প্রবীর বিকাশ সরকার
ছড়াকার, উপন্যাসিক, গবেষক
বিচারপতি ড. রাধাবিনোদ পাল সর্বকালের জন্য অপরিহার্য একটি নাম এবং একটি জ্বলন্ত ইতিহাস।
এখন এই নামটি জাপানের চিন্তাশীল সমাজে নতুন করে উচ্চারিত হচ্ছে। অবশ্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধত্তোর পঞ্চাশ থেকে ষাট দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত তিনি জাপানসহ বিশ্বব্যাপী ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিলেন। কিন্তু এরপর নব্বই দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত তাঁর নামটি হারিয়ে গিয়েছিল। যদিওবা তাঁর নাম জাপানের উচ্চমাধ্যমিক পাঠ্যপুস্তকে মুদ্রিত আছে তথাপি তরুণ প্রজন্মের জাপানিরা জিজ্ঞেস করলে স্মরণ করতে পারে না! এর মূল কারণ হচ্ছে বিচারপতি পালের সঠিক ইতিহাস এবং জাপানের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে বিস্তারিত উপস্থাপন না করা। রাজনীতিকদের দ্বারা নির্দেশিত দায়সারাগোছের তথ্যের কারণে বিদ্যালয় থেকে উত্তীর্ণ হওয়ার পর আর কিছুই মনে থাকে না কারো। কিন্তু ১৯৯৭ সালের রুয়ান্ডা ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল, ২০০৪ সালের সাদ্দাম হোসেইনের ট্রায়াল পুনরায় বিচারপতি রাধাবিনোদ পালের নামটিকে বিদগ্ধ জনের সামনে আবার উপস্থিত করেছে। স্মরণ করিয়ে দিয়েছে টোকিও ট্রাইব্যুনালে তিনি কী রায় দিয়েছিলেন? তাছাড়া বিগত দু-দশক জুড়ে দক্ষিণ কোরিয়া ও চীনে জাপানবিরোধী বিক্ষোভ প্রদর্শনীর ফলে অনেক জাপানিকে বিচারপতি পাল ও টোকিও ট্রাইব্যুনাল নিয়ে নতুন করে চিন্তা করতে উদ্বুদ্ধ করেছে। গবেষণালব্ধ গ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে, হচ্ছে। এককথায় বিচারপতি পাল এবং টোকিও ট্রাইব্যুনাল সমার্থক। জাপানে তাঁর নামটি পুনরায় উদ্ভাসিত হয়েছে ২০০৭ সালে ভারত সফরের সময় দিল্লিস্থ ভারতীয় সংসদে সদ্য স্বেচ্ছাপদত্যাগকারী প্রধানমন্ত্রী আবে শিনজোওর কণ্ঠে উচ্চারিত হওয়ার ফলে। তিনি কলকাতায় ‘ভারত-জাপান সংস্কৃতি কেন্দ্র: রবীন্দ্র-ওকাকুরা ভবন’ উদ্বোধন করার সময় পালের জ্যেষ্ঠপুত্র প্রশান্তকুমার পালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এটা একটি ঐতিহাসিক ঘটনা কারণ, আবের মাতামহ দু-দুবার প্রধানমন্ত্রী কিশি নোবুসুকে ছিলেন পালের ঘনিষ্ঠ ভক্ত ও বন্ধু।
১৯৪৮ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত বিচারপতি পাল টোকিও ট্রাইব্যুনালের (১৯৪৬-৪৮) মাধ্যমে যেভাবে বিশ্বকে প্রচন্ড নাড়া দিয়েছিলেন রাজনৈতিক এবং আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে তেমনটি আর কোনো প্রাচ্যব্যক্তি আজ পর্যন্ত করতে পারেননি। এটা এক বিরলতম ঘটনা বিশ্বইতিহাসে।
কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা বাংলাদেশ ও ভারতের মানুষ জানলেও বিচারপতি রাধাবিনোদ পালের নামটি পর্যন্ত জানে না কোনো প্রজন্মই! এই মানুষটি জন্মেছিলেন অবিভক্ত ভারতের নদীয়া জেলার কুষ্টিয়া মহকুমা, মীরপুর থানার অন্তর্গত শালিমপুর গ্রামে মাতামহের বাড়িতে ১৮৮৬ সালের ৭ই জানুয়ারি তারিখে। তাঁর পিতার নাম বিপিনবিহারী পাল এবং মায়ের নাম মগ্নময়ী দেবী। বর্তমানে শালিমপুর গ্রামটি স্বাধীন বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলায় অবস্থিত। নিরুদ্দেশ পিতার সন্তান চরম দারিদ্রে পর্যবশিত রাধাবিনোদ শৈশব থেকেই ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী, পরিশ্রমী এবং অধ্যাবসায়ী। কুষ্টিয়া থেকে এনট্রাস উত্তীর্ণ হয়ে রাজশাহী কলেজে এফ এ শ্রেণীতে ভর্তি হন। এফ এ-তে ভালো ফল করার পর কলকাতায় গিয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে বি এ কোর্সে ভর্তি হন যা ছিল তাঁর একান্ত ইচ্ছে। ১৯০৭ সালে বি এ উত্তীর্ণ হন। এর মধ্যে কলকাতায় আশ্রিত পূর্বপরিচিত পূর্ণচন্দ্র পালের কন্যা নলিনীবালার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯০৮ সালে গণিত বিষয়ে ¯স্নাতকোত্তর পরীক্ষা পাশ করেন। তারপর চাকরি জীবনে প্রবেশ করেন এলাহাবাদ হিসাব রক্ষণ অফিসের একজন কেরানি হিসেবে। চাকরিরত অবস্থায় ১৯১১ সালে বি এল পরীক্ষায় সফল হয়ে ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে গণিতশ্রাস্ত্রের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন, সেইসঙ্গে স্থানীয় আদালতে ওকালতি করারও সুযোগ পান। ১৯২০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার অব ল পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। পরের বছরই রাধাবিনোদ কলকাতায় চলে যান হাই কোর্টে আইনি পেশায় ক্যারিয়ার গঠন করার জন্য।
সাংবিধানিক আইনে পারদর্শী রাধাবিনোদ পাল ১৯২২ সালে ভারতীয় আয়কর আইনের সংস্কার সাধন করেন। সদা প্রতিদ্বন্দিতামুখী এবং অদম্য জ্ঞানপিপাসু পাল অধ্যাবসায় বলে ১৯২৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন আইন কলেজের অধ্যাপক হন এবং ১৯৩৬ পর্যন্ত অধ্যাপনা করেন। এই অধ্যাপনার পাশাপাশি গভীরভাবে গবেষণায়ও নিযুক্ত থাকেন, তারই ফলশ্রুতি ১৯২৪ সালে ডি এল তথা ডক্টরেট অব ল ডিগ্রি অর্জন। সন্দর্ভের বিষয়: Hindu Philosophy of Law in the Vedic and Vedic times prior to the Institutes of Manu. ১৯২৫ সালে ড.পাল Tagore Professor of Law পদে কলকাতাা বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেন, বিষয়: The Law of Primogeniture with special reference to India, ancient and modern. ১৯২৭ সালে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে রাষ্ট্রীয় আয়কর বিভাগের লিগ্যাল অ্যাডভাইজার হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন। এখানে তিন বছর কাটান। ১৯২৯ সালে তিনি দ্বিতীয় বারের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে Tagore Professor of Law পদ অলঙ্কৃত করেন। এবারের বক্তৃতার বিষয় ছিল: History of the Hindu Law in the Vedic Age and in the Post-Vedic times down to the Institutes of Manu. এইসমস্ত কাজ এবং ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি পরিবার নিয়ে বিভিন্ন স্থানে যেতেন, যেতেন নিজের জন্মগ্রাম শালিমপুরেও। আবাল্য পরিচিত বন্ধু, প্রতিবেশী এবং আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে সময় কাটাতেন। জীবনজীবিকার ক্ষেত্রে ছোট-বড়, ধনী-দরিদ্র বলে কোনো ভেদাভেদ তাঁর চরিত্রে ছিল না। ছিলেন অত্যন্ত নীতিবান, স্নেহবৎসল, জাতীয়তাবোধসম্পন্ন প্রতিবাদী স্বভাবের মানুষ।
