একেবারে নব্বই এর দশকে নেট মোবাইল ছাড়া সময়ে, মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা মেয়ে আমি। গল্পের বই ছিল নিত্য সঙ্গী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পাশাপাশি মনে জায়গা করে নিয়েছিলো আরেকজন, সে হলো বিভূতিভূষণ।
খুব ছোটবেলা থেকেই বিভূতি’বাবুর সৃষ্ট দুর্গা হবার সাধ ছিলো মনে। অপুর সাথে কাশবনে ছুটে বেড়িয়ে ট্রেন দেখতে যাওয়ার মতন সুন্দর কল্পনার চেয়ে আর খুশীর বিষয় আমার কাছে কিছুই ছিলো না। নিজের ভাইটিকে নিয়ে তাই বেরিয়ে যেতাম এদিক ওদিক।
এরপর যখন রান্নার হাতেখড়ি হলো, তখন আমি হলাম ক্ষেন্তি। তার লেখা ‘পুঁই মাচা’র ক্ষেন্তি। উঠোনের মাচা থেকে পুঁই নামানোর সময় আমি ক্ষেন্তি’র মতনই জুলজুলে চোখে নিজেকেই নিজে বলতাম – “আধখানা কিন্তু তুমিই খাবে হে!”
পুঁই শাক নিয়ে আমার আদিখ্যেতার শেষ নেই। বলতে গেলে নটে গাছ মুড়িয়ে যাবে কিন্তু আমার পুঁই এর গল্প ফুরোবে না। যা কিছু আনাছ থাকুক না কেন, আমি কিন্তু মনে মনে বলি, সবকিছুর মাঝে আমি পুঁই’কেই বেছে নেবো।
এরপর যৌবনে একটি গল্প শুনেছিলাম। বিভূতিভূষণ ও নীরদ. সি.চৌধুরী একদিন কলকাতার কর্ণওয়ালিশ স্ট্রিট ধরে চলেছেন।এমন সময় একটা মোটরগাড়ি তাঁদের উল্টোদিক থেকে এসে পাশ কাটিয়ে চলে গেল।
বিভূতিভূষণ ফিরে ফিরে সেই গাড়িটিকে দেখছিলেন, তাই নীরদ জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি দেখছেন?’ বিভূতিভূষণ বুক চাপড়ে বলে উঠলেন, ‘মেরে দিয়ে গেল।’
শোনা যায়, সেই গাড়িতে এক সুন্দরী মেয়ে ছিল। তাকে দেখে বিভূতিভূষণের এতটাই ভালো লেগেছিল যে, তিনি বলে উঠেছিলেন, ‘মেরে দিয়ে গেল।’ তাইতো রোমান্স তার লিখনীতে ফুটে ওঠে।
এজন্যই অপূর্ব-র অপর্ণাকে টিপ পরতে বলার প্রসঙ্গ নিয়ে এই বিভূতিভূষণ লিখেছিলেন: ‘কিন্তু শেষে তাহাকে টিপ পরিতেই হইল। সত্যই ভারী সুন্দর দেখাইতেছিল, প্রতিমার চোখের মত টানা, আয়ত সুন্দর চোখ দুটির উপর দীর্ঘ, ঘনকালো, জোড়াভুরুর মাঝখানটিতে টিপ মানাইয়াছে কি সুন্দর! অপুর মনে হইল — এই মুখের জন্যই জগতের টিপ সৃষ্টি হইয়াছে।‘
আমি কিন্তু আজও এই মধ্যবয়সে এসে অপর্ণার জায়গায় নিজেকে ভাবতেই ভালোবাসি। আমার কল্পনার জগতে খোরাক জোগানোর জন্য বিভূতি বাবুর কাছে আমি চিরঋণী।
শুভ জন্মদিন, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়!
ছবি: সৃজন পাল।