আল মাকসুদ
কবি ও গবেষক
ইতিহাসের আলো-আঁধার
জালালুদ্দিন মুহাম্মদ আকবর (১৫৪২-১৬০৫) মোগল সম্রাট হিশেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ৯৬৩ হিজরি, রবিউসসানি, শুক্রবার। গ্রেগরিয়ান (খ্রিষ্ট্রীয়) ক্যালেন্ডার অনুযায়ী সেটি ছিল ১৫৫৬, ১১ মার্চ (মতান্তরে ১০ মার্চ। আবার ৫ নভেম্বর, এ তথ্যটিও কোনো কোনো আলোচনায় পাওয়া যায়; কিন্তু সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে ১০ কিংবা ১১ মার্চকে)। সম্রাটের বয়স তখন ১৪। বাদশাহ মানেই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব―বয়স যেমনই হোক। তিনি মান্য সকলের কাছে। কেননা তিনি একই সঙ্গে রাজ্যের সকল বিষয়ের অভিভাবক ও অধিকর্তা। বংশকৌলিন্য এবং প্রতিবেশ এ শ্রেণির মানুষকে মহীয়ান করে। তাঁদের প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব কিংবদন্তিতুল্য সবসময়ই। আকবরও ব্যতিক্রম নন; বরং অন্যদের চেয়ে প্রজ্ঞায়, রণকুশলতায়, দূরদর্শিতায় এবং সেক্যুলার চিন্তায় প্রাগ্রসর বোধের নৃপতি হিশেবে খুব দ্রæতই খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন। সম্রাট সাম্রাজ্য বিস্তারে মনোযোগী হবেন―সেই-ই তাঁর প্রধান সামরিক গুণ।
হয়েও ছিলো তাই। মোগল সাম্রাজ্য বিস্তৃতি লাভ করলে ‘বাংলা’ হয়ে ওঠে একটি বৃহৎ সুবা (সুবে/সুবাহ) বা প্রদেশ। রাজ্যের আয়ের প্রধান উৎস―কর বা খাজনা। যা আজও বিশ্বের সব রাষ্ট্রেই বিদ্যমান। কর বা খাজনা আদায়ের জন্য ছিলেন আঞ্চলিক বা প্রাদেশিক কর্মকর্তা। এ সময় সুবা বাংলা-সহ অন্য প্রদেশেও কর আদায় করতে গিয়ে সংকট তৈরি হয়। বিশেষত, গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ বাংলার জনজীবন ছিলো কৃষি নির্ভর। আর, এখানকার কৃষক শ্রেণির ফসলাদি বোনা, কাটা তথা বতর প্রক্রিয়া সবই চলতো ঋতুভিত্তিক। ঋতুর হিশেবটা হতো সূর্যের গতি-প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভর করে। ফলে রাজ্যের প্রজা হিশেবে কৃষকদের পক্ষে খাজনা প্রদান করার জন্য ফসল তোলা অব্দি অপেক্ষা করতে হতো। এতে কর আদায়ের সঙ্গে, ফসল তোলার একটি ফারাক ও সংকট তৈরি হয়।
সম্রাট চেয়েছিলেন এর একটি সর্বগ্রাহ্য সমাধান। রাজ্য ব্যবস্থায় প্রশাসনিক ও রাষ্ট্রীয় ভাষা ছিলো ফারসি; আর বছরের হিশেবনিকেশ হতো হিজরি সনকে বিবেচনায় রেখে। হিজরি সনের সঙ্গে সম্পর্ক চাঁদের। যা শুরু হয় মাসের শেষ দিনের সন্ধ্যায় পশ্চিমাকাশে চন্দ্রোদয়ের মধ্য দিয়ে। পক্ষান্তরে সৌরমাসের সূচনা পূর্বাকাশে সূর্যোদয়ের মাধ্যমে। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে অবশ্য মধ্যরাত তথা ১২ : ১ মিনিটি থেকে দিবসের গণনা শুরু করার রেওয়াজ। এবং এ রেওয়াজই পৃথিবীর বেশি সংখ্যক দেশে প্রচলিত। এমনকি আমাদের দেশেও। তো এই চান্দ্রবর্ষের রীতিকে পরিবর্তন করে একটি গ্রহণযোগ্য সর্ব ভারতীয় বর্ষপঞ্জি তৈরির দায়িত্ব দেয়া হয় মহামতি আকবরের অন্যতম পারিষদ বহুজ্ঞ পন্ডিত ফতেউল্লাহ সিরাজীকে। তিনি সম্রাট আকবর প্রবর্তিত ‘দীন-ই-ইলাহি (১৫৮২)’ অনুসরণে ‘তারিখ-ই-ইলাহি’ নামে একটি সর্বভারতীয় বর্ষপঞ্জি তৈরি করেন। এবং এ বর্ষপঞ্জি তৈরি করার ক্ষেত্রে পারস্য (বর্তমান ইরান) বর্ষপঞ্জিকে নমুনা হিশেবে গ্রহণ করে থাকতে পারেন। বলা বাহুল্য, পারস্য সৌর বর্ষপঞ্জি সেই সময় থেকেই যথেষ্ট বিজ্ঞানসম্মত
জালালুদ্দিন মুহাম্মদ আকবর (১৫৪২-১৬০৫) মোগল সম্রাট হিশেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ৯৬৩ হিজরি, রবিউসসানি, শুক্রবার। গ্রেগরিয়ান (খ্রিস্টীয়) ক্যালেন্ডার অনুযায়ী সেটি ছিলো ১৫৫৬, ১১ মার্চ (মতান্তরে ১০ মার্চ। আবার ৫ নভেম্বর, এ তথ্যটিও কোনো কোনো আলোচনায় পাওয়া যায়; কিন্তু সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে ১০ কিংবা ১১ মার্চকে)। সম্রাটের বয়স তখন ১৪। বাদশাহ মানেই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব―বয়স যেমনই হোক। তিনি মান্য সকলের কাছে। কেননা তিনি একই সঙ্গে রাজ্যের সকল বিষয়ের অভিভাবক ও অধিকর্তা। বংশকৌলিন্য এবং প্রতিবেশ এ শ্রেণির মানুষকে মহীয়ান করে। তাঁদের প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব কিংবদন্তিতুল্য সবসময়ই। আকবরও ব্যতিক্রম নন; বরং অন্যদের চেয়ে প্রজ্ঞায়, রণকুশলতায়, দূরদর্শিতায় এবং সেক্যুলার চিন্তায় প্রাগ্রসর বোধের নৃপতি হিশেবে খুব দ্রুতই খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন। সম্রাট সাম্রাজ্য বিস্তারে মনোযোগী হবেন―সেটি-ই তাঁর প্রধান সামরিক গুণ।
হয়েও ছিলো তাই। মোগল সাম্রাজ্য বিস্তৃতি লাভ করলে ‘বাংলা’ হয়ে ওঠে একটি বৃহৎ সুবা বা প্রদেশ। রাজ্যের আয়ের প্রধান উৎস―কর বা খাজনা। যা আজও বিশ্বের সব রাষ্ট্রেই বিদ্যমান। কর বা খাজনা আদায়ের জন্য ছিলেন আঞ্চলিক বা প্রাদেশিক কর্মকর্তা। এ সময় সুবা বাংলা-সহ অন্য প্রদেশেও কর আদায় করতে গিয়ে সংকট তৈরি হয়। বিশেষত, গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ বাংলার জনজীবন ছিলো কৃষি নির্ভর। আর, এখানকার কৃষক শ্রেণির ফসলাদি বোনা, কাটা তথা বতর প্রক্রিয়া সবই চলতো ঋতুভিত্তিক। ঋতুর হিশেবটা হতো সূর্যের গতি-প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভর করে। ফলে রাজ্যের প্রজা হিশেবে কৃষকদের পক্ষে খাজনা প্রদান করার জন্য ফসল তোলা অব্দি অপেক্ষা করতে হতো। এতে কর আদায়ের সঙ্গে, ফসল তোলার একটি ফারাক ও সংকট তৈরি হয়।
