জীবনের জন্য জরুরি: সাহিত্য নাকি মোটিভেশনাল গ্রন্থ?

বই

কাজী রাফি

কথাশিল্পী

পৃথিবীজুড়ে মিলিয়ন মিলিয়ন বই। এত বই পাঠের জীবনে তো সময় নেই। তাহলে প্রশ্ন জাগে আমরা কী পড়ব এবং কোন বইগুলো পাঠ জীবনের জন্য জরুরি?

এইসব উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই অগণিত পাঠক বইয়ের রাজ্যে প্রবেশ করে হয়ে যায় দিশেহারা। সিদ্ধান্তহীনতায় কিনে নেয় জনপ্রিয় কোনো লেখকের যে কোনো বই। কেউ কেউ আবার নিজের জীবনকে সাজানোর চিন্তায়, নিজের স্বপ্নকে হাতের মুঠোয় কব্জা করার চেতনায় কিনতে থাকে প্রেষণা প্রদানকারীদের (এরা এখন মোটিভেশনাল স্পিকার বলে খ্যাত) বই যা মূলত উপদেশ বাণীর মতো জীবনের সঠিক পথ অনুসরণের নির্দেশনামা। এই বইগুলো অনুপ্রেরণা যোগায়, পাঠককে উজ্জীবিত করে। বিশ্বজুড়ে এর কদর আছে। অনুপ্রেরণা কী? তা হলো চিন্তা-চেতনার অভিনবত্ব/পরিবর্তন। আর প্রেষণা (মোটিভেশন)? তা হলো, কাজের গতি পরিবর্তন, জ্বালানি সরবরাহ ব্যতিত যা ক্ষণিকেই মৃত্যুলাভ করে। খাদ্যগ্রহণের পর তার স্বাদ যেমন দীর্ঘস্থায়ী নয়, প্রেষণাও তেমনি। আর সাহিত্য? সাহিত্য হলো, জীবনের সকল তলকে, অনুভব-উপলব্ধিকে, মানবার্তিকে স্পষ্টভাবে মননে প্রোথিত করার এক নন্দনতাত্ত্বিক মানব-অভিযাত্রা।

গত কয়েকবছর ধরে বইমেলায় সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের তালিকা দেখলে সহজেই অনুমান করা যায় –এই নন্দনতাত্ত্বিক অভিযাত্রায় সামিল হওয়ার চেয়ে কোনো কাজ করে সহজ পন্থায় জীবনে সফল হওয়ার জন্য বর্তমান তরুণ প্রজন্ম মরিয়া। কী ভয়ংকর হতাশায় নিমজ্জিত বলে তারা জীবনে সাফল্যের সূত্র খুঁজছে বুয়েট, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ অথবা আইবিএ-তে শ্রেষ্ঠ ফলাফল অর্জনকারীদের কেতাবে। কাব্য এবং কথাসাহিত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার অর্থ হচ্ছে জাতি হিসেবে নিঃস্ব মননের এবং স্বপ্নহীনতার এক প্রতীক হয়ে ওঠা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে আমরা ক্রমশ সেই পথেই এগিয়ে চলছি। একটা প্রজন্ম আনন্দ আর স্বপ্ন হাতড়ে বেড়াচ্ছে ইউটিউব, ফেসবুকের বর্ণময় পাতায়, তার নিউজফিডে। ভাইরাল হওয়া ছবি, ট্রল, প্রোপাগাণ্ডার বিষয়বস্তু এখন তাদের বেঁচে থাকার রসদ। এর কারণে তাদের জীবনে তৈরি হচ্ছে চরম হতাশা। ভয়ানক হতাশা কাটাতে এইসব বইয়ের ভিতর তারা জীবন-রসদের চেয়ে বইয়ের লেখকদের মতো জীবনে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। জীবন যদি এইসব ভালো ভালো সূত্রের সূত্র ধরে এগুতো! পাহাড়ের চূড়ায় হঠাৎ উঠতে চাওয়ার এই প্রবণতা পাহাড় থেকে পতন ব্যতিত আর কিছু নয়। ভাবতেও ভয় করে –একটা প্রজন্ম কি ভয়াবহ ধারণা নিয়েই বড় হচ্ছে। তাদের উদ্দেশে বলি, পাহাড়ের চূড়ায় ওঠায়, গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়ায় কোনো আনন্দ নেই, আনন্দ হচ্ছে পাহাড়ে ওঠার, গন্তব্যে যাবার চড়াই-উৎরাই পথের বাঁকে বাঁকে অজানা রহস্যটুকু। সেখানে ফেলে রাখা ক্লান্তি-শ্রান্তির অভিযাত্রাটুকু। সেই অভিযাত্রায় অর্জিত স্মৃতিটুকু।

