কুদরত-ই-হুদা
লেখক ও গবেষক
প্রাসাদ দাঁড়িয়ে থাকে ভিত্তির ওপর। কাউকে যখন কোনো কিছুর ভিত্তি বলা হয়, তখন তিনি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন সন্দেহ নেই। কিন্তু তিনি আড়ালে থেকে ক্রিয়াশীল থাকেন। শওকত ওসমান (১৯১৭-১৯৯৮)-কে বাংলাদেশের উপন্যাসের ভিত্তি বলা যায়। তবে, তিনি একা এ-ভিত্তি রচনা করেননি। আরো অনেকের সঙ্গে তিনি বাংলাদেশের উপন্যাসের ভিত্তি রচনা করেছেন। কিন্তু সেই অনেকের সঙ্গে শওকত ওসমানের একটা ভিন্নতা রয়েছে। তিনি ভিত্তির গুরুত্ব যেমন পাওয়ার দাবিদার, তেমনি সৌন্দর্যেরও অংশীদার। তিনি বাংলাদেশের উপন্যাসের ইতিহাসকে নানা বর্ণে যেমন বর্ণিল করেছেন, তেমনি এনে দিয়েছেন একটা সৌন্দর্য-সমৃদ্ধি। শওকত ওসমান বাংলাদেশের উপন্যাসের ইতিহাসে বহুমাত্রিক সমৃদ্ধি এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার দৃষ্টান্ত। তাঁকে একদিক থেকে তুলনা করা যেতে পারে অনেকটা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৮৯৪)-এর সঙ্গে। বঙ্কিম ‘সার্থক’ বাংলা উপন্যাসের জনক। আবার তিনিই নানা শ্রেণির উপন্যাস রচনা করেছেন। বঙ্কিমই বাংলা উপন্যাসের ভাবি-কালের সম্ভাব্য সাধনা ও বিচিত্র গতিবিধির জনকও বটে। একই কথা খাটে বাংলাদেশের উপন্যাসের ইতিহাসে শওকত ওসমান সম্পর্কেও। তিনি বাংলাদেশের উপন্যাসের প্রথম দিককার ‘সার্থক’ ঔপন্যাসিক। আবার শওকত ওসমানই বাংলাদেশের উপন্যাসের সম্ভাব্য সাধনা ও বিচিত্র গতিবিধির জনকও বটে।

শওকত ওসমান উপন্যাসচর্চা করেছেন প্রায় অর্ধ-শতাব্দী জুড়ে। এই দীর্ঘ কাল-পরিসরে তিনি বিচিত্র বিষয় এবং আঙ্গিকের উপন্যাস রচনা করেছেন। শওকত ওসমানের উপন্যাসগুলোকে রচনাকাল, বিষয় ও শিল্প-প্রকৌশলের প্রবণতা অনুসারে ভাগ করলে অন্তত চারটি ধরন বা পর্ব পাওয়া যাবে। প্রথমত, ১৯৪৬ থেকে ১৯৫৮ পর্যন্ত গ্রামীণ জীবননির্ভর ডিটেইলধর্মী উপন্যাস; দ্বিতীয়ত, ১৯৬২ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় শৈল্পিক অবরুদ্ধতানির্ভর রূপক-ফ্যান্টাসিধর্মী উপন্যাস; তৃতীয়ত, ১৯৭১ থেকে ১৯৭৪ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছোট ছোট ঘটনাকেন্দ্রিক উপন্যাস এবং ১৯৮৩ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত স্বাধীন স্বদেশের স্বৈরতান্ত্রিক অবরুদ্ধতার বিরুদ্ধে যূথবদ্ধ মানুষের প্রতিবাদ নির্ভর রূপক এবং বর্ণনাধর্মী উপন্যাস। শওকত ওসমান দ্বিতীয় পর্বে ক্রীতদাসের হাসি (১৯৬২)-সহ রচনা করেন চারটি উপন্যাস― চৌরসন্ধি (১৯৬৬), সমাগম (১৯৬৮), রাজা উপাখ্যান (১৯৭০)।
