অধ্যাপক আনিসুজ্জামান: প্রয়াণদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

আবদুল্লাহ আল মোহন

সহকারী অধ্যাপক, গবেষক

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বাংলাদেশের রাজনীতি, সমাজ ও সাহিত্য-ভুবনের বৃহত্তর পরিমণ্ডলের সম্মানিত এক অনন্য ব্যক্তিত্ব হয়েছিলেন। আমাদের পরম শ্রদ্ধার মানুষ, ভালোবাসার আধার অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। অধ্যাপক আনিসুজ্জমান সময়ের বাতিঘর। তাঁর সমকালে বাংলার বিদ্বান সমাজে যাঁরা দ্যুতি ছড়িয়েছেন তাঁদের মধ্যে সর্বাগ্রে অবস্থান করেছেন ড. আনিসুজ্জামান। এমিরেটাস অধ্যাপক হিসেবে যুক্ত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। হয়েছিলেন অসম্ভব সম্মানের ‘জাতীয় অধ্যাপক’। একনিষ্ঠ গবেষক হিসেবে ড. আনিসুজ্জামান বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে গবেষণার কারণে বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে। ১৮ ফেব্রুয়ারি, সাধক, মনীষী, বাংলার অসাম্প্রদায়িক মুক্তচিন্তার অন্যতম অগ্রদূত অধ্যাপক আনিসুজ্জামান স্যারের জন্মদিন। ১৯৩৭ সালের এই দিনটিতে জন্মগ্রহণ তিনি। উল্লেখ্য, ২০২০ সালের ১৪ মে বিকেল ৪টা ৫৫ মিনিটে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। আজিমপুর কবরস্থানে তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়। জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের প্রয়াণের মধ্য দিয়ে অভিভাবকশূন্য হয়েছে জাতি। তাঁর সামগ্রিক অবদানকে বিনম্র চিত্তে, অতল শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি। প্রাণের মানুষ, পরম শ্রদ্ধার মানুষ, প্রিয় শিক্ষক, প্রিয় অভিভাবককে হারিয়ে ব্যথিত, শোকাতুর আমরা। স্যার, আপনি সবসময় আলো জ্বেলে বাতিঘর হয়ে থাকবেন আমাদের মাঝে। ৮৩ বছরের জীবন পেরিয়েও তিনি ছিলেন চীরযৌবনের দূত, একইরকম প্রাণচঞ্চল। আমৃত্যু আমাদের গর্বিত দিশারী হয়ে তিনি নিজ কর্মে নিষ্ঠাবান, একান্ত ব্রতী ছিলেন; তার সাধনা থামেনি কখনো। স্বনামধন্য গবেষক ও মননশীল লেখক, আজন্মের সজীব ও সৃজনী জীবন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে অদ্যাবধি বাঙালি সমাজ জীবনের অসংগতি ও সংকটমোচনের জন্য যে সংগ্রাম করেছেন, তা তাঁকে করে তোলে বাংলাদেশের বিবেকবান এক অগ্রণী ব্যক্তিত্ব। নানা আত্মজৈবনিক রচনায় আনিসুজ্জামান স্যারের নির্মোহ দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ এবং গ্রন্থগুলিতে সংশ্লিষ্ট সময়খণ্ডে ব্যক্তি ও সমাজের সংকট উন্মোচন কখনও বা প্রসঙ্গত অতীতকে ফিরে দেখা ও ভবিষ্যতের দিকে দৃকপাত খুবই জরুরি হয়ে ওঠে আমাদের আত্ম-অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে। অসংখ্য স্মৃতির সাথেই স্যারের বলা অনেক কথাই মনে পড়ছে। ‘এমেরিটাস প্রফেসর’ কিংবা ‘জাতীয় অধ্যাপক’ বিবেকী মনীষী ড. আনিসুজ্জামান ‘সংস্কৃতি’কে জীবনের অঙ্গ হিসেবে অভিহিত করে বলতেন, ‘নিয়মিত সংস্কৃতি চর্চা আমাদের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে’। ‘জাতি হিসেবে আমাদের বাঙালিদের রয়েছে এক সমৃদ্ধ অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির উত্তরাধিকার’ উল্লেখ করে ড. আনিসুজ্জামান বলেছেন, জাতির অসাম্প্রদায়িক চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য টিকিয়ে রাখতে আমাদের অব্যাহত সাংস্কৃতিক চর্চা আবশ্যক। স্যার পালন করছেন নজরুল ইনস্টিটিউট ও বাংলা একাডেমির সভাপতির দায়িত্বসহ আরো নানান পদের গুরুভার। বর্ণিল কর্মজীবনে শিক্ষকতার পাশাপাশি বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও গবেষণার কাজে সর্বদা ব্রতী ছিলেন এই প্রাজ্ঞজন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে তাঁর রচিত ও সম্পাদিত বাংলা ও ইংরেজি গ্রন্থগুলো উজ্জ্বল আলোকরেখা হয়ে বর্তমান প্রজন্মকে পথ দেখাচ্ছে।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান সমকালীন বাংলা সাহিত্যে সর্বজনশ্রদ্ধেয় এক কীর্তিমান ব্যক্তিত্ব। তাঁর পাণ্ডিত্য ও সৃজনশীলতা দেশে-বিদেশে সুধীজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাব তিনি প্রশংসিত হয়েছেন, পুরস্কৃত হয়েছেন। মহিমান্বিত করেছেন নিজের দেশ, জাতি, ভাষা ও সংস্কৃতিকে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক সকল প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে নিজেকে শিক্ষকতা ও গবেষণায় লিপ্ত রেখেছেন ধ্যানমগ্ন যোগীর মতো। পরিণত বয়সেও তাঁর সার্বক্ষণিকনিষ্ঠাবান কর্মতৎপরতা যে কোনো যুবকের জন্য ঈর্ষার বিষয় হয়ে থাকবে। জ্ঞান-সাধনার পাশাপাশি তিনি দেশ-জাতির সকল প্রগতিশীল আন্দোলনে নিজেকে সংযুক্ত রেখেছিলেন আপসহীন যোদ্ধারমতো, যা তাঁর পাণ্ডিত্ব ও ব্যক্তিত্বে যোগ করে সম্পূর্ণ এক ভিন্নমাত্রা। মননশীল গবেষক হিসেবে যৌক্তিক কারণেই প্রবন্ধ তাঁর সাহিত্য সাধনার প্রধান অবলম্বন। ড. আনিসুজ্জামান আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা, সংস্কৃতি, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পাঠ ও গবেষণায় অপরিহার্য হয়ে উঠেছিলেন। দু’হাত উজাড় করে তিনি আমাদের দিয়েছেন, স্বার্থপরের মত আমরা নিয়েছিও। কিন্তু এ যেন অফুরন্ত ভাণ্ডার- তাঁকে নিঃশেষিত করা যাচ্ছে না। অবাক হয়ে দেখছি তাঁর বাড়-বাড়ন্ত। সনিষ্ঠ জ্ঞান-তপস্যা তাঁকে পরিপূর্ণ করে রাখতে পেরেছিলো। বিদ্বসমাজে তাঁর সচলতা, নিরলস পাঠদান, ক্রান্তি-মুহূর্তে সশরীর উপস্থিতি, নতুন প্রতিভার আহ্বানে এবং সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে পরিভ্রমণ বুদ্ধিবৃত্তিক জগতকে সমুজ্জ্বল করে তোলে। অল্প বয়সে জনপ্রিয় ও নিষ্ঠাবান শিক্ষক হওয়া, তাঁর অধিকাংশ শিক্ষকের আগে পিএইচডি অর্জন, কিশোর বয়স থেকেই বিভিন্ন সাংস্কৃতিক-সামাজিক আন্দোলনের সামনের সারিতে থাকা, কয়েকটি অনবদ্য সম্পাদনাকর্ম এসব মিলে গত শতকের ষাটের দশকেই খ্যাতিমান হয়ে উঠেছিলেন আনিসুজ্জামান। দায় ও দায়িত্বশীলতা, অভিভাবকত্ব মিলে অতুল্য পোর্ট্রেট আনিসুজ্জামানের। নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়া একজন মানুষ আনিসুজ্জামান। তাঁর শিক্ষা, সংস্কৃতি চর্চা, তাঁর লেখালেখি এক মার্গীয় উচ্চতায় মহীরূহ সমান। তিনি ছিলেন আমাদের অভিভাবকও। বাঙালির শেকড়ানুসন্ধান ও চেতনার জাগরণে তাঁর চর্চা ও অধ্যবসায় আমাদের সুদূরের পথনির্দেশক হয়ে ছিলো, থাকবেও।