প্রতিটি মানুষের জীবন, তার পরিপার্শ্ব, তার বড় হয়ে ওঠা ভিন্ন ভিন্ন। হাত-পা, চোখ, কান-মাথার সংখ্যায় সমান হলেও মানুষের জীবনের ভিন্নতার মতো আর কোনো প্রাণির জীবন নয়। কারণ তার রয়েছে একটা নিজস্ব বোধ, অনুভব, চেতনা এবং ভাবনার জগত। প্রতিটি মানুষের ভাবনা-অনুভবে এত বৈচিত্র আছে বলেই আজ মানুষের পৃথিবী এত সমৃদ্ধ এবং অস্তিত্বময়।
ভিডিও গেমসে ফুটবল খেলে নিজেকে যিনি বড় প্লেয়ার মনে করেন বাস্তবতা হলো, গোল করা তো পরের কথা; সত্যিকারের ফুটবল মাঠের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে দৌড়ানোর সক্ষমতাই সে হারিয়ে ফেলে। উপদেশ বাণী পাঠ হলো –ভিডিও গেমসে ফুটবল খেলার মতো। তথ্যের ঝকমকি দ্বারা নয়, চরিত্রের মধ্য দিয়েই জীবনের সাদা-কালো পাঠের বাস্তবতা প্রতিভাত হয়। হিতোপদেশ সম্বলিত গ্রন্থে কোনো চরিত্র সৃষ্টি হয় না বলে তা কোনো দৃষ্টান্ত হয়ে মানব মননে প্রতিভাত হয় না বিধায় আমাদের কল্পনায়, মননে এবং চিন্তায় কার্যকর প্রভাব ফেলতে সক্ষম নয়। যদি হতো, তাহলে সাহিত্যের পরিবর্তে শ্রেষ্ট হিতোপদেশ দাতাদের জন্য নোবেল পুরস্কারের প্রথা চালু হতো।

মোটিভেশনাল হাজার হাজার হাজার বই বাজারে। এসব বই পড়লে আপনি যতই মেধাবী অথবা কর্মক্ষম হোন – দেখবেন, আপনার নিজের কাছে নিজেরই অনেক ঘাটতি আছে বলে মনে হবে। মনে হবে, আমার নিজেকে আর একটু মেরামত, আর একটু ঠিকঠাক করে নিতে হবে। কিন্তু সেই ঠিকঠাক করাটা আর হবে না। আপনি সফলতার আর একটা সূত্র খুঁজবেন। এবং একসময় এত সব সূত্র জেনে আপনার মনে হবে আপনি এক অক্ষম মানুষ -যার দ্বারা অনেক কিছু করা সম্ভব নয়। এভাবেই দিন দিন এবং এক সময় নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস হারানো অসম্ভব কিছু নয়।