সম্রাট চেয়েছিলেন এর একটি সর্বগ্রাহ্য সমাধান। রাজ্য ব্যবস্থায় প্রশাসনিক ও রাষ্ট্রীয় ভাষা ছিলো ফারসি; আর বছরের হিশেব নিকেশ হতো হিজরি সনকে বিবেচনায় রেখে। হিজরি সনের সঙ্গে সম্পর্ক চাঁদের। যা শুরু হয় মাসের শেষ দিনের সন্ধ্যায় পশ্চিমাকাশে চন্দ্রোদয়ের মধ্য দিয়ে। পক্ষান্তরে সৌরমাসের সূচনা পূর্বাকাশে সূর্যোদয়ের মাধ্যমে। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে অবশ্য মধ্যরাত তথা ১২ টা ১ মিনিট থেকে দিবসের গণনা শুরু করার রেওয়াজ। এবং এ রেওয়াজই পৃথিবীর বেশি সংখ্যক দেশে প্রচলিত। এমনকি আমাদের দেশেও। তো এই চান্দ্রবর্ষের রীতিকে পরিবর্তন করে একটি গ্রহণযোগ্য সর্বভারতীয় বর্ষপঞ্জি তৈরির দায়িত্ব দেয়া হয় মহামতি আকবরের অন্যতম পারিষদ বহুজ্ঞ পন্ডিত ফতেউল্লাহ সিরাজীকে। তিনি সম্রাট আকবর প্রবর্তিত ‘দ্বীন-ই-ইলাহি (১৫৮২)’ অনুসরণে ‘তারিখ-ই-ইলাহি’ নামে একটি সর্বভারতীয় বর্ষপঞ্জি তৈরি করেন। এবং এ বর্ষপঞ্জি তৈরি করার ক্ষেত্রে পারস্যের (বর্তমান ইরান) বর্ষপঞ্জিকে নমুনা হিশেবে গ্রহণ করে থাকতে পারেন। বলা বাহুল্য, পারস্য সৌর বর্ষপঞ্জি সেই সময় থেকেই যথেষ্ট বিজ্ঞানসম্মত ছিল।
[hfe_template id=’81’]
‘তারিখ-ই-ইলাহি’
তারিখ-ই-ইলাহি’র বারো মাসের নাম ছিলো ফারসি বর্ষপঞ্জির অনুরূপ। যথাক্রমে : ফারওয়ারদিন, অর্দিবেহেশত্, খোরদাদ, তির, মোরদাদ, শাহ্রিয়ার, মেহ্র, আবান, আজার, দেই, বাহ্মান, এসফান্দ। ফারসি বারো মাসের সঙ্গে ফসল বপণ ও তোলার একটি সমন্বয় হয়। এ জন্য প্রবর্তিত নতুন বর্ষপঞ্জি ‘ফসলি সন’ হিশেবে পরিচিতি লাভ করে। কিন্তু পরে কীভাবে কোনসূত্র ধরে, কার মাধ্যমে ফারসি বারো মাসের নাম সরাসরি বাংলায় চালু হয় তার কোনো বিশ্বস্ত সূত্র পাওয়া যায় না―যা গ্রহণ করা হয়েছে ভারতীয় জ্যোতির্বিদ্যার জনক, সংস্কৃত পণ্ডিত ও গণিতবিদ বরাহমিহির প্রণীত ‘পঞ্চসিদ্ধান্তিকা (৫৫০ খ্রিষ্টাব্দ)’-এর প্রথম খণ্ড‘সূর্যসিদ্ধান্ত’ থেকে। (অন্য চারটি খণ্ডের নাম : রোমকসিদ্ধান্ত, পৌলিকসিদ্ধান্ত, পৈতামহাসিদ্ধান্ত ও বশিষ্ঠসিদ্ধান্ত)। রাজা বিক্রমাদিত্য (খ্রিস্টপূর্ব ১০২- ১৫ খ্রিস্টাব্দ)’র নবরত্ন (অমরসিংহ, কালিদাস, ক্ষপণক, ঘটকর্পর, ধন্বন্তরি, বরাহমিহির, বররুচি, বেতালভট্ট এবং শঙ্কু)’র একজন ছিলেন এই বরাহমিহির। ভারতীয় পঞ্জিকায় শকাব্দের যে উল্লেখ পাওয়া যায়―তা ওই সূর্যসিদ্ধান্তের সৌরবর্ষ গণনাবিধিকে মান্য করেই করা হয়েছিলো বলে ঐতিহাসিকগণ মনে করেন।
এও হতে পারে সিরাজী সংস্কৃত গ্রন্থ ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’ থেকে মাসের নামগুলো গ্রহণ করে সেগুলোকে ফারসি নাম দিয়ে প্রকাশ করেছিলেন―যেহেতু ফারসি ছিলো সে সময়ের রাজভাষা বা রাষ্ট্রভাষা। ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানে নাক্ষত্রিক নামগুলোর সঙ্গে যেমন রাশিচক্রের সাদৃশ্য আছে, তেমনি কিছু মিথও প্রচলিত আছে। আবার ফারসি মাসসমূহও রাশিচক্রের সঙ্গে মিল রেখে প্রবর্তন করা হয়েছে। বাংলা সনের বারো মাসের নাক্ষত্রিক নামগুলো এরকম : বিশাখা থেকে বৈশাখ, জাইষ্ঠা থেকে জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়া থেকে আষাঢ়, শ্রবণা থেকে শ্রাবণ, ভাদ্রপা থেকে ভাদ্র, অশ্বিনী থেকে আশ্বিন, কৃত্তিকা থেকে কার্তিক, পুষ্যা (পউস্যা) থেকে পৌষ, আগৈহনী (মৃগশিরা নক্ষত্রের কথাও উল্লেখ আছে) থেকে অগ্রহায়ণ, মঘা/মগা থেকে মাঘ, ফাল্গুনী থেকে ফাল্গুন, চিত্রা থেকে চৈত্র। ১৫৮৪ সালে আকবরের শাসনকালের ২৯ তম বর্ষে এসে এ সালের সূচনা হয়। কিন্তু এর ব্যবহারিক সময় নির্দেশ করতে আকবরের সিংহাসন-আরোহণকে বিবেচনায় আনা হয়―ফলে ইতিহাসের এ সময়টি নির্দেশিত হয় ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১০ কিংবা ১১ মার্চ; হিজরি ৯৬৩। যদিও ইতিহাসবিদ নীতিশ সেনগুপ্ত এ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করে বলেন, এ সন আকবরের আমলের আরো ৫০ বছর আগে শুরু হয়েছে। (দ্রষ্টব্য: Land of Two Rivers : A History of Bengal from the Mahabharata to Mujib)। এ সময়ে আরবি নববর্ষ তথা হিজরি সালের পয়লা মহররম ছিলো। আবার ফারসি সালের প্রথম মাস ফারওয়ারদিন। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী তা মার্চ-এপ্রিল নিয়ে গঠিত। আবহাওয়াগত কারণে এ সময়টি ইরানে বসন্ত। ফলে বছরের প্রথম মাস তথা নববর্ষ (তাদের ভাষায় নওরোজ মূলত বসন্তদিন) বসন্ত দিয়ে শুরু। গাঙ্গেয় ব-দ্বীপে এ সময়টা শুরু বৈশাখ দিয়ে―ফলে বছরের প্রথম মাস হিশেবে আমরা বৈশাখকে পাই। আরবি মাসগুলোর নাম ঘটনাকেন্দ্রিক। শুধু রবিউল আউয়াল এবং রবিউসসানি ঋতুর বৈশিষ্ট্যকে অনেকটাই ধারণ করে। কারণ এ দু’মাসব্যাপী আরবে বসন্তকালের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। জমাদিউল আউয়াল মাসের সঙ্গে ঠান্ডা আবহাওয়ার সংশ্লিষ্টতা আছে। কিন্তু হিজরি সাল চান্দ্রমাসকে অনুসরণ করে বিধায় গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের সঙ্গে এর হেরফের হয় প্রাকৃতিক কারণেই। এ ক্ষেত্রে যদি বঙ্গাব্দের সূচনাকাল চিহ্নিত করতে চাই―তাহলে দেখা যায় ৯৬৩ হিজরি সাল হতে বঙ্গাব্দের শুরু (বাংলা অভিধানে ‘বঙ্গাব্দ’ শব্দের অর্থও করা হয়েছে এরূপ―‘হিজরি ৯৬৩ অব্দ থেকে প্রবর্তিত সৌর অব্দ’―আধুনিক বাংলা অভিধান : পৃষ্ঠা-৯১০)। অপরদিকে খ্রিস্টীয় ক্যালেন্ডার অনুযায়ী বঙ্গাব্দের শুরু ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে।
হিজরি ও খ্রিস্টীয় সালকে সূচনাচিহ্ন হিশেবে গণনা করলে বর্তমানে বাংলা সালের বয়স যথাক্রমে ৪৭৯ এবং ৪৬৫ বছর দাঁড়ায়। এতে ধরে নেয়া যায় নববর্ষ উদযাপন হাজার বছরের বাঙালি উৎসব নয়। এবং বলা আবশ্যক―যেহেতু বাংলা সাল গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী নির্ধারিত, তাই এখানে হিজরি সাল ধর্তব্য হবে না। লক্ষণীয় বিষয়―লক্ষ্মণাব্দ, শকাব্দ কিংবা বুদ্ধাব্দ যেরকম ব্যক্তিনামের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, বঙ্গাব্দ সেভাবে তৈরি হয়নি, কারণ বঙ্গ নামের কোনো ব্যক্তির অস্তিত্ব ইতিহাসে পাওয়া যায় না। প্রশ্ন হচ্ছে―বাংলা সনের প্রবর্তক তাহলে কে―বস্তুত এ তর্কের কোনো সুরাহা হয়নি আজ অব্দি। আলাউদ্দিন হুসেন শাহ্, সম্রাট আকবর, নাকি মুর্শিদকুলি খাঁ? পঞ্জিকাবিশারদ, ফোকলোরবিদ শামসুজ্জামান খান (১৯৪০-২০২১) বলেন :