১৯৩৬ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারি তারিখে তাঁর জীবনে ঘটে অসামান্য এক ঘটনা। একটি আমন্ত্রণ পত্র আসে সুদূর লন্ডনের প্রিভি কাউন্সিলের একটি মামলায় লড়বার জন্য প্রসিদ্ধ Andrew Yules Company থেকে। সেই প্রথম বিদেশ ভ্রমণ। এরপর তাঁর জীবনে একটার পর একটা সৌভাগ্যের দ্বার উন্মুক্ত হতে থাকে। ১৯৩৭ সালে নেদারল্যান্ডস এর Hague শহরে অবস্থিত Congress of Comparative Law প্রতিষ্ঠানের দ্বিতীয় অধিবেশনে International Academy of Comparative Law কার্যকরী পরিষদের যুগ্ম-সভাপতি নির্বাচিত হন। এবার ছিল দ্বিতীয় বিদেশ ভ্রমণ। ১৯৩৮ সালে আবার আমন্ত্রণ পেলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেবার জন্য Tagore Professor of Law হিসেবে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এটা এক বিরল সম্মান। এবারের বিষয় ছিল: Crimes in International Relations. ক্রমাগত অগ্রগতির সিঁড়ি ভেঙে এগিয়েই যেতে লাগলেন ড.পাল। ১৯৪১ সালের ২৭ শে জানুয়ারি কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি পদে অভিষিক্ত হলেন। তাঁর জন্মদাত্রীর আজীবনকার স্বপ্ন ছিল ছেলে একদিন বিচারপতি হবে! সেই স্বপ্ন সফল হয়েছিল, যদিও মা সেই স্বপ্নের সাফল্য দেখে যেতে পারেননি। তখন হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি ছিলেন স্বনামধন্য ব্যারিস্টার Sir Harold Derbyshire. তাঁর অত্যন্ত ¯স্নেহভাজন ও বিশ্বস্ত ছিলেন বিচারপতি ড.পাল। জানা যায় তাঁরই প্রস্তাবে বিচারপতি ড.পাল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই জাপানে অনুষ্ঠিত The International Military Tribunal for the Far East, সংক্ষেপে টোকিও ট্রাইব্যুনালে (১৯৪৬-৪৮) অন্যতম বিচারকের পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৪৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলারের পদ শূন্য হলে তাঁকে নিয়োগ প্রদান করা হয়। ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে উপাচার্যের দায়িত্বভার পরিচালনা করে অবসর গ্রহণ করেন। আর এই সালেই কর্মবীর ড.পালের কাছে চিঠি আসে জাপানে অনুষ্ঠিতব্য আন্তর্জাতিক মিলিটারি ট্রাইব্যুনালে ১১টি দেশের ১১ জন বিচারকের মধ্যে তাঁকে ভারত থেকে আসন গ্রহণ করার জন্য। বিশ্বের ইতিহাসে জন্ম হয় এক অবিস্মরণীয় ঘটনার। ১৯৪৬ সালের ৫ই মে তারিখে ড.পাল জাপানের পথে রওয়ানা দেন। তাঁর অবস্থান নিশ্চিত করা হয় একেবারে যুদ্ধবিধস্ত রাজধানী টোকিওর বিখ্যাত ইম্পেরিয়াল হোটেলে। এখানে অবস্থান করেই তিনি আড়াই বছর বিচারের কাজ ও রায় সমাপ্ত করে ব্যতিক্রম এক ইতিহাস সৃষ্টি করেন। এশিয়ায় প্রথম নোবেল পুরস্কার বিজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর বাঙালি জাতিকে বিশ্বের দরবারে নতুন করে আলোকিত করেন তিনি। কিন্তু অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, বিশ্ববাসী তাঁর নাম জানলেও ব্রিটিশ ভারতে তাঁর কৃতকর্মের ইতিহাস আদৌ আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারেনি। অজ্ঞাতেই রয়ে গেল এই মহান মনীষীর নামটি।
[hfe_template id=’81’]
১৯৪৮ সালে যখন টোকিও মিলিটারি ট্রাইব্যুনাল বিষয়ে তাঁর লিখিত সুদীর্ঘ ১২৩৫ পৃষ্ঠার ঐতিহাসিক রায়ের সংবাদ বিশ্বগণমাধ্যমে ঝড় তুলল তখন কী এই সংবাদ ভারতবাসী বিশেষ করে কলকাতা ও দিল্লির বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী ও রাজনীতিকদের দৃষ্টিগোচর হয়নি? না হওয়ার তো কথা নয়! কিন্তু তা গুরুত্ব পায়নি বলেই ধারণা করা যায়। কারণ তখনকার ভারতব্যাপী ছিল একেবারেই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি। লাগাতার আন্দোলন, হরতাল, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, মারামারি, খুনাখুনি ইত্যাদি ঘটনার জেরে উন্মাতাল সমগ্র ভারতবর্ষ। সেইসঙ্গে ভারত ভেঙে যাওয়ার সমূহ সঙ্কট। এবং তা ভেঙ্গে গিয়ে তিন টুকরো হয়ে গেল রাজনীতিকদের বাসনা অনুযায়ী।
১৯৪৭ সালে ভারতভাগের পর ভারতের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি ছিল আরও নিদারুণ এবং বিপর্যস্ত। ব্রিটিশের প্রায় ২০০ বছরের উপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি পেয়ে ভারত দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ভারত ও পাকিস্তান। পাকিস্তানের আবার দুটি অংশ একটি উর্দুভাষী পশ্চিম পাকিস্তান অন্যটি বাংলাভাষী পূর্ববাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তান। এই ভারতভাগকে কেন্দ্র করে লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর দেশবদল; কলকাতা, বিহার, পাঞ্জাব, গুজরাট, লাহোর, রাওয়ালপিন্ডি, মুলতান প্রভৃতি শহরে ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা; দিল্লিতে রাজনীতিকদের ক্ষমতা দখলের লড়াই সেইসঙ্গে সাধারণ মানুষের অবর্ণনীয় অভাব, অনটন, দারিদ্র এবং বামপন্থী ও কংগ্রেসপন্থীদের রাজনৈতিক আন্দোলনের উত্তাল তরঙ্গের তলে টোকিও মিলিটারি ট্রাইব্যুনালের সংবাদ বা এই ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে একজন বাঙালি তথা এশিয়াবাসীর পক্ষে শ্বেতাঙ্গ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সরব বিজয়ের সংবাদটি একেবারেই তলিয়ে যায়। গণমাধ্যমেও গুরুত্বের সঙ্গে সংবাদটি আসেনি, আর এলেও এই নিয়ে চিন্তাভাবনা করার মতো দুদÐ অবসরও ছিল না সর্বস্তরের মানুষের। আন্তর্জাতিক রাজনীতি সচেতন কিছু আইনজীবী এবং কতিপয় রাজনীতিবিদ ছাড়া এই ঘটনার কথা জানার সুযোগ ছিল না।
