয়ে পারিপার্শ্বিক পরিবেশ-প্রকৃতি, শস্যশ্যামলে ভরা নৈসর্গিক সুখসৌন্দর্য কবির কাছে বিপুলভাবে ধরা দিতো। তাঁকে লিখতে দেখি¾‘হে পথ হে দেশ একবার ডাকতেই / বুকের ভেতরে এমন নিবিড় করে টেনে নিলে।’ তাই বলে তার কবিতায় যে নারী অনুপস্থিত ছিল তাও নয়। ‘শিশু ও যুবতী’ কবিতায় তাকে লিখতে দেখি¾‘শিশু আর যুবতীর মধ্যে আশ্চর্য মিল রয়েছে / শিশু আর যুবতী দেখলেই দু-হাতে বুকের গভীরে টেনে / চুমোতে চুমোতে চুমোতে চুমোতে আদরে আদরে / আদরে আদরে ভরিয়ে দিতে ইচ্ছে হয়।’
৩
মুক্তিযুদ্ধকালে (১৯৭১) পাক হানাদার বাহিনির নির্মম আচরণকে তিনি প্রাগৈতিহাসিক হিংস্র জন্তুর সাথে তুলনা করেছেন। সে জন্তুও বন্যার জলের ন্যায় ভেসে যায়¾‘ভেসে গেলো জন্তু, জন্তুদের সকল আবাস।’ মানুষ আবার ঘরে ফিরতে থাকে। নতুন করে ঘর নির্মাণ করতে থাকে। কলসি কাঁধে নারী নির্ভয়ে জলে যায়। হুমায়ুন আজাদ লেখেন¾‘১৯৭২ বাংলাদেশে প্রেম আর গৃহের বৎসর।’ কেবল কবিতা লেখাই নয়, আধুনিক বাঙলা কবিতা (১৯৯৪) শিরোনামে একটি কবিতাগ্রন্থও সংকলন করেছিলেন। সংকলনটি কবিতাপাড়ায় কম ঝড় তোলেনি। সৈয়দ আলী আহসান, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, আল মাহমুদ, ফজল সাহাবুদ্দীন, আবদুল মান্নান সৈয়দের কবিতাকে তিনি সংকলনে স্থান দেননি। তুলোধুনা করেছেন শামসুর রাহমানকে শামসুর রাহমান / নিঃসঙ্গ শেরপা (১৯৯৩) লিখে। নজরুলকেও ছাড়েননি। অপরদিকে তিরিশি কবিকুলের প্রতি আবেগে গদগদ বিশেষত সুধীন্দ্রনাথ দত্তের (১৯০১-১৯৬০) কবিতার শৈলী ও স্বরূপে তিনি দারুণ খুশি। তিরিশি এই কবির নামে উৎসর্গ করেছিলেন যতোই গভীরে যাই মধু যতোই ওপরে যাই নীল (১৯৮৭)। সুধীনকে পছন্দ করার কারণ, সুধীন ঈশ্বর নিহত হওয়ার খবরটি কবিতায় রাষ্ট্র করে দিয়েছিলেন। নানাভাবে তিনি আলোচিত-সমালোচিত। অধ্যাপক-ডক্টর-চেয়ারম্যানÑএসব পদপদবির চেয়ে কবি হওয়ার প্রতি তাঁর তীব্র বাসনা ছিল। লিখেছেনও বেশকিছু দারুণ কবিতা। কিন্তু তার নামের পূর্বে ‘কবি’ শব্দের প্রয়োগ খুব একটা দেখা যায় না। এটি ছিল নিদারুণ নিয়তি।
৪
মুক্তিযুদ্ধ-উত্তরকালে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে বিপুল ব্যবধানে হুমায়ুন আজাদ নিদারুণ ব্যথিত হয়েছিলেন। হত্যা, ধর্ষণ, খুন, লুণ্ঠন; অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা, রাজনীতির নীতিহীনতা, ধর্মীয় ভণ্ডামি, নানা পাপ ও পাপাচারে মধ্যযুগীয় বর্বরতায় নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম। জাতির