মঈন আহমেদ
মি. করিম বিশ্বাস– সেগুন কাঠের কারুকর্ম খচিত সাড়ে তিন ফুটের ভারী দরজার বুকে ডোর ভিউয়ারের ঠিক দুই ইঞ্চি উপরে সাঁটানো নেমপ্লেট পড়ে লাজিনা শারমিন হেসে ফেলল।
হাসিটা খলবলিয়ে পেটের ভিতর থেকে দাঁত কপাটি গলে বাইরে চলে এলো। দম বন্ধ করা হাসি! কথায় কথায় হাসি তার পেট উগড়ে বেরিয়ে আসে। মানুষ হাসলে তার দাঁতগুলো মুখে ফুটে ওঠে– দেহের অলঙ্কার। কিছু একটা ছুঁতো পেলেই হলো; নিজেকে থামাতে পারে না লাজিনা শারমিন। সে জানে তার দন্ত বিকশিত হাসিটা প্রাণ-কাড়া, সবসময় এবং সবার জন্য। তার হাসি দেখে সংক্রমণ ব্যাধিতে আক্রান্তের মতো অন্যরাও হেসে ফেলে।
লাজিনা হাসতে জানে। অকাতরে। হাসির দমকে কপোলের চূড়া রক্তিম হয়ে থাকে। লাজিনার মুখে হাসি লেগেই থাকে। এমন হাসি ক`জনে হাসতে পারে!
মি. করিম বিশ্বাস– আচ্ছা নিজের নামের সাথে কেউ মিস্টার লাগায়?
লাজিনার হাসি পাবে না-ই বা কেন! অন্য যে-কেউ হলেও হাসত আর সে তো এমনিতেই হাসি রোগাক্রান্ত। পরিচিতি আছে বন্ধু মহলে। হাসলে পরে সোনা-রঙা দু’গালে ঈষৎ টোল পড়ে। বড় ভালোলাগে দেখতে। তার প্রেমি হতে ইচ্ছা করে, যে কারও। কিন্তু লাজিনা তার এই হাসির জন্য এখনও প্রেমের লহরীতে ভাসতে পারেনি। সে একটা ছেলের সাথে প্রেম করবে, গায়ে গায়ে ঘষা দিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবে, আমি তোমাকে ভালোবাসি বলবে– এগুলো ভাবতেই তার হাসি পায়। অহরহ ভালোবাসার নিবেদনকে সে হেসেই গড়িয়ে দিয়েছে– গ্রহণ করেনি, প্রত্যাখ্যানও করেনি, তথাপি সংযোগ ঘটেনি। কলেজ ইউনিভার্সিটি শেষ হয়ে গেল, লাজিনার প্রেম হলো না।
করিম বিশ্বাস লাজিনার বস, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তিনি হাসেন না। তাঁর বোধ হয় হাসতে মানা। কেউ তাকে হাসতে দেখেনি। কিন্তু লাজিনা তাকে ঠিকই হাসতে দেখেছে। কোনো একদিন ব্যস্ত অফিসে ত্রস্ত লাজিনা কার্যাদেশ অনুমোদনের জন্য ফাইলে ভুল তথ্য পরিবেশন করে বসের কাছে বকা খাচ্ছিল। তিনি মাথা নিচু করে যেন-তেন বকে যাচ্ছিলেন। লাজিনা তার বকা পরিপাক করছিল আর নিঃশব্দে মুখের দুপাশে দুটা গজদন্ত বের করে কেলাচ্ছিল। বস সেটা লক্ষ করেননি। তিনি যখন লাজিনার দিকে মুখ তুলে চাইলেন, লাজিনা স্বভাবত হাসছে। তাও আবার দন্ত বিকশিত করে। মি. বিশ্বাস অবাক হলেন। তার বকা খেয়ে কেউ হাসতে পারে এটা বিশ্বাস বিশ্বাসই করতে পারলেন না।
তিনি কপট রাগ করে বললেন, তোমার কি চাকরির মায়া একটুও নেই।
লাজিনা ঝকঝকে মুক্তার মতো দাঁত আগের থেকে আরও একটু ফুটিয়ে জানতে চাইল, কেন স্যার?
তুমি ভুল করেছ, তা জানো?