এক
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ষাটের দশক সবচেয়ে বেশি দ্বন্দ্বপূর্ণ, উত্তাল, সংক্ষুব্ধ। এই দশকে অধিকাংশ সময় রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন স্বৈরশাসক আইয়ুব খান। তাছাড়া চল্লিশ এবং পঞ্চাশের দশকের যাবতীয় রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক সঙ্কটের অঙ্কুর ষাটের দশকেই ক্রমাগত মহীরুহ হয়ে উঠতে থাকে। বাঙালি জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক চেতনার বৃত্ত এই দশকেই ক্রমস্ফীতি এবং পূর্ণতা লাভ করে। এ দশকেই রাজনৈতিকতা পূর্ববাংলার সমগ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে ক্রমে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এই দশকটি বাঙালি জনগোষ্ঠীর জাতীয় জীবনের সবচেয়ে বিপর্যস্ত সময়। আবার একইভাবে এই দশকটিই বাংলাদেশের সাহিত্যের সবচেয়ে সৃষ্টিমুখর সময়। বাংলাদেশের কথা ও কবিতা-সাহিত্য এ দশকেই সবচেয়ে বেশি সমৃদ্ধ হয়েছে।
সমগ্র ষাটের দশকের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক অবরুদ্ধতা ছিল প্রবল। প্রলোভন, হুমকি এবং চতুরতার আশ্রয়ে ষাটের দশকের স্বৈরশাসকগোষ্ঠী প্রগতিশীল মুক্তবুদ্ধির চর্চায় এবং সাহিত্যচর্চায় নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষ উদ্যাপনে সরকার নানাভাবে বাধ সাধে। ‘এ ব্যাপারে (রবীন্দ্র-জন্মশতবর্ষ উদ্যাপন) সামরিক সরকারের কোনো প্রকাশ্য বিরোধিতা না-থাকলেও কিছু সময় পূর্বে নানা অজুহাতে আলাউদ্দিন আল আজাদ, কে. জি মোস্তফা ও আনোয়ার জাহিদ প্রমুখ সংস্কৃতিসেবীদের গ্রেফতার করা হয়েছিল। ফলে বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন সন্ত্রস্ত’ (সাঈদ-উর রহমান ২০০১ : ৭৯)। এছাড়া এই ষাটের দশকেই ‘পর-পর কয়েকটি বইয়ের প্রকাশকের ওপর ‘কেন বইগুলো বাজেয়াপ্ত করা হবে না’ তার কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করা হয়। …ঘটনাপ্রবাহ প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কর্মীদের উদ্বিগ্ন করে’ (সাঈদ-উর রহমান ২০০১ : ১২৪)। এছাড়া বি.এন.আর, প্রেস ট্রাস্ট, পাকিস্তান রাইটার্স গিল্ড, আদমজী দাউদ পুরস্কার এবং উপাধি বিতরণের মাধ্যমে এদেশের একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী, শিল্পি-সাহিত্যিকদের বেতনদাসে পরিণত করে পাকিস্তানী প্রশাসন। এভাবে ‘আইউবের সামরিক শাসন জনগণের মৌলিক অধিকারই হরণ করেনি, অস্তিত্বের সংকট তৈরী করে, অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে বাঙালির প্রগতিশীল ও জাতীয়তাবাদী চেতনা’ (আহমেদ মাওলা ২০০৯ : ৯৪)। এই রাষ্ট্রীয় অবরুদ্ধতা এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে লেখক-বুদ্ধিজীবীদের কেউ-কেউ আত্মবিক্রয়ের পথে গিয়েছেন, কেউ-বা হলেন লিবিডোতাড়িত, রিরংসাপ্রিয়, পলায়নবাদী এবং বিবরকামী নেতিবাচক জীবনচৈতন্যের দিকে মনোযোগী।
[hfe_template id=’81’]
কিন্তু শওকত ওসমান আত্মবিক্রয়, আত্মরোমন্থন, লিবিডো, রিরংসার পথে নিজেকে চারিয়ে দেননি। বরং তিনি এই অবরুদ্ধ ও অচলায়তন সময়পর্বে সমকালীন বিদ্রোহ, আক্ষেপ, অভীপ্সা ইত্যাদি প্রকাশের জন্য গ্রহণ করেন রূপক নামক শিল্পাঙ্গিককে। হয়ত ব্যক্তিগত নিরাপত্তা, সরকারি চাকরি, পরিবারের সদস্যদের জীবনধারণের নিরাপত্তা ইত্যাদি বিবেচনা করেই তিনি এই উপন্যাসাঙ্গিকটি বেছে নিয়েছেন। শওকত ওসমানের ভাষায়― ‘আমরা বেশির ভাগ লোকই বাঁচি ফন্দি করে। রূপক উপন্যাস যে লিখেছি সেটা তো এক রকম ফন্দি। অনেকেই তার সময়কার প্রতিকূলতাকে সরাসরি মোকাবিলা করতে পারে না। ফলে অন্যভাবে প্রকাশ করেন।’ (সৈয়দ আজিজুল হক ২০০৮ : ৭৫) প্রকৃতপক্ষে, ‘শওকত ওসমানের প্রতীকাশ্রয়ী মানসচেতনার জন্ম স্বকাল-সঙ্কট থেকে নিরাপত্তা লাভের জন্যই। শওকত ওসমানের কৃতিত্ব তিনি তাঁর পলাতক চেতনাকে নিরীক্ষাধর্মী শিল্পরূপে উদ্ভাসিত করতে সমর্থ হয়েছেন।’ (সৈয়দ আকরম হোসেন ১৯৯৭ : ১০৬) ক্রীতদাসের হাসি রূপকাঙ্গিকে রচিত ‘নিরীক্ষাধর্মী শিল্পরূপ।
দুই
রূপক হচ্ছে সাহিত্যের একটি প্রকরণ, যেখানে মূল বক্তব্যবিষয়কে আড়াল করা হয় বাহ্যিক কোনো ঘটনা বা অনুষঙ্গের আবরণে। উল্লেখ্য যে, রূপকের মধ্যে প্রতীকের উপস্থিতি অনিবার্য হয়ে ওঠে। কারণ প্রতীক ছাড়া রূপকের উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয় না। শিল্প-সাহিত্যে রূপক স্বভাবতই অল্প-বিস্তর ব্যবহৃত হয়। কারণ শিল্প-সাহিত্য বাস্তব নয়। বাস্তবের একধরনের রূপকই বটে। নজরুল যেমনটি বলেছেন, ‘আসল কথাটা চাপা দিতে ভাই কাব্যের জাল বুনি।’ সাহিত্যে এই কাব্যের জাল বা আবরণ একধরনের রূপকের কাজই করে। এই মাত্রার রূপক সাহিত্যমাত্রই আত্মস্থ করে থাকে। কিন্তু সচেতন আঙ্গিক হিসাবে রূপকের আশ্রয় গ্রহণ কখনো কখনো সাহিত্যিকের জন্য অনিবার্য হয়ে পড়ে। তখন রূপক হয়ে ওঠে এক কৌশলী আঙ্গিক। বিশেষত, ‘জাতীয় জীবনে সংঘর্ষ যখন অনিবার্য হয়ে ওঠে তখনি’ অনেক সময় রূপকের আশ্রয় গ্রহণ অনিবার্য হয়ে ওঠে। শওকত ওসমানের ক্রীতদাসের হাসি উপন্যাসে রূপকের ছদ্মাবরণও অনুরূপভাবে নিরাপত্তারই এক বর্ম হিসাবে গৃহীত হয়েছে। ক্রীতদাসের হাসি উপন্যাসের আঙ্গিক তাই নির্দিষ্ট দেশ-কালের বাস্তবতারই আরেক বাস্তবতা হয়ে উঠেছে।