‘[…] বাংলা সন ঠিক কখন, কীভাবে প্রচলিত হয়েছিল তা এখনও একেবারে নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারেন নি। কিন্তু নানা পরোক্ষ প্রমাণে মনে করা হয়- সম্রাট আকবর এ সন প্রবর্তন করেন। সম্রাট আকবর যদি সরাসরি বাংলা সন প্রবর্তন নাও করে থাকেন, তবুও এর প্রচলনে তাঁর পরোক্ষ অবদান আছে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ সম্রাট আকবর সর্বভারতীয় ইলাহি সন প্রবর্তন করেছিলেন। বাংলা সন সেই ইলাহি সনের প্রত্যক্ষ প্রভাবেই প্রচলিত হয়েছে। সে জন্যই অধিকাংশ সন-গবেষক ও ঐতিহাসিক মনে করেন যে, বাংলা সন সম্রাট বা কোনো মুসলমান রাজা-বাদশাহ বা সামন্তপ্রভু প্রবর্তন করেছিলেন। এঁদের মধ্যে উড়িষ্যার বিখ্যাত ঐতিহাসিক মেঘনাদ সাহা মনে করেন আকবরের তারিখ-ই-ইলাহি বা ইলাহি সন হলো বঙ্গাব্দের মূলে। অন্যদিকে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেনও তাঁর মিলেনিয়াম বক্তৃতায় (নয়াদিল্লি ২০ আগস্ট ১৯৯৮) সম্রাট আকবরকেই বাংলা সনের প্রবর্তক হিসেবে অভিহিত করেন’। (বাঙালির প্রাণের উৎসব : বাংলা নববর্ষ)। তিনি অন্য একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করেন:‘[…] (সম্রাট আকবর) বিভিন্ন অঞ্চলের ঋতু ও কৃষি উৎপাদনের প্রতি লক্ষ্য রেখে প্রজাদের খাজনা দেওয়ার সুবিধার্থে নানা আঞ্চলিক সনের প্রবর্তন করেন বা আঞ্চলিক সনের কাঠামো নির্দেশ করে দেন। সেই কাঠামো-সূত্র অবলম্বন করেই কোনো কর্তৃপক্ষ বা আঞ্চলিক অধিপতি বাংলা সন চালু করেন। আমরা মনে করি নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ বাংলা সনের প্রবর্তক। আকবর যে আঞ্চলিক সন প্রবর্তন করেন তা হল উড়িষ্যার আমলি সেন [সন], বিলায়েতি সন, সুরাসানি সন ইত্যাদি। এই সনগুলোকে বলা হয় ‘ফসলি সন’। বাংলা সনও তেমনি ফসলি সন। ‘আইন-ই-আকবরি’ থেকে জানা যায়, সম্রাট এমন একটি ত্রুটিমুক্ত এবং বিজ্ঞানসম্মত সৌর সনের প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, যা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবার জন্য আদর্শ হবে। কেননা বাংলা সন যেমন হিজরি সন নয়, তেমনি এটি ইলাহি সনের উপজাত হলেও মূল ইলাহি সন থেকে ভিন্ন। হিজরি সনের ওপর ভিত্তি করে হলেও এর গঠন-পদ্ধতি ভারতীয় শকাব্দের মতো, তবে এটি শকাব্দের সমগোত্রীয় নয়। শকাব্দের সঙ্গে এর সম্পর্ক এইটুকু যে, এর মাস ও দিনের নাম শকাব্দ থেকে নেওয়া হয়েছে’(বাংলা সন ও পঞ্জিকার ইতিহাস ও সংস্কার)।
উপর্যুক্ত দুটো দীর্ঘ উদ্ধৃতি থেকে তর্কের সমাধান হলো না, বরং বেড়ে গেলো মনে করি। তিনি কিছু বাক্য ও শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করেছেন যা তাঁর মতো একজন পণ্ডিতের লেখায় উপস্থিত থাকা অনাকাঙ্ক্ষিত। যেমন―প্রথম আলোচ্য অংশে তিনি বলেছেন―‘সে জন্যই অধিকাংশ সন-গবেষক ও ঐতিহাসিক মনে করেন যে, বাংলা সন সম্রাট বা কোনো মুসলমান রাজা-বাদশাহ বা সামন্তপ্রভু প্রবর্তন করেছিলেন’। দ্বিতীয় আলোচ্য অংশে বলেছেন―‘সেই কাঠামো-সূত্র অবলম্বন করেই কোনো কর্তৃপক্ষ বা আঞ্চলিক অধিপতি বাংলা সন চালু করেন’। কোনো সম্রাট, মুসলিম রাজা বাদশাহ, করে থাকতে পারেন, কোনো কর্তৃপক্ষ, আঞ্চলিক অধিপতিও করে থাকতে পারেন―এ ধরনের কথা বিভ্রান্তিমূলক, উপরন্তু সৃষ্টি করে ধোঁয়াশা। তবে ইতিহাসের বহুমাত্রিক আলোচনার সূত্র ধরে এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়―বাংলা সনের প্রবর্তক সম্রাট আকবর। এ বিষয়ে যিনি কাজ করেছেন সম্রাটের নির্দেশমত তিনি পন্ডিত ফতেউল্লাহ সিরাজী। অপরদিকে, সুবেদার (পরবর্তীতে নবাব) মুর্শিদকুলি খাঁ বাংলায় পুণ্যাহ নামে যে অনুষ্ঠান চালু করেছিলেন―তার মধ্য দিয়েই কালক্রমে বাংলা নববর্ষ একটি অনুষ্ঠানের রূপ পরিগ্রহ করে―এ কথা বলা যায় নিঃসংশয়ে। আজ, এটিই বাঙালির সর্বজনীন লোকউৎসব। এর আবেদন অপরিমেয়। একে ছাপিয়ে ছাড়িয়ে কোনো উৎসব বেড়ে ওঠেনি, ওঠে না। উঠবেও না।
র বারো মাসের নাম ছিলো ফারসি বর্ষপঞ্জির অনুরূপ। যথাক্রমে : ফারওয়ারদিন, অর্দিবেহেশত্, খোরদাদ, তির, মোরদাদ, শাহ্রিয়ার, মেহ্র, আবান, আজার, দেই, বাহ্মান, এসফান্দ। ফারসি বারো মাসের সঙ্গে ফসল বপণ ও তোলার একটি সমন্বয় হয়। এ জন্য প্রবর্তিত নতুন বর্ষপঞ্জি ‘ফসলি সন’ হিশেবে পরিচিতি লাভ করে। কিন্তু পরে কীভাবে কোনসূত্র ধরে, কার মাধ্যমে ফারসি বারো মাসের নাম সরাসরি বাংলায় চালু হয় তার কোনো বিশ্বস্ত সূত্র পাওয়া যায় না―যা গ্রহণ করা হয়েছে ভারতীয় জ্যোতির্বিদ্যার জনক, সংস্কৃত পÐিত ও গণিতবিদ ভারহমিহির (বরাহমিহির) প্রণীত ‘পঞ্চসিদ্ধান্তিকা (৫৫০ খ্রিষ্টাব্দ)’-এর প্রথম খÐ ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’ থেকে। (অন্য চারটি খন্ডের নাম : রোমকসিদ্ধান্ত, পৌলিকসিদ্ধান্ত, পৈতামহাসিদ্ধান্ত ও বশিষ্ঠসিদ্ধান্ত)। রাজা বিক্রমাদিত্য (খ্রিষ্টপূর্ব ১০২- ১৫ খ্রিষ্টাব্দ)’র নবরত্ন (অমরসিংহ, কালিদাস, ক্ষপণক, ঘটকর্পর, ধন্বন্তরি, বরাহমিহির, বররুচি, বেতালভট্ট এবং শঙ্কু)’র একজন ছিলেন এই বরাহমিহির। ভারতীয় পঞ্জিকায় শকাব্দের যে উল্লেখ পাওয়া যায়―তা ওই সূর্যসিদ্ধান্তের সৌরবর্ষ গণনাবিধিকে মান্য করেই করা হয়েছিলো বলে ঐতিহাসিকগণ মনে করেন।
