পাবনা শহরের লাইব্রেরি বাজার সড়কের পাশের সাদামাটা আরামদায়ক তিনতলা একটি বাড়িতে সকালে প্রাতরাশের টেবিলে তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় । তিনি তাজুল মোহাম্মদ, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক । কবি মজিদ মাহমুদের আমন্ত্রণে ঈশ্বরদী’র ‘চর গড়গড়ি’ গ্রামে কবি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘বৌটুবানী পাঠশালা’র বার্ষিক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম আমরা দুজনেই । মধ্যম উচ্চতার দৈহিক গড়নের মানুষটির শিরে শ্বেত-শুভ্র কেশ । তাঁকে দেখে, তাঁর মৃদু আর বিনয়ী কন্ঠস্বর শুনে ধারণা করা শক্ত যে এই মানুষটি দেশব্যাপী শত শত মাইল হেঁটে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংগ্রহ করে বেড়িয়েছেন । মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গবেষণায় ইতিমধ্যেই তিনি বাঙালি পাঠক হৃদয়ে স্থায়ী আসন পেয়ে গেছেন । সম্প্রতি ঘোষিত বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত এই লেখক বিগত প্রায় তিরিশ বছর ধরে লিখেছেন অসংখ্য গ্রন্থ । মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক তাঁর মোট গ্রন্থের সংখ্যা ২২ টি । পাবনা থেকে ঢাকায় ফিরে এসে প্রথমেই আমি বাংলাবাজারে চারুলিপি প্রকাশনে গিয়ে ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সন্ধানে’ গ্রন্থটি সংগ্রহ করি ।
‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সন্ধানে’ গ্রন্থে মোট ২১৪ টি শিরোনামের কাহিনি গল্প বলার রীতিতে বলা হয়েছে । পাঠকমাত্রই বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় না যে, ওগুলো মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তান বাহিনি এবং তাদের এদেশীয় দোসরদের কৃত জঘন্য অপকর্মের দগদগে ক্ষতের প্রামান্য বয়ান ।সেইসব দগদগে ক্ষতের উৎস খুঁজতে গিয়ে লেখক আমাদেরকে প্রতিবারই নিয়ে গেছেন অনাবিস্কৃত এক একটি কুরুক্ষেত্রে । সেখানে তাঁর দেখা ও শোনা নির্যাতিত প্রতিটি চরিত্রের গগন বিদারী আর্তি নিখুঁতভাবে উঠে এসেছে তাঁর কলমে ।
তাজুল মোহাম্মদ তাঁর নিজের বর্ণনায় বলেছেন, একেবারে শুরুর দিকটায় কোনো রকম পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন নি তিনি । পূর্ব-প্রস্তুতিও ছিল না মোটেই । মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়গুলোতে রাজনৈতিক কারণেই ঘুরতে ঘুরতে নজরে আসে মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত মনের শতগুণ বেশি মানুষের । বধ্যভূমিগুলোতে শুয়ে থাকা মানুষগুলোর পরিচয় জানার আগ্রহ বাসা বাঁধে তাঁর মনে । ওঁরা কারা ? কি তাঁদের পরিচয় ? সবাই কি রাজনীতি করতেন ? তা করলেও কি পাকিস্তান এবং ইসলামের শত্রু ছিলেন তাঁরা ? তাঁরা কি হুমকি সৃষ্টি করেছিলেন ইসলামি রাষ্ট্র পাকিস্তানের প্রতি ? তাঁদের সবাই কি আওয়ামী লীগার বা হিন্দু ছিলেন ? আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে কিংবা হিন্দুর সন্তান