ক্রীতদাসের হাসি উপন্যাসে বিধৃত হয়েছে আইয়ুবী স্বৈরশাসনের স্বরূপ এবং পূর্ববাংলার স্বাধীনতাকামী মানুষের অন্তর্সত্য। ‘দীরহাম দৌলত দিয়ে ক্রীতদাস কেনা, গোলাম কেনা চলে, বান্দী কেনা সম্ভব―ক্রীতদাসের হাসি কেনা যায় না’―নায়ক তাতারীর এই উক্তিই উপন্যাসের মূলকথা। এই বিষয়বস্তু রূপায়ণের জন্যই ক্রীতদাসের হাসি উপন্যাসে আঙ্গিককৌশল হিসাবে গৃহীত হয়েছে রূপক। কাহিনির আদল হিসাবে কল্পিত হয়েছে আরব্য উপন্যাসের কাহিনির আদল; উদ্দেশ্য শাসকদের বিভ্রান্ত করা। কারণ―‘রূপকশৈলীর উপন্যাসের শিল্পী সাধারণত যে কাহিনী বর্ণনা করেন সে কাহিনীর প্রতি বিশ্বাসযোগ্য ভ্রান্তি অর্জনের জন্য এক ধরনের কাহিনীর অবতারণা করেন যাতে পাঠকের কাছে নিকটস্থ ইঙ্গিতের আড়ালটা অক্ষুণ্ন থাকে। (আহমেদ মাওলা ২০০৯ : ৯৬)
খলিফা হারুনর রশীদ বাগদাদের অধিপতি। বিপুল তাঁর পরাক্রম। গগনচুম্বী তার স্বেচ্ছাচারিতা। নিষ্ঠুরতায় যমতুল্য, আবার দাক্ষিণ্যে অতুল। সব মিলিয়ে এক খাঁটি সামন্ত। নিজের ভগ্নিপতি উজিরে আজম জাফর বার্মেকীর কতলাদেশ পালিত হবার পর থেকে তার মানসিক অস্থিরতা তৈরি হয়। রাতে এদিক-ওদিক ঘুরতে ঘুরতে একদিন দেখেন গোলাম তাতারী ও বান্দী মেহেরজানের প্রণয়রত দৃশ্য এবং শোনেন আনন্দিত তাতারীর প্রফুল্ল হাসি। সেই হাসি মনোদুঃখী হারুনর রশীদ আবার শোনার জন্য তাতারীকে নিয়ে আসেন প্রাসাদে। গোলামি থেকে মুক্ত করার প্রতিশ্র“তি দেন পূর্বোক্ত হাসি শোনানোর শর্তে। কিন্তু তাতারী হাসি তো দূরের কথা, খাওয়া-পরা বন্ধ করার উপক্রম করে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে থাকে। হারুনর রশীদের শত চেষ্টা, আদেশ ও নিষ্ঠুরতায়ও তার অবসান হয় না। এমনকি অবশেষে তাতারী শব্দ করা পর্যন্ত বন্ধ করে দেয়। ক্রুদ্ধ হারুনর রশীদ তাকে বেদম প্রহারের নির্দেশ দেন কথা বলানোর জন্য। মেহেরজানকে পর্যন্ত নিয়ে আসেন চেষ্টা চালানোর জন্য। কিন্তু কিছুই সফল হয় না। হারুনর রশীদের ক্ষোভ, দুঃখ, উত্তেজনা যখন চরমে তখন তাতারী বলে ওঠে, ‘শোন হারুনর রশীদ। দীরহাম দৌলত দিয়ে ক্রীতদাস গোলাম কেনা চলে। বান্দী কেনা সম্ভব―! কিন্তু―কিন্তু―ক্রীতদাসের হাসি―না―না―না―না―’ ( শওকত ওসমান ২০০১ : ৩৮৩)। কবি নওয়াসও মন্তব্য করেন, ‘হাসি মানুষের অন্তরাত্মারই প্রতিধ্বনি।
[hfe_template id=’81’]