পেশায় তিনি নিরলস জ্ঞানসাধক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, চিন্তায় ও মননে দূরদর্শী একজন মুক্তবিশ্বের সুনাগরিক, রাষ্ট্রনায়ক। বাংলা, বাঙালি ও বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কোনটি? অবশ্যই তার বাঙালিত্ব, বাঙালি জাতীয়তাবাদ। এই বাঙালি জাতীয়তা বোধটি সমগ্র বাঙালির মধ্যে জাগ্রত হয়েছিল মূলত ’৪৭-উত্তর ধর্মভিত্তিক দেশভাগের ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক শোষণ-নির্যাতনের প্রেক্ষাপটে। পাশ্চাত্যে ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লব, রুশ বিপ্লব এবং ফরাসি বিপ্লবের মতো তখন আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীরাও এগিয়ে এলেন বাঙালির স্বাধীকার তথা আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠায়। ওইসব অগ্রগণ্য বুদ্ধিজীবীদের পুরোধা ব্যক্তিত্বের একজন ছিলেন আনিসুজ্জামান। আমাদের মাতৃভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ এবং তার পরবর্তী পাঁচ দশকে এ দেশের মানুষের প্রতিটি গণতান্ত্রিক সংগ্রামে অকুতোভয় ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অন্যতম অধ্যাপক; একাধারে অতুলনীয় গবেষক, চিন্তক ও অসামান্য লেখক। তিনি শিক্ষাবিদ, কিন্তু তার শিক্ষার অহঙ্কার ছিলো না এতটুকুও। উদাহরণযোগ্য তিনি বিনয়ী, নিরহঙ্কারী মানুষ ছিলেন। তাঁর জীবনযাপন সাদাসিধে, সরল। অপরিসীম মানসিক ধৈর্যশক্তি এবং বয়স ও শ্রেণি-পেশার পার্থক্য ভুলে সবার সঙ্গে তাঁর মিশে যাওয়ার ক্ষমতা ঈর্ষণীয়। তিনি লিখেছেন অবিরাম। তিনি মুক্তবুদ্ধি, সুরুচি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে নিঃশঙ্কচিত্ত। কয়েক প্রজন্মের শিক্ষক হিসেবে জাতির অন্যতম অভিভাবক হিসেবে তিনি প্রজন্মকে জানান, বর্তমানকে জানান, ভবিষ্যতের জন্য বলেছেন। মানতে বাধ্য করেন না কিন্তু সকলেই মেনে নেন। এই অভিভাবকত্ব কী কম! বিরল। এই শ্রদ্ধাভজন মানুষটি শিক্ষক হিসেবে তাঁর ছাত্রদের প্রতি মমতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন অকুণ্ঠ চিত্তে। ফলশ্রুতিতে তাঁর সে-সব শিক্ষার্থীও আজ সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছেন স্বমহিমায়। কিন্তু কোনো কৃতিত্ব নিয়ে কখনো সামনে এসে দাঁড়াননি এই গুণি মানুষটি। আনিসুজ্জামান যে গণতান্ত্রিক ও উদারনৈতিক সমাজের স্বপ্ন দেখতেন, শ্রেণিকক্ষের ভেতরে ও বাইরে বহু মানুষকে তাতে যেভাবে অনুপ্রাণিত করতে পেরেছেন, সেখানেই তাঁর সার্থকতা। উন্নত রুচি, সংযম ও পরমতসহিষ্ণুতা চর্চায় তিনি ছিলেন আদর্শ। ছিলেন অনুচ্চকণ্ঠ, কিন্তু নীতি ও আদর্শের ব্যাপারে আপসহীন। নব্বইয়ের দশকে গড়ে ওঠা গণ–আদালতে তিনি যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগনামা উত্থাপন করেছিলেন। পরবর্তীকালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হলে মৌলবাদীদের হুমকি অগ্রাহ্য করে তিনি আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন।