এই যে আপনার কাছে জানলাম। আগে জানতে পারলে তো সংশোধন করেই নিয়ে আসতাম। ভুলটা কি আর আনতাম। বলে, গজদন্তসহ উপর নিচ ষোলো খানা ঝিলিকমারা দাঁত উন্মুক্ত করে মাসকারা আঁকা চোখ মেলে তাকিয়ে থাকল।
লাজিনার নির্বিকার হাসি দেখে একসময় নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মি. বিশ্বাসও হেসে ফেললেন। পরক্ষণেই হেরে যাওয়া নিজেকে সামাল দিয়ে একটু জোরে বলে উঠলেন, অহ্ হেল! গেট ইউরসেল্ফ আউট অফ হেয়ার।
বসের হঠাৎ ইংরেজি ভাষা শুনে শ্রেয়সী লাজিনা একটু অপ্রতিভ হলো। সে ফাইলটা হাতে নিয়ে পেন্সিল হিলের খটখট শব্দ আর মেদবিহীন কুমারী নিতম্বে দশআনা বিশআনা ছন্দ তুলে দরজা ঠেলে বেরিয়ে গেল। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল– দাঁড়াও সুযোগ পেয়েনি, পিছন থেকে আমার দোলানো পাছা দেখা আর তোমার বসগিরি ছোটাবো।
সেই থেকে লাজিনা বসকে শায়েস্তা করার জন্য তার পেছনে হাত ধুয়ে পড়ে আছে।
মি. করিম বিশ্বাস গুরুগম্ভীর ভাব দেখান। বসগিরি আর কি! কিন্তু তিনি আদতে একজন নরম দিলের মানুষ। সবাই জানে। ওপর থেকে চোটপাট দেখান কিন্তু ভেতরে তিনি পাখির ছানার মতো নরম তুলতুলে। বিয়ের চৌহদ্দি পার করেননি। নারীর প্রতি মোহ আদৌ আছে কিনা কেউ বলতে পারবে না। অফিসে প্রচুর নারী কর্মী আছে, সমস্তরের বা অধস্তন কেউ কিন্তু তার দিকে অঙুলি তুলে কথা বলতে পারবে না। ভালো মানুষ মি. করিম বিশ্বাস, সকলের সমীহের পাত্র।
মি. করিমের যৌবনকালের এক বন্ধু নবীন সরকার এই অফিসের একাউন্টস বিভাগের প্রধান। তাঁর কোনো এক দুর্বল মুহূর্তে কেউ একজন জেনে যায় যে, একদা যুবক বয়সে মাতাল যৌবনের দিশাহারা লগ্নে একটি কিশোরীর প্রেমে পড়ে সামাজিকভাবে নাজেহাল হওয়ার পর নারীদের থেকে তিনি দূরে দূরে থাকেন। অজগাঁয়ের কথা, বিশ বছর পেরিয়ে গেছে, ভোলেননি আজও।
কানকথাটি সহকর্মীদের মুখে ঘুরতে ঘুরতে একদিন লাজিনা শারমিনের কানে এসে আলোড়ন তুলল। লাজিনা ভীষণ উত্তেজিত হয়। নিজে নিজে হাসে আর মনে মনে বলে, তাহলে আগেই সাহেব নাজেহাল হয়েছেন!
তার জানতে খুব ইচ্ছা করে, কী এমন ঘটেছিল সেদিন যে আজ বিশ বছর পরেও সেটা ভুলতে পারছে না লোকটা! কোনো এক রাঙা রোদের দুপুরে কাঁধে লুটানো দুই বেণি রচয়িত্রী কিশোরীসহ ঢেউ খেলানো সর্ষে ক্ষেতে ধরা পড়েছিল নাকি! হি হি হি!
