মূল : নাওয়াল আস-সাদাবী
অনুবাদক: ফারহানা আজিম
প্রকাশক: প্রথমা
ফেরদৌস নামের মিশরীয় নারীর এই গল্পটা আপনার একটুও অচেনা লাগবে না কারন সম্ভবত পৃথিবীর পিছিয়ে পড়া সমাজের নারীদের জীবন এক সূতায় গাঁথা। বর্বর আরব সমাজের সাথে আমাদের সমাজের ফারাক বেশ খানিকটা থাকলেও ফেরদৌসের মতো নারীদের পরিণতি প্রায় এক।
ফেরদৌসকে তার রাষ্ট্র আর পুরুষপ্রধান সমাজ বেশ্যা বানায়। তার জীবন নানান উত্থান-পতনের। ছোটবেলায় মাকে প্রতিদিন বাপের কাছে কঠিন মার খেতে দেখতে দেখতে তার মনে প্রশ্ন আসে, জন্ম দিতে বাবা কেন লাগে? ফেরদৌসের আর ভাই-বোনেরা অভাবে অনাহারে নির্যাতনে মুরগীর বাচ্চার মতো মরে গেলেও ফেরদৌস বাঁচে তার অফুরন্ত প্রাণশক্তিতে। কায়রো শহরে চাচার সাথে আসে স্কুলে পড়তে। চাচার সাথে শারীরিক সম্পর্ক ঘটে যেন খুব স্বাভাবিক। চাচার বিয়ে হলে ফেরদৌসকে পাঠানো হয় বোর্ডিং স্কুলে। একমাত্র এখানকার জীবনই ফেরদৌসের পুরো জীবনের মধ্যে সবচে সুখকর। মাধ্যমিকে স্কুলে দ্বিতীয় আর পুরো শহরে সপ্তম হয় সে। কিন্তু এ পর্যন্তই। মাধ্যমিকের ওই কাগজটুকু ছাড়া আর কোনও সুযোগ সে পায়নি জীবনে।
আবার ফেরে চাচার বাড়িতে। চাচী তাকে ঘাড় থেকে নামাতে বুড়ো এক মাইজার আত্মীয়ের সাথে বিয়ে দেয় ফেরদৌসকে। সেখানে বাবার মতোই নির্যাতন আর ম্যারিটাল রেইপ।
স্বামীর বাড়ি থেকে মার সহ্য করতে না পেরে ফেরদৌস যে বৃহৎ পৃথিবীতে এসে পড়ে সেই পৃথিবী তার স্বামীর মতোই নিষ্ঠুর। সেই পৃথিবী তাকে বিবর দেয়নি। ক্রমাগত তাকে বেশ্যা বানিয়ে গেছে। বাবা, চাচা, স্বামী, ইব্রাহিম, ফৌজি, বেইউমি- সবগুলা কুত্তার বাচ্চা, সবগুলা পুরুষ- জাস্ট ভিন্ন ভিন্ন নামে ঘুরে বেড়াচ্ছে- ভাবে সে।
বেশ্যাবৃত্তি মোট তিনবার তিন ধরনে করে সে। একবার মনে হয় থার্ড ওয়েভ ফেমিনিজম এর ন্যারেশন অনুযায়ী সে স্বাধীন হয়ে গেল। দামী অ্যাপার্টমেন্ট, দামী বেশভূষা, নিজের মতো খরচ করা ইভেন কি ‘না’ বলার অধিকারও যেন পায় সে। কিন্তু সাংবাদিক বন্ধু যার সাথে সে করতো রাজনীতির আলাপ সে যখন শুতে আসে ফেরদৌস বলে, রেট কিন্তু একই, এবং সময় বাঁধা। সাংবাদিক শ্লেষের সুরে বলে ওঠে, “সবসময় মূল্যতালিকা ঝুলায় রাখো কেন? মনে হয় কোনও ডাক্তারের চেম্বারে আছি!”
ফেরদৌস বলে, তুমি কি আমার পেশাকে ছোট করছো না ডাক্তারের পেশাকে? দাইয়ু নামে সাংবাদিক বলে, দুটোই তবে কাজের সময় অন্তত ডাক্তার জানেন তার কাজটা সম্মানজনক আর তোমারটা তা নয়।
এই ‘অসম্মানজনক’ শব্দটা আবারো ওলটপালট করে দেয় ফেরদৌসের জগত। সে সব ছেড়েছুড়ে মাধ্যমিকের টুকরো কাগজ নিয়ে আবারো ঝাঁপ দেয় ‘সম্মানজনক’ চাকরির খোঁজে। চাকরি করতে করতে বোঝে, নারীর জীবন মানেই অসম্মানের জীবন হোক সে বেশ্যা অথবা বেশ্যা না! এই চাকরিতে এসে ফেরদৌস প্রেমে পড়ে। এবং যথারীতি প্রতারিত হয়। পুরুষটি ছিল বিপ্লবী। ফেরদৌস বোঝে, কেউ তার মতো শরীর বেচে, কেউ মেধা, কেউ বিপ্লব। সবই বেচাকেনা।
সে আবার ফিরে যায় বেশ্যাবৃত্তিতে। একসময় নিজের পেশায় ভাগবসানো এক দালালকে খুন করে সে ফাঁসির অপেক্ষা করে।
মিশরের নাওয়াল আস-সাদাবী একজন নারীবাদী লেখক এবং মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। সত্য ঘটনা অবলম্বনে লিখেছেন এই বই। ফাঁসির আগের রাতে ফেরদৌস তার গল্প বলে যান লেখককে। বলে যান যে, “আমি খুন করেছি তাই ওরা আমাকে ফাঁসি দিচ্ছে তা নয়, ফাঁসি দিচ্ছে কারন ওদের মুখোশ আমি টেনে খুলে ফেলেছি। ওরা আমাকে ভয় পাচ্ছে তাই ফাঁসি দিচ্ছে। আমার তাতে কিছু আসে যায় না। আমি জানি আমি কোনও অপরাধ করিনি, কারন অপরাধ করতে হলে পুরুষ হতে হয়।” রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইতে বলা হলে সে তা প্রত্যাখান করে।
এই গল্প বিশ্বের ৪০টি ভাষায় অনুদিত হয়েছে। “উইম্যান এ্যাট পয়েন্ট জিরো” বাংলায় অনুবাদ করেছেন ফারহানা আজিম। খুবই সুপাঠ্য অনুবাদ। চুম্বকের মত টেনে রাখে এমন সরল ভাষান্তর। অনুবাদককে ভালোবাসা।

ইশরাত জাহান ঊর্মি
সাংবাদিক, অ্যাকটিভিস্ট