এও হতে পারে সিরাজী সংস্কৃত গ্রন্থ ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’ থেকে মাসের নামগুলো গ্রহণ করে―সেগুলোকে ফারসি নাম দিয়ে প্রকাশ করেছিলেন―যেহেতু ফারসি ছিলো সে সময়ের রাজভাষা বা রাষ্ট্রভাষা। ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানে নাক্ষত্রিক নামগুলোর সঙ্গে যেমন রাশিচক্রের সাদৃশ্য আছে, তেমনি কিছু মিথও প্রচলিত আছে। আবার ফারসি মাসসমূহও রাশিচক্রের সঙ্গে মিল রেখে প্রবর্তন করা হয়েছে। বাংলা সনের বারো মাসের নাক্ষত্রিক নামগুলো এরকম : বিশাখা থেকে বৈশাখ, জাইষ্ঠা থেকে জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়া থেকে আষাঢ়, শ্রবণা থেকে শ্রাবণ, ভাদ্রপা থেকে ভাদ্র, অশ্বিনী থেকে আশ্বিন, কৃত্তিকা থেকে কার্তিক, পুষ্যা (পউস্যা) থেকে পৌষ, আগৈহনী (মৃগশিরা নক্ষত্রের কথাও উল্লেখ আছে) থেকে অগ্রহায়ণ, মঘা/মগা থেকে মাঘ, ফাল্গুনী থেকে ফাল্গুন, চিত্রা থেকে চৈত্র। ১৫৮৪ সালে আকবরের শাসনকালের ২৯ তম বর্ষে এসে এ সালের সূচনা হয়। কিন্তু এর ব্যবহারিক সময় নির্দেশ করতে আকবরের সিংহাসন-আরোহণকে বিবেচনায় আনা হয়―ফলে ইতিহাসের এ সময়টি নির্দেশিত হয় ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১০ কিংবা ১১ মার্চ; হিজরি ৯৬৩। যদিও ইতিহাসবিদ নীতিশ সেনগুপ্ত এ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করে বলেন, এ সন আকবরের আমলের আরো ৫০ বছর আগে শুরু হয়েছে। (দ্রষ্টব্য: Land of Two Rivers : A History of Bengal from the Mahabharata to Mujib)। এ সময়ে আরবি নববর্ষ তথা হিজরি সালের পয়লা মহররম ছিলো। আবার ফারসি সালের প্রথম মাস ফারওয়ারদিন। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী তা মার্চ-এপ্রিল নিয়ে গঠিত। আবহাওয়াগত কারণে এ সময়টি ইরানে বসন্ত। ফলে বছরের প্রথম মাস তথা নববর্ষ (তাদের ভাষায় নওরোজ মূলত বসন্তদিন) বসন্ত দিয়ে শুরু। গাঙ্গেয় ব-দ্বীপে এ সময়টা শুরু বৈশাখ দিয়ে―ফলে বছরের প্রথম মাস হিশেবে আমরা বৈশাখকে পাই। আরবি মাসগুলোর নাম ঘটনাকেন্দ্রিক। শুধু রবিউল আউয়াল এবং রবিউসসানি ঋতুর বৈশিষ্ট্যকে অনেকটাই ধারণ করে। কারণ এ দু’মাসব্যাপী আরবে বসন্তকালের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। জমাদিউল আউয়াল মাসের সঙ্গে ঠান্ডা আবহাওয়ার সংশ্লিষ্টতা আছে। কিন্তু হিজরি সাল চান্দ্রমাসকে অনুসরণ করে বিধায় গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের সঙ্গে এর হেরফের হয় প্রাকৃতিক কারণেই। এ ক্ষেত্রে যদি বঙ্গাব্দের সূচনাকাল চিহ্নিত করতে চাই―তাহলে দেখা যায় ৯৬৩ হিজরি সাল হতে বঙ্গাব্দের শুরু (বাংলা অভিধানে ‘বঙ্গাব্দ’ শব্দের অর্থও করা হয়েছে এরূপ―‘হিজরি ৯৬৩ অব্দ থেকে প্রবর্তিত সৌর অব্দ’―আধুনিক বাংলা অভিধান : পৃষ্ঠা-৯১০)। অপরদিকে খ্রিষ্টীয় ক্যালেন্ডার অনুযায়ী বঙ্গাব্দের শুরু ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে।
হিজরি ও খ্রিষ্টীয় সালকে সূচনাচিহ্ন হিশেবে গণনা করলে বর্তমানে বাংলা সালের বয়স যথাক্রমে ৪৭৯ এবং ৪৬৫ বছর দাঁড়ায়। এতে ধরে নেয়া যায় নববর্ষ উদ্যাপন হাজার বছরের বাঙালি উৎসব নয়। এবং বলা আবশ্যক―যেহেতু বাংলা সাল গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী নির্ধারিত, তাই এখানে হিজরি সাল ধর্তব্য হবে না। লক্ষণীয় বিষয়―লক্ষ¥ণাব্দ, শকাব্দ কিংবা বুদ্ধাব্দ যেরকম ব্যক্তিনামের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, বঙ্গাব্দ সেভাবে তৈরি হয়নি, কারণ বঙ্গ নামের কোনো ব্যক্তির অস্তিত্ব ইতিহাসে পাওয়া যায় না। প্রশ্ন হচ্ছে―বাংলা সনের প্রবর্তক তাহলে কে―বস্তুত এ তর্কের কোনো সুরাহা হয়নি আজ অব্দি। আলাউদ্দিন হুসেন শাহ্, সম্্রাট আকবর, নাকি মুর্শিদকুলি খান? পঞ্জিকাবিশারদ, ফোকলরবিদ শামসুজ্জামান খান (১৯৪০-২০২১) বলেন :
‘[…] বাংলা সন ঠিক কখন, কীভাবে প্রচলিত হয়েছিল তা এখনও একেবারে নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারেন নি। কিন্তু নানা পরোক্ষ প্রমাণে মনে করা হয়-সম্রাট আকবর এ সন প্রবর্তন করেন। সম্রাট আকবর যদি সরাসরি বাংলা সন প্রবর্তন নাও করে থাকেন, তবুও এর প্রচলনে তাঁর পরোক্ষ অবদান আছে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ সম্রাট আকবর সর্বভারতীয় ইলাহি সন প্রবর্তন করেছিলেন। বাংলা সন সেই ইলাহি সনের প্রত্যক্ষ প্রভাবেই প্রচলিত হয়েছে। সে জন্যই অধিকাংশ সন-গবেষক ও ঐতিহাসিক মনে করেন যে, বাংলা সন সম্রাট বা কোনো মুসলমান রাজা-বাদশাহ বা সামন্তপ্রভু প্রবর্তন করেছিলেন। এঁদের মধ্যে উড়িষ্যার বিখ্যাত ঐতিহাসিক মেঘনাদ সাহা মনে করেন আকবরের তারিখ-ই-ইলাহি বা ইলাহি সন হলো বঙ্গাব্দের মূলে। অন্যদিকে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেনও তাঁর মিলেনিয়াম বক্তৃতায় (নয়াদিল্লি ২০ আগস্ট ১৯৯৮) সম্রাট আকবরকেই বাংলা সনের প্রবর্তক হিসেবে অভিহিত করেন’। (বাঙালির প্রাণের উৎসব : বাংলা নববর্ষ)। তিনি অন্য একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করেন:
‘[…] (সম্রাট আকবর) বিভিন্ন অঞ্চলের ঋতু ও কৃষি উৎপাদনের প্রতি লক্ষ রেখে প্রজাদের খাজনা দেওয়ার সুবিধার্থে নানা আঞ্চলিক সনের প্রবর্তন করেন বা আঞ্চলিক সনের কাঠামো নির্দেশ করে দেন। সেই কাঠামো-সূত্র অবলম্বন করেই কোনো কর্তৃপক্ষ বা আঞ্চলিক অধিপতি বাংলা সন চালু করেন। আমরা মনে করি নবাব মুর্শিদ কুলি খান বাংলা সনের প্রবর্তক। আকবর যে আঞ্চলিক সন প্রবর্তন করেন তা হল উড়িষ্যার আমলি সেন [সন], বিলায়েতি সন, সুরাসানি সন ইত্যাদি। এই সনগুলোকে বলা হয় ‘ফসলি সন’। বাংলা সনও তেমনি ফসলি সন। ‘আইন-ই-আকবরি’ থেকে জানা যায়, সম্রাট এমন একটি ত্রæটিমুক্ত এবং বিজ্ঞানসম্মত সৌর সনের প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, যা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবার জন্য আদর্শ হবে। কেননা বাংলা সন যেমন হিজরি সন নয়, তেমনি এটি ইলাহি সনের উপজাত হলেও মূল ইলাহি সন থেকে ভিন্ন। হিজরি সনের ওপর ভিত্তি করে হলেও এর গঠন-পদ্ধতি ভারতীয় শকাব্দের মতো, তবে এটি শকাব্দের সমগোত্রীয় নয়। শকাব্দের সঙ্গে এর সম্পর্ক এইটুকু যে, এর মাস ও দিনের নাম শকাব্দ থেকে নেওয়া হয়েছে’। (বাংলা সন ও পঞ্জিকার ইতিহাস ও সংস্কার)।
