পরেরদিন সকালের নাস্তা সেরে বাসার পাশের পুকুরটায় বড়শি নিয়ে সকলে মাছ ধরতে গেল। অরিত্রদের গ্রামের বাড়ি দেখাশোনা করেন বশির। তাকে সে ভোরে আসতে বলেছিল। বশির এলে তাকে সাথে নিয়ে অরিত্র ভোরে এসে মাছ ধরার স্থানসহ, বড়শি এবং খাবার প্রস্তুত রেখেছিল। অরোরা মাছ ধরার অভিজ্ঞতা না থাকলেও এ নিয়ে তার কোতূহলের সীমা নেই। চয়ন আজ বেশ গম্ভীর। অরিত্রুই তাকে মাছ ধরার কৌশল শিখিয়ে দিতে গিয়ে বলল, “ফাতনাটা হঠাৎ ডুবে যাওয়ার মুহূর্তে হ্যাচকা টান দিলেই…“
অরিত্র যখন অরোরাকে মাছ ধরানোর কৌশল শেখানোতে ব্যস্ত তখন চয়ন মনে মনে অদ্ভুত এক ভবিষ্যবচনের বাজী ধরলেন। তা হলো, প্রথম মাছটা অরোরার বড়শিতে ধরা পড়লে তিনি অরণির ভাবনা সঠিক বলে মনে করবেন।
ভোরের আলো চয়নের ভাবিকথনকে সত্যি করতেই আজ তার আলোকে গাছ-পাতার ফাঁক-ফোকর দিয়ে প্রক্ষিপ্ত করেছে ঠিক অরোরার ফাতনার আশপাশে। ওপর থেকে ছড়িয়ে পড়া সেই আলোই মাছদের চোখের মণিতে অরোরার ফাতনায় ঝুলন্ত খাবারকে বেশি স্পষ্ট করেছে। ফলে যা হবার তাই হলো। এই মৃদু শীত শীত সকালে ছায়ায় ফাতনা ফেলে বসে থাকা চয়নের ফাতনার দিকে মাছগুলো কোনো আগ্রহ খুঁজে পেল না। দু একটা পাতা ঝরে পড়ছে জলের ওপর। নিরিবিলি এই প্রকৃতির সান্নিধ্য, এই ঝরে পড়া পাতার সাথে জলের মেশা গন্ধ, এই না শীত না গরম অনুভব অরোরাকে আনমনা করে দিল। অরিত্র তার দিনলিপিতে এই প্রকৃতিরই আরাধনা করে লিখেছিল, ‘আমার দেশের প্রকৃতি ঠিক আমার মায়ের মতো। তার শরীরে ফেলে এসেছি আমার শৈশব আর কৈশোরের গন্ধ। আমার দেশের প্রকৃতি প্রেমিকার মতো, তার চোখে চোখ রাখলেই মনে পড়ে শরীরে জাগা প্রথম শিহরণ। আমার দেশের প্রকৃতি অনুভবের তীরে তীরে ভাসা এক নৌকা, রাতে আর দিনে; গোধূলী আর ঊষালগ্নে বয়ে চলা এক স্মৃতিকাতরতার বেদনা। এই বিদেশ বিভূঁইয়ে না এলে আমার সেই প্রকৃতি আর মায়ের কাছে ফিরে যাওয়ার কী তীব্র আকুলতা তাকে হয়তো অনুভব করতে পারতাম না।‘
ডায়েরিতে লেখা অরিত্রের কথাগুলো মনে হওয়ামাত্র, অরোরার ভেতর অবশ হয়ে এলো। তার এমন হয়, ‘শারিরীক-শিহরণ‘ শব্দটা তার শরীরে বাস করা তীব্র আর তীক্ষ্ম যন্ত্রণার অতীত হয়ে ফিরে আসে। শিহরণের পরিবর্তে সে কুঁকড়ে আসে। শরীরে জাগা তার প্রথম শিহরণ কখন এসেছিল তার কিছুই মনে পড়ে না এখন। তার কারণ হয়তো, শরীরি কোনো অনুভবকে তীব্রভাবে অনুভব করার আগেই পাহাড়ি এক ভয়ংকর