এমন সময় ক্রিং ক্রিং, ইনটারকম বেজে উঠল। সে হাসতে হাসতে মিন মিন করে নিজেকে শুনিয়ে বলল, তোমার কোনো সময়জ্ঞান নেই প্রভু, যখন ইচ্ছা বেজে ওঠ।
লাজিনা, আর ইউ বিজি? মি. নবীন সরকারের কণ্ঠস্বর।
নট সো মাচ্, স্যার।
রুমে আসেন।
আদেশটা হেঁকে বস লাইন কেটে দিলেন। বসদের এই আচরণ খুব পীড়াদায়ক। লাজিনা বহুবার বহুজনকে এই আচরণ করতে দেখেছে। নিজের কথা শেষ হওয়ামাত্রই লাইনটা কেটে দেয়। এরা আবার নিজেদের বুকে শিক্ষিত তকমাও আঁটে। সামনাসামনি মানুষ তার প্রয়োজন শেষ হলে যেমন বিদায় নেয় বা অনুমতি নেয় ঠিক তেমনি ফোনেও কথা শেষ করার পরে অপর প্রান্তের কোনো কথা রয়েছে কিনা সেটা জেনে নিয়ে তবেই ফোনের লাইন বিচ্যুত করা উচিত। এটাই সভ্যতা, ইংরেজিতে যাকে বলে এটিকেট।
লাজিনা ইচ্ছার বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়াল। নবীন সাহেবের অফিসকক্ষের সামনে যাওয়ামাত্র বাবরি চুলের তার স্মার্ট সেক্রেটারি টেবিলময় ছড়িয়ে থাকা কাগজপত্র থেকে চাহনি তুলে ইশারায় চোখের তারা নাচিয়ে ভিতরে চলে যেতে বলল। লাজিনাও দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে গেল। নবীন সরকার ফোনে কথা বলছেন না কারও সাথে তর্কে লিপ্ত হয়েছেন বোঝা যাচ্ছে না। তিনি হাত দিয়ে চেয়ার দেখিয়ে বসার ইঙ্গিত করলেন। লাজিনা বসে তাঁর কথা শুনছিল– না না আমাকে ঠিক করে বলো… তুমি কি তাহলে বিয়ে করবে না… সে দায়িত্ব তো আমার… না কোনো মানসম্মান যাবে না… ঠিক আছে পরে কথা বলছি… লাজিনা ইজ ইনফ্রান্ট অফ মি। আবারও সেই একই আচরণ, ফোন ছেড়ে দিলেন।
লাজিনা বুঝতে পারল তিনি অফিসেরই কারও সাথে কথা বলছিলেন। লাজিনা ঢাকায় অবস্থিত সান্নিডেল স্কুল থেকে এ লেভেল করে ইন্ডিয়া থেকে হিউম্যান বিহেভিয়ারের ওপর উচ্চ শিক্ষা নিয়েছে। সে ইংরেজিতে পড়াশোনা করেছে ঠিকই কিন্তু মাতৃভাষার প্রতি তার অদ্ভুত মায়া রয়েছে। সে বলে, যতই ইংরেজি মারাও না কেন তুমি কিন্তু বাঙালি, তোমাকে বাংলাতেই চিন্তা করতে হবে আর বাংলাতেই স্বপ্ন দেখতে হবে। হাসতেও হবে বাংলাতেই!
মি. নবীন ফোন রেখে লাজিনার দিকে তাকালেন। লাজিনা স্বভাবজাত গজদন্ত উপচানো হাসি তাঁকে উপহার দিলো। তিনি একটা খাম বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, কনগ্রাচুলেশন।
লাজিনা প্রশ্নদৃষ্টি নিক্ষেপ করল। তিনি পুনরায় বললেন, খুলে দেখ।
লাজিনা তাঁর হাত থেকে খামটা নিয়ে খুলে আদ্যোপান্ত দুইবার পড়ল। মাত্র চার লাইন লেখা, ইংরেজিতে। ভাবতেই অবাক লাগছে। মাত্র তিন মাস হয়েছে তার চাকরির। কনফারমেশনের সাথে সাথে একটা প্রোমোশন পাওয়া নিশ্চয় আনন্দের। লাজিনারও খুব আনন্দ হচ্ছে। ফুটে ওঠা অপার তৃপ্তি তার চোখে মুখে স্পষ্ট হলো। অনাবিল অন্তরে, কখনও মুখের গহ্বরে হাসিটা খলবল করছে। সে বলল, স্যার আই ফিল অনার্ড, থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ।