ক্রীতদাসের হাসি উপন্যাসের চরিত্রায়ণের ক্ষেত্রে ঔপন্যাসিক নাট্যিকরীতি অবলম্বন করেছেন। চরিত্রগুলোকে ঔপন্যাসিক ইতি এবং নেতি―দুই শ্রেণিতে ভাগ করে পারস্পরিক দ্বন্দ্বসংঘাতের মধ্য দিয়ে তাদের ফুটিয়ে তোলার প্রয়াস পেয়েছেন। প্রধান চরিত্রগুলোর মধ্যে একদিকে আছে খলিফা হারুনর রশীদ, মশরুর, অন্যদিকে আছে তাতারী, আবু নওয়াস, আবু ইসহাক প্রমুখ। চরিত্রগুলো অধিকাংশই ঐতিহাসিক এবং বাগদাদি। কিন্তু উপন্যাসটির এই স্থানিক পটবাস্তবতা এবং চরিত্রগুলোর ঐতিহাসিক বাস্তবতা কেবল বাহ্য অর্থেই উপন্যাসটিতে ব্যবহৃত হয়েছে। নিহিত অর্থের দিকে তাকালে দেখা যাবে যে, উপন্যাসটির স্থানিক পট ষাটের দশকের পাকিস্তান তথা পূর্ববাংলা। আর চরিত্রগুলোর বাস্তবতাও ষাটের দশকের পাকিস্তান রাষ্ট্রের চৌহদ্দির মধ্যেই অনুসন্ধেয়। উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রই প্রতীকী তাৎপর্যে বিভূষিত হয়ে শওকত ওসমানের চরিত্রায়ণকৌশলকে অনন্য শিল্পিতা দান করেছে। ‘চরিত্রগুলি―এক একটি চেতনার প্রতীক। খলিফা ও মশরুর, তাতারী ও কবি নওয়াস—যথাক্রমে ক্ষমতা-অন্ধ অত্যাচারী, উৎপীড়িত মানবতার এবং শাশ্বত সৌন্দর্য ধারণার সঙ্কেতবহ।’ (সৈয়দ আকরম হোসেন ১৯৯৭ : ১০৬) উপন্যাসে প্রতীকী চরিত্র সাধারণত যান্ত্রিক এবং নি®প্রাণ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কিন্তু ক্রীতদাসের হাসি উপন্যাসের চরিত্রগুলো প্রতীকী দায় বহন করেও ঔপন্যাসিকের চরিত্রায়ণকৌশলের গুণে তারা সপ্রাণে এবং সবেগে বিকশিত হয়ে উঠেছে।
ক্রীতদাসের হাসি উপন্যাসটির আঙ্গিক একই সঙ্গে নাটক এবং উপন্যাসের আঙ্গিকবৈশিষ্ট্যকে সাঙ্গীকৃত করে রয়েছে। অথচ নাটক এবং উপন্যাস সাহিত্যের দুটি ভিন্ন প্রকরণ। যদিও স্বীকার্য যে, উপন্যাস বর্ণনাত্মক শিল্পরীতি হলেও নাটকের শিল্পরীতি ছাড়া উপন্যাস চলে না। শুধু নাট্যরস নয়, কবিত্বও উপন্যাসের মধ্যে দুর্লক্ষ্য নয়। এ জন্য বলা হয়, ‘সাহিত্যের সকল শাখার মধ্যে উপন্যাস সর্বাপেক্ষা গণতন্ত্রী। আপন বলিষ্ঠ প্রাণবত্তায় কাহিনি কবিত্ব, নাট্যরস সকল কিছুকে জারিত করে উপন্যাস নিজ স্বরূপে বিশিষ্ট।’ (সরোজ বন্দ্যোপাধায় ২০০০ : ৩৪) কিন্তু ক্রীতদাসের হাসি উপন্যাসে নাটকের উপাদান এবং আঙ্গিকবৈশিষ্ট্য এত বিস্তৃত পরিসরে গৃহীত হয়েছে যে, এটিকে অনেক সময় নাটক বলেই ভ্রম হয়। অথচ ক্রীতদাসের হাসি নাটক নয়, পুরদস্তুর উপন্যাস। উপন্যাস একটি বর্ণনাত্মক (ঘধৎৎধঃরাব) শিল্প, আর নাটক একটি ক্রিয়াত্মক (অপঃরড়হ) শিল্প। কিন্তু ক্রীতদাসের হাসিতে এ দুয়ের এক অপূর্ব বিমিশ্রণ লক্ষ করা যায়। ঔপন্যাসিক প্রতিটি