আমাদের জাতিসত্তার বিবেক প্রহরী অধ্যাপক আনিসুজ্জামান পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনা জেলার বসিরহাটে জন্মগ্রহণ করেন। ছেলেবেলার অনেকটা সময় কেটেছে কলকাতায়। তাঁর পিতা এ টি এম মোয়াজ্জেম হোমিও চিকিৎসক। মা সৈয়দা খাতুন গৃহিনী, লেখালেখির অভ্যাসও ছিল। পিতামহ শেখ আবদুর রহিম ছিলেন লেখক ও সাংবাদিক। আনিসুজ্জামান ছিলেন পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে চতুর্থ। তিনি স্ত্রী সিদ্দিকা জামান, দুই মেয়ে রুচিতা জামান, শুচিতা জামান এবং ছেলে আনন্দ জামান। কলকাতার পার্ক সার্কাস হাইস্কুলে শিক্ষাজীবন শুরু করেছিলেন আনিসুজ্জামান। সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত সেখানেই পড়েছেন। দেশভাগের পর তিনি খুলনা জিলা স্কুলে এবং তারপর ঢাকায় প্রিয়নাথ হাইস্কুলে (বর্তমানে নবাবপুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয়) পড়েন। ১৯৫১ সালে প্রিয়নাথ হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক ও ১৯৫৩ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৬ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক এবং ১৯৫৭ সালে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে স্নাতকোত্তর লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সে সময়ে বিভাগীয় প্রধান ছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। শিক্ষক হিসেবে তিনি পেয়েছিলেন শহীদ মুনীর চৌধুরীকে। অনার্সে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে “নীলকান্ত সরকার” বৃত্তি লাভ করেন। পরে তিনি ‘ইংরেজ আমলে বাংলা সাহিত্যে বাঙালি মুসলমানের চিন্তাধারা (১৭৫৭-১৯১৮)’ শীর্ষক গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। এ ছাড়া ১৯৫৬ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘উনিশ শতকের বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাস ইয়ংবেঙ্গল ও সমকাল’ বিষয়ে পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রি অর্জন করেন। পেশাগত জীবন তিনি শুরু করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা দিয়ে, ১৯৫৯ সালে। এরপর ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে জুনিয়র রিডার হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ভারতে গিয়ে শরণার্থী শিক্ষকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি’র সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। যুদ্ধকালে গঠিত বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে যুক্ত হন।

[hfe_template id=’81’]