ওয়েলকাম। কিন্তু ধন্যবাদটা তোমার করিম সাহেবের পাওনা।
আমি বুঝতে পারছি স্যার।
এ রেস্পেকটেবল ম্যান হ্যাজ ফলেন… বলে চুপ করে গেলেন মি. নবীন। তিনি বোধ হয় ভাবলেন, লাজিনাকে বলার এখনও সময় হয়নি। তিনি ত্বরিত প্রসঙ্গ পরিবর্তন করতে গিয়ে লাজিনাকে একেবারে বিদায় জানিয়ে দিলেন। মুখ থেকে কেউ যেন শব্দগুলো টেনে বের করে দিলো, হ্যাভ এ গুড ডে, লাজিনা।
লাজিনা নবীনের কথার লেজ ধরে উঠে দাঁড়িয়ে গেল। বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে সে আনন্দ মনে বসের রুম থেকে বেরিয়ে আসল। তার কানে সব কিছু ছাপিয়ে, এ রেস্পেকটেবল ম্যান হ্যাজ ফলেন… কথাটা বারবার বাজতে লাগল। সে নিজের আসনে না গিয়ে মি. করিমের রুমের দিকে এগিয়ে গেল।
কক্ষের সামনে তাঁর সেক্রেটারি আসনে ছিল না। কি করবে এখন ফেরত যাবে কিনা ভাবছে এমন সময় মি. করিমের রুম থেকে তাঁর সেক্রেটারি বের হয়ে এসে বলল, ভিতরে যান। স্যার ইস ওয়েটিং ফর ইউ।
বোঝা গেল সিসিটিভির অপরিসীম গুরুত্ব।
লাজিনা ভিতরে পা রাখার সাথে সাথে মি. করিম উঠে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানালেন।
লাজিনা স্মিত হেসে ধন্যবাদ জানালো। বস উঠে দাঁড়িয়ে তাকে অভিবাদন জানিয়েছেন। লাজিনা করিম সাহেবের বডি লাংগুয়েজ বোঝার চেষ্টা করল। একথা সেকথা বলে সময় নিলো। তার কানে ‘এ রেস্পেকটেবল ম্যান হ্যাজ ফলেন…’ বারবার বাজতে লাগল। করিম সাহেবকে আজ যথেষ্ট সপ্রতিভ মনে হলো। লাজিনার ঠোঁটের কোণ থেকে হাসি মিলাচ্ছে না। সে মনে মনে বলল, প্রেম করতে চাও আর মুখ ফুটে বলতে পারো না। কেমন পুরুষ গো তুমি!
বসের কক্ষে বেশিক্ষণ অকারণ অবস্থান নেওয়াটা সমীচীন নয়। বেরিয়ে আসলো লাজিনা।
সিটে এসে বসার সাথে সাথে হ্যান্ডসাম সুবোধ চৌধুরী এসে কনগ্রাচুলেশন জানালো। আধা ঘণ্টার মধ্যে মোটামুটি পুরো অফিস জেনে গেল লাজিনার পদোন্নতির কথা। কেউ কেউ ভেতরে ভেতরে খুশি না হলেও চেহারার মধ্যে একটা আনন্দভাব ফুটিয়ে নিজেকে প্রকাশ করার নিষ্ফল চেষ্টা করল। লাজিনা বেশ ভালোই অনুমান করতে পারলো তাদের মনের পরিস্থিতি। তাতে তার কিছু যায় আসে না।
লাজিনার মাথার মধ্যে একটা কথাই শুধু ঘুরপাক করছে, ‘এ রেস্পেকটেবল ম্যান হ্যাজ ফলেন…’। সে ভালো করেই বুঝতে পারছে মি. নবীন কাকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বলেছেন। একবার নবীন সাহেবের কাছে ফোন করে কনফার্ম হতে ইচ্ছা হলো। উন্মাদ! অবুঝ নাকি! ঊনত্রিশ বছর বয়সে এসে ছ্যাবলামো করাটা সাজে না!