উপর্যুক্ত দুটো দীর্ঘ উদ্ধৃতি থেকে তর্কের সমাধান হলো না, বরং বেড়ে গেলো মনে করি। তিনি কিছু বাক্য ও শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করেছেন যা তাঁর মতো একজন পন্ডিতের লেখায় উপস্থিত থাকা অনাকাক্সিক্ষত। যেমন―প্রথম আলোচ্য অংশে তিনি বলেছেন―‘সে জন্যই অধিকাংশ সন-গবেষক ও ঐতিহাসিক মনে করেন যে, বাংলা সন সম্রাট বা কোনো মুসলমান রাজা-বাদশাহ বা সামন্তপ্রভু প্রবর্তন করেছিলেন’। দ্বিতীয় আলোচ্য অংশে বলেছেন―‘সেই কাঠামো-সূত্র অবলম্বন করেই কোনো কর্তৃপক্ষ বা আঞ্চলিক অধিপতি বাংলা সন চালু করেন’। কোনো সম্রাট, মুসলিম রাজা বাদশাহ, করে থাকতে পারেন, কোনো কর্তৃপক্ষ, আঞ্চলিক অধিপতিও করে থাকতে পারেন―এ ধরনের কথা বিভ্রান্তিমূলক, উপরন্তু সৃষ্টি করে ধোঁয়াশা। তবে ইতিহাসের বহুমাত্রিক আলোচনার সূত্র ধরে এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়―বাংলা সনের প্রবর্তক সম্রাট আকবর। এ বিষয়ে যিনি কাজ করেছেন সম্রাটের নির্দেশমত তিনি পন্ডিত ফতেউল্লাহ সিরাজী। অপরদিকে, সুবেদার (পরবর্তীতে নবাব) মুর্শিদকুলি খান বাংলায় পুণ্যাহ নামে যে অনুষ্ঠান চালু করেছিলেন―তার মধ্য দিয়েই কালক্রমে বাংলা নববর্ষ একটি অনুষ্ঠানের রূপ পরিগ্রহ করে―এ কথা বলা যায় নিঃসংশয়ে। আজ, এটিই বাঙালির সর্বজনীন লোকউৎসব। এর আবেদন অপরিমেয়। একে ছাপিয়ে ছাড়িয়ে কোনো উৎসব বেড়ে ওঠেনি, ওঠে না। উঠবেও না।
আঁতুড়ঘর, মিথকথা, লোককথা, উৎসব, বাস্তবতা
আঁতুরঘর ওই গ্রাম, তথা―পল্লিসমাজ ও তাদের জীবন জীবিকার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উৎপাদন ব্যবস্থা। উদ্দেশ্য জমিদার মহাজনের কর আদায়। কারা দেবে সে কর? কৃষক। সুতরাং সংবৎসর যাই হোক আজ এই দিনে (কর, দেনা শোধের দিনে) দাও একটু মিষ্টিমুখ করিয়ে। জমিদার নায়েব-কর্মচারির হাত থেকে একটু মিষ্টি, এক খিলি পান একজন গরিব চাষির কাছে বিরাট অর্জন। অর্জন না হলেও প্রাপ্তি তো বটে! মূলত সেই থেকে শুরু। এখানে ধর্ম, জাত কিংবা সম্প্রদায় গৌণ। কারণ হিন্দু হোক,আর মুসলমানই হোক―এরা তো প্রজা! এরা কৃষক, ভাগচাষি। এতে সুবিধাটা হয়েছে―এরা দাঁড়িয়েছে এক প্ল্যাটফর্মে। নবাব মুর্শিদকুলি খান রাজস্ব আদায়ের জন্য বছরের শেষদিনকে নির্ধারণ করে প্রবর্তন করেন ‘পুণ্যাহ’ নামক অনুষ্ঠানের―এখানেও উদ্দেশ্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক। জমিদারি প্রথা উঠে গেলো―কিন্তু খাজনা আদায়ের ওই দিনটার আনন্দঘন মুহূর্তটা রয়েই গেলো। সে আনন্দ নিশ্চয়ই তিক্ত-মধুর। পরের দিন বছরের পয়লা দিবস। নতুন আমেজ, নতুন বিশ্বাস ও প্রত্যয়ে বেঁচে থাকার, নিজেকে ভাববার প্রয়াস ছিলো হয়তো। এবং তাদের সমন্বিত এই কর্মায়োজন হয়ে উঠেছে জাতিভেদহীন, সাম্প্রদায়িকতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। সময়স্রোতে ভেসে ভেসে তা আজ সর্বজনীন। এবং বাঙালির উৎসব। বর্ষবরণ উৎসব। সম্মিলনের অনুঘটক নবাব, জমিদার, সামন্তপ্রভু―এটি সত্য। কিন্তু যারা এটিকে মঞ্চায়ন করেছেন সমগ্র বাংলার জমিন জুড়ে, যারা এর কুশীলব তারা জনবাংলার খেটেখাওয়া ঋণগ্রস্ত দায়েপড়া কৃষকসমাজ। তাদের সঙ্গে ছিলো ধীবর, তাঁতি, কুমোর―এমন পেশার ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীও। এ হচ্ছে অনস্বীকার্য সত্য।
[hfe_template id=’81’]
মিথকথায় জানি প্রজাপতি দক্ষের সাতাশ কন্যা, সাতাশটি নক্ষত্র। এদের বিয়ে নিয়ে চিন্তিত পিতা দক্ষ একদিন চন্দ্রদেবের খোঁজ পেলেন এবং চন্দ্রদেবের সঙ্গে বিয়ে হলো দক্ষের সাতাশ সুন্দরী কন্যার মহা ধুমধামে। খরতাপময় সুন্দরী বিশাখা―আমাদের প্রিয় বৈশাখ। অনিন্দ্য চিত্রা হচ্ছে চৈত্র। তার শেষবেলায় তথা বিদায়-প্রহরে আয়োজন হয় ‘চৈত্রসংক্রান্তি’র। অম্ল ব্যঞ্জন আর তিতা শাকের আয়োজন থাকে সনাতন হিন্দুর ঘরে। এক সময় বাঙালিমাত্রই এটি করতো―এতদ্ব্যতীত আছে আরো আচার-অনুষ্ঠান। উদ্দেশ্য―পুরনো বছরের অম্লতা তিক্ততা ভুলে নতুন বছরকে স্বাগত জানানো। এতে পারস্পরিক বন্ধন দৃঢ় হয়, নতুন বছর ভালো কাটবে―এই হলো বিশ্বাস। পালন হয় ‘আমানি’―যার অর্থ দাঁড়ায় অম্লপানি, পান্তাভাতের পানি (বলাবাহুল্য, এটিই এখন পান্তাভাত) এবং এটি পালন করা হতো বিশেষ একটি রিচুয়াল হিশেবে। বাড়ির গৃহিণীরাই করতেন। আগের রাতে কিছু চাল ভিজিয়ে রাখা হতো, সঙ্গে একটি আমের ডাল, মানে পাতা-সহ শাখা। সূর্যোদয়ের পূর্বেই এ টক হয়ে যাওয়া ভেজানো চাল―খাওয়ানো হতো বাড়ির সকলকে। আর ভেজানো আমের শাখার পানি সবার গায়ে ছিটানো হতো―সব ধরনের বালাইমুক্ত হওয়ার লোকবিশ্বাস থেকে। বর্ষবরণের সঙ্গে যুক্ত ছিলো ‘আর্তব’ শব্দটিও। এরও একটি লৌকিকবিধি আছে। এর অর্থ ঋতুজাত/ঋতুসম্বন্ধীয়―যা গ্রীষ্ম বর্ষা ঋতুকেই বোঝায়। আবার এটি স্ত্রীরজঃসম্বন্ধীয়। এখানেও লোকাচার আছে, নেত্রকোনা-সহ বিভিন্ন হাওর অঞ্চলে ভূমি তথা জমিকে রজঃস্বলা করতে জমির কোনায় স্ত্রীরজঃ লাগিয়ে দেয়া হতো অথবা লাল রঙ। স্ত্রীরজঃ যেহেতু উৎপাদন-সক্ষমতার প্রতীক, সুতরাং তারও একটি প্রতীকী মূল্য আছে। এই যে আচারক্রিয়া, তার সবটুকুতেই লোকবিশ্বাস। এখানে বিজ্ঞান খুঁজে লাভ নেই। হ্যাঁ ধর্ম―প্রথা তো ধর্মের আড়ালেই বেড়ে ওঠে। কিন্তু তাতে থাকে অসাম্প্রদায়িক মানবিক কল্যাণবোধ―এ সত্যকে ভুলে গেলে সংকীর্ণতা ভর করতে পারে, বিধিনিষেধের শাস্ত্র হয়ে উঠতে পারে সর্বমানবিক চেতনার অন্তরায়। লক্ষণীয় যে, এ ধরনের মেয়েলি উৎসব স্মরণ করিয়ে দেয় মাতৃতান্ত্রিক কৃষিসমাজের আদিকথা। এবংবিধ আচার―সব ওই কল্যাণ কামনা থেকেই।