পরিচ্ছেদের শুরুতে নাটকের মতোই স্থান-কাল-পাত্র-পাত্রী সম্পর্কে কিছুটা নির্দেশনা দিয়ে তারপর নাট্যিক সংলাপের মাধ্যমে কাহিনিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। চরিত্রগুলো মূলত তাদের সংলাপের মাধ্যমেই বিকশিত হয়েছে। কিন্তু নাটকের সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, ‘বিস্তৃত বাস্তব’-কে বিস্তৃতভাবে উপস্থাপন করতে না পারার সীমাবদ্ধতা। শওকত ওসমান তাঁর ক্রীতদাসের হাসি উপন্যাসে মাঝেমধ্যেই প্রয়োজনানুসারে বর্ণনাত্মক পরিচর্যার মাধ্যমে কাক্সিক্ষত ‘বিস্তৃত বাস্তবে’র আলেখ্য নির্মাণ করেছেন। এ জন্য প্রয়োজনমতো কোনো কোনো পরিচ্ছেদের পুরোটাই ঔপন্যাসিক বর্ণনাত্মকরীতিতে উপস্থাপন করেছেন।
ক্রীতদাসের হাসি উপন্যাসের শুরু উত্তম-পুরুষের দৃষ্টিকোণে। কিন্তু সেই দৃষ্টিকোণ দ্রুত পরিবর্তিত হয়ে রূপান্তরিত হয়েছে সর্বজ্ঞ দৃষ্টিকোণে। প্রকৃতপক্ষে উপন্যাসের রাউফুনের আখ্যানটি মূল উপন্যাসের সঙ্গে যেহেতু সংযুক্ত নয়, সেহেতু বলা যায়, উপন্যাসটি মূলত সর্বজ্ঞ দৃষ্টিকোণে রচিত। উপন্যাসটি যেহেতু অধিকাংশই নাট্যিকরীতিতে রচিত, সেহেতু প্রতিটি পরিচ্ছেদেই কখনো দুই বা কখনো দুইয়ের অধিক চরিত্রের দৃষ্টিকোণে ঘটনা বর্ণিত, বিবৃত এবং দৃষ্ট হয়েছে। কখনো দুটি দৃষ্টিকোণের দ্বন্দ্ব, কখনো একটি দৃষ্টিকোণের নির্বিরোধ ব্যবহারের মাধ্যমে উপন্যাসটির অবয়ব সম্পূর্ণতা পেয়েছে। এভাবে একাধিক চরিত্রের দৃষ্টিকোণ এবং ঔপন্যাসিকের নিজস্ব দৃষ্টিকোণের সমবায়ে গঠিত হয়েছে ক্রীতদাসের হাসি উপন্যাসের কাহিনিবৃত্ত। যেমন, তের পরিচ্ছেদে ব্যবহৃত হয়েছে বুসায়না এবং তাতারী দুজনের সংলাপ। কিন্তু পরিচ্ছেদটিতে ঔপন্যাসিক তাতারীর দৃষ্টিকোণ ব্যবহার করে উপন্যাসের ধারিত জীবনদৃষ্টির ওপর আলো ফেলেছেন― ‘আত্মহত্যা ভীরু বুজ্দীলের কাজ। মানুষ জীবনের মুখোমুখি দাঁড়ায়, মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ায়। সে পিছু হটে না। জন্তুরা যেমন লেজ গুটিয়ে পালায় তেমন পালায় না।’ ( শওকত ওসমান ২০০১ : ৩৬১)
ভাষা হচ্ছে ভাবের আধার। উপন্যাসে ঔপন্যাসিকের অন্বিষ্ট জীবনকে ধারণ এবং প্রকাশ করে ভাষা। তাই ‘লেখকের জীবনদৃষ্টি এবং দর্শনের সঙ্গে ভাষার ওতপ্রোত সম্বন্ধ।’ (সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় ২০০০ : ৩৫) ক্রীতদাসের হাসি উপন্যাসে শওকত ওসমান আরব্য প্রতিবেশ নির্মাণ করেছেন। ফলে সঙ্গত কারণেই ক্রীতদাসের হাসি উপন্যাসের ভাষা কেবল কাহিনি বর্ণনার বাহন হিসাবে ব্যবহৃত হয়নি, এর ভাষাকে পালন করতে হয়েছে এক স্বতন্ত্র জীবন ও সংস্কৃতির স্বরূপকে ধারণ করার দায়িত্ব। অর্থাৎ উপন্যাসের ভাষা যে জীবনকে অনুকরণ করেছে, সেই জীবনের উপযোগী হয়ে ওঠার জন্য নিজের অঙ্গে ধারণ করেছে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশিমাত্রায় আরবি-ফারসি শব্দ। শওকত ওসমানের ঔপন্যাসিক ভাষা স্বভাবতই আরবি-ফারসি শব্দ-বহুল। কিন্তু ক্রীতদাসের হাসি উপন্যাসের ভাষায় আরবি-ফারসি শব্দের প্রয়োগ কেবল বিশিষ্ট গদ্যবৈশিষ্ট্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে বরং তা এক বিশেষ সংস্কৃতির ধারক-বাহক হয়ে উঠেছে। খলিফা হারুনর রশীদের ভাষা কেবল আরবি-ফারসি শব্দবহুলই নয়, এর বাগবিধিও বাগদাদের খলিফার পদমর্যাদার সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করেছে। শুধু হারুনর রশীদ নন, উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রই কমবেশি আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার করেছে। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, উপন্যাসে কোনো চরিত্র যখন তাদের স্বাধীন সত্তার কথা বা স্বাধীনতার কথা বলেছে তখন তাদের সংলাপে আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার কম। আবু ইসহাক কবি। সত্য-সন্ধানী এবং স্বাধীনতার পূজক। এ কারণে তার ভাষায় আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার কম। শুধু তাই নয়, উপন্যাসের ভাষা ব্যবহারের আরেক গভীর তল রয়েছে। পূর্বেই বলা হয়েছে, ক্রীতদাসের হাসি উপন্যাসের চরিত্রগুলো প্রতীকাশ্রয়ী। হারুনর রশীদ ষাটের দশকের পাকিস্তানি স্বৈরশাসক আইয়ুব খানেরই প্রতীক। পাকিস্তানবাদী এই চরিত্রের সংলাপে তাই আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার বেশি। অন্যদিকে পূর্ববাংলার স্বাধীনতাপিয়াসী শোষিত মানুষের প্রতীকী চরিত্রগুলোর সংলাপে আরবি-ফারসির ব্যবহার তুলনামূলকভাবে কম। এভাবে ক্রীতদাসের হাসি উপন্যাসের ভাষা ইতিহাসের এক গভীরতলকে ধারণ করে এবং উপন্যাসের বিষয় ও জীবদৃষ্টিকে যথার্থভাবে ফুটিয়ে তুলে শিল্পসফলতা লাভ করেছে।
[hfe_template id=’81’]
সময়কে ধারণ করার আকাক্সক্ষা এবং শিল্পিতা, উভয় দিক থেকে শওকত ওসমানের ক্রীতদাসের হাসি শুধু শওকত ওসমানের নয়, সমগ্র বাংলাদেশের উপন্যাসের ইতিহাসে এক তাৎপর্যপূর্ণ উপন্যাস। এই উপন্যাসের পাঠ কেবল উপন্যাসের পাঠ নয়, এ যেন একই সাথে ইতিহাস আর শিল্পের ভুবন দিয়ে ভ্রমণের এক অনন্য অভিজ্ঞতা। এই অর্থে ক্রীতদাসের হাসি কেবল উপন্যাস নয়, এটি বাংলাদেশের ষাটের দশকের সাংস্কৃতিক-বুদ্ধিবৃত্তিক-ঐতিহাসিক বাস্তবতার শিল্পিত বাস্তবতা। এসব বিবেচনায়, ক্রীতদাসের হাসি-কে অনেকে শওকত ওসমানের ঔপন্যাসিক সত্তার শ্রেষ্ঠ শিল্পকীর্তি বলে মনে করেন।