[hfe_template id=’81’]
মি. করিম যে তার প্রতি দুর্বল সে তো ভালো করেই বুঝতে পারছে। সে নিজের কথা আর কী বলবে। করিম সাহেবকে দেখতে দেখতে নিজেরও তো তাকে ভালো লেগেছে। এতো ভালোমানুষ! তার এক সময় মনে হলো করিম সাহেব বিড়ম্বনায় পড়েছিল বলেই আজও অবিবাহিত রয়ে গেছে। বোধ হয় তারই জন্যে। কথাটা মনে হতেই খুব হাসি পেল। সে মাথা নিচু করে একটু হেসে নিলো। হাসতে হাসতেই তার মাথার মধ্যে একটা বুদ্ধির উদয় হলো। সে ততক্ষণাৎ করিম সাহেবের অফিস প্রোফাইলে ঢুকল। ১২ জুলাই তাঁর জন্ম তারিখ। ও মা! কর্কট রাশির জাতক! কিন্তু কর্কটের কামড় তো তিনি দেন না কখনও। নিপাট ভালো মানুষ। ১২ জুলাই অর্থাৎ আগামী পরশু। শুক্রবার। ছুটির দিন। ভালোই হয়েছে। সে একটা পরিকল্পনা মনে স্থির করে অফিসের কাজে মনোনিবেশ করল।
শুক্রবার সকাল দশটায় চমৎকার লালরঙা একটা লিলেনের শাড়ি পরে সে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। নিজের প্রতিবিম্ব দেখে হৃদয় স্ফিত করে প্রশ্বাস নিলো।
ঘর থেকে বেরিয়ে একটা রিক্সায় উঠল। ধানমন্ডির শংকরে ফুলের দোকান থেকে একটা লাল তাজা গোলাপ কিনে আবার রিক্সায় চড়ে বসল। তারপর মি. করিমের গাড়িচালক সবুজ মিয়ার দেওয়া নয় নম্বর সড়কের ঠিকানায় নেমে রিক্সা ছেড়ে দিলো।
বাড়ির ভিতরে প্রবেশের মুখে দারোয়ান তাকে আটকানোর চেষ্টা করলে সে তার ভুবনভোলানো হাসি ছড়িয়ে ‘লাজিনা, ফোর-সি’ বলে পেন্সিল হিলের খটখট শব্দ তুলে লিফটের দিকে এগিয়ে গেল। তার রূপের ঠমকের কাছে মাঝবয়সি দারোয়ানের মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। গরিব ব্যাটা হাঁ হয়ে লাজিনার চলে যাওয়া দেখতে দেখতে তার নাম ঠিকানা দুটোই ভুলে গেল।
লাজিনা ৪-সি ফ্ল্যাটের সামনে এসে মি. করিম বিশ্বাস, নেমপ্লেটে নাম পড়ে প্রথমে প্রাণ ভরে হেসে নিলো। হাসি তার ভিতরের অবশিষ্ট দ্বিধাকে হৃদয় থেকে একেবারে উচ্ছেদ করে দিলো।
সে কলিং বেলে চাপ দিয়ে ডোর ভিউয়ারের সামনে লাল গোলাপটা ধরে অপেক্ষায় থাকল।
করিম সাহেব ক্রয় করা ফ্ল্যাটে নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করেন। লাজিনা জানে তাঁর মা বাবা উভয়ে সুস্থ শরীরে বেঁচে আছেন। তাঁরা গ্রামের বাড়িতে থাকেন। শহরমুখো খুব একটা হন না। চার দেওয়ালের ভিতর থাকতে তাদের দম আটকে আসে।
তাঁদের নিদাঘ দুপুরে আমগাছের গোড়ায় শীতল পাটিতে গা এলিয়ে তালপাতার পাখার বাতাস ভালোলাগে, গভীর রাতে টিনের চালে বৃষ্টি পতনের ছন্দ ভালোলাগে, আকাশের নিচে পুঞ্জ পুঞ্জ ফেনিল মেঘের দৌড়াদৌড়ি ভালোলাগে, হেমন্তের সকালে পাকা ধানের ক্ষেতে ঢেউ খেলানো দৃশ্য ভালোলাগে, শীতের ভোরে কুয়াশা ঢাকা পুকুরের পাড় ভালোলাগে, ফাল্গুন মাসের বাতাসে ভেসে থাকা আমের মুকুলের ঘ্রাণ ভালোলাগে– এগুলো শহরে কোথায়!