ভারতীয় রাজনৈতিক জটিলতার কারণে টোকিও ট্রাইব্যুনালে বিচারপতি পালের ঐতিহাসিক ভূমিকার কথা কলকাতা তথা দিল্লিতে প্রচার লাভে প্রধান প্রতিবন্ধকতাই ছিল রুশপন্থী সমাজতন্ত্রীমনা কংগ্রেস পার্টি প্রধান রাজনীতিবিদ নবভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু বলে শোনা যায়। সমবয়সী ঘনিষ্ঠ বন্ধু নেহরুর সঙ্গে বিচারপতি পালের সদ্ভাব ছিল না বলে জানতে পারি বিচারপতি পালের পুত্র আইনজীবী প্রশান্ত কুমার পালের ভাষ্য থেকেই। ২০০৭ সালে কলকাতার ডোবার লেনে অবস্থিত তাঁর ছিমছাম একতলা বাসভবনে গিয়ে কিছু তথ্য সংগ্রহ করতে সমর্থ হই। তিনি খুবই আনন্দিত হয়েছিলেন যে একজন জাপান প্রবাসী বাংলাদেশী ৭০০০ হাজার মাইল দূর থেকে নমস্য বিচারপতি পালের খোঁজে তাঁর পুত্রের বাড়িতে এসেছিল বলে! তাঁর ভাষ্য থেকে জানা যায় যে, টোকিও ট্রাইব্যুনালে বিচারপতি পালের প্রদত্ত রায়টি মনোঃপূত ছিল না নেহরুর। নেহরু প্রত্যাশা করেছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মিত্রবাহিনী প্রধান আমেরিকার পক্ষে বিচারপতি পাল তাঁর রায় প্রদান করবেন! কিন্তু ন্যায়দন্ডের মূর্তপ্রতীক –একদা কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ বিচারপতি পাল যে নিরপেক্ষ রায়ই প্রদান করবেন সেটা ছিল নির্ধারিত বলাই বাহুল্য। এই রায়ের কারণে প্রধানমন্ত্রী নেহরু বিচারপতি পালকে তিরস্কারও করেছিলেন বলে কথিত আছে। শুধু তাই নয়, তাঁকে নানাভাবে বিব্রত, বিপর্যস্ত করার কথাও তাঁর ছেলে আমাকে বলেছিলেন। ফলে মানসিক বিপর্যয়ের ভেতর দিয়ে বিচারপতি পাল তাঁর বাকী জীবনটা কলকাতায় কাটিয়েছিলেন। কিন্তু অবদমিত সাহসের বরপুত্র বিচারপতি পাল একজন শান্তিবাদী কর্মীও ছিলেন মৃত্যু পর্যন্ত (১৯৬৭)। কলকাতায় ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন মুভমেন্ট এর শাখা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সে কথায় পরে আসছি।
তার আগে আমার কাছে একটা রহস্য এখনো অনুন্মুক্ত রয়ে গেছে অনেকের মতো, আর সেটা হল: কেন কলকাতা হাই কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি রাধাবিনোদ পালকেই টোকিও ট্রাইব্যুনাল কর্তৃপক্ষ তথা এঐছ (জেনারেল হেড কোয়ার্টার) প্রধান জেনারেল ডগলাস ম্যাক-আর্থার ১১ জন বিচারপতির অন্যতম একজন হিসেবে নিয়োগ দিলেন? তিনি কী তাঁর জীবনবৃত্তান্ত না জেনেই তাঁকে নিযুক্ত করেছিলেন এই আন্তর্জাতিক সামরিক আদালতে? যেখানে ভারতবর্ষ তখনো ব্রিটিশ শাসনের অধীনে দমনিত! সেখানে পরাধীন একটি দেশ থেকে একজন বিচারপতিকে কেন ট্রাইব্যুনাল কর্তৃপক্ষ নিয়োগ দেবেন কিছুতেই বোধগম্য নয়। নিশ্চয়ই এর পেছনে গভীর কোনো উদ্দেশ্য অথবা কারণ ছিল। কার্যকারণ বলতে তো একটা কথা আছেই।
অবস্থাগতিকে দুটি কারণকে চিহ্নিত করা যেতে পারে বলে মনে হয়:
প্রথম কারণ হচ্ছে, ইন্টারন্যাশনাল মিলিটারি ট্রাইব্যুনাল ফর দি ফার ইস্ট সংক্ষেপে টোকিও ট্রাইব্যুনাল যেহেতু আন্তর্জাতিক একটি বিচার তাই তাতে আন্তর্জাতিক আইনজ্ঞ বিচারপতি না থাকলে পরে তা সমালোচনার সম্মুখীন হবে। সুতরাং অন্ততপক্ষে একজন হলেও আন্তর্জাতিক আইনবিশেষজ্ঞ বিচারক নিয়োগ না দিলে নয়। কিন্তু তৎকালীন বিশ্বে আন্তর্জাতিক আইনবিশেষজ্ঞ খুব বেশি ছিলেন না বলেই প্রতীয়মান হয়। আর থাকলেও মিলিটারি ট্রাইব্যুনালে বসতে রাজি হননি কেউ। কারণ যথার্থ আইন বহির্ভূত মিলিটারি ট্রাইব্যুনাল আমেরিকায় শ্বেতাঙ্গ শক্তিধর রাজনীতিকরা শতাধিক বছর আগে থেকেই করে আসছেন, এটা আমেরিকার কালচারও বটে! কিন্তু এবার যেহেতু যুদ্ধাপরাধের বিচারটা বহির্বিশ্বের একটি দেশে অনুষ্ঠিত হচ্ছে সুতরাং এটা আন্তর্জাতিক মানদন্ডে না করলে মানইজ্জৎ খোয়ানোর ব্যাপারও আছে বলে কর্তৃপক্ষ অনুধাবন করেছিলেন। তাই আন্তর্জাতিক আইনজ্ঞ বিচারক খুঁজতে ভারতের দিকে তাকাতে হয়েছিল বিচারের আয়োজক মার্কিন জেনারেল ডগলাস ম্যাক-আর্থারকে। এক ঢিলে যাতে দুটি পাখি মারা যায় তাও তিনি চিন্তা করেছিলেন অথবা নিদের্শিত হয়েছিলেন বলে প্রতীয়মান হয়। যা আসলে দ্বিতীয় কারণ অর্থাৎ ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনরত ভারতীয়দেরকে সতর্ক করা বা আইওয়াশ করে দেয়া। অর্থাৎ স্বাধীনতা নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে পরিকল্পিত টোকিও ট্রাইব্যুনালের মতো শাস্তি তাদের ঘাড়েও চেপে বসতে পারে এই চিত্রটি দেখানো! বলা বাহুল্য, বিচারকারী মিত্রবাহিনীর তিনটি দেশের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদী গ্রেট ব্রিটেন অন্যতম।
কিন্তু শেষমেষ তা রক্ষা হয়নি। ভারতের স্বাধীনতাকে আটকে রাখা যায়নি। ধর্মের ঢোল আপনি বেজে ওঠার মতো ভুল অঙ্ক ধরেই এগিয়ে চলছিল টোকিও মিলিটারি ট্রাইব্যুনাল। আজন্ম স্বাধীনতাকামী, জাতীয়তাবাদী এবং শ্বেতাঙ্গবিরোধী বিচারপতি পালকে নিযুক্ত করাই ছিল মহাভুল, যাকে বলে গোড়াতেই গলদ। আর সেটা প্রথম থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন ট্রাইব্যুনালের অন্যতম ব্রিটিশ প্রতিনিধি বিচারক স্কটিশ অধিবাসী লর্ড ইউলিয়াম প্যাট্রিক। তিনি কিছুতেই বিচারপতি পালকে সহ্য করতে পারছিলেন না, কারণ বিচারপতি পাল ট্রাইব্যুনালের সত্যিকারের চেহারাটি ধরে ফেলেছিলেন। নানা রকম বাদপ্রতিবাদ করছিলেন। সাম্রাজ্যবাদীমনস্ক শ্বেতাঙ্গ প্যাট্রিক আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন এবং ব্রিটিশ সরকারকে চিঠি পর্যন্ত লিখেছিলেন পালকে সরিয়ে দেবার জন্য কিন্তু পারা যায়নি জেনারেল ম্যাক-আর্থারের কারণে। কেন? সে এক মহারহস্য! জেনারেল আর্থার চেয়েছিলেন, আন্তর্জাতিক একজন আইনজ্ঞ যদি বিচারে থাকেন তাহলে তাকে দিয়ে বিচার চালিয়ে নিয়ে উদ্দেশ্য মিটিয়ে ফেলা। কিন্তু এলোমেলো, অপরিপক্ক, অস্পষ্ট এবং জোরজবরদস্তিমূলক এই বিচারের নোংরা জল তাদের মুখেই পড়েছিল। ধর্মের ঢোলের মতো গোমর ফাঁস করে দিয়েছিলেন জেনারেল ম্যাক-আর্থার নিজেই।