উপত্যকায় তার সেই আবেগের গ্রন্থিকে কেটে ফেলা হয়েছিল। আজো তার ব্যতিক্রম হলো না। তবু, অরোরার মনের কোণে এক প্রশ্ন দাঁনা বাঁধল, দুই/তিন বছরের মধ্যে বদলি হয়ে তাকে ছেড়ে অন্য কোথাও চলে গেলে অরিত্র কি এভাবে তার জন্যও নস্টালজিক হয়ে উঠবে? তার কি মনে পড়বে, অরোরা নামের এক নারীর কথা যে তাকে প্রথম দেখাতেই শারিরীক কোনো শিহরণ ছাড়াই তার চোখের কোণে লুকানো বিনয়ী মায়াটুকু শনাক্ত করেছিল? অরিত্র কি ভুলে যাবে অরোরাকে? নাকি প্রতিদিন সূর্যোদয়ে, জোছনার কোনো মায়াবী প্রহরে তার মনে পড়বে, ‘অরোরা আমার দেশের প্রকৃতির মতো অনুভবের তীরে তীরে ভাসা এক নৌকা, রাতে আর দিনে; গোধূলী আর ঊষালগ্নে বয়ে চলা এক স্মৃতিকাতরতার বেদনা।‘
তার মনের কোণে উঁকি দেয়া এইসব প্রশ্নের অন্তরালে প্রচ্ছন্নভাবে স্বপ্নহারানো এক অরোরা তার ভেতর থেকে পুনরায় স্বপ্ন দেখতে আরম্ভ করেছে তারই অজান্তে। তাকে তার কৈশোরের সব স্বপ্নের কাছে ফিরিয়ে নিতেই যেন স্রষ্টা এক শতরঞ্চির ছক এঁকেছেন। তার প্রথম চালটা ছিল অরিত্রকে সহকর্মী হিসাবে পাওয়া। দ্বিতীয়টা হয়তো অরিত্রের লেখা নিত্যদিনের অনুভবমালা আর তাকে লেখা চিঠি। তারপর মাতোমা নিজেই। স্রষ্টা এই খেলায় সবচেয়ে শক্তিশালী চালটা নির্ধারণ করে রেখেছিলেন, অরণি নামের এক নারীর মাঝে; যার পরিবারে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নারী-লাঞ্ছনার অতীত ইতিহাস আছে। অরিত্রদের বাড়ির চারপাশে অনন্য এই প্রকৃতি সেই দাবার চালে কম ভূমিকা রাখছে না। এই প্রকৃতি, আর তাদের নিত্যনতুন আনন্দের ভিন্ন ভিন্ন সব উৎস সমান সক্রিয়তায় অরোরাকে বদলে নিচ্ছিল, ফিরিয়ে নিচ্ছিল তার মনের কোরকে লুকিয়ে থাকা স্বপ্নের কাছে, তার শরীরে জাগা প্রথম অনুভবের কাছে। সবার কাছে খোলামেলা ভাণ ধরার অভিনয়ে অভ্যস্ত অরোরা ফিরে যাচ্ছিল নারীসত্তার পবিত্র অনুভূতির কাছে, যে অনুভব একজন নারীকে নিজেকে আড়াল করে চুপি চুপি কাউকে তার আত্মার কাছে স্থান দেয়। নারী হয়ে জন্মানোকে অভিশাপ ভাবলেও অরোরা জানে না যে, ভালোবাসলে অথবা প্রিয় মানুষের কাছে একান্ত হয়ে গেলে একজন নারী তার কোরক থেকে যে অনিন্দ্য মহিমায় উন্মেষিত হয় তার সৌন্দর্য দেখার জন্য স্রষ্টা শুধু দাবার চাল নয়; হয়তো কোনো একদিন ধ্বংসপ্রাপ্ত ব্রক্ষ্মাণ্ডকে পুনরায় সৃজন করবেন।