হলেই পাকিস্তানের শত্রু হবে কেন ? এরকম আরো অনেক প্রশ্নের উত্তর জানতেই পথে নেমেছিলেন তাজুল মোহাম্মদ । ১৯৮০ সালের দিকে তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে সংগ্রহ করতে শুরু করেন মুক্তিযুদ্ধের তথ্য-উপাত্ত । সরাসরি ক্ষতিগ্রস্তদের নিকট থেকে তুলে আনা তথ্যসমৃদ্ধ প্রতিবেদনসমূহ প্রকাশিত হতে থাকে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় । প্রথমে ‘সাপ্তাহিক একতা’ এবং ‘দেশবার্তা’ পত্রিকায় । ১৯৮৪ থেকে প্রায় চার বছর ধরে ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিক ‘সচিত্র সন্ধানী’তে ।
১৯৮০ সালে সিলেট শহর থেকে ১৯ মাইল দক্ষিণে বুরুঙ্গাবাজার এলাকায় কর্মসূত্রে কিছুদিন অবস্থান করেন তাজুল মোহাম্মদ । সেখানেই তাঁর সখ্য হয় স্থানীয় উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক শ্রীনিবাস চক্রবর্তীর সাথে । সংস্কৃতিমনা ও রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তিত্ব শ্রীনিবাস একদিন স্কুল ভবনের পাশে উন্মুক্ত স্থানে একটি গর্ত দেখালেন তাজুল মোহাম্মদকে । এই স্থানটিতে নাকি মাটি চাপা দেয়া হয়েছিল ৮১ টি মৃতদেহ । কৌতুহল জাগলো তাজুলের মনে । এর আগে পেশাগত কাজে তিনি সুনামগঞ্জ ও সিলেটের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে শুনেছেন গণহত্যার কাহিনি । দেখেছেন অনেক বধ্যভূমি, প্রত্যক্ষ করেছেন পাকিদের অত্যাচারে বিকলাঙ্গ মানুষদের, এমনকি ধর্ষিতা নারীদের । হাহাকার করেছে তাঁর অন্তরাত্মা, সঞ্চিত হয়েছে ক্ষোভ । এখানে এসেও দেখলেন বধ্যভূমি, শুনলেন গণহত্যার কাহিনি । সরেজমিনে জানলেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনির নারকীয় কীর্তি, নারী নির্যাতনের জঘন্য অনাচার । আর, এদেশীয় চাটুকারদের জাতিদ্রোহিতামুলক অপরাধকর্ম । পিঠে তিন-তিনটে বুলেটের দাগ বহন করা শ্রীনিবাস চক্রবর্তী ও বেঁচে থাকা অসংখ্য বিকলাঙ্গ মানুষ জানালেন সেই গণহত্যার কাহিনি । ১৯৭১ সালের ২৬ মে সকালবেলায় একদল পাকসেনা গ্রামে ঢোকে জলপাই রঙের জিপে চড়ে । স্থানীয় এক কুখ্যাত দালাল ছাদ মিয়া পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছিল তার প্রভুদের । স্থানীয় দালালরা ভাঁওতাবাজীর আশ্রয় নিয়ে গ্রামের সহজ-সরল লোকদের শান্তি-সভার নামে স্কুলের মাঠে জড়ো করে । যারা যেতে চান নি তাদেরকে হুমকি-ধমকি দিয়ে নিয়ে আসা হয় । তারপর স্কুলের দুটি কামরায় হিন্দু-মুসলিম হিসেবে বিভক্ত করে আলাদাভাবে ঢোকানো হয় গ্রামবাসীদের । এবারে রশি দিয়ে বেঁধে দাঁড় করিয়ে গুলি করা হয় তাদের । পালিয়ে যাবার চেষ্টা করে সফল হন কয়েকজন । সর্বমোট ৮১ জনকে হত্যার পর ঘাতকেরা গ্রামে ঢুকে লুটপাট-ধর্ষন চালায় নির্বিচারে । শ্রীনিবাস চক্রবর্তীর চোখের সামনেই গুলি করে হত্যা করা হয় তাঁর বাবাকে এবং দুই ভাইকে । পিঠে গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনিও মৃতদেহগুলোর সঙ্গে মিশে ছিলেন । বুরুঙ্গাবাজারের এই গণহত্যার বিবরন জেনে-শুনে তাজুল মোহাম্মদ স্থির থাকতে পারেন নি । তিনি এই গণহত্যার ওপর একটি প্রতিবেদন তৈরি করেন । গণহত্যা তথা মুক্তিযুদ্ধের বিষয় নিয়ে ওটাই তাঁর প্রথম লেখা । সাপ্তাহিক ‘দেশবার্তা’ পত্রিকায় প্রতিবেদনটি ছাপা দিয়েই মূলত শুরু হয় তাজুল মোহাম্মদের ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সন্ধানে’র যাত্রা।