অন্যদিকে, বিচারপতি পালও ট্রাইব্যুনালের হাবভাব দেখে –এটা যে জাপান তথা বিশ্বমানবতার বিরুদ্ধে বিরাট ষড়যন্ত্র এবং প্রতারণা তিনি তা ভালো করেই অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কারণ ১১ জন বিচারপতির মধ্যে ১০ জনই ছিলেন সাধারণ আইনজীবী না হয় ছোটখাটো আদালতের বিচারক অথবা মিলিটারি আইনের লোক –অবশ্যই আন্তর্জাতিক আইনজ্ঞ নন। এবং বিচারপতি পাল দেখলেন নির্দিষ্টভাবে কোনো আন্তর্জাতিক আইনকানুনও নেই যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য! কীসের ভিত্তিতে এই বিচার অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে–যুগপৎ বিস্মিত এবং ক্রোধান্বিত হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সুযোগ যখন হাতে এসেছেই তিনি সেটাকে যথাযথভাবেই ব্যবহার করতে দ্বিধাবোধ করেননি। প্রকৃতপক্ষে, বিচারপতি পালেরই জয় হয়েছে, পরাধীন এশিয়াবাসীর বিজয় চিহ্নিত হয়েছে তাঁর দীর্ঘ রায়ের মাধ্যমে। মানবতা, শান্তি এবং আইনের ক্ষেত্রে একটি সোনালি মাইলফলক তাঁর প্রদত্ত ভিন্নমতাবলম্বী সুদীর্ঘ ‘জাপান নির্দোষ রায়’।
বিচারপতিপুত্র প্রশান্তকুমার পালের ভাষ্য থেকে জানা যায়, জেনারেল ডগলাস ম্যাক-আর্থারের প্রতিনিধি নেদারল্যান্ডস এর আইনজ্ঞ বার্ট রোলিং (Bernard Victor Aloysius Roling) টোকিও ট্রাইব্যুনালের কমিটি গঠনের প্রাক্কালে ভারতে গিয়ে নেহরুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং ট্রাইব্যুনালের জন্য একজন বিচারপতি চান যিনি আন্তর্জাতিক আইনবিশেষজ্ঞ। কিন্তু নেহরু ভারতে তেমন কেউ নেই বলে তাঁকে অবহিত করেন। অথচ ১৯৩৭ সালে হেইগ শহরে অনুষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক আইন সম্মেলনে বিচারপতি পাল অন্যতম যুগ্ম-সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এই সংবাদ কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে সর্বোচ্চ ডিগ্রিপ্রাপ্ত একজন আইনজ্ঞ জওহরলাল নেহরু জানতেন না তা কি বিশ্বাসযোগ্য? তবে কি ব্যক্তিগত খ্যাতিজনিত ঈর্ষা নাকি রাজনৈতিক মতাদর্শের বশবর্তী হয়ে নেহরু তাঁর বন্ধু আন্তর্জাতিক আইনবিশেষজ্ঞ বিচারপতি রাধাবিনোদ পালের নামটি বলেননি বার্ট রোলিংকে তা গবেষণাসাপেক্ষ। নেহরু ছিলেন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নঘেঁষা সমাজতন্ত্রী আর বিচারপতি পাল ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী কট্টর জাতীয়তাবাদী। কমিউনিস্ট ও ন্যাশনালাস্টিদের বিরোধ চিরাচরিত।
যাহোক, বিফল মনোরথে আইনজ্ঞ বার্ট রোলিং স্বদেশে ফিরে যান। এরপর কোনো না কোনো সূত্র ধরে তিনি বিচারপতি পালের খোঁজ পান এবং আবার ভারত তথা কলকাতায় যান। আর এখানেই বুঝি ইতিহাস নড়ে উঠেছিল তার নতুন পাতা উল্টানোর তাগিদে। বিচারপতি পাল যেন এই সুযোগের প্রতীক্ষায় ছিলেন আকৈশোর থেকে। লুফে নেন এই সুযোগটি টোকিও মিলিটারি ট্রাইব্যুনালে অন্যতম বিচারপতি তথা ভারতীয় প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেবার জন্য। পেছন থেকে সহয়তা করেছিলেন পূর্বোল্লেখিত কলকাতা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি স্যার ডার্বি শায়ার। কেন? সেও এক মহারহস্য!
[hfe_template id=’81’]
আজকে টোকিও মিলিটারি ট্রাইব্যুনালের কথা অনেকেই জানেন। বিচারপতি পাল যে প্রথম থেকেই এই ট্রাইব্যুনালকে অস্বীকার করেছিলেন, বলেছিলেন বিচারের নামে প্রহসন, অভিহিত করেছিলেন ‘বিজিতের প্রতি বিজয়ীর বিচার’ বলে তার প্রমাণ তো বিচার শেষে মার্কিন সিনেটের উচ্চ সভায় আহুত হয়ে জেনারেল ডগলাস ম্যাক-আর্থারের স্বীকারোক্তি (৩রা মে, ১৯৫১) থেকেই প্রমাণিত। গণমাধ্যমের কল্যাণে বিশ্ববাসীও তাই জেনেছিল। অবশ্য বিচারপতি পাল ছাড়াও ফ্রান্সের বিচারপতি হেনরি বার্নাড এবং নেদারল্যান্ডস এর বিচারপতি বার্ট রোলিংও এই বিচারের কিছু দিক সম্পর্কে ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন। তাঁদেরকে প্রভাবিত করেছিল বিচারপতি পালের যৌক্তিক অভিমত ও মতামত। যে কারণে জেনারেল ম্যাক- আর্থারের টোকিও ট্রায়াল “ভুল বিচার” ছিল বলে স্বীকার করা ছাড়া আর অন্যপ্রকার উপায় ছিল না। তিনি আরও বলেছিলেন, অভিযুক্ত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জেনারেল তোজো হিদেকিসহ সকলেই নিজেদের ‘নিরাপত্তা’র কারণে যুদ্ধ করেছেন। ট্রাইব্যুনালে দাঁড়িয়ে একাই জেনারেল তোজো বারংবার দৃঢ়তার সঙ্গে উচ্চারণ করেছেন, তিনি আপন দেশ রক্ষার্থে যুদ্ধ করেছেন, আগ্রাসী যুদ্ধে নেতৃত্ব দেননি। তাহলে কেন জেনারেল ম্যাক-আর্থারের নেতৃত্বে মানবতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ, শান্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ; চীন, কোরিয়া, আমেরিকার বিরুদ্ধে আগ্রাসী যুদ্ধ করার অপরাধে অভিযুক্ত করা হল জাপানকে? কীসের বদলা বা প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল মিত্রশক্তি প্রধান আমেরিকা? এসবের উত্তর বিচারপতি পালের জ্ঞানগর্ভ রায়ের মধ্যে উল্লেখিত আছে। টোকিও ট্রাইব্যুনালের আড়াই বছরের সময়কালে ইম্পেরিয়াল হোটেলের একটি কক্ষে বসে বিগত ২০টি বছরের জাপানের ইতিহাসসহ নানা ধরনের বহু গ্রন্থাদি এবং তথ্যাদি ঘেঁটে সুদীর্ঘ রায় লেখেন যখন, তখন অন্যান্য বিচারপতিরা জাপানের যত্রতত্র ঘুরেবেড়িয়ে খাওয়াদাওয়া করছিলেন বলে কথিত আছে।
প্রকৃতপক্ষে, জেনারেল ম্যাক-আর্থার মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস. ট্রুম্যানের ইচ্ছেকেই বাস্তবায়িত করতে বাধ্য ছিলেন। ট্রুম্যান ছিলেন তাঁর আগের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্টের অনুসারী। ইহুদি জায়োনিস্ট ফ্রাঙ্কলিন ডিলানো রুজভেল্ট, এলগার হিস, হ্যারি ডেক্সটার হোয়াইটসহ আরও ইহুদি এবং প্রভাবশালী রাশিয়ান কমনিটার্ন তথা কমিউনিস্ট এজেন্টদের ষড়যন্ত্রের ফসলই হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, আণবিক বোমা তৈরির ম্যানহাটেন প্রজেক্ট এবং টোকিও ট্রাইব্যুনাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাঁধিয়েইছিল ইহুদি জায়োনিস্টরা। রাষ্ট্রবিহীন বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা ‘ডিয়াসপোরা’ ইহুদিরা একটি নিজস্ব রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে বহু বছর ধরেই ষড়যন্ত্রে মেতেছিল। বিশেষ করে যুদ্ধে জাপানকে টেনে আনা এবং সাজানো বিচারের মাধ্যমে তাকে অপরাধী করে পরবর্তী বিশ্বজয়ের টার্গেটই করেছিল তাঁরা। আর এই ষড়যন্ত্রে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইহুদি বংশোদ্ভ‚ত ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট। পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস. ট্রুম্যান ছিলেন ইহুদি তথা জায়োনিস্টদের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। তাঁর নেতৃত্বেই জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে বিশ্বের প্রথম আণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। পোলান্ডে জন্ম ইহুদি পদার্থ বিজ্ঞানী পরবর্তীকালে আমেরিকায় আশ্রিত ড.