উদ্যাপন তত্ত¡ তালাশ করলে দেখা যায়-শুরুটা পুণ্যাহ নামক অনুষ্ঠান দিয়ে। তারপর সেটা বিস্তৃতি পেয়েছে। সেখানে হালখাতা―তথা বাণিজ্য, অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা যতোটা, হৃদ্যতা ততোটা ছিলো না। যেখানে খাজনা আদায় মুখ্য ছিলো, সেখানে আনন্দ কিংবা উৎসবচিন্তা ছিলো খুবই গৌণ―এটি বুঝতে কষ্ট হয় না। তবুও গ্রামনির্ভর কিছু খেলা আনন্দের উপকরণ হিশেবে ছিলো। ঘৌড়দৌড়, মেলা, সার্কাস এবং কিছু লৌকিকখেলাা সম্ভবত আনন্দায়ক এবং গ্রামীণ আর্থসামজিক জনজীবনের সঙ্গে অধিক জুতসই ছিলো। ঢাকার নবাব-পরিবার ঢাকার নাগরিক জীবনে এবং পুরনো ঢাকার ব্যবসায়ী সমাজ, সাধারণের মাঝে জনপ্রিয় করে তুলেন বর্ষবরণকে। শাহবাগের হস্তশিল্প প্রদর্শন ও কৃষিমেলার আয়োজন ঢাকার নবাবদের উদ্যোগে হয়েছে। এ বিষয়ে সৈয়দ আবুল মকসুদ (১৯৪৬-২০২১) বলেন : ‘[…] সলিমুল্লাহ বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন করতেন জাতীয় উৎসব হিসেবে। এদিন তিনি ঘনিষ্ঠদের কাপড়চোপড় প্রভৃতি উপহার দিতেন। ঢাকার চকবাজারে কয়েক দিনের জন্য মেলা বসত। যাত্রাপালা, গানবাজনা হতো, খেলাধুলা হতো। নবাব বৈশাখী উৎসবে ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা দিতেন। পয়লা বৈশাখে তিনি সাধারণ মানুষের জন্য খাবারের আয়োজন করতেন। ১৯০৪ সালের ১৪ এপ্রিল বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে সলিমুল্লাহ শিলংয়ে তাঁর দুই পুত্রের কাছে ‘বিভিন্ন উপহারসামগ্রী’ পাঠান কর্মচারীদের মারফত। পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে শিশুদের নতুন কাপড়চোপড় কিনে দিতেন’। (নবাব সলিমুল্লাহ ও তাঁর সময়, পৃষ্ঠা- ১৮৪-১৮৫)।
শামসুজ্জামান খানের প্রবন্ধ বাংলা সন ও পঞ্জিকার ইতিহাস ও সংস্কার থেকে জানতে পারি-‘১৯৫৪ সালের পূর্ব বাংলার সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগ উৎখাত হয়ে যাওয়ার পরই শুধু যুক্তফ্রন্ট সরকার ও মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক বাংলা নববর্ষের ছুটি ঘোষণা করে বাঙালির জাতিগঠন ও বাঙালি জাতীয়তাবাদকে একটি সুস্পষ্ট পথনির্দেশ দান করেন এবং সে বছর বিপুল উৎসাহে বাঙালি তার নববর্ষ উদ্যাপন করে’। এবং তার পরের ইতিহাস আমাদের সকলের জানা―১৯৬১ সালে রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষ্যে পূর্ব বাংলায় ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনায় নববর্ষ পালন হয়। ১৯৬৭ সালে প্রথম বেসরকারিভাবে ‘ছায়ানট’-এর উদ্যোগে প্রাতিষ্ঠানিক রূপলাভ করে বাংলা নববর্ষ। এ প্রসঙ্গে দৈনিক প্রথম আলো (১৪ এপ্রিল ২০২১, ১ বৈশাখ ১৪২৮)তে প্রকাশিত ‘দুঃসময় কাটবে, এই আশাবাদ’ শিরোনামের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায় : ‘[…] ১৯৬৭ সাল থেকে রাজধানীতে রমনার বটমূলে নববর্ষের সূচনা হয়ে আসছে ছায়ানটের প্রভাতি গানের আসর দিয়ে। এই বটমূলে সন্ধান দিয়েছিলেন উদ্ভিদ বিজ্ঞানী ও আলোকচিত্রী নওয়াজেশ আহমেদ। এর আগে নানাভাবে নানা সাংস্কৃতিক সংগঠন বর্ষবরণের উৎস [উৎসব] আয়োজন করত। ধীরে ধীরে ছায়ানটের আয়োজনের মাধ্যমে বর্ষবরণ উৎসব একটি কেন্দ্রীকতা পায়। […] ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের আয়োজনে ১৯৯৮ সাল থেকে সূচিত পয়লা বৈশাখের বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রা এখন ইউনেসকোর বিশ্বঐতিহ্য’। বলাবাহুল্য, রমনার বটমূল নামে যাকে চিনি, সেটা মূলত অশ্বত্থতলা/অশ্বত্থমূল। স্মৃতিচারণ করেছেন ছায়ানটের প্রধান সন্জীদা খাতুন :
‘[…] উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে রমনার লেক আর এপাশে ডালপালা মেলা অশ্বত্থগাছের বিস্তৃত ছায়া। এভাবে আবিষ্কৃত হয়েছিল নবর্ষের জন্য উপযুক্ত ওই প্রশস্ত জায়গাটি। সেটা ইংরেজি ১৯৬৭ সাল আর বাংলা ১৩৭৪। রমনার বৃহৎ বৃক্ষটিকে অশ্বত্থ জেনেও ‘বট’ নামে অভিহিত করায় ভুল নেই। গ্রামের অশ্বত্থতলায় হাট বসলে হাটের জায়গাটির সে নাম শুনতে বেশ মানানসই লাগে। আবার শহরের অশ্বত্থমূল নববর্ষের মিলনমেলা হলে, বটমূল দিব্যি সুশ্রাব্য লাগে। রমনার ওই বৃক্ষটির নাম বিশেষ করে অশ্বত্থ বলতে হবে নিঃসন্দেহে; কিন্তু বাংলাদেশের বৃহত্তম অনুষ্ঠানটিকে ‘বটমূলে’র অনুষ্ঠান বললে ভুল হবে না। (যেভাবে রমনার বটমূলে পহেলা বৈশাখ : দৈনিক কালের কণ্ঠ, ২৬ চৈত্র ১৪২৭। ৯ এপ্রিল ২০২১)। ১৯৭২ সালে স্বাধীনতা-উত্তর বঙ্গবন্ধুর সরকার পহেলা বৈশাখে সরকারি ছুটি ঘোষণা করে এবং সেই সঙ্গে ‘বাংলা নববর্ষ’ স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় উৎসবের স্বীকৃতি পায়।
প্রসঙ্গ বাস্তবতা―পুরো গ্রীষ্মকাল জুড়ে পান্তাভাত ছিলো গ্রামবাংলায় সকালের প্রধান খাবার; আজও আছে অনেকটাই অবিকৃত। গ্রাম মানেই কৃষিনির্ভর জনজীবন। সেখানে পান্তা অনিবার্য। এটি সম্ভবত শুরু হয়েছিলো ব্যঞ্জনের অভাবহেতু। কৃষকের ঘরে চাল ছিলো, কিন্তু মাছ-মাংস আমিষ তরিতরকারি―এসব? তা ছিলো সম্পন্ন সচ্ছল কৃষকের ঘরে। ভূমিহীন, ভাগচাষি, বর্গাচাষির ঘরে তা ছিলো না। তারাই খেয়েছে পান্তা, সঙ্গে লবণ, শুকনো লঙ্কা আর পেঁয়াজ। সহজলভ্য সহজপাচ্য খাবার। কালক্রমে তা সচ্ছল অসচ্ছল সকল কৃষকের সকালের তৃপ্তিকর খাবারে পরিণত হয়েছে। কারণ তা স্বাস্থ্যকর মনে হয়েছে তাদের কাছে এক সময়। সরল কথা―পান্তা খেতো, এখনো খায় ডেঁড়েমুষে, তৃপ্তি করে। পান্তার সঙ্গে ইলিশ ছিলো কি? কীভাবে? ইলিশ কি সুলভ ছিলো তখনো? পদ্মা-যমুনা কিংবা সমুদ্র তীরবর্তী ধীবরদের জীবনে কিছুটা সুলভ হতে পারে। তবুও তা পান্তাভাতের সঙ্গে বোধ হয় নয়। ‘পদ্মানদীর মাঝি’র কুবের, ধনঞ্জয়, গণেশের কথা আমরা জানি। আবার জানি শেতলবাবুর কথাও। ইলিশের মরসুমেও তারা কি ইলিশের স্বাদ পেয়েছে? বরং তা হয়েছে কলকাতার বাবুদের বিলাসী খাদ্য, ‘সকালে বিকালে বাজারে ইলিশ কিনিয়া কলিকাতার মানুষ ফিরিবে বাড়ি। কলিকাতার বাতাসে পাওয়া যাইবে পদ্মার ইলিশ মাছ ভাজার গন্ধ’। (পদ্মানদীর মাঝি, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়)। বলা যায়―বোশেখের মধ্য পর্যায়ে কাঁঠাল পাওয়া যেতো, পাটের চাষ হতো―শাক হিশেবে পাট খেত থেকে অতিরিক্ত ঘন পাটগাছগুলো তুলে ফেলা হতো―সেগুলো শাক হিশেবে ছিলো কৃষকের কাছে অমৃত। শাকান্ন ছিলো কৃষকের অনুপায় খাদ্যাভ্যাস। এবং দেশের প্রায় সর্বত্রই পাটশাক, কাঁঠাল এবং এঁচড় (কাঁচা কাঁঠালের ব্যঞ্জন) দিয়ে পান্তাভাত খাওয়ার রেওয়াজ যথেষ্ট আদি এবং প্রাচীন; কোনো কোনো অঞ্চলে পাকা বিচি কলা দিয়েও খেতো―এখন অবশ্য তা প্রায় দুষ্প্রাপ্য। মোটকথা―এ জনপদের কৃষক সমাজের মানুষের কাছে পান্তা খাওয়ার উপকরণ হিশেবে শুকনো লঙ্কা, পেঁয়াজ, লবণ, শাক, কাঁঠালের অস্তিত্ব ও সাদৃশ্য খুব সহজেই মিলবে। কিন্তু ইলিশ দিয়ে পান্তা খেয়েছে কোন সময়ের বাঙালিকৃষক, অথবা বিত্তবান তথাকথিত ভদ্রলোক বাঙালি তা বলা মুশকিল। বরং ভয়াবহ কথা বলেছেন রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন বিহার উড়িষ্যা যখন বাংলার অন্তর্ভুক্ত ছিলো তখন―তাঁর ‘চাষার দুক্ষু’ প্রবন্ধে : ‘পঁচিশ বৎসর পূর্ব্বে উড়িষ্যার অন্তর্গত কণিকা রাজ্যের অবস্থা এই ছিল যে, কৃষকেরা ‘‘পখাল’’ (পান্তা) ভাতের সহিত লবণ ব্যতীত অন্য কোনো উপকরণ সংগ্রহ করিতে পারিত না। […] সাত ভায়া নামক সমুদ্র-তীরবর্ত্তী গ্রামের লোকেরা পখাল ভাতের সহিত লবণও জুটাইতে পারিত না। তাহারা সমুদ্র-জলে চাউল ধুইয়া ভাত রাঁধিয়া খাইত।’ তাই মনে করি, অধুনা বর্ষবরণের সংস্কৃতিতে ‘পান্তাইলিশের সংস্কৃতি’ আটষট্টি হাজার গ্রামবাংলার বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে এক ধরনের নাগরিক ইয়ার্কি ছাড়া আর কিছুই নয়।