অরোরার ফাতনা জলে দ্রুত ডুবে যেতে দেখে বশির জোরে চিৎকার দিয়ে বাংলায় কী যেন বলল যার আগামাথা কিছুই বুঝল না আনমনা অরোরা। তবে তার চিৎকারে অরোরা চমকে উঠে দ্রুত এক হ্যাচকা টান দিল এবং বড়সড় এক মাছকে তার বড়শির সুতার সাথে শূণ্যে ঝুলতে দেখে আনন্দে দিশেহারা হল। এই প্রথম জয়ের এক আনন্দ তার চোখ-মুখ ছাপিয়ে উঠল এবং সাথে সাথে চয়নের ভেতরটা কেঁপে উঠল। নিজের সাথে এমন ভবিষ্যবচন করে সারাজীবন তিনি কখনোই সেই ভবিষ্যবাণীর সন্ধান পান নি। কোন অলক্ষ্য থেকে কোনো এক সূক্ষ্ম শক্তি যেন অরোরা আর অরিত্রের মাঝে তাদের সম্পর্ককে আরো নিবিড় করতে কাজ করে যাচ্ছে। তাঁর মুখে হাসি ফুটল। নৈসর্গিক ব্যাপারগুলোর প্রতি তিনি সারাজীবন দুর্বল। সেই দুর্বলতা সবল হয়ে আজ অরোরার পক্ষ নিল। বাবা-মা হীনা অরোরার প্রতি এই মুহূর্তে তিনিও অরণির মতো চোখ নিয়ে তাকালেন। দেখলেন, শুকনা মাটিতে পড়ে বড় রুই মাছটা যত ছটফট করছে, তার চেয়েও ছটফট আনন্দে অরোরা তার হাত দুটি মুষ্ঠিবদ্ধ করে একের পর এক শূন্যে লাফ দিচ্ছে। এক অনন্য রূপসী তরুণীর প্রাণোচ্ছাসে ভরা এই আনন্দটুকুর মাঝে তিনি কেন যেন এক নতুন জীবনের সংকেত পেলেন। যে সংকেত তাকেও অরণির মতো অরোরাকে বড় আপন ভাবাতে বাধ্য করছে।
অরোরার এই আনন্দে তিনি নিজেও আনন্দিত হয়ে উঠলেন। আনন্দ আর বেদনা দুই-ই সংক্রামক। তা প্রবাহিত হয় পাশে বাস করা মানুষের হৃদয়ন্ত্রীতে। জীবনের নির্ভেজাল আর সাদামাটা এই আনন্দকে স্মরণীয় করতে তিনি তা উদযাপন করতে চাইলেন। তার মাথায় অভিনব এক বুদ্ধি খেলা করল। বাঙালি মাথায় উদযাপনের সবচেয়ে বড় উপাদান নিয়ে ভাবতে গেলে প্রথমেই যা মনে পরে তা খাদ্য-সংক্রান্ত। তিনি ভিন্ন পরিবেশে খাদ্য পরিবশন এবং ভোজের কথা ভাবলেন। বশিরকে ইশারায় কাছে ডাকলেন। তার কানে কানে বললেন, “বাসা থেকে রান্নার সামগ্রি আর চুলা নিয়ে আয়। আজ এখানেই আমি নিজে রান্না করে অরোরাকে খাওয়াব। বড় রুইটার ফ্রাই দিয়ে আজ চা-বিরতি হবে।“
বশির খুশিতে ডগমগ হয়ে এক দৌড়ে বাসার ভেতর গিয়ে অরণিকে তথ্যটা দিলেন। চয়নের এই খেয়ালের উৎস ভালো করে জানেন অরণি। আনন্দে ভেসে গেলেই তিনি বনভোজেনে মেতে উঠতে ভালোবাসেন। সুতরাং অরণিও এই আনন্দ অবগাহনে যোগ দিতে বশিরের সাথে বাসার কাজের মেয়েটাকে নিয়ে রান্নার প্রস্তুতিতে মেতে উঠলেন। বাসা থেকে সিডি প্লেয়ার এনে আগে থেকেই বিদ্যুতের সংযোগ তারে তা সংযুক্ত করে গান ছেড়ে দিলেন। আর বন-পুকুরের