ওপ্পেন হাইমার ছিলেন আণবিক বোমা তৈরির জনক। আণবিক বোমা তৈরির প্রকল্প গ্রহণ করার পেছনে ইন্ধন জুগিয়েছিল জার্মানিতে জন্ম পরবর্তীকালে আমেরিকায় আশ্রিত নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ইহুদি পদার্থ বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের প্ররোচনা। ইহুদিদের পরিকল্পিত আণবিক বোমা এবং টোকিও ট্রাইব্যুনালের সুদূর প্রসারী ফলাফলই হচ্ছে ফিলিস্তিনিদের হটিয়ে দিয়ে তাদের দেশে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, য়োরোপে ন্যাটো জোট গঠন, বিশ্বকে দুভাগে যথাক্রমে পুঁজিবাদ ও সাম্যবাদে বিভক্ত করে শাসন ও শোষণ। এক্ষেত্রে ১৯৫০ সালে আমেরিকার এফবিআই কর্তৃক উদঘাটিত সোভিয়েত কমিনটার্ন গুপ্তচরদের ভয়ঙ্কর ‘ভেনোনা প্রজেক্ট’ পাঠ করলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং টোকিও ট্রাইব্যুনাল সম্পর্কিত ষড়যন্ত্রের স্বরূপ বোঝা যায়। আমেরিকার সবচেয়ে শক্তিশালী গুপ্ত রাজনৈতিক জোট ‘ডিপ স্টেট’ এর অদৃশ্য ভূমিকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংগঠনের পেছনে ছিল না এমন ধারণা করাও অস্বাভাবিক কিছু নয়।
টোকিও ট্রাইব্যুনাল নিয়ে জাপানে ও অন্যান্য দেশে বেশ কিছু বই ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। এই বিচারকে বিশ্লেষণ করতে গেলে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন। আজকে কয়েকটি বিষয় নিয়ে সংক্ষিপ্তাকারে কিছু বলাই সমীচিন।
প্রথমত: প্রাচ্য থেকে এই বিচারের রায়কে প্রথম এবং শক্তিশালী রাজনৈতিক একটি প্রতিবাদ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। কেননা:
১. জাপানকে সাম্রাজ্যবাদী, আগ্রাসনবাদী, গণহত্যাকারী, শান্তিবিরোধী বলে মিত্রশক্তি (আমেরিকা, বৃটেন এবং নেদারল্যান্ডস) যেভাবে অপরাধী চিহ্নিত করেছে তার প্রতিত্তোরে এশিয়ায় অত্যাচারী সাম্রাজ্যবাদী, শান্তিহরণকারী এবং গণহত্যাকারী শ্বেতাঙ্গ শক্তি ব্রিটিশ, ওলন্দাজ, ফরাসি, স্পেইন, পর্তুগিজ যে প্রথম ছিল তা মুক্তকণ্ঠে অতিসাহসের সঙ্গে বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়েছিলেন বাঙালি বিচারপতি রাধাবিনোদ পাল।
২. যে কারণে এশিয়ায় গণহত্যার জন্য জাপানকে নাৎসির সঙ্গে তুলনা করেছে মিত্রশক্তি, একই কারণে হিরোশিমা, নাগাসাকিতে আণবিক বোমা নিক্ষেপ করে নিষ্পাপ লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করার জন্য আমেরিকারও বিচার তিনি দাবি করেছেন।
৩. যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার জন্য যেখানে কোনো আন্তর্জাতিক আইনই ছিল না, তড়িঘড়ি করে নিজেরা আইন তৈরি করে জাপানি যুদ্ধাপরাধী বলে কথিতদেরকে বিচার করেছে তা ছিল সম্পূর্ণ অবৈধ এবং প্রহসন। তাঁর এই সুচিন্তিত রায়ের কারণেই যুদ্ধাপরাধীদের জন্য আন্তর্জাতিক আইন প্রণয়নে জাতিসংঘ পরে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। যুদ্ধের পর জাতি সংঘের আন্তর্জাতিক ল কমিশনে দু-দুবার নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন যথাক্রমে ১৯৫৮ এবং ১৯৬২-৬৭ সাল পর্যন্ত, যা এক বিরল সম্মান একমাত্র বাঙালি হিসেবে তিনিই অর্জন করেছিলেন।
দ্বিতীয়ত: এশিয়া তথা বিশ্বব্যাপী প্রথম শান্তিবাদী আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল টোকিও ট্রাইব্যুনালের কারণেই। আণবিক বোমা বিধ্বস্ত হিরোশিমাকে কেন্দ্র করে শান্তিবাদী আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিলেন কতিপয় জাপানি বুদ্ধিজীবী যেমন খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ ও আধুনিক প্রকাশনার পথিকৃৎ শিমোনাকা ইয়াসাবুরোও, নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী ড.ইউকাওয়া হিদেও, সাম্যবাদী ও শান্তিবাদী নেতা কাগাওয়া তোয়োহিকো, সাংবাদিক ও রাজনীতিবিশেষজ্ঞ তানাকা মাসাআকি প্রমুখ। ট্রাইব্যুনালের সময় ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে পরিণত হওয়া পুত্রতুল্যশিষ্য সাংবাদিক, লেখক ও রাজনীতি গবেষক তানাকা মাসাআকি, হেইবোনশা পাবলিশারের কর্ণধার শিমোনাকা ইয়াসাবুরোও প্রমুখের আমন্ত্রণে বিচারপতি পাল দ্বিতীয়বার জাপানে আসেন হিরোশিমা শহরে ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন মুভমেন্ট কর্তৃক আয়োজিত এশিয়ার প্রথম শান্তি সম্মেলনে ১৯৫২ সালে। এতে তিনি সভাপতিত্ব করেন। এই সম্মেলনে আমেরিকা, য়োরোপ, আফ্রিকা, এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া থেকে শতাধিক প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন। তাঁদের সম্মুখে তিনি উচ্চকণ্ঠে বলেন, “হিরোশিমা, নাগাসাকিতে আণবিক বিস্ফোরণের কৈফিয়তটা কী? জাপানে বোমা ফেলার কারণ কী ছিল? সেইসময় রাশিয়ার মাধ্যমে জাপান আত্মসমপর্ণের চেষ্টা কি করেনি? কেন সেটা আমলে না নিয়ে এমন নিষ্ঠুর বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটানো হল? একই শ্বেতাঙ্গ জাতির দেশ জার্মানিতে বোমা না ফেলে কেন জাপানে ফেলা হল? সেখানে জাতিগত বৈষম্য কি ছিল না? এদ্বৎসত্তে¡ও আজ পর্যন্ত তাঁদের পক্ষ থেকে দুঃখজনক একটি বাক্যও শুনতে পাইনি আমরা! তাঁরা তাঁদের হাত এখনো পরিষ্কার করেনি। এই রকম অবস্থায় কীভাবে তাঁদের সঙ্গে আমরা শান্তির কাজ করব?”
