ইতিহাসবিদ আহমদ মমতাজও চলে গেলেন !

ড. তপন বাগচী

কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক

 

চাটগাঁর বেলা বিস্কুটের ২০০ বছর, বোস্তামি কাছিম কিংবা চট্টগ্রামের বলী খেলার ইতিহাস জানতে চাইলে আহমদ মমতাজের বিকল্প নেই। আঞ্চলিক ইতিহাসের নিষ্ঠাবান গবেষক ছিলেন তিনি। ‘মুক্তিযুদ্ধের কিশোর ইতিহাস : চট্টগ্রাম জেলা’, ‘বাংলাদেশে কমনওয়েলথ যুদ্ধসমাধি’, ‘বাহান্নর ভাষাসংগ্রামী’,‘ শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু’ তাঁর গবেষণার বই। বেশ কিছু গ্রন্থের সহলেখক হিসেবে কাজ করেছেন তাঁর জুটি রাইহান নাসরিন। বাংলা একাডেমিতে চাকরিতে যোগদানের আগে মমতাজভাই যতদিন এসেছেন, একা আসেননি, সঙ্গে লেখক রাইহান নাসরিনও আসতেন। একাডেমির বাইরে কোনো অনুষ্ঠানে বা চলতি পথে দুজনকে একসঙ্গেই দেখতে পেতাম। বাংলা একাডেমি দুজনের যৌথরচনা বেরিয়েছে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবী বিনোদবিহারী চৌধুরীর জীবনী লিখেছেন দুজনে মিলে। আমি কলকাতা থেকে কিছু ছবি এনে দিয়েছিলাম। মমতাজ ভাই ‘চট্টগ্রাম পরিক্রমা’ নামে একটি গবেষণা পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। আমি ‘ফরিদপুর ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ নামের একটি গবেষণাপত্রিকার সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত জেনে আমাদের অন্যরকম সখ্য ছিল। তিনি ‘শমসের গাজী’ নিয়ে একটি অসাধারণ ইতিহাসগ্রন্থ লিখলেন। এক পর্যায়ে পাণ্ডুলিপিটি দেখার সুযোগ হয় আমার। আমি জানালাম যে সমশের গাজী নিয়ে ‘যাত্রাপালা’ আছে। তাতেও কল্পিত কিছু কাহিনি ও চরিত্র আছে। আছে কিছু জনশ্রুতি। তাঁকে বললাম জনশ্রুতি থেকেও ইতিহাসের উপকরণ পাওয়া যায়। তিনি আবার ঘাঁটতে শুরু করলেন। আমিও যাত্রাপালার তথ্যটি সংগ্রহ করে দিলাম। বইটি বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এরকম অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের তথ্যবিনিময় চলে। তাকে মাস দুয়েক আগে কবি সৌমিত্র দেবের কাছ থেকে একটি দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থের ফটোকপি এনে দিলাম। তখনও তিনি অসুস্থ। নাসরিন আপাও অসুস্থ দীর্ঘদিন ধরে। দুজনে দুজনের সেবা করতেন। এখন নাসরিন আপা একা চলবেন কী করে?
আহমদ মমতাজ বাংলা একাডেমিতে একটু বেশি বয়সে যোগদান করেন সহপরিচালক হিসেবে। বাংলা একাডেমি প্রেসে ছিল তাঁর অবস্থান। মুদ্রণশৈলী ভাল বুঝতেন। তাঁর মাপের একজন ইতিহাস-গবেষক বাংলা একাডেমিতে কাজ করেছেন, এটা আমাদের গৌরব। প্রাক্তন মহাপরিচালক শামসুজ্জামান স্যারকে ধন্যবাদ জানাই তিনি তাঁকে খুঁজে এনে বসিয়েছিলেন।
মমতাজ ভাই সত্যিসত্যি চলে গেলেন? আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। আপনার ঘরে গেলে খালি মুখে ফিরিনি কখনো। নাসরিন আপা যেদিন আসতেন, বাটি ভরে খাবার নিয়ে আসতেন। তা কেবল আপনার জন্য নয়, আমাদের মতো ছোটভাইদের জন্যও।