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে ১৯৫০ সাল থেকেই আনিসুজ্জামানের পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা। মুজিবনগরে তাজউদ্দীনের বিচক্ষণ কর্মকাণ্ড সরেজমিনে কাছ থেকে দেখেছেন। মহান ভাষা আন্দোলন, রবীন্দ্র উচ্ছেদবিরোধী আন্দোলন, রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী আন্দোলন এবং ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলনে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন।

জন্মদিনের এক আলোচনায় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেছিলেন, ‘জীবনের এ বেলায় এসেও নিজেকে বৃদ্ধ মনে হয় না। জীবন তৃষ্ণার আবেগে এখনও নিজেকে তরুণ মনে হয়। যা পেলাম, তাতে তৃপ্ত। প্রত্যাশার চেয়ে প্রাপ্তিই বেশি। নইলে কী আর এত ভালোবাসা! দীর্ঘ জীবনের কোনো বিশেষত্ব নেই, যদি না জীবনে সৃষ্টি থাকে। বাবার নিকট থেকে সময়নুবর্তিতা শিখেছিলাম আর সত্যানুবর্তিতা শিখিয়েছিলেন মা।’ নিজের মা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘১৯৫২ সালে শহীদ মিনার নির্মাণের পরপরই মা আমাকে আর বাবাকে নিয়ে শহীদ মিনারে যান। সেখানে সবাই ফুল দিচ্ছিল শহীদের স্মরণে। মায়ের কাছে ফুল ছিল না। মা হাতের বালা খুলে দিয়েছিল শহীদ মিনারের বেদিতে।’

১৯৬৯ সালের জুন মাসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের রিডার হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭১ সালে ভারতের শরণার্থী শিক্ষকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি’র সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তারপর বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭৪-৭৫ সালে কমনওয়েলথ অ্যাকাডেমি স্টাফ ফেলো হিসেবে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে গবেষণা করেন। জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা-প্রকল্পে অংশ নেন ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসেন। ২০০৩ সালে অবসর গ্রহণের পর সংখ্যাতিরিক্ত শিক্ষক হিসেবে যুক্ত হন। ২০১৮ সালের ১৯ জুন সরকার তাঁকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেয়। সর্বৃশেষ তিনি বাংলা একাডেমির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন। যুক্ত ছিলেন সাহিত্য পত্রিকা কালি ও কলম-এর সঙ্গে।

একজন আলোকিত মহৎপ্রাণ মানুষ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। আমাদের অসামান্য অভিভাবক আনিসুজ্জামান শুধুমাত্র সময়ান্তরে আমাদের কাছে এক মহীরুহ হয়ে ওঠেননি; আশৈশব তাঁর বেড়ে ওঠার ইতিহাস, পারিবারিক আবহ এক্ষেত্রে যেমন ভূমিকা রেখেছে, তেমনি তাঁর লেখাপড়া ও জানার প্রতি আগ্রহ তাঁকে লক্ষ্য অর্জনে অনেক বেশি অগ্রসর করে দিয়েছে। তিনি শুধু দেশ-বিদেশে লেখাপড়া শেখা একজন সাধারণ মেধাবী শিক্ষকমাত্র হয়ে থাকতে চাননি, নিরন্তর সৃষ্টিশীলতা ও শিক্ষার মধ্যে তিনি নিজেকে আবিষ্কার করতে চেয়েছেন। এ প্রমাণ আমরা তাঁর লেখালেখিতে যেমন লক্ষ্য করি, তেমনি তা স্পষ্ট হয় তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের বিষয়গুলোর দিকে লক্ষ্য করলে। বাংলা ইংরেজি মিলিয়ে তিনি যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের গ্রন্থগুলো সম্পাদনা করেছেন- আনিসুজ্জামানের মেধাজাত সেইসব বিষয়ের ওপর আলো ফেলার মতো দ্বিতীয় কাউকে তো চোখে পড়ে না। বরং বিস্মিত হতে হয় তিনি সত্যি সত্যি কী বিচিত্র বিষয়কে ধারণ করে বড় হয়েছেন! কী বর্ণঢ্য তার জীবন! জ্ঞানের জন্য, নিজেকে রাঙিয়ে তুলতে তিনি কী অমানুষিক পরিশ্রমই না করে গেছেন; এবং করছেন। লেখক ও অভিভাবক আনিসুজ্জামানের যে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে সবার সামনে উঠে এসেছে; তা হলো- তিনি মানুষের চেতনার ও বুদ্ধিবৃত্তির উপেক্ষিত এলাকাগুলোকে শনাক্তকরণে তাঁর দীর্ঘ বর্ণাঢ্য জীবনের অভিজ্ঞতায় আলো ফেলে চলেছেন। সেটা তাঁর বক্তৃতা, লেখা, আড্ডা-অন্তরঙ্গতায়ও প্রমাণিত হয়েছে। আজ তাই সমাজের সুস্থ বোধসম্পন্ন মানুষের কাছে কখনো কখনো হয়ে পড়েন একক নির্ভরতা। আজ আমাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক অভিভাবকত্ব খুঁজতে গেলে তাঁর বিকল্প মেলাই দুরূহ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার রচনা আমাদের শিল্প-সংস্কৃতি ও ইতিহাসের বিবেচনায় খুবই গুরুত্ববহ।