এই সফরে তিনি জাপানের একাধিক জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, সংবর্ধনা সভা, যুদ্ধে স্বজনহারানো জাপানিদের ‘নিহোন ইজোকুকাই’ সংগঠনের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে এবং ইম্পেরিয়াল হোটেলে আয়োজিত সংবর্ধনা সভায় আইনজীবীদের সমাবেশে তাঁর প্রদত্ত ‘জাপান নির্দোষ রায়’ সম্পর্কে সুদৃঢ় কণ্ঠে নিরপেক্ষতা দাবি করেন। তিনি বলেন, “আমি সমবেদনার বশবর্তী হয়ে জাপানের পক্ষে রায় প্রদান করিনি। আইনের সত্যতা রক্ষার্থে সচেষ্ট থেকে নিরপেক্ষ রায় দিয়েছি। আমার রায় নিয়ে গবেষণা করুন। আমার রায় নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির কোনো কারণ নেই।” যদিওবা বিশিষ্ট মনস্তাত্তি¡ক এবং সংস্কৃতি সমালোচক আশিস নন্দী বিচারপতি পালের রায় নিয়ে পান্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা করেছেন এবং উক্ত রায়ে পালের অন্তর্নিহিত ভারতীয় ঐতিহ্য এবং আফ্রো-এশিয় জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রভাব পড়েছিল বলে মতামত ব্যক্ত করেছেন। এমন অভিমত কোনো কোনো জাপানি গবেষকের ক্ষেত্রে দেখা যায়।
বিচারপতি পাল এই ভ্রমণের সময় যুদ্ধের পর জাপান বিগত কয়েক বছরে বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে যা হতাশাব্যঞ্জক বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। ভুল ইতিহাস বিদ্যালয়ের কোমলমতী ছাত্রছাত্রীদেরকে পড়ানো হচ্ছে বলে ক্রোধান্বিত হয়েছিলেন। তখন তিনি ‘জাপানিরা জাপানে ফিরে এসো’ বলে জাপানিদেরকে আহবান জানান। হিরোশিমা জাদুঘরের সম্মুখে স্থাপিত স্মৃতিফলকে লিখিত একটি বাণীর অর্থ তাঁকে থমকে দেয়: [শান্তিতে ঘুমাও। ভুলের পুনরাবৃত্তি আর ঘটতে দেব না।]। অর্থটি ব্যাখা করে তাঁকে শোনান দোভাষী ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের জাপান প্রবাসী অন্যতম প্রধান বিপ্লবী এএম নায়ার। ব্যাখ্যা শুনে বিস্ময়ের সঙ্গে, গভীর পরিতাপের সঙ্গে বিচারপতি বলেন, “যারা বোমা ফেলেছে ক্ষমা তাঁদেরকে চাইতে হবে, তাঁরা ভুল করেছে। জাপানিরা ক্ষমা চাইবে কেন? এটা সঠিক হয়নি। ভুল ইতিহাস শেখানো উচিত নয়।”
[hfe_template id=’81’]
হিরোশিমা জাদুঘরের অনতিদূরে অবস্থিত হোনশোওজি বৌদ্ধমন্দিরে যুদ্ধে নিহত মানুষের আত্মার শান্তি কামনা করে একটি স্মৃতিফলক স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়। এই মন্দিরের প্রধান পুরোহিত কাকেই য়োশিআকির অনুরোধে একটি বাণী লিখে দেন বাংলা ও সংস্কৃতভাষায় বিচারপতি পাল। ৬ আগস্ট ১৯৪৫ সালের সকাল ৮:১৫ মিনিটে নিক্ষিপ্ত আণবিক বোমার আঘাতে এই মন্দিরসহ সমগ্র হিরোশিমাতে লক্ষাধিক নিহত মানুষের আত্মার শান্তির উদ্দেশে তিনি কাগজে যে বাণীটি লিপিবদ্ধ করেন সেটি নিম্নরূপ:
নির্যাতিত এশিয়ার মুক্তিযজ্ঞে
মন্ত্রদীক্ষিত স্বর্গত আত্মার
শান্তি কামনায়
--রাধাবিনোদ পাল
৬ নভেম্বর, ১৯৫২
হোনশোওজি মন্দির চত্বরে স্থাপিত পাথুরে স্মারক ফলকটি খোদাইকৃত বিচারপতি পালের বাণী নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নীরবে বিগত প্রায় ৬৯ বছর ধরে। প্রতি বছর অনেক বাঙালি ও ভারতীয় হিরোশিমা শান্তি জাদুঘর পরিদর্শনে যান কিন্তু জানেন না এই ফলকটির কথা।
সেটা আজও যত্নের সঙ্গে সংরক্ষিত হচ্ছে অধিকাংশ জাপানিরাও তা জানে না। দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত বন্দরনগরী ফুকুওকা শহরে অবস্থিত গণমুক্তি আন্দোলনের প্রবল প্রভাবশালী নেতা, রাজনীতিবিদ, গুপ্ত রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ‘গেনয়োওশা’র প্রতিষ্ঠাতা, চীনা বিপ্লবী ড.সান-ইয়াত সেন, মহাবিপ্লবী রাসবিহারী বসু, বিপ্লবী হেরম্বলাল গুপ্ত প্রমুখের রাজনৈতিক আশ্রয়দাতা গুরু তোওয়ামা মিৎসুরুর সমাধিতে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন। প্রায় প্রতিদিনই তিনি কোথাও না কোথাও বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিচ্ছিলেন, সমাবেশে তাঁর রায় নিয়ে গবেষণা করার আহবান জানাচ্ছিলেন–এই উপলক্ষণকে গণমাধ্যম তখন ‘পা-রু ছেনফুউ’ বা ‘পালবায়ু’ বলে আখ্যায়িত করেছিল। একাধিকবার তিনি যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। টোকিওর সুগামো প্রিজনেও তিনি গিয়েছিলেন যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত আসামী প্রাক্তন প্রধান মন্ত্রী জেনারেল তোজো হিদেকিসহ অন্যান্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য। তোজো তাঁকে একটি হাইকু লিখে উৎসর্গ করেছিলেন। ফাঁসিতে মৃত্যুবরণের পর জেনারেল মাৎসুই ইওয়ানের শোকানুষ্ঠানেও উপস্থিত হয়েছিলেন বিচারপতি পাল।
বিচারপতি পালের স্বর্গবাসী সহধর্মিণীর পবিত্র স্মৃতির সম্মানার্থে বন্ধু শিমোনাকা ইয়াসাবুরোও টোকিওর হোনকানজি বৌদ্ধমন্দিরে একটি শোকসভার আয়োজন করেছিলেন তানাকা মাসাআকির কাছ থেকে একটি ঘটনা জানতে পেরে। তানাকা জানতে পেরেছিলেন, অসুস্থ প্রিয়তমা পত্নীকে পাল বলেছিলেন তাঁকে নিয়ে জাপানে আসবেন, ঘুরে বেড়াবেন। কিন্তু তা আর হয়নি, ১৯৪৮ সালে ট্রাইব্যুনাল শেষে স্বদেশে ফিরে গেলে স্ত্রীর মৃত্যু হয়। অথচ এই মহীয়সী স্ত্রীর অনুরোধেই তিনি ট্রাইব্যুনালে ফিরে এসেছিলেন। জানা যায় যে, বিচার চলাকালীন বিচারপতি পাল স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়ার জরুরি সংবাদ পান মেয়ের কাছ থেকে ফলে তৎক্ষণাৎ কলকাতায় ফিরে যান স্ত্রীকে সেবা করার জন্য। কিন্তু মানবতাবাদী সহধর্মিণী তাঁকে বলেন, “আজকে জাপানের ভাগ্য বিচারাধীন, তুমি গিয়ে তার জন্য লড়াই করো। আমার জন্য চিন্তা করো না। তুমি ফিরে না আসা পর্যন্ত আমি মরবো না।”
বিচারপতি পাল জাপানকে এত ভালোবেসেছিলেন যে এই দেশে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত কামনা করেছিলেন বলে আমাকে একবার বলেছিলেন প্রাক্তন প্রধান মন্ত্রী জেনারেল তোজো হিদেকির নাতনি তোজো ইউকো সান, বিশিষ্ট ইতিহাস গবেষক, গ্রন্থকার ও পরিবেশবাদী কর্মী। তাঁর সঙ্গে ছিল আমার গভীর বন্ধুত্ব। ২০১৩ সালে দূরারোগ্য ব্যাধিতে ৭৪ বয়সে ইহলোক ত্যাগ করেন। বিচারপতি পালকে তিনি গভীরভাবে শ্রদ্ধা করতেন অগনতি জাপানি নাগরিকের মতো, ২০০০ সালে প্রথম সাক্ষাতেই তিনি যখন জানতে পারলেন আমি পাল হানজি’র (হানজি>বিচারপতি) জন্মভূমি তথা বাংলাদেশের লোক তখন বিনম্র শ্রদ্ধার সঙ্গে সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, পা-রু হানজি ওয়া নিহোনজিন নো ইনোচি নো অনজিন দেসু য়ো!, অর্থাৎ, বিচারপতি পাল হচ্ছেন জাপানিদের জীবনদাতা!