পিতা হত্যা (১৯৭৫), সামরিক শাসনের সূচনা, প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির ক্ষমতায় আরোহণ─এসময়পর্বে তাঁকে লিখতে দেখি─সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে (১৯৮৫)। প্রগতিশীল শক্তি প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়। কবিমনে হতাশা জেগে ওঠে। মনে হয়, পুরো দেশটা পঙ্গু হয়ে গেছে। ক্ষুব্ধ কবিকে লিখতে দেখি¾‘এক দশকেই মুক্তিযোদ্ধা / বাঙালি / আর বাংলাদেশ / মাথা থেকে হৃদপিণ্ড থেকে পা পর্যন্ত পঙ্গু হয়ে গেছে।’ এসময়পর্বে হয়তোবা কবিতায় ভাবপ্রকাশে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছিলেন না তিনি। অনুভব করছিলেন গদ্যসাহিত্যের। এসময়ই আমরা হুমায়ুন আজাদকে প্রবন্ধনিবন্ধ ও উপন্যাস-আখ্যানে প্রবেশ করতে দেখি। পত্রপত্রিকায় কলাম লেখার আরম্ভ এখান থেকেই।
৫
সাহিত্যের অপরাপর শাখাপ্রশাখার চেয়ে প্রবন্ধসাহিত্য গভীরভাবে টানে। সর্গীয়সুখ অনুভব করি। বারবার পড়তে চাই হুমায়ুন আজাদের প্রবন্ধ। প্রবন্ধসাহিত্যেই তাকে দারুণভাবে জ্বলে উঠতে দেখি। যৌক্তিক বিচারবিবেচনায় যা সত্য বলে বিবেচিত হতো তা-ই বলে দিতেন। ইনিয়েবিনিয়ে বলা তাঁর স্বভাবে ছিল না। তিনি যা বলতেন, সরাসরি, স্টেটকাট। রাজনীতি অথবা সমাজসেবকের প্রতি তাঁর আস্থা ছিল না; আস্থা ছিল না মধ্যবিত্ত অথবা উচ্চমধ্যবিত্ত তথাকথিত শিক্ষিত সমাজের প্রতি। তার বিবেচনায়¾‘চিরকালই সমাজ শাসন ক’রে আসছে তৃতীয় মানের প্রায় বর্বর, সংবেদনাশূন্য, স্থুল মানুষেরা।’ তথাকথিত শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী সমাজ জাগতিক লোভলালসার মোহে, পদপদবির আশায়, নিজের বিবেক, বোধবুদ্ধি, স্বভাবচরিত্র বিসর্জন দিয়ে দলদাস হয়ে যায়। দলের মুখের দিকে তাকিয়ে স্লোগান দেয়। দলের বাঁধাবুলি আবৃত্তি করে। এই প্রকৃতির বুদ্ধিজীবীকে তিনি ‘ক্যাঙ্গারু’ ও ‘বাদুর’ শ্রেণির জীবের সঙ্গে তুলনা করেছেন। স্বার্থপর-সুবিধাবাদী প্রতারকদের প্রতারণা, অসততা, অসাধুতা, ভণ্ডামি তিনি সইতে পারতেন না। তাঁর কাছে এসব মানুষের আবেদন হারিয়ে যায়। কখনোসখনো বধির হতে ইচ্ছে করতো। ক্ষমতা তাঁর কাছে অসুন্দর ও অশ্লীল মনে হতো। ক্ষমতাবানের কাছ থেকে তিনি দূরে সরে থাকতেন। ক্ষমতাবানের মুখের চেয়ে চড়ুই পাখির চেহারা তার কাছে সুখকর মনে হতো। স্বস্তির জন্য প্রায়ই তিনি প্রকৃতি ও পাখির কাছে ফিরে যেতেন। তাকে লিখতে দেখি¾‘আমি আমার সুখগুলো প্রকৃতি ও প্রতিবেশ থেকে পুরোপুরি ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগ করি।’