সহায়ক গ্রন্থ ও প্রবন্ধ:
আহমেদ মাওলা (২০০৯), বাংলাদেশের উপন্যাসের শৈলী বিচার, বিদ্যা প্রকাশ, ঢাকা।
কুদরত-ই-হুদা (২০১৩), শওকত ওসমান ও সত্যেন সেনের উপন্যাস : আঙ্গিক বিচার, আদর্শ, ঢাকা।
শওকত ওসমান (২০০১), শওকত ওসমান : উপন্যাসসমগ্র, ১ম খন্ড, (সম্পা. বুলবন ওসমান সম্পাদিত), সময় প্রকাশন, ঢাকা।
সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় (২০০০), বাংলা উপন্যাসের কালান্তর, দে’জ পাবলিশিং, ৪র্থ সংস্করণ, কলকাতা।
সাঈদ-উর রহমান (২০০১), পূর্ব বাংলার রাজনীতি-সংস্কৃতি ও কবিতা, ২য় সংস্করণ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা সংস্থা, ঢাকা।
সৈয়দ আকরম হোসেন (১৯৯৭), প্রসঙ্গ : বাংলা কথাসাহিত্য, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা।
সৈয়দ আজিজুল হক (২০০৮), ‘রূপক উপন্যাসগুলো একটা কৌশল’, ব্যক্তি ও সাহিত্যিক শওকত ওসমান, (সম্পা. বুলবন ওসমান) দীপ্তি প্রকাশনী, ঢাকা

ড. কুদরত-ই-হুদা
ড. কুদরত-ই-হুদার জন্ম ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৮, ফরিদপুর জেলার আলফাডাঙা থানায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেছেন ‘ষাটের দশকে জাতীয়তাবাদী চিন্তার বিকাশ ও বাংলাদেশের কবিতা’ বিষয়ে। সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করেন। গবেষণা ছাড়াও নিয়মিত ছোটগল্প, সাহিত্য-সমালোচনা এবং ইতিহাস ও চিন্তামূলক বিষয়ে লেখালেখি করেন। প্রকাশিত গ্রন্থ : প্রবন্ধ— শওকত ওসমান ও সত্যেন সেনের উপন্যাস : আঙ্গিক বিচাৱ [আদর্শ, ২০১৩] জসীমউদ্দীন [প্রথমা প্রকাশন, ২০১৮]
COMMENTS
Thanks Kudrat-E-Huda. Thanks Jhenuk.
দারুণ একটি লেখা।
ডুবে গিয়েছিলাম লেখার মাঝে। চমৎকার উপন্যাস বিশ্লেষণ। পাশাপাশি লেখক শওকত উসমানকেও দারুণ মূল্যায়ন। তোমার প্রতিটা গদ্য আমি মুগ্ধতা নিয়ে পড়ি। অনলাইন কিংবা অফলাইনের আলোচনা গুলোও গিলে গিলে খাই। শুভকামনা স্নেহাশিস হুদা (প্রিয় হুদা স্যার)
চমৎকার লেখা। ঐতিহাসিক ঘটনার প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ সাপেক্ষে শওকত ওসমানের সাহিত্যের আঙ্গিকগুণ আলোচনা করা হয়েছে দারুণ দক্ষতার সাথে। লেখাটা পড়ে জানার আনন্দ পেয়েছি।
আগেই পড়া ছিলো ‘ক্রীতদাসের হাসি’। আর আজ এই চমৎকার লিখাটি পড়ে অনেক কিছু জানলাম।