তাঁর রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা শতাধিক। তাঁর প্রবন্ধ-গবেষণা গ্রন্থের মধ্যে- মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য, মুসলিম বাংলার সাময়িকপত্র, মুনীর চৌধুরী, স্বরূপের সন্ধানে, Social Aspects of Endogenous Intellectual Creativity (1979) Factory Correspondence and other Bengali Documents in the India Official Library and Records, আঠারো শতকের বাংলা চিঠি, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, পুরোনো বাংলা গদ্য, মোতাহার হোসেন চৌধুরী, Creativity, Reality and Identity, Cultural Pluralism, Identity, Religion and Recent History, আমার একাত্তর, মুক্তিযুদ্ধ এবং তারপর, আমার চোখে, বাঙালি নারী : সাহিত্যে ও সমাজে, পূর্বগামী, কাল নিরবধি প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। বিদেশি সাহিত্যের অনুবাদ করেছেন- অস্কার ওয়াইল্ডের ‘An Ideal Husband’ এর বাংলা নাট্যরূপ ‘আদর্শ স্বামী’, আলেক্সেই আরবুঝুভের ‘An Old World Comedy’ -র বাংলা নাট্যরূপ ‘পুরনো পালা’।. একক ও যৌথ সম্পাদনা করেছেন- রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগর-রচনা সংগ্রহ (যৌধ), Culture and Thought (যৌথ), মুনীর চৌধুরী রচনাবলী ১-৪ খণ্ড, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, প্রথম খণ্ড’ (যৌথ), অজিত গুহ স্মারকগ্রন্থ, স্মৃতিপটে সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মারকগ্রন্থ, নজরুল রচনাবলী ১-৪ খণ্ড (যৌথ), SAARC : A People’s Perspective, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের আত্মকথা, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ রচনাবলী (১ ও ৩ খণ্ড), নারীর কথা (যৌথ), ফতোয়া (যৌথ), মধুদা (যৌথ), আবু হেনা মোস্তফা কামাল রচনাবলী (১ম খণ্ড, যৌথ), ওগুস্তে ওসাঁর বাংলা-ফরাসি শব্দসংগ্রহ (যৌথ), আইন-শব্দকোষ (যৌথ)।

[hfe_template id=’81’]

জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান দেশে-বিদেশ অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলের কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় ‘সাম্মানিক ডি. লিট’ উপাধিতে ভূষিত করে। ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য কেশরীনাথ ত্রিপাঠী অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে এই উপাধি প্রদান করেন। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান এর আগে রবীন্দ্রভারতী ও নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও সাম্মানিক ডি. লিট লাভ করেছেন। আনিসুজ্জামান দাউদ পুরস্কার (১৯৬৫), বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৭০), একুশে পদক (১৯৮৫), আনন্দ পুরস্কার (১৯৯৩), রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডি.লিট (২০০৫), এশিয়াটিক সোসাইটিতে (কলকাতা) ইন্দিরাগান্ধী স্মারক বক্তৃতা, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে শরৎচন্দ্র স্মারক বক্তৃতা, নেতাজী ইনস্টিটিউট অফ এশিয়ান অ্যাফেয়ার্সে নেতাজী স্মারক বক্তৃতা, অনুষ্টুপের উদ্যোগে সমর সেন স্মারক বক্তৃতা প্রদান এবং ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মভূষণ’ (২০১৪)পদকে ভূষিত করে। এ ছাড়া তিনি দুবার আনন্দবাজার পত্রিকার ‘আনন্দ পুরস্কার’, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘জগত্তারিণী’ পদকসহ দেশ-বিদেশে অনেক পদক ও সম্মাননা পেয়েছেন।

দীর্ঘ কর্মময় জীবনে হাজারো ঘটনা এবং বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের সংস্পর্শে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ধীরে ধীরে নিজেকে পরিণত করেছেন এক মহামহীরুহ হিসেবে। প্রয়াত সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের ‘আমার বন্ধু আনিসুজ্জামান’ শীর্ষক কবিতার শেষাংশ পাঠে সকলের ‘প্রিয় স্যার’ অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের জীবন ও কাজের একটি রেখাচিত্র পাওয়া যায়। ‘মানুষ জন্ম নেয় এবং মানুষ বড় হয়-/বয়সে বড় হয় সকলে, কর্মে কতিপয়।/ এক জীবনের অর্জন কি এক কথাতে বলা যায়?/ প্রতিদিনের চিত্রলেখা দিনের শেষে মুছে যায়।/ সবটাই কি মুছতে পারে কালের হাত চলমান?/ অমোচ্য যে নামগুলো তার একটি আনিসুজ্জামান’।

ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম কীভাবে সহাবস্থান করে সেই প্রশ্ন তুলে অধ্যাপক আনিসুজ্জমান বলেছেন, ১৯৭১ এর পূর্ববর্তী ২৪ বছরের সংগ্রাম ও অর্জনের সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী ৪৬ বছর পশ্চাদপসারণ ও বিসর্জনের ইতিহাস। এক সম্মাননা অনুষ্ঠানে আনিসুজ্জামান স্যার বলেন, “১৯৭৭ সালে সামরিক আইনের অধীন ঘোষণাবলে সংবিধানের যে সংশোধনী আনা হয়েছিল, তাতে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে গণতন্ত্রের গায়ে হাত পড়েনি, তবে সমাজতন্ত্রের পরে যুক্ত হয়েছিল ‘অর্থাৎ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচার’। তারপর আমরা এটি বজায় রেখেই প্রথমে বিরাষ্ট্র্রীয়করণের পথ ধরলাম এবং পরে মুক্তবাজার অর্থনীতি প্রবর্তন করলাম। “এখন আর যাই হোক ‘অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচার’ আমাদের লক্ষ্য নয়। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আমাদের খুবই কাম্য, কিন্তু সম্পদের সুষম বণ্টনের প্রশ্নটি আমরা অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রতিবন্ধক হিসেবে বিবেচনা করছি যেন।” তিনি বলেন, “এখন মাঝে মধ্যে ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার দাবি ওঠে। সংবিধানের সংশোধনীর দ্বারা ১৯৭২ সালের রাষ্ট্র্রপরিচালনার মূলনীতি ফিরিয়ে আনা হয়েছে বটে, কিন্তু ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম রয়ে গেছে। ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম কীভাবে সহাবস্থান করতে পারে, তা আমাদের বোধগম্য নয়।” বাংলাদেশের সংবিধানের অনুবাদক আনিসুজ্জামান বলেন, “তাই ১৯৭২ এর সংবিধানে রাষ্ট্রপরিচালনার যেসব মূলনীতি ঘোষিত হয়েছিল, অক্ষতভাবে তা যে ফিরে আসবে, আমার সে ভরসা নেই। অবশ্য আমি জানি, ইতিহাস কখন কেমন মোড় নেয়, তা বলা দুঃসাধ্য। এবং সে মোড় নেওয়ার সময়ে ইতিহাস আমার ভরসা-নির্ভরতাকে বিবেচনায় নেবে না। “আজ মনে হয়, ১৯৭১ থেকে আমরা দূরে, বহু দূরে চলে এসেছি এবং ১৯৭১ এর পূর্ববর্তী ২৪ বছরের সংগ্রাম ও অর্জনের ধারার সঙ্গে তুলনা করলে তার পরবর্তী ৪৬ বছরের ধারাকে পশ্চাদপসারণ ও বিসর্জনের ইতিহাস বলতে হবে।”