[hfe_template id=’81’]
পোশাক―হ্যাঁ জমিদার, মহাজনদের দেয়া পোশাক―কী ছিলো সেসব? একটি লুঙ্গি, কমদামি একটি গামছা, কিষানির জন্য ডুরে শাড়ি―এই-ই বোধ হয়। কিন্তু প্রজা কৃষকের সন্তানদেরকেও কি দেয়া হতো নতুন কাপড়? অপরপক্ষে, কৃষকের যেখানে খাজনা দেয়াই মুখ্য হতো, মহাজনের দেনা শোধ করাটাই যেখানে আবশ্যক―তখন কি তার পক্ষে সন্তান স্ত্রী এদের জন্য নতুন পোশাক কেনার সুযোগ হতো? হতো না। তবে, তারা কেউ কেউ উচ্চবিত্তের দয়াদাক্ষিণ্যস্বরূপ কিছু পেতেন―অথবা জমিদারের কাচারিতে যাওয়ার আগে নতুন বছরে অপেক্ষাকৃত ভালো পোশাক পরার চেষ্টা করতেন নিশ্চয়ই। জুতো, না জুতো ছিলো না। খালি পা। অবশ্য, খড়ম পরতেন সচ্ছল যারা ছিলেন। বাঙালি হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে পুরুষরা পরতেন ধুতি, লুঙ্গি আর নারীরা শাড়ি। এর বেশি কিছু নয়। কারো শার্ট, নিমা বা গেঞ্জি, ফতুয়া, পাঞ্জাবি থাকলেও সেটি পরতেন না, কাঁধে ঝুলিয়ে রাখতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন―তার গুহ্য কারণ অর্থনৈতিক বৈষম্য। আশির দশকে আমার স্কুল জীবনে দেখেছি গ্রামের অসচ্ছল ভূমিহীন কৃষকের ছেলেদেরকে ¯স্রেফ নেংটি পরতে। গায়ে আর কিছু ছিলো না। খেত-খামারে কাজ করতো এমন বয়স্ক পুরুষ কামলা-শ্রমিকদেরকেও দেখেছি মালকোচা দিয়েছে নেংটির মতো করে―যাতে নিতম্বের বড়ো অংশই দৃশ্যমান,―এতে লজ্জার কিছু ছিলো না, অসভ্যতামিও নয় ওটা। আবার হতে পারে―ওটিই একমাত্র লুঙ্গি, সেটিকে কাদা-মাটির হাত থেকে রক্ষা করার একটি উপায়। কিন্তু এও তো সত্য―সেই প্রকাশটা যেনো মনের অজান্তেই এমন ‘আমরা তোমাদের ওই তথাকথিত সভ্যতাকে এমনিভাবে পাছা দেখাই, যার ইচ্ছে দেখে নাও। গাঁয়ের মহিলারা পরতো শাড়ি কোনোরকম পেঁচিয়ে পেটিকোট, ব্লাউজ ছাড়া। এ চিত্রও রোকেয়ার উপরিউক্ত প্রবন্ধে পাওয়া যায় : ‘পুরুষেরা বহুকষ্টে স্ত্রী লোকের জন্য ৮ হাত কিংবা ৯ হাত কাপড় সংগ্রহ করিয়া দিয়া নিজেরা কৌপিন ধারণ করিত’। জয়নুলের ছবিতেও দেখি নেংটি পরা মাথাল মাথায় পুরুষ আর সঙ্গে কিষানির পরনে দুপাট্টা শাড়ি। মূলত এটিই প্রকৃত চিত্র। এরাই আমাদের পূর্বপুরুষ। এরাই ছিলো সেই জমিদার, মহাজনদের প্রজা ও খাতক। এরা শ্রমজীবী। এদের ঘাম, ক্লান্তি, অবসাদ আর দুঃশ্চিন্তা খুব যে পরিবর্তিত হয়েছে এমন নয়। কেউ কেউ হয়তো যারা কৃষিকে মূলভিত্তি না ধরে এগিয়েছে―তারা কিছুটা এখনো সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে। তারা মোড়ল এবং উত্তরাধুনিক কৃষক। এদের কপালে দুঃশ্চিন্তার ভাঁজ নেই। কিন্তু যারা প্রকৃত অর্থেই ছিলেন কৃষক, চাষি―তাদের কপালে এখনো ভাঁজ পড়ে। তাদের ভয় আছে দেনা শোধের। সন্তানের পড়াশোনার খরচ সরবরাহ করার। স্মরণ করা যেতে পারে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর এই মন্তব্যটি : ‘কারো পৌষ মাস কারো সর্বনাশ এই সত্যের শীত-গ্রীষ্ম নেই বাংলাদেশে; সব ঋতুতেই সত্য সে, উল্টো-সিধে সকল অবস্থাতেই। পহেলা বৈশাখেও।
বিধাভোগী যারা তাদের জন্য পৌষ মাস, সর্বনাশ অসুবিধা-সহ্যকারীদের। শহরের বিলাসীদের কাছে পহেলা বৈশাখ সুবিধা নিয়ে আসে নতুনতর; ছুটি পাওয়া যায়, শোনা যায় গান, কবিতা পাওয়া যায়; উদ্যমশীল হলে বটবৃক্ষমূলের সংস্কৃতিও। মেহনতি ও সংকটাচ্ছন্ন কৃষকের কাছে বৈশাখ অর্থ খরা, মহাজনের সুদ, চাষের অনিশ্চয়তা। প্রকৃতি তার পুরাতন শত্রæতার নতুন যুদ্ধক্ষেত্র খোলে যেন বিপদগ্রস্ত মানুষের সঙ্গে এই বৈশাখে’। (সেই পুরাতন বৃত্ত, প্রবন্ধ সমগ্র ১, পৃষ্ঠা- ২১৯)
অন্তরে যে বাঁশি বাজে করুণ পূর্বেই বলেছি বাংলা নববর্ষ মূলত উৎসব হয়ে আসেনি। আমরা উৎসব বানিয়েছি। মানে এ সমাজের প্রাকৃতজন কালের পরিক্রমায় এই দিনে নতুন আত্মবিশ্বাসের স্বপ্নে দুঃখ ও জরার অর্গল খোলে নিজেকে অপরের কাছে মেলে ধরবার আকাক্সক্ষাবোধ করেছে। এখানে আনন্দই মুখ্য হয়ে ওঠে এক সময়। আর ওই যে, মহাজনের লাল মলাটের হিশেবের খাতা, হালখাতা ওটি মূলত শোষণের। ওখানে বিশেষ আনন্দ নেই। যারা সে সময়ে দেনা শোধ করেছেন, তাদেরকে মহাজন, ব্যবসায়ী, জমিদার শ্রেণি, সামন্তপ্রভুরা করুণা করে কখনো কখনো জামাকাপড় দিয়েছেন। খুবই সস্তা দরের। গরিব প্রজা, চাষি তাতেই আনন্দে মেতেছেন। অথবা জমিদার নায়েবের সামনে সহাস্যবদনে বিনীতভাবে দাঁড়িয়েছেন। রাজাও খুশি, প্রজাও তাই। লাল মলাটের খাতাটাই হচ্ছে শাসকের। ওই রঙটা শাসকের, সাম্রাজ্যবাদীদের। ব্রিটিশ যেখানে যতো স্থাপনা গড়েছে সবই লাল। লাল দালান শাসকের নিয়ন্ত্রিত কারাগার, লাল ফিতা বড় কর্তার ক্ষমতার চিহ্ন, লাল কলমের দাগ মানে―বাতিল; লাল ফৌজ নিয়ন্ত্রক শ্রেণির বাহিনী, রেড সিগনাল, রেড এলার্ট, লাল বাতি মানে বিপজ্জনক কিছু―থেমে যাও, নির্দেশ। রক্তচক্ষু মানে লাল চোখ―এ চোখ ওই শাসকের (আঁখি করি লাল রাজা ক্ষণকাল রহিল মৌনভাবে)। প্রকৃতিতে সূর্য ওঠে লাল আভা ছড়িয়ে, তীব্র হয়, ঘোষণা করে দিবসের সূচনা―তার অস্তগমনের সময়েও লাল আভা ছড়িয়ে জানিয়ে দিয়ে যায়―আমি যতোক্ষণ ততোক্ষণই আলো―তারপর অন্ধকার। যেনো বলে দেয়―অপেক্ষা করো আমি আসছি আবার দাপটের মহিমা