কলিং বেলের শব্দে করিম একটু বিরক্ত হলেন। এইমাত্র কাজের মেয়েকে বিদায় করে দরজা বন্ধ করে অ্যান্ডয়েড টিভিতে কৌশিকী চক্রবর্তীর ঠুমরি শুনতে বসেছেন। কৌশিকী যেমন সুন্দর রাগ পরিবেশন করেন তেমন তাঁর হাসিটাও ভারি সুন্দর! বড় ভালোলাগে তাঁকে।
করিম কোমরে লুঙ্গি বাঁধতে বাঁধতে দরজায় এসে ডোর ভিউয়ারে চোখ রাখলেন। দরজার ওপাশে লালচে একটা আভা ছাড়া কিছু দেখা যাচ্ছে না।
কে?
অপর পাশে নিশ্চুপ। তিনি ভিউয়ারে চোখটা আটকে রেখে আবার ডাকলেন, কে?
এবার লাল আভাটা একটু দূরে সরে গিয়ে লাল গোলাপের আদল নিলো। তিনি বুঝতে পারলেন তার জন্মদিনে কেউ শুভেচ্ছা জানাতে এসে রহস্য করছে। দরজাটা খোলা যায়।
তিনি দরজা খুলে কোনো অপ্সরাকে দেখার মতো চমকে উঠলেন। তার মুখ আপনাআপনি হাঁ হয়ে গেল, বিমোহিত দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল।
শারমিন প্রাণমাতানো হাসির সাথে গোলাপটা এগিয়ে দিয়ে বলল, শুভ জন্মদিন।
ঘটনার আকষ্মিকতায় হতভম্ব করিম হাত বাড়িয়ে ফুলটা নিয়ে নিঃসাড় দাঁড়িয়ে রইলেন। মুখ থেকে রা করতে পারছেন না। তিনি কী কথা বলতে ভুলে গেছেন?
কী ব্যাপার এভাবে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখবেন? ভিতরে আসতে বলবেন না?
সম্বিত ফিরে এলো করিমের। ইয়েস ইয়েস প্লিজ কম ইন।
কণ্ঠে এক অদ্ভুত জড়তা কোথায় থেকে এসে ভর করেছে।
না সরলে আসব কীভাবে?
ওহ হো! সরি।
[hfe_template id=’81’]
করিম একটু সরতেই লাজিনা ঘরের ভিতর ঢুকে ভারী দরজা ঠেলে বন্ধ করে দিলো। দরজা লক হওয়ার একটা মৃদু খটাস শব্দ হওয়ামাত্র লাজিনা করিমকে দুবাহুতে বেঁধে নিলো।
এই করছেন কী, ছাড়ুন! করিম নিজেকে বাহুপাশ থেকে মুক্ত করার ব্যর্থ প্রয়াস করলেন।
লাজিনা আলতো স্পর্শে করিমকে ধরেছিল। করিমের আতঙ্ক দেখে লাজিনা বন্ধনটা আরও দৃঢ় করল। বুকে রাখা মুখটা তুলে করিমের চোখে নিজের দৃষ্টি ধরে রেখে বলল, ছাড়ার জন্য তো তোমাকে ধরিনি।
মি. করিমের কান বিশ্বাস করতে চাচ্ছে না। বক্ষঃস্পন্দন হলকুমে এসে আটকে গেছে। অথচ নাড়িতে রক্ত দ্রুত লয়ে ধাবিত হচ্ছে। তার আবেশিত দৃষ্টি দেওয়াল ঘুরে টেলিভিশনের পর্দায় গিয়ে পড়ল। সেখানে কৌশিকী চক্রবর্তী সুরের ভাঁজে ভাঁজে চোখ পাকিয়ে হাসছেন।

মঈন আহমেদ
জন্ম: ১৯৫৮
সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা।
গল্পও লেখেন। শিল্পাঙ্গনে বিচরণ করছেন বহুকাল ধরে। নাটক করেছেন এবং তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়নায়’ ইব্রাহিম হুজুরের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। নব্বই দশকের শেষে তিনি প্রচ্ছদ শিল্পী হিসেবে দক্ষতা দেখিয়েছেন। বিচ্ছিন্নভাবে এখনো প্রচ্ছদ আঁকেন।
দুই সন্তানের গর্বিত পিতা এবং স্ত্রী-ই তাঁর প্রেমিকা
প্রকাশিত গন্থ: বাদ্যি, ফুলবালা (দুটিই উপন্যাস)