আমরা তখন থাকি খুলনায়। আমার বাবা ছিলেন সরকারী চাকুরে। চাকুরীর সুবাদে সরকারী দোতলা ভবনেই ছিল আমাদের বসবাস। নীচতলা বাবার কর্মস্থল। ছিল বর্তমান পি টি আই সড়কে। মুক্তিযুদ্ধে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পরিত্যক্ত বাড়ি-ঘর, যেগুলো পরবর্তীতে সরকারী মালিকানাধীন হয়ে যায়, তেমন একটি বাড়ি। কম পক্ষে বিঘা খানেক জমির উপর মূল বাড়িটি। মূল রাস্তা থেকে কাটা তার দিয়ে পুরো বাড়িটির সীমানা নির্ধারণ করা।
দোতলা ভবনটি বাদে বাকি জমির উপর বাড়ির পেছন দিকে একটি দীঘি বা পুকুর, পাড় ঘেষে বিভিন্ন ধরনের ফলের গাছ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি জাম গাছ। এই পুকুর পাড়ের পেছন দিক দিয়ে শুরু হয়েছে আরেকটি বাড়ির সীমানা।
মূলপাকা রাস্তার সাথে ভেতর বাড়ি ঢোকার পথ। ঢোকার পথের দুপাশে নানা রকম বাহারের ফুল বাগান। ফুল বাগান ধরে সামনে এগোলে বিশাল উঠোন। দোতলা ভবনটির নীচতলার টানা বারান্দার মধ্য ভাগের একটি অংশ হতে ৮/১০ধাপের সিঁড়ি উঠোনে নেমে গেছে। উঠোন ও বাগানের কাছ বরাবর ঢোকার পথের ডানপাশে লাল রঙের একটি টয়োটা গাড়ি রাখার জায়গা। নীচতলার বাম পাশ ধরে ছিল রান্না-ঘর, খাওয়া-ঘর, লাকড়ি-ঘর, কুয়োতলা, চাপ-কল, গোসলখানা ও পায়খানার বন্দোবস্ত।
আমার খুব করে মনে আছে পায়খানা স্থানটি একেবারে আলাদা করে মূল ভুমি থেকে ৮/১০ ধাপ সিঁড়ি সুউচ্চে বানানো। এ-সকল বন্দোবস্তের সাথে মূল ভবনের যোগাযোগের সংযোগস্থল হলো টানা বারান্দার প্রথম এক অংশ। নীচতলার আরেক পাশে ৩/৪টা রুম নিয়ে বাবার অফিস। সেখানে ঢোকার পথ মূল পথটা ছাড়াও টানা বারান্দায় লাগোয়া একটা দরোজা দিয়েও ঢোকা যেতো। অফিস ও আবাস দুটোরই খাবার পানি থেকে শুরু করে অন্যান্য প্রয়োজনীয় আনুষঙ্গিক সব কিছুর বন্দোবস্ত একত্রিত।
যাইহোক, এই বাড়িটি ঘিরেই আমার শৈশবের তিনটি বছর জড়িয়ে; আমার স্মৃতির প্রথম পাঠ। এরও আগের স্মৃতি আমার মস্তিষ্ক আমাকে মনে রাখতে দেয় নি। সম্ভবত আমার দুই থেকে পাঁচ বছর বয়স অবধি আমি এখানেই বসবাস করেছি।
এ সময়ের স্মৃতির প্রথমেই আমার বাবা সমুজ্জ্বল। মনে আছে বাবা খুব সকালেই নির্ধারিত খাকি পোশাকে কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য তৈরী হতেন। বুকে লাগাতেন পদ সম্বলিত পেতলের ব্যাজ। নাস্তা সেরে নিতেন নীচে গিয়ে। আমাদের খুব প্রচলিত একটি নাস্তা: দুধের রুটি ভিজিয়ে খাওয়া। আবার মাঝেমধ্যে রুটিতে খাঁটি ঘি আর চিনি মিশিয়ে গোল করে পেঁচিয়ে –রোল বানিয়ে খাওয়া। কিযে তার স্বাদ আজও মুখে লেগে আছে! এছাড়া পরোটা – আলুভাজি, পরোটা- ডিম ইত্যাদিও হতো মাঝে সাঝে। খাওয়া দাওয়ায় ব্যাপারে বাসায় একটা উৎসব উৎসব ভাব বিরাজ করত সব সময়। সাদা পুডিং বানানো হতো প্রায়ই।