নিয়ে। সূর্য শাসকদলেরই প্রতিনিধিত্ব করে। লাল পতাকা, লাল ঝান্ডাা, লাল নিশান, শ্রমিক আন্দোলন, লেলিন, মাও সেতুং সবখানেই ওই লালেরই দাপট; বিপ্লব―রক্তের সিঁড়ি ডিঙিয়ে, রাজপথ রাঙিয়ে আসে ক্ষমতার মহাসিংহাসন। হোক তা সাম্যের, কমিউনিস্টের কিংবা গণতন্ত্রের। সিংহাসনের চতুর্পাশে ক্ষমতাগন্ধী লাল থাকবেই। ক্ষমতা যেখানে লাল সেখানে। এমনকি সিঁদুর, লাল টিপ, লাল বেনারসি, কিংখাব তাতেও প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত ওই কর্তৃত্ববাদের―মানে আজ থেকে তুমি আমার! এই লাল থেকে আমরা আজও বের হতে পারিনি। শাসক আছে, শোষণও আছে। কিন্তু যে উৎসব আজ মনঃপ্রেরণাজাত, প্রাণের অস্তিত্বের, তা যতোটা বাহ্যিক জৌলুসকে ধারণ করে বেঁচে থাকতে চায়, নিজেকে প্রকাশ করে―ঠিক ততোটা গ্রামীণ শিল্প, তাঁতি, জেলে, কুমোর, ভূমিহীন কৃষক, বয়াতিদের কায়ক্লেশে বেঁচে থাকা জীবনের মর্মবেদনাকে উপলব্ধি করে বলে মনে হয় না। এরা অবহেলিত ছিলো আগেও, এখনো তাই।
এবং এজন্যই এদের কেউ কেউ এখন পূর্বপুরুষের পেশা ছেড়ে ভিন্ন পেশায় প্রবেশ করছে। এতে এ ধরনের পেশার যে একটি জনজীবন এ বাংলায় ছিলো তার কোনো অস্তিত্ব থাকবে না এক সময়। অস্তিত্ব যেখানে থাকবে, সেখানে কর্পোরেট সভ্যতা প্রতিনিধিত্ব করছে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের মতো ঝলমলে চেহারা নিয়ে। এদের নামগুলো দেশি―কিন্তু এদের বিপণনকেন্দ্রগুলোতে প্রবেশাধিকার নেই স্বল্প আয়ের একজন মধ্যবিত্ত বাঙালিরও, কৃষক তো বহু দূরের কথা। আড়ম্বর আনন্দকে ছাপিয়ে গেলে তাতে গলদ থাকে। সংশয় তৈরি হয়। বঞ্চিত হয় সাধারণজন। বৈষম্য চোখে পড়ে তীব্রভাবে। সেরকম কিছু বর্ষবরণের মাঝে আমরা লক্ষ করি না কি? নিজের নাম শোনা আর অপরকে শোনানো কখনো কখনো আমাদের উৎসবের আঙিনা দখল করে ফেলে। তখন তাকে উৎসব বলতে ভয় করে। স্মরণ করি রবীন্দ্রনাথের কথা― ‘[…] আজ আমাদের দীপালোক উজ্জ্বলতর খাদ্য প্রচুরতর আয়োজন বিচিত্রতর হইয়াছে―কিন্তু মঙ্গলময় অন্তর্যামী দেখিতেছেন আমাদের শুষ্কতা আমাদের দীনতা আমাদের নির্লজ্জ কৃপণতা। আড়ম্বর দিনে দিনে যতই বাড়িতেছে, ততই এই দীপালোকে এই গৃহসজ্জায় এই রসলেশশূন্য কৃত্রিমতার মধ্যে সেই শান্তমঙ্গলস্বরূপের প্রশান্ত-প্রসন্নমুখচ্ছবি আমাদের মদান্ধ দৃষ্টিপথ হইতে আাচ্ছন্ন হইয়া যাইতেছে। এখন আমরা কেবল আপনাকেই দেখিতেছি, আপনার স্বর্ণরৌপ্যের চাকচিক্য দেখাইতেছি, আপনার নাম শুনিতেছি ও শুনাইতেছি’। (উৎসবের দিন)।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করি―বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটকে চিন্তা করে ১৪২৮ বঙ্গাব্দের প্রতিপাদ্য ছিলো জাতীয় কবির কবিতার পঙ্ক্তি :‘কালো ভয়ংকরের রূপে এবার ঐ আসে সুন্দর’। সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের কথা দিয়ে শেষ করি―‘[…] আমাদের বিপদে-আপদে, সংকটে-সন্তাপে সান্তনা আর সাহস জোগান রবীন্দ্রনাথ আর নজরুল। একজনের জন্ম বৈশাখে, আরেকজনের জ্যৈষ্ঠে। গ্রীষ্মের মেজাজটা নজরুলের কবিতাতেই বেশি স্পষ্ট, তিনি বিপ্লবের গান গেয়ে আমাদের জাগান, তাঁর অগ্নিবীণায় অসুন্দরের প্রাণে কাঁপন তোলেন। তবে রবীন্দ্রনাথেও বৈশাখের খরতাপ আছে, আগুন আছে, যে আগুন প্রাণের আবর্জনাকে পোড়ায়’। (মারি বিজয়ের কেতন উড়াও শূন্যে, দৈনিক প্রথম আলো : ১৪ এপ্রিল ২০২১, ১ বৈশাখ ১৪২৮) শুভ হোক সবকিছু। জয় হোক মানবের। মারিমুক্ত হোক মাতা বসুমতী। শুদ্ধতম চেতনায় জাগুক পৃথিবীর মানুষ ও তার অলিগলি।
১১ বৈশাখ ১৪২৮
২৪ এপ্রিল ২০২১

আল মাকসুদ
জন্ম ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬ সালে জামালপুর জেলার শৈলেরকান্দা। সহকারী অধ্যাপক, ময়মনসিংহের সরকারি আনন্দ মোহন কলেজ, বাংলা বিভাগ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। প্রিয় লেখালেখির বিষয় কবিতা ও প্রবন্ধ । পেয়েছেন স্বতন্ত্র (শিল্প-সাহিত্য বান্ধব) লিটল ম্যাগাজিন ২০১৬ সম্মাননা।
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: এই নাও শঙ্খচাঁদ, এবং তার জন্য এ পঙক্তিমালা, কুমারী রাতের আশীর্বাদ, কবিতানগর উচ্চ বিদ্যালয়। প্রকাশিত প্রবন্ধগ্রন্থ: কবিতা অকবিতা: কাব্যপাপ ও অন্যান্য প্রবন্ধ।
COMMENTS
শাড়ি চুড়ি পান্তা ইলিশ এই নিয়েই পহেলা বৈশাখ উদযাপন করি, তথ্য বলতে ওই চাকরির পড়া মুখস্থ করতে গিয়ে দুয়েকটা নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন জানতাম কেবল।
এই যে এতো তথ্য উপাত্ত তাৎপর্য চেতনা ইতিহাস প্রভৃতির সমন্বয়ে ঢেলে সাজানো এই স্নাত পূতপবিত্র শব্দের উপস্থাপন! এটা নিঃসন্দেহে পাঠককে নিমজ্জিত করে বৈশাখী সুরের সুপ্রাচীন নান্দনিক সাগরে।
“ইতিহাসের আলো-আঁধার” অংশে লেখাটায় একই অংশের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে, যেটা পাঠককে খানিক দিশেহারা অবস্থায় ফেলে, তবে সুখের কথা হলো তবুও পাঠক ছেড়ে যায় না, লেখাটা টেনে নিয়ে যায় একদম ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’ ‘আইন-ই-আকবরী’, সমাধানের বেড়ে যাওয়া তর্ক হয়ে লৌকিকখেলা, পুণ্যাহ, প্রজাপতি দক্ষের মিথ, স্ত্রীরজঃসম্বন্ধীয় প্রতিকী ব্যাখ্যা, গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ ও উপন্যাসের সাথে সম্পর্ক স্থাপন, সকল তন্ত্রে লাল-তত্ত্ব (!), দারিদ্র্য আর ঐশ্বর্য আকাঙ্ক্ষার যৌথখামার, মারিমুক্তির জন্যে আকুল প্রার্থনা প্রভৃতির রসায়নে আহা! কী উপস্থাপন!
গুরুজি! প্রণাম নিবেন।
দুঃখ পেয়েছি কিঞ্চিৎ এই ভেবে যে গুরুজি নিশ্চয়ই কাজের চাপে বড্ড যান্ত্রিক সময় যাপন করছেন। তাইজন্যে লেখায় কিছু কারিগরি ত্রুটির ফল লক্ষ্যণীয়।
সেই সাথে এ-ও বলবো, নিঃসন্দেহে অসাধারণ শিরোনাম এবং দেহ-মন নিয়ে অপূর্ব গবেষণালব্ধ উপস্থাপন এই লেখা।
পুনর্বার মন্তব্যে বলতে চাই আরেকটা কথা। লেখাটা পড়তে পড়তে যখন সবশেষে পেলাম গুরুজির মুখশ্রী, তখন মুগ্ধতা পরিপূর্ণ হলো।
ভালো থাকবেন গুরুজি।