আহমদ মমতাজ ১৯৬০ সালের ৩০ জুন মিরসরাই উপজেলার করেরহাট ইউনিয়নের পশ্চিম অলিনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আবদুল বারি ও মাতার নাম আমেনা খাতুন। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮২ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে এমএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ কর্তৃক ১০ খণ্ডে প্রকাশিত বাংলা পিডিয়ার একজন নির্বাচিত লেখক ছিলেন তিনি। সর্বশেষ তিনি বাংলা একাডেমির সহকারী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
আহমদ মমতাজ ৮০’র দশকে চট্টগ্রামের ইতিহাসের বিভিন্ন তথ্য ও উপকরণ সংগ্রহ করতে শুরু করেন। ১৯৮০ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত মীরসরাইর ইতিহাস নিয়ে ব্যাপক তথ্যানুসন্ধান চালান। ‘মীরসরাইর ইতিহাস সমাজ ও সংস্কৃতি’ তার রচিত ও প্রকাশিত দ্বিতীয় গন্থ। ইতোপূর্বে তার লেখা চট্টগ্রামের ‘সুফি সাধক প্রথম খণ্ড’ প্রকাশিত হয়েছে। আহমদ মমতাজের অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের বাংলার অসংখ্য কিংবদন্তির নায়ক, ত্রিপুরা রাজ্য ও চাকলা রোশনাবাদের শাসক ‘শমশের গাজী তার জীবন ও কীর্তি’ এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলে শত শত বছর ধরে প্রচলিত প্রবাদ প্রবচন ও গ্রামীণ লোকসাহিত্যের বিভিন্ন বিষয়াদি নিয়ে ‘চট্টগ্রামের লোকসাহিত্য ও লোকজ জীবন’ নামে দুটি গবষণা গ্রন্থ রচনা করেন। এ ছাড়া তিনি শমসের গাজী, বিপ্লবী বিনোদবিহারী চৌধুরী (যৌথ), মুক্তিযুদ্ধের কিশোর ইতিহাস : চট্টগ্রাম জেলা, বাংলাদেশে কমনওয়েলথ যুদ্ধসমাধি (যৌথ), মুক্তিযুদ্ধের বীরগাথা (যৌথ), শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু (যৌথ), পলাশি থেকে ঢাকা, বাহান্নর ভাষাসংগ্রামী (যৌথ), ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম, ভাষা আন্দোলনে চট্টগ্রাম (যৌথ), বাজিমার ছানাপোনা (শিশু-কিশোরদের জন্য) সহ বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা করেছেন। আহমদ মমতাজের কাজের মূল্যায়ন হয়নি। অত্যন্ত বিনয়ী ও মেধাবী এই ইতিহাসবিদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।

ড. তপন বাগচী
মাদারীপুর, কদমবাড়িতে নিজ মাতুলালয়ে তাঁর জন্ম ১৯৬৮ সনের ২৩ অক্টোবর ।
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতায় এমএ-পিএইচডি। বর্তমানে বাংলা একাডেমির উপপরিচালক।
অনেক বিখ্যাত গানের রচয়িতাও তিনি।
উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: লোকসংস্কৃতির কতিপয় পাঠ, বাংলাদেশের যাত্রাগান: জনমাধ্যম ও সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত, মুক্তিযুদ্ধে গোপালগঞ্জ, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ: চন্দ্রাহত অভিমান,’সাহিত্যের সাম্প্রতিক পাঠ, নজরুলের কবিতায় শব্দালঙ্কার, তৃণমূল সাংবাদিকতার উন্মেষ ও বিকাশ,
জীবনী: বিপ্লব দাশ, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ।
সম্পাদনা করেছেন: আনন্দনাথ রায়ের ফরিদপুরের ইতিহাস, অম্বিকাচরণ ঘোষের বিক্রমপুরের ইতিহাস।
কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ পেয়েছেন সাংস্কৃতিক খবর পদক (কলকাতা, ২০১৩), মহাকবি মাইকেল মধুসূদন পদক (২০১২), নতুন গতি সাহিত্য পুরস্কার (কলকাতা, ২০১১), সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সাহিত্য পুরস্কার (২০০৯), মহাদিগন্ত সাহিত্য পুরস্কার (২০০৮ কলকাতা), এম নূরুল কাদের শিশুসাহিত্য পুরস্কার (২০০৮), জেমকন সাহিত্য পুরস্কার (২০০৮), অমলেন্দু বিশ্বাস স্মৃতি পদক (২০০৮), জসীমউদ্দীন গবেষণা পুরস্কার (১৯৯৬), মুনীর চৌধুরী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯১) এবং আরও অনেক দেশি-বিদেশি পদক-সম্মাননা।

 

Please Post Your Comments & Reviews

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected!!
Share via
Copy link
Powered by Social Snap