সান্নিধ্যের দিনটা অরোরার প্রতিদিন একই ধরণের ব্যস্ত আর পানসে জীবনে বর্ণিল আর বৈচিত্রময় আনন্দমুখর এক দিন হয়ে থাকল। এবং আজ সে স্পষ্ট অনুধাবন করল যে, বৈচিত্রময়তাই জীবনকে লম্বা করে দেয়। মাত্র ত্রিশ ঘণ্টা পার হয়েছে অরিত্রদের বাসার চারপাশের এই নিরিবিলি পরিবেশে। তবু অরোরার মনে হচ্ছে, অনেক অনেক দিনের আনন্দমাখা স্মৃতি জমা হয়েছে তার মানসপটে। তারা সকলে দুপুরের খাবার শেষ করে চেয়ার নিয়ে সেখানেই বসে কিছুক্ষণ কাটাল।
বিকেলে বাসায় ফিরে গোসল সেরে সে বিশ্রাম নিল মূলত চাঁদনি রাতে বারান্দায় বসে আড্ডায় মেতে উঠার জন্য। শুয়ে শুয়ে আরো একটা সিদ্ধান্ত নিল সে। তা হলো, অরণির কাছ থেকে রান্নার কৌশলগুলো রপ্ত করতে সে এখন থেকে দুপুরের রান্নার সময় তার কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নেবে। জেনে নিবে, অরিত্রের প্রিয় খাবার। এবং কোনো একদিন অরণির মতো রান্না করে অরিত্রকে তা খাইয়ে তাকে স্মৃতিকাতর ও নস্টালজিক করে তুলব। দেশে বাবা-মা নেই, আপন আত্মীয়-স্বজন যারা আছেন তারা অরোরাকে স্নেহ করলেও তাদের ব্যস্ততার কাছে সেই স্নেহ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। সুতরাং, তার নিজের কোথাও এতদিন ফিরে যাবার তাড়া ছিল না। তবে, এখন থেকে তার ইচ্ছা করবে অরণির কাছে ফিরে আসতে। রক্ত সম্পর্কের চেয়েও ভালোবাসার বন্ধন মানুষকে বেশি কাছে টানে।

কাজী রাফি
কথাশিল্পী
জন্ম – ২২ নভেম্বর, ১৯৭৫, বগুড়ায়।
মানুষ ও তাদের যাপিত জীবন এবং প্রকৃতি দেখার প্রয়োজনে ঘুরেছেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। চাকরির প্রয়োজনে আফ্রিকায় বাস করেছেন দুই বছরের অধিক সময় এবং আফ্রিকার প্রকৃতি-সংস্কৃতি, তাদের প্রান্তিক মানুষের যাপিত জীবনকে দেখেছেন খুবই কাছ থেকে। আফ্রিকার পটভূমিতে লেখা ‘ধূসর স্বপ্নের সাসান্দ্রা’ তাঁর প্রথম উপন্যাস। এই উপন্যাসেই কালি ও কলম পুরস্কার লাভ করেছেন তিনি; তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ, ১১ টি উপন্যাস এবং ৬ টি ছোট গল্পগ্রন্থ সবই পাঠক প্রিয়তায় প্রথম সারিতে। তাঁর লেখা ‘ত্রিমোহিনী’ উপন্যাসকে মহাকাব্যিক অ্যাখ্যা দিয়েছেন কিংবদন্তী ছোট গল্পকার হাসান আজিজুল হক।
পুরস্কার, এইচএসবিসি কালি ও কলম পুরস্কার -২০১০, এমএস ক্রিয়েশন সম্মাননা -২০১০, নির্ণয় স্বর্ণপদক-২০১৩, এসএম রাহী পদক ২০১৯
