দেবাশিস ভট্টাচার্য
কবি, লেখক
ক’দিন থেকে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। আকাশের ভাবগতি বোঝা মুশকিল। এই রোদ উঠে আবার হঠাৎ করে কালো মেঘ দল বেঁধে এসে চারপাশ ঘিরে ফেলে।
শুরু হয় প্রবল বৃষ্টিপাত, বজ্রপাতও ঘটে মাঝেমাঝে।
গুঁইসাপটার বয়স হচ্ছে। বিশেষ করে আশ্বিন কার্তিক মাসে সে ডিম দেয়। অতিরিক্ত বৃষ্টি হলে পুকুর ডুবে যায়। পুকুরের দক্ষিণ কোনায় একটি মাটির ঢিবির মত উঁচু জায়গায় তার বাসা। এখান থেকে পুকুরটার উপর নজর রাখা যায় এবং খাওয়া-দাওয়ারও সুবিধা। পুকুর থেকে মাছ ধরে কিম্বা পাশের জঙ্গল থেকে পাখি, পাখির ডিম, সাপ, সাপের ডিম এসব খেয়ে তার ভালোই দিন কাটে। শীতের সময় শরীর শক্ত রাখতে হয় তাই এই সময়টায় ভালো খাওয়া-দাওয়া দরকার। তার শরীরটা সম্পূর্ণ শক্ত চামড়ায় ঢাকা। লেজ খুব তীক্ষ্ণ, ধারালো। চোখদুটো মার্বেলের মত। হা করলে মুখে দুপাটি সুতীক্ষ্ণ দাঁত দেখা যায়। কাটা জিভ বের করে মানুষকে সতর্ক করে।
আনসারের পায়খানাটা পুকুর পাড়ে সেদিন দুপুরে আনসারের বউ পায়খানায় বসেছিল। হঠাৎ করে গুঁইসাপটি হেলেদুলে খাওয়ার মনে করে সেদিকে যেতেই। মেয়ে লোকটা জুড়ে দিল চিৎকার।
কোনোরকম সে বাথরুম সেরে ছুটে বেরিয়ে আসলো। গুঁইসাপটা আরেকটু ভিতরে গিয়ে চারপাশ দেখলো। কাউকে না দেখে সে আবার বেরিয়ে এসে পুকুরের দিকে নেমে গেল। এদিকে আনসারের বউয়ের গুঁইসাপটা নিয়ে নানান কথা তার দুই ছেলেকে বলতে লাগলো এবং বাথরুম অন্য জায়গায় সরিয়ে আনার জন্য তাদের বাবাকে বলতে বলল। কারন রাত-বিরাতে আরো ভয়ংকর অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।
এই জায়গাটা একটা বিশাল সংরক্ষিত এলাকা। একসময় এই জায়গাটা মোহন্তদের ছিল। তাদের ঘরবাড়ি, নাটমন্দির, শিবমন্দির সহ একাদিক স্থাপনা ছিল এই এলাকা জুড়ে। আইয়ুব খানের আমলে একটি সরকারি ইন্ডাস্ট্রি স্থাপনের জন্য সরকার জায়গাটি অধিগ্রহণ করে। এতে করে মোহন্তদের এক একর জায়গা, বসতভিটা, পুকুর, নাটমন্দির সবই বেহাত হয়ে যায়। এখন পুকুরের চারপাশে বিভিন্ন ফলবতি গাছের বাগান। পুকুরটা এখন অন্যের কাছে লিজ দেওয়া। বড়বড় মাছ আছে পুকুরে। তাই গুঁইসাপটির খাওয়ার কখনও অভাব হয়নি।
পুকুরের দক্ষিণ পাশ ঘেষে আনসার ব্যারাক হাইস্কুল, প্রাইমারি স্কুল, হাসপাতাল, আবার কর্মচারীদের আবাসিক থাকার ব্যবস্থাও রয়েছে। আনসারদের লাগানো যে ছোট্ট সরকারি অফিস ঘরটি আছে তাতে প্রতিদিন কর্মব্যস্ততা থাকে। অফিসটিতে তিনজন কর্মচারী আছেন। তারা সকাল নয়টায় আসে পাঁচটায় চলে যান। এরপর থেকে আনসারের বউ দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে বাসায় একা পরে থাকে। কখনও কখনও খুব ভয় হয় তবুও ছেলে