শহীদ ইকবালের ভাষায় বলতে হয়, মনস্বীতায় মানুষ কেমন? অবশ্যই মঙ্গলকর। প্লেটোর ভাষায়, ‘মঙ্গলপ্রবণ’। কারা? দার্শনিকরা। কীভাবে? শিক্ষায়-সংস্কৃতিতে জ্ঞান-সৃজনে নতুন আলোর প্রয়াসে। অধিক আলোর অনুসারী যিনি। অন্ধকার বিতাড়ন করেন তিনি। সর্বত্র সক্রিয়, স্বতন্ত্রভাবে- এই আনিসুজ্জামান। তিনি জ্ঞানকে এগিয়ে নেন, আবিষ্কর্তারূপে। সে জ্ঞান মুক্তির, মুক্তি অনুসারীদের কল্যাণে। তীব্রতররূপে যা জীবনের জন্যও প্রাসঙ্গিক। স্থবিরত্ব কাটায়। আলাদা করে না মানুষকে। এক করে। সামষ্টিক করে। ধর্ম দিয়ে, বর্ণ দিয়ে, শ্রেণি দিয়ে ভেদ আনে না। চেনায় না। বরং এক করে। এই এক করার ক্ষেত্রে আচরণের সংস্কার-কুসংস্কারকেও তাড়ায়। ঠিক সেটি তিনি গড়ে তুলতে সক্ষম হন ইতিহাসের ধারাজলে। সামগ্রিক করে। অতুল্য বা জিঙ্গোইজমে নয়, শান্ত সন্তরূপে। কেন বাঙালি? বাঙালির ভাষা কী? সে কি বঙ্কিম পড়বে না? মুসলমানের সাহিত্য নাই? মীর মশাররফ তো ধুলোয় গড়া! এসবে বুঝি দ্বিধার কাল ছিল একদা। একদা কী- এই পঞ্চাশ-ষাট বছর আগেও। তখন ‘মানুষ বড়’, ‘জীবন বড়’- কথাটা পাঠক্রমের ভেতর দিয়ে যৌক্তিক করে এগিয়ে নেওয়া সহজ ছিল না। গ্রহণীয়তাও পায় নাই। এভাবে প্রতিকূলতায় ছিলেন আনিসুজ্জামানের পূর্ব-প্রজন্ম। তরুণ আনিসুজ্জামান তাঁদের নিকট থেকে প্রতিকূলতার শর্ত চিনে নেন- নিতে সক্ষম হন। দ্বিধা ছাড়াতে পরেন। তাই মুসলমান হয়েও হন সংস্কারমুক্ত আধুনিক। ইতিহাস-নৃ-বিজ্ঞান জেনে রুচি গড়েন, উদারতায়- প্রগতিতে, হন বামপন্থার কর্মী, পরে সেই দৃষ্টিকোণ থেকে সাহিত্য ও মানুষ রচনা, মানুষের ক্ষেত্রকে প্রস্তুত করা- সম্মুখের বৈরিতাকে পেরিয়ে এগিয়ে নেওয়া। অতঃপর আশ্চর্য হই, পেছান নি তিনি। অনেক ধর্মভীরু বা ধার্মিক- প্রতিক্রিয়াশীল সবটুকু বুঝেই স্বীয় পথ রচনা করেন, অন্যকেও টানেন- শামিল করতে পারেন- কোমলমতিদের চেনান, শাদা-কালো, সত্য-মিথ্যা- নিজ দেশ ও দেশের প্রগতিশীল রাজনীতিকে বুঝিয়ে দেন। লেখাতেও সবটাই তাই। বক্তৃতায়ও ঠিক একই কথা। অংশগ্রহণেও সেটুকুতেই। তাই বইগুলো তীব্র ও জাজ্জ্বল্যমান সত্যে ভরা থাকে। সত্যসন্ধ রূপ বিকিরিত, বিবর্ধিতও। এ বিকিরণ আলোর কিরণচ্ছটা। প্রত্যেকটি কাজেই তাই। প্রত্যেকটি মুহূর্তকে তিনি সে অর্থেই সমর্পণ করেন ও কাজে লাগান, নির্মাণ করেন। মনস্বীতারও দাম তাই তাঁর ঘরে ওঠে। সকলের কাছ থেকে। নির্বিশেষ করে।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান মনে করতেন, বাংলাদেশ রাষ্ট্র আজ অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে। তবে তিনি আশা প্রকাশ করেছেন, দেশ বর্তমান অবস্থার চেয়ে ভালোর দিকে অগ্রসর হবে এবং একদিন শোষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটবে। আর এই সমালোচনামূলক আশাবাদের কারণেও আমাদের অভিভাবক আনিসুজ্জামান আরো শ্রদ্ধাবান ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন। যে কোনো জাতির জন্য এমন একজন আনিসুজ্জামান নিঃসন্দেহে ক্ষণজন্মা হয়ে আবির্ভূত হন। এমন মানুষের জন্ম যে কোনো জাতির জন্য বিরল সৌভাগ্যের। যে মানুষটি জীবনে কখনো নিজেকে ফাঁকি দেননি; একটি মুহূর্তও অপব্যয়িত হতে দেননি; একটি ক্ষণও জ্ঞানের আলোহীন পথ হাঁটেননি, তিনি আনিসুজ্জামান। বিরাশি বছরের জীবনে যে বিশাল সৃষ্টিসম্ভার, উপদেশ-নির্দেশনা ও সত্য প্রকাশের দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন; তাকে অতিক্রম করা যে কারো কাজ নয়। এমন ললাট লিখন কেবল কোনো সৌভাগ্যবান জাতিরই থাকে।

[hfe_template id=’81’]

এই পাথর সময়ে সমাজের সর্বস্তরে দ্যুতিহীন মানুষের প্রবল দাপট এখন। দ্যুতিময় মানুষের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের এই চিরপ্রস্থানে তাঁর পরিবারের সদস্যরা হারালেন নিকটতম মানুষটিকে, ছাত্ররা হারালেন মনস্বী শিক্ষককে, বন্ধু ও অনুরাগীরা হারালেন নম্রভাষী সুরসিক স্বজনকে; কিন্তু জাতি হারাল অনন্য এক অভিভাবক। তরুণ বয়স থেকে মুখর এক কর্মময় জীবন তিনি বরণ করে নিয়েছিলেন। আর সে জীবন মিশে গিয়েছিল বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসের উত্থান–পতনময় বন্ধুর পথে। আনিসুজ্জামানের উদারতা, রুচি, সংযম ও পরমতসহিষ্ণুতা বিচিত্র মত ও পথের মানুষকে তাঁর বন্ধু ও শুভার্থী করে তুলেছিল। তিনি ছিলেন আক্ষরিক অর্থে অজাতশত্রু। আনিসুজ্জামান, আমাদের হাতেগোণা অল্পক’জন দ্যুতিময় মানুষের মধ্যে সবচে বর্ণিল সবচে প্রবীন সর্বজনশ্রদ্ধেয় নাম। যাঁর হীরক দ্যুতি তাঁর চারপাশকে আলোকিত করে রেখেছিলো। যাঁর স্নিগ্ধ উপস্থিতি নানান সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিকসংকট ও টানাপোড়েনে অস্থির ও দিশেহারা মানুষের হৃদয়ে প্রশান্তির প্রলেপ মেখে দিয়েছিলো। উদ্দাম হাওয়া বইয়ে দেয়। স্বপ্ন ও আশাবাদ রোপন করে দেয়। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চা, গবেষণা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন, অসাম্প্রদায়িক সমাজ নির্মাণ এবং জাতির গণতান্ত্রিক মানস গঠনে তাঁর নিরন্তর সাধনা রবীন্দ্রনাথের কবিতার কথাই মনে করিয়ে দেয়। ‘এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ/ মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান।’ সর্বার্থেই তিনি ছিলেন মৃত্যুহীন প্রাণ। তাঁর শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়। তিনি আমাদের মাথার ওপরে ছায়া হয়ে ছিলেন, স্মরণেও থাকবেন সবসময়- প্রিয় স্যারের স্মৃতির ছায়ায় সেই আশাবাদেই শেষ করি। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান স্যারের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাই।