কিন্তু এর চেয়ে আপনি যদি মনোযোগ বদলে মহানদের জীবনী পাঠ করেন, ভালো একটা গল্প/উপন্যাসের চরিত্রকে ভালোবেসে ফেলেন – দেখবেন আপনার নিজেকে ঠিকঠাক বা মেরামত করার কথা মনে পড়বে না। কেন না, অনন্য এই চরিত্রগুলো জীবনের যে সংগ্রাম, উত্থান-পতন, প্রেম-অপ্রেম; তার ভিতর দিয়ে যান। এদেরকে ভালোবাসতে গিয়ে বড়ত্বকে অজান্তেই আপনি ধারণ করবেন। সুতরাং আপনি ভিতর থেকে ‘সম্ভাবনা’ আবিস্কার করে ফেলবেন। মনে হবে, আরো স্বপ্ন দেখার জন্য, আরো জ্ঞানার্জনের জন্য, আরো বড় হয়ে ওঠার জন্য, আপনার জন্ম হয়েছে। আপনার অজান্তে আপনি বিকশিত হবেন।

[hfe_template id=’81’]

বর্তমান জগতে প্রচারণার ধরণ বদলে গেছে। কর্পোরেট মানসিকতার কারণে প্রচারণা এক ধরনের প্রপাগান্ডায় পরিণত হয়েছে। প্রচারণাকে এবং বৈষয়িক সাফল্যকে বড় মনে করে আপাত সাফল্য পাওয়াদের জনপ্রিয়তাকে আদর্শ মনে করার কোনো কারণ নেই। হীরা অন্ধকারে আলো ছড়ায়। কাঁচ দিনের আলোয় খুব ঝকঝক করে। কে না জানে কাচের চেয়ে হীরা কত মূল্যবান! তথ্যের চকমকি দ্বারা নয়, চরিত্রের মধ্য দিয়েই জীবনের সাদা-কালো পাঠের বাস্তবতা প্রতিভাত হয়। সেইসব চরিত্র যা জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত নিয়েই স্বমহিমায় সামনে এগিয়ে যায় আমাদের মন-মননে, আত্মায়-সত্তায় উদ্ভাসিত হয় ভোরের নরম রোদের মতো। কোথায় পাবো তেমন চরিত্র? মহান মানুষের জীবনী ছাড়া গল্প-উপন্যাসে। কিন্তু বাস্তব চরিত্রের চেয়ে গল্প-উপন্যাসে সৃষ্ট চরিত্রগুলোই আমাদের মানসলোকে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে। কেন না, কল্পিত এই চরিত্রগুলোর মাঝে বাস্তব-পরাবাস্তবতার চেয়ে সেই চরিত্রের নায়কোচিত আচরণ, পোড় খাওয়া জীবনে তার আত্তীকরণ অথবা ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয়ের মাঝে লুকিয়ে থাকে আমাদের স্বকীয় চেতনা। গল্পের চরিত্র এই স্বকীয় চেতনাকে জাগিয়ে দিয়ে আমাদের সত্তাকে শক্তিশালী করে তোলে।