একেবারেই কিছু করতে না পেরে সিগারেটের পড়ে থাকা পেছনের অংশটুকু কুঁড়িয়ে নিয়ে ঠোটে চেপে ধরে তাতে টান দিতাম। এবং তার ফলে আমি কাশতে কাশতে অস্থির হয়ে যেতাম। আর আমার বড় ভাইয়ের সেই কী অট্রহাসি। সে আমার হাত থেকে নিয়ে বলতো, ‘দেখ কিভাবে টানতে হয়।‘ সে তখন পড়ে চতুর্থ শ্রেনিতে । আমার তখনও হাতেখড়ি হয়নি।
বাবাকে আমরা ডাকতাম ‘আব্বু।‘ আব্বুর অফিসে সম্ভবত মাসিক মিটিং এর দিন উর্ধ্বতনসহ আরও অনেক স্টাফরা আসতেন। সেদিন বাসায় একটা সাজ সাজ রব পড়ে যেতো। কারণ সেদিন দূরদূরান্ত থেকে যারা মিটিংয়ে আসতেন তাদের দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা হতো এখানেই । রান্না করতেন বাবুর্চি । আম্মা তা‘ পরিচালনা করলেও মূল তদারকি করতেন আব্বু নিজেই। আব্বুর সেই জাদরেলী ভাব নিয়ে রান্না তদারকির বিষয়টা ছোটবেলা থেকেই আমাকে বেশ মুগ্ধ করতো। আমি একটা নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত জানতামই না যে রান্না বিষয়টা কেবল মাত্র নারীদের জন্য। সেদিন আম্মা নিজের হাতে পুডিং করতেন। আমি প্রতি মাসেই অপেক্ষায় থাকতাম কবে আব্বুর অফিসে মিটিং হবে। মাঝে মধ্যে মিটিং শেষ হতে হতে রাত পেরিয়ে যেত।
[hfe_template id=’81’]
আব্বুর অফিসকক্ষে আমাদের প্রবেশ নিষিধ। তাই কখনই ভেতরে গিয়ে দেখা হয়নি সেই অফিস রুমটি কেমন; তবে জানালার ফাঁক দিয়ে দেখতাম, বিশাল এক রুমে বিশাল এক টেবিল, তার চারপাশে চেয়ার ছড়ানো –আব্বুর বসার চেয়ারটি রিভল্ভিং, স্টীলের আলমারী , ক্যাবিনেট , তাকের কিছু কিছু অংশও দেখা যেত। অফিস রুমটি আমাদের ভাই বোনের কাছে ছিল একটা বিশাল প্রলোভন। এটা বাবার জব এতটুকু বুঝতাম কিন্ত বিশাল সময় ধরে এখানে কি হয় তা আমরা কিছুতেই বুঝতে পারতাম না। এই নিয়ে আমাদের দুই ভাই বোনের তখন নানান জল্পনা কল্পনা। আব্বুকে এই বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলে তিনি শুধু মুচকি মুচকি হাসতেন। মনে আছে, যেদিন মিটিং করতে করতে সন্ধ্যা পেরিয়ে যেতো তখন বারান্দার সাথে লাগোয়া রুমটিতে কেউ কেউ এসে ধুমপান করে যেতেন। আমরা দু, ভাইবোন উৎসুক হয়ে বারান্দার সাথের রুমটায় ঘোরাফেরা করতাম। একেবারেই কিছু করতে না পেরে সিগারেটের পরে থাকা পেছনের অংশটুকু কুঁড়িয়ে নিয়ে ঠোটে চেপে ধরে তাতে টান দিতাম। এবং তার ফলে আমি কাশতে কাশতে অস্থির হয়ে যেতাম। আর আমার বড় ভাইয়ের সেই কী অট্রহাসি। সে আমার হাত থেকে নিয়ে বলতো, ‘দেখ কিভাবে টানতে হয়।‘ সে তখন পড়ে চতুর্থ শ্রেনিতে । আমার তখনও হাতেখড়ি হয়নি।
যাইহোক তার ধুমপানের হাতেখড়ি সেখান থেকেই হয়েছিল কিনা তা আমার জানা নেই; তবে ওটা ফুঁকাতে পরবর্তীতে আমি তেমন কোন উৎসাহ পাইনি।
আম্মাকে সবচেয়ে বেশী মনে পড়ে –নীচতলার বারান্দার সিঁড়িতে বসে পুরাতন সোয়েটার থেকে উল ছাড়াচ্ছেন অথবা নতুন কোন সোয়েটার – হাত মোজা বুনছেন নাহয় বড় বড় বেতের দেয়াল ঝুঁড়িতে উল দিয়ে বিভিন্ন নকশা তুলছেন। আম্মার এই কাজগুলো খুবই নান্দনিক –আমি দূর থেকে দেখতাম কিম্বা আম্মার সাথে উল ছড়ানোতে সাহায্য করতাম।