[hfe_template id=’81’]
গনহত্যার উপাত্ত সংগ্রহের এক পর্যায়ে সুরিকোনার মসজিদের গণহত্যার বিবরণটি তাজুল মোহাম্মদের মনে এক নতুন উপলব্ধির জন্ম দেয় । ইসলামের ভিত্তিতে জন্ম পাকিস্তানের সম্পর্কে তাঁর ধারণা আরো সমৃদ্ধি লাভ করে। ঘটনাটি এরকম :একটি ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানকে তখনো টিকিয়ে রাখার প্রবক্তারা বলতো, বাঙালিরা পুরো মুসলমান নয় । হিন্দুর সান্নিধ্যে থেকে এদের ধর্মীয় বিশ্বাস দুর্বল হয়ে পড়েছে । ঈমান-আকিদা একেবারেই নড়বড়ে । আর, তাই বাঙালির ঈমান দৃঢ় করার লক্ষ্যে প্রেরিত হয়েছে সেনাবাহিনী । এই সেনাবাহিনী অকারণে অমানুষিকভাবে হত্যা করেছে লাখো ধর্মপ্রাণ বাঙালিদের । ইসলামকে সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা এবং ইসলামি রীতিনীতি অনুসরণে বাঙালিদেরকে মনোযোগী করে তোলার মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের তরে পাক-সেনাবাহিনী প্রেরিত হয়েছে বলে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকরা প্রচার করে বেড়াচ্ছিল । অথচ সুরিকোনা মসজিদে ঢুকে উপাসনারত মুসল্লিদের নির্বিচারে হত্যা করার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ তাদের কাছে ছিল না । প্রতিবাদ করা দূরে থাক, বরং সমর্থন করেছে তারা, সহযোগিতা করেছে হত্যাকাণ্ডে । এই ছিল পাকিস্তান ও পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর ইসলামপ্রীতির নমুনা ।
শেরপুর থেকে লঞ্চযোগে যাওয়া যায় সুরিকোনা । সাদিপুর থেকে প্রায় তিনমাইল পশ্চিমে বালাগঞ্জ থানার শেষ প্রান্তে গ্রামটির অবস্থান । কুশিয়ারা নদীর তীর বরাবর সুরিকোনা । নদীর অপর তীরে নবীগঞ্জ থানার দুর্গাপুর গ্রাম । লঞ্চঘাট থেকেই সুরিকোনা গ্রাম শুরু । পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যে রাতে সুরিকোনা গ্রামে ঢোকে, তাদের বশংবদ রাজাকার-আলবদর ব্যতীত আর কেউ জানতো না এই খবর । গ্রামের মানুষ তখন ঘুমে । নিরাপদ আশ্রয়স্থল বিবেচনা করে অন্যান্য গ্রাম থেকে আগত বাঙালিরাও আছে এ গ্রামে । শেষ রাতে ঘুম ভাঙে মুয়াজ্জিনের কন্ঠে আজানের ধ্বনি শুনে । ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা ত্বরিত শয্যাত্যাগ করে অজু করে ছোটেন মসজিদের পানে । আঁধার তখন কাটছে । মুসল্লিদের ভিড়ে ভরে গেছে মসজিদ । নামাজ শুরু হল । ফরজ নামাজ আদায় করছেন ধর্মভীরু বাঙালি মুসলমানরা । কিন্তু ততক্ষণে মসজিদ চারদিক থেকে ঘেরাও হয়ে গেছে । পাকিস্তানি সৈন্যরা তখন প্রবেশ করছে মসজিদে । সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে প্রার্থনারত নিরীহ মানুষগুলোর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো হায়েনারা । পবিত্র মসজিদ অপবিত্র হলো বুটের আঘাতে । প্রার্থনার স্থান দখল করলো দানবীয় শক্তি । অস্ত্র ধরলো নামাজরত মুসলমানের বুকে । আগ্নেয়াস্ত্রের মুখে বের করে নিয়ে এল তাদের । এভাবে দুনিয়ার আর কোথাও মসজিদ থেকে নামাজরত মুসলমানদের নিয়ে হত্যা করার নজির সৃষ্টি হয়নি । অথচ পাকিস্তানি সৈন্যরা তা-ই করেছে । তারপর কুশিয়ারা নদীর তীরে মুসল্লিদেরকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করা শুরু করে । আবছা সেই আঁধারে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণ রক্ষা করতে সমর্থ হন হাতে গোনা কয়েকজন । আর প্রাণ দিয়ে শহীদ হয়েছিলেন অসংখ্য বাঙালি ধর্মপ্রাণ মুসলমান ।
তাজুল মোহাম্মদের লেখার গভীর অনুভূতি ও স্বাধ্যায়মগ্নতা মুগ্ধ করার মতো । তিনি বাঙালি পাঠকের কাছে মুক্তিযুদ্ধকালীন গণহত্যা ও নারী নির্যাতনের কাহিনিগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তুলে ধরেছেন । তাঁর বর্ণনায় নির্যাতিতের মর্মবেদনাই ব্যক্ত হয়েছে । র দেখা এবং শোনা প্রতিটি জীবিত অথবা মৃত চরিত্রকে সংশ্লিষ্ট ঘটনাসহ তিনি এমনভাবে বিশ্লেষণ করেছেন যে অবাক হতে হয় । প্রকাশের ভাষাটিও চমৎকার ও সাবলীল । এমন প্রাণবন্ত গদ্যে তিনি লিখতে সিদ্ধহস্ত যে তাঁর লেখার কোথাও বিদ্যার কচকচি নেই । ৫২০ পৃষ্ঠার কলেবরের গ্রন্থটির ভূমিকায় সর্বজন শ্রদ্ধেয় বিদ্বান ব্যক্তিত্ব হায়াৎ মামুদ লিখেছেন : ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সন্ধানে’ আমাদের জাতীয় ইতিহাসেরই প্রারম্ভিক অধ্যায় । এই ইতিহাস জানা আমাদের অবশ্য কর্তব্যের অন্তর্গত নিশ্চয়ই । তাজুল মোহাম্মদ নিজে স্বচক্ষে ১৯৭১ সালের ৯ মাস ব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের সবটুকু প্রত্যক্ষ করেছিলেন, এবং যেখানে যেক্ষেত্রে যেমন প্রয়োজন তাতে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন । দীর্ঘকাল প্রবাসে অবস্থান করলেও সারাক্ষণ বুকের মধ্যে হৃৎস্পন্দনের সঙ্গে লালন করে বেড়াচ্ছেন মাতৃভূমি বাংলাদেশকে । বাংলাদেশকে নিয়ে তাঁর স্বপ্ন দেখার শেষ নেই । সে-সকল স্বপ্ন আমাদেরও স্বপ্ন । আমাদের সকল স্বপ্ন সার্থক হোক । এই বাসনা যেমন তাঁর, তেমনি আমাদেরও ।”
সৌভাগ্যবশত যারা আমার মতো ৭১ পরবর্তী এই স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছে, তারা দেখেনি মুক্তিযুদ্ধ, সরাসরি অনুভব করেনি পাকিস্তান বাহিনির তাণ্ডব ও বর্বরতার তীব্রতাকে । তবু তাদেরও অধিকার রয়েছে মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস জানার । তাদেরও দায়িত্ব রয়েছে সঠিক ইতিহাস চর্চার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে সত্যের মুখোমুখি দাঁড়ানোর । কারণ আমরা জেনেছি, ইতিহাসের পরিচয়, বংশপরিচয়ের মতোই মানুষরূপে শুধু জানান দেয়া নয়, ব্যক্তিরূপে বিকশিত হওয়ার জন্যেও অপরিহার্য । তাজুল মোহাম্মদ আজীবন এই অপরিহার্য দায়িত্বটিকেই জীবনের একমাত্র ব্রত মনে করে এগিয়ে চলেছেন ।