দু’টির লেখাপড়ার কথা চিন্তা করে বাসা ছাড়েননি। স্বামীর স্বল্প বেতনের চাকরীতে ভালো বাসা ভাড়া করে থাকতে হলে ছেলেদের পড়ার খরচ জোগানো সম্ভব হবে না। তাই মাথাগুঁজে এখানেই পড়ে আছে। তার স্বামী আনসারও সুস্থ না। তার শরীরের বাম হাত এবং বাম পা স্ট্রোকের কারনে অবশ হয়ে গেছিল। বেশ কিছুদিন থেরাপি দেওয়ার পর এখন কিছুটা ভালো আছে। টুকটাক কাজকর্ম সে করতে পারে।
সেদিন হঠাৎ করে আবার গুঁইসাপটা পুকুর থেকে উঠে এলো। গুটিগুটি পায়ে সে আনসারের বউয়ের মুরগীর আড়ালের নিচ দিয়ে সোজা পিছনের দরজা দিয়ে সরকারি অফিসটাতে ঢুকে গেল।
আনসারের বউ দূর থেকে এই দৃশ্য দেখছিল। ভয়ে মাষ্টার, পিয়ন ও অন্যান্য সহকারীরা সামনে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। গুঁইসাপটা অফিস থেকে কিছুতেই বের হচ্ছে না। একবার এদিকে যায় আরেকবার ওদিকে ঘুরে আসে। বারবার জিভ বের করে সবাইকে ভয় দেখায়। সামনের রাস্তাটার ওপাড়ে মোল্লার চায়ের দোকান। মোল্লাকে খবর দেওয়া হয় গুঁইসাপটি তাড়ানোর জন্য।
মোল্লা শক্ত একটা কাঠ নিয়ে আসে। হাঁটু পর্যন্ত লুঙ্গি গোঁজ দিয়ে পড়ে। এরপর কাঠটি নিয়ে গুঁইসাপটি তাড়াতে অফিসে ঢুকে। একদিক থেকে তাড়ালে গুঁইসাপটি অন্যদিকে চলে আসে। কোনো উপায় না দেখে মোল্লা কাঠটি দিয়ে বিশাল গুঁইসাপটিতে ধাক্কা দিতে দিতে অনেক কষ্টে আবার পিছনের দরজা দিয়ে অফিস থেকে বের করে দেয়। এবং পেছনের দরজা আটকে দেয়। সবাই বলাবলি করছিল পুকুরে জলের পরিমাণ বেশি থাকায় তার বাসায় ডিম পাড়ার অবস্থা ছিল না। কারন ডিমগুলো সংরক্ষণ করা, নিয়মিত তা দেয়া সেখানে সম্ভব নয়। তাই সে একটা নিরাপদ জায়গা খুঁজছিল। সেই কারনেই হয়তো সে একটা আশ্রয় খুঁজছে। মাষ্টার মোল্লাকে নিষেধ করেছিল গুঁইসাপটিকে না মারার জন্য। কারন তার পেটে ডিম আছে।
এরপর প্রতিদিন অফিস খোলা হয়। পাহারাদার হিসেবে বাঘা বসে থাকে পেছনের দরজায়। গুঁইসাপটিকে আর দেখা যায় না। সে হয়তো চলে গেছে নিরাপদ অন্য কোনও স্থানে।

দেবাশিস ভট্টাচার্য
সীতাকুণ্ড উপজেলার আমিরাবাদ গ্রামে জন্ম: ১ ডিসেম্বর ১৯৬২ সালে ।
ডাককর্তা হিসেবে কর্মরত নিভৃতচারী লেখক দেবাশিস ভট্টাচার্য কবিতা, ছড়া, নাটকসহ সাহিত্যের সব মাধ্যমে লিখলেও গল্পকার হিসেবেই তিনি সর্বাধিক পরিচিত।
বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নাসরিন জাহান সম্পাদিত ‘বাংলাদেশের গল্প আশির দশক’ গ্রন্থে আশি দশকের উল্লেখযোগ্য গল্পকার হিসেবে তাঁর ‘পোকা জাতের মানুষ’ গল্পটি অন্তর্ভুক্ত হয়।
প্রকাশিত গ্রন্থ: আনন্দ মৃত্যুর কাছে, পোকা জাতের মানুষ ও অন্যান্য গল্প, আলোকিত কফিন, বিনয় বাঁশি এক বায়েনের গল্প, জাদুর ঢোল ও অন্যান্য আরো সাতটা গল্পগ্রন্থ।