মনে আছে, আব্বু আরেকটি অফিস করতেন; একই দিনে দু‘জায়গায় অবস্থান করতেন। সেটি ছিল আনসার ক্যাম্প। ওটাকে ভূতের বাড়িও বলা হয়। বিভিন্ন জাতীয় দিবসে সেখানে সাংস্কৃতিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান হতো। আব্বু বিশেষ দিনগুলোতে এবং রিহার্সেলের দিনগুলোতে আমাদের সেখানে নিয়ে যেতেন। এই দিনগুলোর জন্যও আমরা বিশেষভাবে অপেক্ষা করতাম, কারণ তখনও আমাদের বাসায় টিভি ছিল না। টিভি বলে কিছু ছিল তাও আমরা জানতাম না। সন্ধ্যার পরের সময়গুলো আমাদের খুব বিষন্নতায় কাটতো। মনে আছে সন্ধ্যার পর প্রায় সময়ই বিদ্যুৎ থাকতো না। আমি আর আম্মা দোতলার বিশাল বারান্দার রেলিংয়ে ভর করে বড়-রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতাম আর অপেক্ষা করতাম –কখন আব্বু ফিরবে।
এমন একটা বিষাদময়তার মধ্যে আব্বুর ক্যাম্পের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের দিনগুলো ছিল বড় ঝলমলে। আমরা খুশীতে ডগমগ করতাম। সেখানে দেশাত্ববোধক “একবার যেতে দে না আমার ছোট্র সোনার গাঁয়“, “ও আমার বাংলা মা তোর আকুল করা রূপের সুধা“ ছাড়াও একটি গানের কথা খুব মনে পড়ে “বন্ধু তোর বারত নিয়া আমি যামু“।
বাসায় আব্বু যতক্ষন থাকতেন –মনে আছে ততক্ষন গান বাজতো। ছুটির দিন মানে –রোববার সারা দিন-রাত গান বাজতো। তখনও আমাদের বাসায় টেপ রেকর্ডার ছিল না; রেডিওতে গান বাজতো। বিভিন্ন ছায়াছবির গান ও লালন গীতির কথা মনে আছে। ফরিদা পারভীনের কন্ঠে “মিলন হবে কতদিনে“ শুনতে শুনতে আব্বু দুপুর বেলায় কদবেলের ভর্তা বানানোর নির্দেশনা দিচ্ছেন কিংবা গ্রীষ্মকালে পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে জামগাছ থেকে লোক দিয়ে ঢাউস ঢাউস সাইজের ঝুড়ি ভর্তি জাম পাড়াচ্ছেন আর দূর থেকে ভেসে আসছে “বাড়ির কাছে আরশী নগর, ও সেথা পড়শী বসত করে, আমি একদিনও না দেখিলাম তারে।“
আমার আব্বু খুব কাজ-প্গল মানুষ; কর্মব্যস্ত থাকতেন সারাক্ষণ; তবে দরাজ কন্ঠে কাজের নির্দেশনা দিয়েই যেতেন। আব্বুর কাছাকাছি –পাশাপাশিই থাকতাম; তারপরও মনে হতো ওভাবে বোধহয় আব্বুকে কাছে পাই না। আব্বুর আদর পাওয়ার জন্য বা দৃষ্টি আকর্ষনের জন্য আমি যখন বিকেল বেলা বাগানে একা একা ঘুরতাম বা খেলতে যেতাম তখন গোলাপ ফুলের গাছে থেকে কাঁটা তুলে সে কাঁটা পায়ে গেঁথে কাঁদতে কাঁদতে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতাম আর বলতাম “ আব্বু আমার পায়ে কাঁটা ফুটেছে।“ আব্বু উৎকন্ঠায় দৌঁড়ে এসে আমার পা দেখতেন এবং পরক্ষনেই অট্রহাসিতে ভেংগে পড়তেন। আমার কান্না পেতো। আব্বুর হাসি দেখে আমার শোক বহুগুন বেড়ে যেত। কারণ আব্বু পায়ে হাত দিয়ে বুঝে ফেলতেন গোলাপের কাঁটা নিজে নিজে পায়ে ফোটে না।
আজ যখন আমি নিজে এই স্মৃতি রোমন্থন করছি আব্বু তখন দুরপরবাসে। আজ আমি শিশু-আমার সেদিনের ভুলটি ভেবে একা একাই আব্বুর মতো হাসি। আর আব্বুকে খুব রকম মিস করি। আব্বুর সাথে আড্ডা দিতে দিতে এই স্মৃতিটি রোমন্থন করতে মনের ভেতর বড় ব্যাকুলতা অনুভব করি। চোখ ও মন আদ্র হয়ে উঠে।
খুলনার আরেকটি স্মৃতি বড় চমকপ্রদ। বিলেতি দুধ। বড় টিনের মধ্যে সেই দুধ থাকতো। এই দুধ দিয়ে চা তৈরী হতো। আর আমরা –ছোটরা চুরি করে হাতে নিয়ে খেতাম। একবার খেয়ে শেষ হয়ে গেলে আবার খেতাম; আবার শেষ হলে আবার। এই প্রলোভনের কোন শেষ ছিল না। সবকিছুরই সীমা আছে। তাই বড়দের সামনে খেতে ইচ্ছে করলেও মাঝেমধ্যে মনের লাগাম টানতে হতো। সেক্ষত্রে আম্মা বিকেল বেলায় ঘুমিয়ে পড়লে চুরি করে খাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না
[hfe_template id=’81’]
আম্মাকে সবচেয়ে বেশী মনে পড়ে –নীচতলার বারান্দার সিঁড়িতে বসে পুরাতন সোয়েটার থেকে উল ছাড়াচ্ছেন অথবা নতুন কোন সোয়েটার – হাত মোজা বুনছেন নাহয় বড় বড় বেতের দেয়াল ঝুঁড়িতে উল দিয়ে বিভিন্ন নকশা তুলছেন। আম্মার এই কাজগুলো খুবই নান্দনিক –আমি দূর থেকে দেখতাম কিম্বা আম্মার সাথে উল ছড়ানোতে সাহায্য করতাম।
আম্মা রাবীন্দ্রিক ভঙ্গিমায় বসে সোয়েটার বুনছেন আর দূর থেকে সন্ধ্যা মূখার্জীর কন্ঠে গানের সুর ভেসে আসছে –আমি তার ছলনায় ভুলবো না।
আমার স্মৃতি মনিকোঠায় অতি প্রিয় একটি দৃশ্য !

নাজমা সুলতানা তুহিন
পিতা- মুহাম্মদ আলী আকবর
মাতা-বিলকিস বানু
জন্ম- ১০/১১/১৯৭৪
বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এ চাকুরীর পর দীর্ঘ ১১ বছর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এর প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্বরত। বাবা একজন সরকারি চাকুরে এবং মুক্তিযোদ্ধা। মা গৃহিনী। বাবার কর্মসুত্রে বিভিন্ন জেলা শহরে ছেলেবেলা কেটেছে। পরবর্তীতে নিজ কর্মসুত্রে একা একা দেশের বিভিন্ন জেলায় ভ্রমন ও বসবাসের সুযোগ হয়েছে। দেশের বাইরে দুইটি দেশে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। নানা রকম মানুষ, স্থান,আবহাওয়া, মানুষের আচার-আচরণ, খাদ্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি ইত্যাদি নিয়ে শখের বশে ফেসবুকে গত ৫/৬ বছর ধরে লিখতে লিখতেই অনেকের নজরে আসি। ভ্রমণ কাহিনী লিখেছি।অনুবাদ করেছি সবই শখের বশে। বই পড়ি, ভ্রমন করি, আবৃত্তি করি, সাধারণ মানুষের সাথে মিশতে ভালোবাসি। অচেনা মানুষকে সাহায্য করতে ভালো লাগে। কিশোরী অবস্থায় বিবাহিত জীবন শুরু। স্নাতক ইডেন মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে, ব্যবস্থাপনায় স্নাতকোত্তর ঢাকা কমার্স কলেজ থেকে। পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিপ্লোমা ফাইন্যান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট এ বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট থেকে। একমাত্র কন্যা সন্তান ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে পাবলিক এডমিনিস্ট্রেশন থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এ কর্মরত আছে।