সাহিত্য পাঠের অভ্যাস রপ্ত হয় বস্তুত শৈশব থেকেই। সেজন্যই অভিভাবককে সতর্কতার সাথে বই নির্বাচন করা প্রয়োজন। কেন না, একটা ভালো বই একজন শিশুর মনলোকে যেমন আলোকবর্তিকা তেমনি একটা বাজে বই তার সময়ক্ষেপনের সাথে গ্রন্থের প্রতি বিতৃষ্ণার নিয়ামক হতে পারে। এই দিকটাই আমাদের দেশে খুবি অবহেলিত। লেখকরা শিশুদের মেধা-মননকে কাঁচা মনে করে সহজীকরণের সূত্র খুঁজতে গিয়ে অনেক সময় ভুলেই যান ভবিষ্যত প্রজন্মের হাতে বই তুলে দেওয়ার গুরু-দায়িত্বের কথা। আমাদের বইমেলা সংস্কৃতির মাঝে যা কিছু মহান তার মধ্যে বেঁচা-কেনার সমীকরণে ঢুকেছে মন-খাদক লোভের পিঁপড়া। আগামী প্রজন্মের স্বার্থেই আমাদের অন্তত এই একটা জায়গায় লোভ পরিহার করতেই হবে।
এখনকার প্রজন্ম মূল্য দিয়ে জীবনকে মাপতে চাইছে। কিন্তু জীবন মূল্যমানে নয় বরং তা পরিমাপিত হয় অর্থবহতায়। বড় মাপের কর্ম ছাড়া জগতে বড় হওয়ার উপায় নেই। সেই কর্ম যা মানব সভ্যতাকে এগিয়ে নিতে, তাকে টেকসই করতে সাহায্য করে। বর্তমান জগতে প্রচারণার ধরণ বদলে গেছে। কর্পোরেট মানসিকতার কারণে প্রচারণা এক ধরনের প্রপাগান্ডায় পরিণত হয়েছে। প্রচারণাকে এবং বৈষয়িক সাফল্যকে বড় মনে করে আপাত সাফল্য পাওয়াদের জনপ্রিয়তাকে আদর্শ মনে করার কোনো কারণ নেই। পার্ল অন্ধকারে আলো ছড়ায়। কাঁচ দিনের আলোয় খুব ঝকঝক করে। কে না জানে কাচের চেয়ে পার্ল কত মূল্যবান!
গ্রন্থ হলো সেই কল্পনা এবং বোধ-অনুভবের সূতিকাগার। মনুষ্যচর্চার শ্রেষ্ঠ উপাসনালয়। কিন্তু কোন গ্রন্থগুলো পাঠে আমাদের এই জীবনচর্চা অর্থবহতা পাবে? বই বাছাইয়ে ব্যক্তি স্বাধীনতাই বড়। কিন্তু জীবনাভিজ্ঞতা বড় না হলে ভালো পাঠক হওয়া যায় না বিধায় ভালো বই নির্বাচন তখন কঠিন হয়ে পড়ে। পড়াশুনার জন্য পারিবারিক ঐতিহ্য গড়ে না ওঠার কারণে কোন ধরণের বই তার সন্তানের পাঠের জন্য উপযুক্ত –তা নির্বাচনে আমাদের দৈন্যতা লক্ষনীয়। ফলে আমাদের সন্তানদের হাতেও আমরা তুলে দিতে পারছি না, ভালো কোনো বই।

সমস্যা হলো, সস্তা দরের বই পড়ার অভ্যাস একবার রপ্ত হলে বই আর উপজীব্য কোনো বিষয় থাকে না। একসময় ভালো বইয়ের জন্যও আগ্রহটুকু হারিয়ে যায় বলে বস্তুত তিনি পাঠকের খাতা থেকে খরচ এবং খারিজ হয়ে যান। কিন্তু জ্ঞানচর্চা ব্যতিত আমাদের একটা জীবন যদি কেটে যায় শুধু চাওয়া-পাওয়ার হিসাব নিকাশে তাহলে আমাদের মনে হয় দুঃখিত হওয়ার কারণ তৈরি হয়। সে জীবন তো ঠিক মনুষ্য জীবন নয়।

ব্যক্তি মানুষের প্রতিটি স্বপ্ন এবং প্রতিটি আকাঙ্খার রয়েছে একটা পতনবিন্দু। সেই পতনবিন্দুকে গল্পের ভিতর চরিত্রের মধ্য দিয়ে পাঠক সনাক্ত করতে পারে। গল্প-উপন্যাস জীবনের পতনবিন্দুকে চিনতেই শুধু সহায়তা করে না তা থেকে উত্তরণের জন্য তার স্বপ্ন-কামনার ভিতর তৈরি করে দেয় এক ধরনের মানসিক প্রস্তুতি। কল্পনার সমৃদ্ধি কারণেই তৈরি হয় সেই মানসিক প্রস্তুতি। মানুষের কল্পনা সচেতনভাবেই এই প্রস্তুতি নিতে তাকে সহায়তা করে। সেজন্যই জ্ঞানের চেয়ে কল্পনা মনুষ্যজীবনে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে।

একটা মহান উপন্যাস/গল্পে কী থাকে? থাকে বিস্তৃত এক জীবন, চরিত্রের উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে সেইসব বদলে যাওয়া চরিত্রের জীবন সংগ্রাম এবং মানুষের জীবনার্তি। মানুষের প্রয়োজনে, বিপদে তাদের পাশে থাকার মন্ত্র হলো মানুষের এই জীবনার্তিকে উপলব্ধি করতে শেখা। যা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বাইরে গল্প-উপন্যাস থেকেই উপলব্ধ বিধায় আহরিত হয়। গল্প-উপন্যাসে থাকে আগামী দিনের জন্য ইঙ্গিতবহ বার্তা যা স্পষ্ট করে লেখক না বললেও পাঠকের অবচেতন মন তার ইঙ্গিতটুকু নিয়ে সচেতন হয়ে ওঠে। গল্পে থাকে পরাজিত জীবনকে ঘুরে দাঁড় করানোর চরিত্রগুলোর দৃঢ়তা যা পাঠকের স্নায়ুতন্ত্রে আশ্রয় নিয়ে তাকেও এক ধরনের জীবন সংগ্রামের মুখোমুখি ময়দানে সাহসিকতার সাথে দাঁড় করানোর জন্য অনুপ্রেরণা দেয়। গল্পের দর্শন এবং কল্পনা অবচেতনভাবেই জীবন এবং জগতকেকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণে তীক্ষ্ম চোখ তৈরি করে দেয়। কল্পনার কারণেই আইনস্টাইন আলোর ভিতর কণা দেখতে পেয়েছিলেন। আর পবিত্র কোরানেও বলা হয়েছে, ‘তারা দুজন সমান নয়, যে দেখে এবং যে দেখে না (অন্ধ এবং চক্ষুষ্মান সমান নয়)’। গল্প জীবন এবং জগতকে অন্তর্লোকের চোখ দিয়ে দেখার আয়না।

গল্প-কবিতার বাক্যে বাক্যে ছড়ানো জীবনার্তি অথবা অনুভব একজন মানুষকে অন্য মানুষের জীবনার্তির প্রতি, তার অনুভব-অনুভূতির প্রতি, তার স্বপ্ন এবং মর্যাদার প্রতি অনুভবসমৃদ্ধ করে দেয়। গল্প-উপন্যাসই মানুষের চোখের দৃষ্টিকে, আত্মার শক্তিকে এতদূর ছড়ায় যে, একজন সুপাঠকের শক্তিশালী আত্মা পদ-পদবি, অর্থ-বিত্তের আত্মংহারকে পায়ে ঠেলে মানবতাকে, মানুষের আত্ম-মর্যাদার স্থানটুকুকে সে সনাক্ত করতে চায়। সবার উপর মানুষ সত্য এবং সেই মানুষের মাঝে তিনিই সত্য যার আছে প্রজ্ঞাময় হৃদয়, মানবিক মূল্যবোধের জাগ্রত সত্তা –তাকেই চিনতে শেখায় গল্প-উপন্যাসের পটভূমিতে চিত্রিত জীবন। কেননা খল চরিত্রকে কল্পনায় সে ঘৃণা করার অনুশীলন উপন্যাসের বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে অঙ্কিত জীবন থেকেই করতে শেখে বলে এমনটা হয়। শাণিত ভাষার সর্বোচ্চ মেধাসম্পন্ন শব্দচয়নে সৃষ্ট সাহিত্য পাঠকের যে মননকে চুম্বকের মতো আটকে রাখে তা তাকে করে হৃদিক। আর সত্যি হলো এই, মানবিক বোধ এবং মর্যাদাসম্পন্ন মানুষের সংখ্যা যত বাড়তে থাকে একটা জাতি, জাতি হিসেবে তত সমৃদ্ধ হতে থাকে।

সত্যিকার সৃষ্টিশীল একজন মানুষেরও চারপাশের এইসব জনপ্রিয়তায় অস্থির হওয়া উচিত নয়। তারা সময়ের চেয়ে অনেক বেশি অগ্রসরমান থাকেন বলে বর্তমান কালের মানুষ তাকে সাথে সাথে গ্রহণ করতে পারবেন –এমনটা ভাবা ঠিক নয়। নোবেল পুরস্কারের আগে রবীন্দ্রনাথের বই খুব বেশি মানুষ পড়তেন না। তখন রেলস্টেশন এবং বটতলার চটি বই বিক্রি হতো অনেক বেশি। জীবনানন্দ দাসের কথা আর না-ই বা বলি। কিন্তু এখন? ভ্যান গগের চিত্রকর্মগুলো বিক্রি হয় না বলে তিনি তা দিয়ে ঘরের চালে ঢাকনা দিয়েছেন, ফুটো বন্ধ করেছেন। অর্ধাহারে, অনাহারে ভ্যান গগ মারা গিয়েছেন। কিন্তু চিত্রকর্মের জগতে ভ্যান গগ এখন অবিস্মরণীয় নাম। অর্থাৎ শিল্পের পথ আত্মত্যাগের। কেন না, শিল্পীর প্রগতিশীল চেতনার জন্য, অগ্রগামী ভাবনার জন্য বর্তমান কাল এবং সময় তাঁকে মূল্যায়নে সময় নেয়। প্রকাশকগণের শিল্পসত্তার চেয়ে ব্যবসায়িক সত্তা বেশি জাগরুক বলে তাঁরা প্রচারণায় সরবদের গুরুত্ব দেবেন –এই-ই তো স্বাভাবিক। একজন শিল্পীর দৃষ্টি থাকে প্রজন্মান্তরে, মহাকালে। দূরকে দেখার এই দৃষ্টি এবং দর্শন না থাকলে, শিল্প করতে চাওয়া ক্লিশে- ক্লান্তির এবং গ্লানিকর বলেই একসময় মনে হবে। জনস্তুতি রাজনীতিবিদদের নিত্যদিনকার পুষ্টিকর খাদ্য হলেও শিল্পীর জন্য তা অপুষ্টির কারণ হতে পারে! পৃথিবীর সমস্ত কালেই, সকল যুগে নষ্টদের দৌড়াত্মে মানুষের জীবন, তাদের ভবিষ্যৎ বিপদাপন্ন থাকে। একজন বোধসম্পন্ন শিল্পীসত্তার মানুষ এই দৌড়াত্মে সামিল হওয়া থেকে শুধু বিরতই থাকবেন না, মুক্তির পথ অন্বেষণ করবেন –তাই-ই প্রত্যাশিত। সেজন্যই ত্যাগটুকু তাঁর কপালের মহাতীলক।
একটা সত্য ঘটনা/গল্প বলি। কোনো এক অলিম্পিক গেমস। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কয়েকজন দূরন্ত গতির মানবের শরীরের সব মাংসপেশিতে ছলকে উঠেছে শক্তির প্রত্যয়। তাদের চোখের সামনে বিশ্বজয়ের হাতছানিতে উঁকি দিচ্ছে দূরের লাল ফিতায় দৃশ্যমান গন্তব্য। কয়েক সেকেণ্ডের জন্য স্টেডিয়াম ভর্তি হাজার মানুষ তো বটেই সারাবিশ্বের অগণিত মানুষ রুদ্ধশ্বাসে টেলিভিশনের পর্দায় সেই মুহূর্তকে আলিঙ্গনের জন্য অপেক্ষা করছেন। কিন্তু মাঝপথেই ঘটল অঘটন। একজন প্রতিযোগী পেশিতে টান পড়ায় ট্র্যাক থেকে ছিটকে পড়লেন। আড়চোখে পাশে ফিরে তাকাতেই সামনে থাকা প্রতিযোগী সেই দৃশ্য দেখলেন এবং তার তীব্র গতিকে নিয়ন্ত্রণ করে থামলেন। তার দেখাদেখি অন্য প্রতিযোগীরাও ফিরে এলেন। সতীর্থ একজন প্রতিযোগীকে বাদ দিয়ে তাদের প্রথম হওয়ার ইচ্ছা আর জাগেনি। একটু পরের দৃশ্য ছিল এমন। সব প্রতিযোগী মিলে আহতজনকে নিয়ে একসাথে ফিনিসিং পয়েন্টের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। তাদের পা একই তালে মাটিতে পড়ছে। সমগ্র বিশ্ব থমকে তাকিয়ে আছে সেই দৃশ্যপানে। তাঁরা একসাথে গন্তব্যবিন্দুতে পা রাখামাত্র স্টেডিয়ামের সব দর্শক তাঁদের সম্মান জানাতে একসাথে উঠে দাঁড়ালেন। তুমুল করতালিতে তাঁদের অভিনন্দিত করলেন। বিশ্বের ইতিহাসে এত এত মানুষের আনন্দাশ্রুর সাথে তাদের দীর্ঘ করতালির ঘটনা আর ঘটেনি।

[hfe_template id=’81’]

গল্প মানুষকে, মানুষের জীবনকে সমগ্রতার দিকে টানে। হিতোপদেশ আর বাণী ব্যক্তি বিশেষের জীবনকে তলিয়ে দেখতে চাওয়ার এক প্রবণতা। ব্যক্তিজীবনে মানবিক উন্নয়নের আড়ালে বস্তুত আয়-উন্নতির হিসা্ব-নিকাশকে আড়চোখে দেখে তুষ্টি অথবা অতুষ্টির বয়ান। কিন্তু সাহিত্য সমগ্র মানবতার দিকে চোখ মেলে, হৃদয় খুলে দেখার প্রবণতা। ব্যক্তিক বড়ত্বের চেয়ে সাহিত্য সমগ্র মানবতার বড়ত্বকে বড় করে দেখার চোখ ফুটিয়ে দেয়। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, সাহিত্য সেই কাজটা করে প্রতিটি ব্যক্তির জীবনে ধীর লয়ের গান গেয়ে গেয়ে, তার আত্মাকে এক অনাবিল শান্ততা উপহার দিয়ে।
কিন্তু তার মানে কি এই আমরা সারাক্ষণ গল্প-উপন্যাস-কবিতা নিয়েই থাকব। না, তাও নয়। বরং ইতিহাস, বিজ্ঞান, দর্শনসহ জ্ঞানের বিচিত্র শাখায় বিচরণের জন্য সাহিত্যের কাছ থেকেই প্রবল আগ্রহের জন্মটাকে নিয়ে আমাদের অভিযাত্রাকে গতিময় করব। কে না জানে, একজন মননশীল ব্যক্তির কাছে পৃথিবী তার দ্বার খুলে দেয় আনন্দের কল-কাকলিতে। কিন্তু মননহীনতা, শুধু তথ্যের চকমক দ্বারা পরিপূর্ণ হৃদয় তা গ্রহণে ক্লান্ত হয়ে পড়ে শীঘ্রই। সাহিত্য ধৈর্ষ এবং স্থৈর্য শেখায় কিন্তু তথ্য শেখায় সহজ পন্থায় জীবনে বড় হওয়ার পথ। আর পৃথিবীর প্রতিটি মহাপ্রাণ ব্যক্তি জানেন যে, জীবনে সফলতা লাভের সহজ যে পন্থা তাতে যত অনৈতিকতা মানবিকতা ততই ক্ষীণ ।

এই নিবন্ধে আমি নিজেও অনেক মোটিভেশনাল কথা বললাম। কিন্তু আমি নিশ্চিত, পাঠক হিসেবে আপনি একদিন এই সব হিতোপদেশ ভুলে যাবেন। কিন্তু চেষ্টা করেও ভুলতে পারবেন না, এই নিবন্ধে উল্লেখিত অলিম্পিকের ইতিহাসে ঘটে যাওয়া গল্পটি।