আবদুল্লাহ আল মোহন

পাবনা জেলার যমুনাতীরের নগরবাড়ী ঘাটের সন্তান আবদুল্লাহ আল মোহন। বর্তমানে ভাসানটেক সরকারী কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ বিষয়ে গবেষণায় দেশ-বিদেশের আগ্রহী পাঠকদের মাঝে তাঁর রচনা যেমন মনোযোগ আকর্ষণ করেছে, তেমনি মনস্বী শিক্ষাবিদদের কাছেও পেয়েছেন উচ্ছ্বসিত প্রশংসা। ভাসানটেক সরকারী কলেজের মুজিববর্ষ পালন কমিটির আহ্বায়ক আবদুল্লাহ আল মোহনের ইতিমধ্যে মুজিববর্ষেই প্রকাশিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সংক্রান্ত গবেষণামূলক গ্রন্থ এবং ভ্রমণগদ্য- ‘খোকা থেকে মুজিব : বঙ্গবন্ধু থেকে জাতির পিতা’, ‘সম্পর্কের সেতুবন্ধনে : বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনা’, ‘বঙ্গবন্ধু ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ’, ‘হাসু থেকে শেখ হাসিনা : জননেত্রী থেকে বিশ্বনেত্রী’ এবং ভ্রমণকাহিনি ‘দৃষ্টি ও অন্তর্দৃষ্টির ভারত ভ্রমণ’। প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে আরো কয়েকটি গ্রন্থ। শিক্ষাকে শিক্ষার্থীর জন্য সৃজনশীল ও আনন্দময় করে তুলতে মোহনের অভিনব প্রচেষ্টা আনন্দময় সহশিক্ষার সৃজনশীল আয়োজন ‘মঙ্গল আসর’ এবং ‘গড়ি ঘরে ঘরে পাঠাগার’ কর্মসূচি উল্লেখযোগ্য। সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগেও তৈরি করা হয়েছে তথ্যচিত্র ‘মোহনের মঙ্গল আসর।
পাবনা জেলার যমুনাতীরের নগরবাড়ী ঘাটের সন্তান আবদুল্লাহ আল মোহন। বর্তমানে ভাসানটেক সরকারী কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ বিষয়ে গবেষণায় দেশ-বিদেশের আগ্রহী পাঠকদের মাঝে তাঁর রচনা যেমন মনোযোগ আকর্ষণ করেছে, তেমনি মনস্বী শিক্ষাবিদদের কাছেও পেয়েছেন উচ্ছ্বসিত প্রশংসা। ভাসানটেক সরকারী কলেজের মুজিববর্ষ পালন কমিটির আহ্বায়ক আবদুল্লাহ আল মোহনের ইতিমধ্যে মুজিববর্ষেই প্রকাশিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সংক্রান্ত গবেষণামূলক গ্রন্থ এবং ভ্রমণগদ্য- ‘খোকা থেকে মুজিব : বঙ্গবন্ধু থেকে জাতির পিতা’, ‘সম্পর্কের সেতুবন্ধনে : বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনা’, ‘বঙ্গবন্ধু ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ’, ‘হাসু থেকে শেখ হাসিনা : জননেত্রী থেকে বিশ্বনেত্রী’ এবং ভ্রমণকাহিনি ‘দৃষ্টি ও অন্তর্দৃষ্টির ভারত ভ্রমণ’। প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে আরো কয়েকটি গ্রন্থ। শিক্ষাকে শিক্ষার্থীর জন্য সৃজনশীল ও আনন্দময় করে তুলতে মোহনের অভিনব প্রচেষ্টা আনন্দময় সহশিক্ষার সৃজনশীল আয়োজন ‘মঙ্গল আসর’ এবং ‘গড়ি ঘরে ঘরে পাঠাগার’ কর্মসূচি উল্লেখযোগ্য। সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগেও তৈরি করা হয়েছে তথ্যচিত্র ‘মোহনের মঙ্গল আসর।

Please Post Your Comments & Reviews

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected!!
Share via
Copy link
Powered by Social Snap