হিরোশিমা শান্তি সম্মেলন চলাকালে তাঁর রায়টি এই প্রথম জাপানি ভাষায় প্রকাশ করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নোবুসুকে কিশি ১৯৫২ সালে। তারপর কলকাতায় ফিরে গিয়ে ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন মুভমেন্টের একটি শাখা কলকাতায় উন্মুক্ত করে শান্তির পক্ষে কাজ করে যান মৃত্যু পর্যন্ত (১০.১.১৯৬৭)।
১৯৬৬ সালে শেষবারের জন্য বিচাপরপতি পাল জাপানে আগমন করেন সম্রাট হিরোহিতোর কাছ থেকে তাঁর অবদানের মূল্যায়নস্বরূপ রাষ্ট্রীয় পদক ‘পার্পল রিবন’ গ্রহণ করার জন্য।
তৃতীয়ত: পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদকে অনুসরণ, অনুকরণ এবং বিচারের রায় গ্রহণে জাপানের মহাভুল ছিল বলে বিচারপতি পাল মনে করেছেন। চীনে ‘নানকিং গণহত্যা’র জন্য জাপানকে কঠোর নিন্দা জানান। যদিও তখন নানকিং গণহত্যা অনুষ্ঠিত হয়েছিল কিনা সে বিষয়ে জরিপ চলছিল, যথেষ্ট গবেষণাও হয়নি তখন। সাম্প্রতিককালে যেমন হচ্ছে এবং নানকিংএ অবস্থিত তখনকার শ্বেতাঙ্গ বিদেশিদের সঙ্গে মিলেমিশে যৌথভাবে জেনারেল চিয়াং কাইশেকের অনুসারীরা বিপুল প্রপাগান্ডা, মিথ্যে সংবাদ প্রচার করছিল যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এবং অনেক জাল আলোকচিত্রর সত্যতা পাওয়া গেছে যা তৎকালীন দেশ-বিদেশের সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল। তথাপি, বিচারপতি পালের রায়ে মেইজি যুগ (১৮৬৮-১৯১২) থেকে শোওয়া যুগের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯২৬-১৯৪৫) পর্যন্ত পাশ্চাত্য শ্বেতাঙ্গ সাম্রাজ্যবাদকে অনুসরণ ছিল জাপানের জন্য দুর্বল দিক। শুধু তাই নয়, টোকিও ট্রাইব্যুনালের রায়কে মেনে নিয়ে জাপান মহাভুলও করেছে এটাও সত্য। হিরোশিমা জাদুঘরের প্রাঙ্গণে স্থাপিত স্মৃতিফলকটির বাণীটিই তার বড় প্রমাণ। সঠিক ইতিহাস জাপান সরকার তার শিশু এবং তরুণ প্রজন্মকে আদৌ শেখানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেনি আজ পর্যন্ত। ফলে যুদ্ধপূর্ব ও পরবর্তী ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জাপানিরা কিছুই জানে না। যে কারণে আজকে চীন ও দুই কোরিয়ার বিষ্দোগারের শিকার হচ্ছে জাপান। বিপুল খেসারত দিতে হচ্ছে সঠিক ইতিহাস না পড়ানো, না শেখানোর জন্য প্রজন্মের পর প্রজন্মকে। ইতিহাস শিক্ষা তাই কতখানি গুরুত্বপূর্ণ চলমান জাপান-চীন-কোরিয়ার নাজুক সম্পর্ক থেকে সহজেই বোধগম্য।
উপসংহার:
জাপানের সঙ্গে বিচারপতি পালের ভাগ্যবন্ধন অবিচ্ছিন্ন। ২০১৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর তারিখের দৈনিক সানকেইশিম্বুন পত্রিকায় আমেরিকার প্রভাবশালী সংবাদপত্র দৈনিক নিউ ইয়র্ক টাইমস এর প্রাক্তন টোকিও ব্যুরো প্রধান ব্রিটিশ নাগরিক হেনরি এস. স্টকস এক সাক্ষাৎকরে টোকিও ট্রাইব্যুনালকে ‘ফুকুশুউ গেকি’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বিচারপতি পালের রায়কেই সমর্থন করেছেন। বিগত ৫০ বছর ধরে জাপানে বসবাস করে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। যদিওবা তরুণকালে আর দশজন শ্বেতাঙ্গের মতো তিনিও এই উক্ত ট্রাইবুন্যালকে সঠিক মনে করেছিলেন কিন্তু বহু বছর ধরে জাপানে বসবাস করার ফলে আজকে তাঁর চোখে ধরা পড়ছে জাপানের আসল ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং জাপানিদের শান্তিবাদী চিন্তাচেতনা। জাপান যে এশিয়ায় আগ্রাসী অভিযান চালায়নি, স্বেচ্ছায় গণহত্যা সংঘটিত করেনি এটা এখন দিনের আলোর মতো সুস্পষ্ট। তাঁর এই ‘ফুকুশুউ গেকি’ বা ‘প্রতিশোধ-প্রহসন’ মন্তব্যটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু টোকিও ট্রাইব্যুনাল সম্পর্কিত জাপানিদের ইতিহাসভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং মিত্রশক্তি কর্তৃক প্রদত্ত রায়ের প্রতি নতিস্বীকারজনিত পররাষ্ট্র নীতি আদৌ সন্তোষজনক নয় বলে তিনি সমালোচনা করেছেন। প্রতিশোধমনা বিজয়ীর বিচারের মতো এই বিচারে প্রদত্ত শান্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ, মানবতাবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং চীনে গণহত্যা সংঘটনের জন্য যেভাবে জাপানকে অবৈধভাবে অপবাদ দিয়ে নির্মমভাবে বিদ্ধ করেছে সেই অপবাদ থেকে বেরিয়ে না এলে নয় বলে তিনি মন্তব্য করেন।
এরকমভাবে বিশ্বব্যাপী বহু শ্বেতাঙ্গ তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করেছেন বিগত দশকগুলোতে। আমেরিকা, বৃটেন, রাশিয়া, জাপানসহ নানা দেশে নতুন নতুন তথ্য প্রকাশিত হচ্ছে সরকারিভাবে ৫০-৬০ বছর ধরে নিষিদ্ধ হিমাগারে হিমায়িত থাকার পর। প্রদর্শনীতে বা গ্রন্থাকারে উন্মুক্ত তথ্যাদি থেকে সুস্পষ্টভাবেই বোঝা যাচ্ছে যে জাপান নাৎসি জার্মানিদের মতো আদৌ যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত করেনি, পরিস্থিতিগত কারণে হতাহত হয়েছে শত্রু-মিত্র দুপক্ষের বহু সেনা এবং নিরীহ মানুষ, যা যুদ্ধের সময় সংঘটিত হয়ে থাকে সাধারণত। জাপান কখনোই শান্তির বিরুদ্ধে, মানবতাবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেই জড়াতে চায়নি জাপান। জড়ানো হয়েছে গভীর-গভীর ষড়যন্ত্র করে। তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ জাপানের কাছে প্রেরিত ভয়ঙ্কর ‘ভেনোনা প্রজেক্টে’র নকল ‘হাল নোট’, যেটা ছিল আমেরিকার তখনকার স্বরাষ্ট্র সচিব কর্ডেল হাল (Cordell Hall) স্বাক্ষরিত মূল নোটের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। কাজেই কুখ্যাত ‘হাল নোট’ যা জাপানের আত্মসম্মানে আঘাত দিয়েছিল প্রচÐভাবে সেটি ছিল নকল হাল নোট। বিচারপতি পাল এই তথ্য জানতেন না, তাঁর প্রদত্ত রায়ের পরে এই তথ্য উদঘাটিত হয়েছে ১৯৫০ সালে। জাপান ১৯৪১ সালের ৭ই ডিসেম্বর হাওয়াইই দ্বীপে অবস্থিত আমেরিকার নৌসেনা ঘাঁটি ‘পার্ল হার্বার’ আক্রমণ করেছিল মূলত এর পেছনে ছিল আমেরিকার গভীর-গভীর ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনা। যা এখন গবেষণার মাধ্যমে জানা যাচ্ছে। অর্থাৎ আমেরিকা সুকৌশলে এমন ফাঁদ পেতেছিল যাতে করে জাপানের দিক থেকে বন্দুকের প্রথম ‘গুলি’টা বেরিয়ে আসে, তাহলে জাপানকে সহজে ‘আগ্রাসনের’ জন্য দায়ী করা যাবে এবং আমেরিকা তৎক্ষণাৎ শত্রু জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে। অথচ জাপান আক্রমণের আগেই যুদ্ধ ঘোষণাপত্র পাঠিয়েছে আমেরিকাস্থ জাপানি রাষ্ট্রদূতের কাছে। সেই ঘোষণাপত্র জাপানি রাষ্ট্রদূত আমেরিকার সরকারের কাছে পাঠিয়েছেন পার্ল হার্বার আক্রমণের এক ঘণ্টা পর। এই রহস্যের সমাধান আজও হয়নি। তথাপি জাপান যুদ্ধে জড়িয়েছে বিধায় নিজের আত্মরক্ষার্থে যুদ্ধ করা ছাড়া উপায় ছিল না, উপায় ছিল না জ্বালানি ও খাদ্যের জন্য এশিয়ার দেশগুলোকে দখল করা ছাড়া। এবং এটাই সত্য যা বিচারপতি পালের রায় এবং মার্কিন জেনারেল ডগলাস ম্যাক-আর্থারের স্বীকারোক্তিতে প্রমাণিত হয়েছে। (বিস্তারিত জানা যাবে আমার লিখিত “জাপানের শেষ সামুরাই: তোজো হিদেকি” প্রবন্ধে [জানা অজানা জাপান ২য় খÐ, ২০০৯।])
বিচারপতি পালের ‘জাপান নির্দোষ রায়’ আজও জাপান তথা এশিয়ার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ রক্ষাকবচ। তিনি তাঁর সুদীর্ঘ রায়ে কাউকেই শত্রæ বলেননি, শত্রæ হওয়ার জন্য আহবানও জানাননি। তাই সময় এসেছে আজকে তাঁর রায়টি নিয়ে গবেষণা এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষাদানের। এশিয়ায় বর্তমানে নতুন সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র এনার্জি-বুভুক্ষু চীনের যে আগ্রাসী রুদ্ররূপ আমরা দেখতে পাচ্ছি তা শান্তির জন্য মহাহুমকিস্বরূপ। এই অনাকাক্সিক্ষত উত্থিত শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হলে শান্তিবাদী বিচারপতি পালের মহান রায়টিই যে একমাত্র সাহস এবং ভরসা তা আর না বললেও চলে। জাপানের বিশ্ববিদ্যালয়সহ এশিয়ার অন্যান্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, হিরোশিমা-নাগাসাকি এবং টোকিও ট্রাইব্যুনালকে কেন্দ্র করে গবেষণা ও উচ্চশিক্ষার বিভাগ উন্মুক্ত করা জরুরি বলে মনে করি।
যুদ্ধহীন শান্তিময় ও সমৃদ্ধ সমাজ গড়ার লক্ষ্যে সত্য ইতিহাসকে জানতে হবে–আর তাই বিচারপতি পালের রায় পাঠের বিকল্প নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির ৭৬তম স্মরণবর্ষে তাঁকে জানাই গভীর গভীর শ্রদ্ধা।
[hfe_template id=’81’]
পুনশ্চ:
বিশ্বখ্যাত ন্যায়দন্ডের মূর্তপ্রতীক, অমিত সাহসী যে মহান বাঙালি বিচারপতি রাধাবিনোদ পাল, তাঁকে কিন্তু আজ পর্যন্ত অবহেলাভরে কোনোদিন সম্মান দেয়নি ভারত সরকার। ১৯৫৭ সালে ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন মুভমেন্ট কর্তৃক কিয়োতো শহরে আয়োজিত শান্তি সম্মেলনে অতিথি হয়ে এসেছিলেন বিচারপতি পালের পুরনো বন্ধু প্রধান মন্ত্রী জওহরলাল নেহরু কিন্তু তিনি বিচারপতি পাল সম্পর্কে একটি কথাও বলেননি। আর বাংলাদেশ তো তাঁর নামই জানে না! ভারতবাসীর অবহেলিত আর বাঙালির অজ্ঞাত সেই মানুষটির সম্মান ও মর্যাদা আজ জাপানে পর্বতসমান। তাঁর প্রদর্শিত পথ ও শিক্ষাকে বর্তমান ও অনাগত প্রজন্মকে আলোকিত করার লক্ষ্যে ১৯৭৪ সালে কানাগাওয়া-প্রিফেকচারের হাকানো নামক জায়গায় স্থাপিত হয়েছে ‘পাল-শিমোনাকা স্মারক জাদুঘর’ যা ভারতীয় বা বাঙালি জানেন বললেই চলে। ১৯৯৭ সালে কিয়োতো শহরের হিগাশিয়ামা রিয়োজান নামক স্থানে শোওয়া নো মোরি উদ্যানে এবং ২০০৫ সালে টোকিওর কেন্দ্রস্থল কুদানশিতা শহরে অবস্থিত শিন্তোও ধর্মীয় মন্দির ইয়াসুকুনি জিনজার প্রাঙ্গণে দুটি স্মৃতিফলক স্থাপন করে জাপান-বাংলা মৈত্রী বন্ধনকে আরও সুদূরপ্রসারী করেছেন জাপানি নেতৃবৃন্দ। প্রতিষ্ঠা করেছেন শান্তিবাদের অনন্য এক দৃষ্টান্ত।

প্রবীর বিকাশ সরকার
জন্ম ১৯৫৯ সালে। সাহিত্যচর্চার সূচনাকাল ১৯৭৬। ১৯৮৪ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে স্নাতকোত্তর অধ্যয়নরত থাকাকালীন জাপান গমন।
১৯৯১ সালে জাপানে প্রথম বাংলা ম্যাগাজিন ‘মাসিক মানচিত্র’ পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক। ২০০৩ সালে প্রকাশ করেন পরীক্ষামূলক ত্রৈমাসিক মিনি কাগজ অন্যচিত্র। ১৯৯৪ সালে গঠিত মুক্তচিন্তা ও সৃজনশীল পাঠচক্র ‘আড্ডা টোকিও’র প্রতিষ্ঠাতা পরিকল্পক। ১৯৯৮ সালে গঠিত ‘সাংবাদিক-লেখক ফোরাম জাপান’ এর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। বর্তমানে য়োকোহামাস্থ ‘জাপান-বাংলা অ্যাসোসিয়েশন’ এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক। এছাড়া কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত ‘ভারত-জাপান সংস্কৃতি কেন্দ্র’ এর সঙ্গে তিনি সংশ্লিষ্ট। ২০০৪-৫ সালে জাপানের প্রাচীন তাকুশোকু বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি গবেষক হিসেবে যোগদান । লিখছেন ‘ইতিহাস আছে ইতিহাসে নেই’, ‘জাপানে রবীন্দ্রচিহ্নের সন্ধানে’ গবেষণামূলক ইতিহাসগ্রন্থ।
প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ: উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে (রাজনৈতিক ছড়া), মানচিত্র পাবলিশার্স, জাপান, ১৯৯৫। অবাক কান্ড (শিশুতোষ ছড়া), বাংলাদেশ শিশু একাডেমী, ঢাকা, ২০০২। তালা (উপন্যাস), স্বরব্যঞ্জন, ঢাকা, ২০০৫। জানা অজানা জাপান (প্রবন্ধ, ১ম খন্ড), মানচিত্র পাবলিশার্স বাংলাদেশ, ২০০৮। জানা আনজানা জাপান (হিন্দি), দেশ প্রকাশন, দিল্লী, ভারত, ২০০৮। জানা অজানা জাপান (প্রবন্ধ, ২য় খন্ড), মানচিত্র পাবলিশার্স বাংলাদেশ, ২০০৯। জাপানের নদী নারী ফুল (প্রবন্ধ), দশদিক, বাংলাদেশ, ২০০৯। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং জাপান: শতবর্ষের সম্পর্ক (প্রবন্ধ), বিবেকবার্তা, জাপান, ২০১১। Rabindranath Tagore: India-Japan Cooperation Perspectives (Collection of Essays), India Center Foundation Japan, 2011.