কাজী রাফি – কথাশিল্পী
জন্ম – ২২ নভেম্বর, ১৯৭৫, বগুড়ায়।
মানুষ ও তাদের যাপিত জীবন এবং প্রকৃতি দেখার প্রয়োজনে ঘুরেছেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। চাকরির প্রয়োজনে আফ্রিকায় বাস করেছেন দুই বছরের অধিক সময় এবং আফ্রিকার প্রকৃতি-সংস্কৃতি, তাদের প্রান্তিক মানুষের যাপিত জীবনকে দেখেছেন খুবই কাছ থেকে। আফ্রিকার পটভূমিতে লেখা ‘ধূসর স্বপ্নের সাসান্দ্রা’ তাঁর প্রথম উপন্যাস। এই উপন্যাসেই কালি ও কলম পুরস্কার লাভ করেছেন তিনি; তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ, ১১ টি উপন্যাস এবং ৬ টি ছোট গল্পগ্রন্থ সবই পাঠক প্রিয়তায় প্রথম সারিতে। তাঁর লেখা ‘ত্রিমোহিনী’ উপন্যাসকে মহাকাব্যিক অ্যাখ্যা দিয়েছেন কিংবদন্তী ছোট গল্পকার হাসান আজিজুল হক ।
পুরস্কার, এইচএসবিসি কালি ও কলম পুরস্কার -২০১০, এমএস ক্রিয়েশন সম্মাননা -২০১০, নির্ণয় স্বর্ণপদক-২০১৩, এসএম রাহী পদক ২০১৯

COMMENTS

  • মনোযোগ দিয়ে পড়লাম রাফি, অনেককথা গুছিয়ে লিখেছ সুন্দর করে-লেখক, বাবা আর সমাজের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে তোমার জেনুইন কনসার্ন ভেতরে নাড়া দিল। কজন ভাবে তোমার মতো করে-তাই ভাবছি। আমাদের সমাজে নীতি-নৈতিকতা আর দায়িত্ববোধে, এ সব পালনের জায়গাগুলোতে যে ধ্বস নেমেছে তা দু:খজনক। বিবেক কেঁদে মরছে অন্ধকারে। আলো নেই- কোথায় আলো?
    আমার মতে, মোটিভেশনাল স্পীচগুলো তাদেরকেই বেশি উজ্জীবিত করে যারা অলরেডি মোটিভেটেড। আর ভালো বইয়ের/বইপড়ার কোনো বিকল্প নেই।

    অলিম্পিকে সেই বিশেষ দৌড় আর ফিনিশ লাইনে সবার একই সঙ্গে পা মিলিয়ে এগুনোর ঘটনাটা যখন পড়ছিলাম তখন গা শিউরে উঠেছিল। চোখও ভিজে উঠেছিল। প্রতিযোগিতা মানে হঠাৎ দুর্ঘটনায় কবলিত বা অক্ষম হয়ে যাওয়া প্রতিদ্বন্দ্বীকে একলা ফেলে প্রতিযোগিতায় সাফল্য অর্জন নয়। জীবনের অপার মাহাত্ম্যের, অমিয় অর্থের এমন সুন্দর একটা বাস্তব গল্প শোনালে!
    পিন/পতন নিরবতায় লিখছি এই মন্তব্য, আমার বাচ্চারা অডিটোরিয়ামে বসে নিজ নিজ কাজ করছে। একটা বিশেষ কারণে ওদের এখানে নিয়ে এসেছি। ছবি দেখলে খুব ভাল লাগত তোমার। কী সুন্দর পরিবেশ! ( ছবি দিতে মানা-ওদের নিরাপত্তার জন্য, বাইরের কেউ যেন এদের চিনতে না পারে। কী সুন্দর সিস্টেম!)
    আমি ডিউটিতে, ওরা মন দিয়ে কাজ করছে।

    এমন সুন্দর একটা লেখার জন্য তোমাকে অজস্র ধন্যবাদ।

  • মনযোগ দিয়ে পড়লাম।সাহিত্যের গুরুত্ব চমৎকারভাবে উপস্থাপনের জন্য লেখককে বিশেষ ধন্যবাদ।হীরা এবং কাঁচের একই উদাহরণ দুইবার এসেছে।ঝিনুককেও বিশেষ ধন্যবাদ।

  • Please Post Your Comments & Reviews

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    error: Content is protected!!
    Share via
    Copy link
    Powered by Social Snap