৬
হুমায়ুন আজাদের চোখে শয়তান আর ভাঁড় ধরা পরতো। এসব শয়তান আর ভাঁড়দের কথাই বলতে চেয়েছেন নানা প্রবন্ধেনিবন্ধে। তিনি চেয়েছিলেন শয়তানমুক্ত স্বদেশ গড়তে; উত্তর প্রজন্মের জন্যে একটি নিরাপদ বাসভূমি নির্মাণ করতে। কিন্তু শয়তানেরা সেই বাসভূমি নরকে পরিণত করে। মধ্যযুগীয় বর্বরতা নিয়ে আসে। তাঁকে লিখতে দেখি¾ ‘চারপাশে দেখতে শুরু করলাম ছাইপাশ; তিন দশক ধ’রে যা দেখে দেখে চোখ দুটি একেবারে প’চে গেছে। এখন আর কিছুই দেখতে ইচ্ছে করে না। তাকালেই দেখি শয়তান আর ভাঁড়।’ এসব ‘শয়তান আর ভাঁড়’ কোনো একটি একক রাজনৈতিক দলে নয়; শিক্ষক, সাংবাদিক, আমলা, বুদ্ধিজীবী সর্বত্রই দৃশ্যমান। আমলা প্রসঙ্গে তাকে লিখতে দেখি¾‘আমলারা দুটি ব্যাপার শিখেছে─ওপরঅলাকে সেজদা করতে আর নিচঅলাকে লাথি দিতে; এবং ঘুষ খেতে।’ আমরা কি এই বাঙলাদেশ চেয়েছিলাম (২০০৩) উৎসর্গপত্রে তাঁকে লিখতে দেখি¾‘তার ধানক্ষেত এখনো সবুজ, নারীরা এখনো রমণীয়, গাভীরা এখনো দুগ্ধবতী কিন্তু প্রিয়তমা, বাঙলাদেশের কথা তুমি কখনো আমার কাছে জানতে চেয়ো না; আমি তা মুহূর্তও সহ্য করতে পারি না।’ সুবিধাবাদী, স্বার্থপর, ভণ্ড, প্রতারকদের তিনি একেবারেই সইতে পারতেন না। এদের কথাই বলতে চেয়েছেন আমরা কি এই বাঙলাদেশ চেয়েছিলাম গ্রন্থে। কাউকে ছাড় দেননি। একেএকে নাম ধরেধরে উল্লেখ করেছেন।
৭ হুমায়ুন আজাদের সাহস ও সততা দেখে মুগ্ধ হই। নির্ভয়ে-নিশঙ্কায় তিনি সত্যবচন উচ্চারণ করে যেতে পারতেন। এই সাহস ও সততার পেছনে ছিল নির্লোভ মনমানসিকতা। কোনোকিছু প্রত্যাশা করতেন না তিনি। যা আছে তাতেই খুশি থাকতে পারতেন। কেবল চাইতেন লেখা ও বলার স্বাধীনতা, শিল্পের স্বাধীনতা, সত্যসন্ধানের স্বাধীনতা। সাহিত্য সম্মেলন উপলক্ষ্যে জার্মান দেশে গিয়েছিলেন। সেখানেই হোটেলে নিজকক্ষে ১২ আগস্ট তার মৃত্যু ঘটে। সেই রহস্য আজো উদঘাটিত হয়নি। এমনকি বাংলা একাডেমি অঙ্গনের ঐ হামলাও। প্রয়াণদিবসে তাঁর প্রতি অনন্ত ভালোবাসা।

মোহাম্মদ আব্দুর রউফ
শিক্ষক, গবেষক-সাহিত্য সমালোচক
আহমদ ছফার সাহিত্যকর্ম বিষয়ক অভিসন্দর্ভ রচনায় রত। প্রকাশিত গ্রন্থ – মজিদ মাহমুদ কবি ও কবিতা, বাংলা প্রবন্ধশৈলী ও সমালোচনা, আহমদ ছফা। জন্ম ১ মার্চ ১৯৮২। পড়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে।