কাজল কাপালিক
অধ্যাপক, গবেষক, লেখক
এক
প্রত্যেক জাতি তার অতীত ইতিহাস নিয়ে সচেতন। স্বজাতির ইতিহাসের প্রতি এই আগ্রহ স্বভাবজাত। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং ভারতের মিজোরাম ও ত্রিপুরা রাজ্যে বসবাসকারী ম্রাইমা বা মারমা জনগোষ্ঠী এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সংখ্যা এগারো। এরা চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, মুরং, ম্রো, বম, পাংখোয়া, চাক, খিয়াং, খুমী, লুসাই প্রভৃতি। ১৯৭৮ সালে যথাক্রমে রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলাকে সাথে নিয়ে কক্সবাজার, মৌলভীবাজার, রাজশাহী, নেত্রকোনায় সরকারি ও বেসরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য ২০১০ সালের এপ্রিল মাসে একটি আইনও প্রণয়ন করা হয়েছে। এরা বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য প্রভৃতির সংরক্ষণ ও প্রসারে নানামুখি কার্যক্রম বাস্তবায়নের চেষ্টা করে যাচ্ছে। মারমাদের নিয়ে ইতোপূর্বে বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রচিত হয়েছে। তবে, বিশ্ববাসীর কাছে নিজেদের মাথা উঁচু করতে এবং নিজেদের ইতিহাস ও সংস্কৃতি সংরক্ষণ করতে মংসানু চৌধুরী এবং উ ক্য জেন ২০১৪ সালে ‘মারমা উন্নয়ন সংসদ’ কর্তৃক দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। এরই ধারাবাহিকতায় নানা প্রতিকূল পরিবেশ পেরিয়ে বিনা পারিশ্রমিকে ক্ষেত্র সমীক্ষণের মাধ্যমে লেখকদ্বয় কাজটি সম্পূর্ণ করেন। ‘মারমা ইতিহাস ও সংস্কৃতি’ নামে তা গ্রন্থাকারে ২০১৮ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত হয়। নানাদিক থেকে বর্তমান গ্রন্থটি ব্যতিক্রম।
‘মারমা ইতিহাস ও সংস্কৃতি’ নামক বইয়ের খণ্ড সংখ্যা দুই; যথাক্রমে প্রথম খণ্ড : ইতিহাস এবং দ্বিতীয় খণ্ড : সংস্কৃতি। ৩৯২ পৃষ্ঠাব্যাপী এই বইয়ের প্রথম খণ্ড এবং দ্বিতীয় খণ্ড মিলে মোট অধ্যায় সংখ্যা তেরোটি; প্রথমে ছয় ও পরে সাতটি। বইয়ের শেষে মানচিত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামের চিত্র থেকে শুরু করে ক্ষেত্র অনুসন্ধানের নানা চিত্র এবং ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ মোট ৬০টি রঙিন চিত্র স্থান পেয়েছে। লেখকদ্বয় যতদূর সম্ভব নির্মোহভাবে মারমাদের ইতিহাস ও সংস্কৃতির বিশেষ দিকগুলোর প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন। মংসানু চৌধুরী এবং উ ক্য জেন একাজে কতোটা সাফল্য অর্জন করেছেন তা বিচারোর্ধ্ব না হলেও মারমাদের নানা বিষয় উপস্থাপনে তাঁরা ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছেন।
[hfe_template id=’81’]
বইটির ‘মুখবন্ধে’ লেখকদ্বয় বলেন, মারমা জনগোষ্ঠীর ইতিহাস ও সংস্কৃতি নিয়ে ভিন্ন ভাষাভাষী লেখকবৃন্দ এ জাতিকে আদিবাসী, উপজাতি মগ বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী নামে আখ্যায়িত করেছে; তাদেরকে ১৭৮৪ সালের বর্মী-আরাকানী যুদ্ধের উদ্বাস্তু হিসেবে চিহ্নিত করেছে; তাদেরকে মোগল-আরাকানী যুদ্ধের পরাজিত আরাকানী বাহিনির বংশধর হিসেবে আখ্যায়িত করেছে; আবার কেউ তাদেরকে চট্টগ্রাম অঞ্চলে আরাকানী রাজার শাসনামলে ‘মগ’ নামে খ্যাত বঙ্গের সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলে লুণ্ঠনকারীদের উত্তরসূরী হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করলেও এগুলোর কোনোটারই জোরালো কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে বলে মারমা জনগোষ্ঠী মনে করে না। এসব লেখকবৃন্দের বিবরণকে মারমাগণ খণ্ডিত, অসম্পূর্ণ ও বাস্তবতা বিবর্জিত বলে মনে করেন।
তাহলে পাঠকমনে প্রশ্ন জাগতে পারে মারমাদের প্রকৃত ইতিহাস কী? এদের পূর্বপুরুষ কারা? তারা কোথা থেকে কিভাবে বাংলাদেশে এসেছে? বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে এদের কোন উপায়ে অভিবাসন ঘটে? মারমাদের বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি কীরূপ? কীভাবে তারা ধর্মীয় ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে? তাদের জীবনে স্বতন্ত্র এই ঐতিহ্য কীভাবে এবং কতোটা প্রভাব ফেলেছে? অন্য কোনো অনুষঙ্গ এদেরকে প্রভাবিত করে কি না। ‘মারমা ইতিহাস ও সংস্কৃতি’ গ্রন্থের লেখকদ্বয় এজাতীয় প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করতে প্রচলিত মতের পক্ষে-বিপক্ষে না গিয়ে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে মারমাদের ইতিহাস ও সংস্কৃতি উদ্ধারে ব্রতী হয়েছেন। তবে, প্রত্যক্ষভাবে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে এবং অসংখ্য ঐতিহাসিক গ্রন্থ ও তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তায় তাঁরা এসব ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিচার করেছেন।
দুই
মংসানু চৌধুরী এবং উ ক্য জেন ‘মারমা ইতিহাস ও সংস্কৃতি’ বইয়ের প্রথম খণ্ডে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূপ্রকৃতি, অধিবাসী, মারমা জাতির ইতিহাস, টিবেটো-বার্মান ও অস্ট্রো-এশিয়াটিক জনগোষ্ঠী, আরাকানের ইতিহাস, মারমা জাতির শেকড় সন্ধান, প্রাক-বৃটিশ ও ঔপনিবেশিক শাসনামলের বার্মা, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে মারমাদের অবস্থান, ত্রিপুরায় মারমা, মারমাদের দল ও মারমা-মগ বিতর্ক প্রভৃতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। এসব ইতিহাস থেকে জানা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনপদের মধ্যে মারমা দ্বিতীয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী। এরা নিজেদেরকে মঙ্গোলীয় জাতির বংশধর বলে পরিচয় দিয়ে থাকে। এদের চেহারা, শারীরিক গঠন, গায়ের রং প্রভৃতি মঙ্গোলীয়দের সাথে অধিকাংশেই মিল আছে। মারমা নৃগোষ্ঠীর লোকেরা মঙ্গোলীয় বংশোদ্ভূতদের মধ্যে টিবেটো বার্মা জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। কালের বিবর্তনে এই বংশধর বার্মার চিনহিল প্রদেশ, ভারতের মিজোরাম ও মণিপুর অঙ্গরাজ্য এবং বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। নিকট অতীতকাল থেকে মারমারা বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলার বিভিন্ন এলাকায় আশ্রয় নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। প্রাগৈতিহাসিক কাল হতে বিভিন্ন নৃগোষ্ঠী বিভিন্ন তাগিদে ভিন্ন স্থান বা দেশ হতে এদেশে আসে। এভাবেই বাংলাদেশ বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাস, সংস্কৃতি ও সভ্যতার মিলনকেন্দ্রে পরিণত হয়।
মারমাদের আদিনিবাস মায়ানমারের আরাকান রাজ্যে। আনুমানিক ১৬০০ হতে ১৮০০ সালের মাঝামাঝি মারমা গোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে আসে। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলার মধ্যে বান্দরবান জেলায় তাদের মূল জনগোষ্ঠীর বসবাস বেশি। মারমা শব্দটি ‘ম্রাইমা’ শব্দ থেকে এসছে। এরা মায়ানমার থেকে এসেছে বিধায় তাদের ম্রাইমা নাম থেকে নিজেদেরকে মারমা নামে ভূষিত করে। ক্যাপ্টেন টি. এইচ. লুইন-এর এক বিবৃতি থেকে জানা যায়, পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীগুলোর আরাকান ত্যাগের কারণেই অনেকটা ১৮২৪ সালে বর্মী যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিলো এবং উর্বর আরাকান প্রদেশকে ব্রিটিশ রাজ্যের অন্তর্ভুক্তকরণের মধ্য দিয়ে এই যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। এটি শুধু পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীগুলোর অঞ্চলগত কারণেই নয়, বৃহত্তর এবং অধিকতর ঐতিহাসিক গুরুত্বের দিক থেকেও তা কৌতূহলোদ্দীপক। কিছুসংখ্যক মারমা বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলা কক্সবাজার ও পটুয়াখালীতে বাস করে। মারমাদের ধারাবাহিক ও নির্ভরযোগ্য ইতিবৃত্ত না থাকায় তাদের সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য পাওয়া দুষ্কর। তবে, বার্মিজ ও মারমাদের মধ্যে জাতিগত যোগসূত্রকে অস্বীকার করা যায় না। ইংরেজ এবং বাঙালি জাতি তাদেরকে ‘মগ’ হিসেবে উল্লেখ করে। পাহাড়ি অন্যান্য নৃগোষ্ঠী মারমাদেরকে বিভিন্ন নামে চিহ্নিত করে থাকে। যেমন ম্রোরা মারমাদেরকে ‘ম্রান’ লুসাই ও পাংখুয়ারা ‘ম্রাং’, চকমারা ‘ম্রাইং’, ত্রিপুরারা ‘মুখু’, খুমীরা ‘ক্রামো’, খিংয়াংরা ‘ওঅ’ বলে ডাকে। অধিকাংশ পাহাড়ি জনগোষ্ঠী তাদেরকে ভিন্ন ভিন্ন নামে ডাকলেও মারমারা নিজেদেরকে কখনো মগ বলে পরিচয় দেয় না। এমনকি মারমাদের ভাষায় বা বার্মিজ ভাষায়ও মগ বলে কোনো শব্দ নেই।
মারমা জাতিগোষ্ঠীর দুইটি দল রাজনৈতিক কারণে শরণার্থী হয়ে দুইবারে প্রথমে চট্টগ্রাম এবং পরে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি স্থাপন করে। এর প্রথম দল সম্পর্কে জানা যায়, প্রাচীনকালে শ্যামদেশ বা বর্তমান থাইল্যান্ড শ্বেতহস্তীর জন্য সুবিখ্যাত ছিলো। ১৫৬৪ সালে ব্রহ্মদেশের অন্তর্গত পেগুর তেলেইংরাজ শ্যামদেশ আক্রমণ করে সেখানকার রাজার চারটি শ্বেতহস্তী লুণ্ঠন করে নিয়ে আসেন। ১৫৯৯ সালে আরাকানরাজ মিনয়াজাগী (রাজত্বকাল ১৫৯৩-১৬১২) পেগু আক্রমণ করে চারটি শ্বেতহস্তী, তেলেইং রাজকুমার মেংশোয়েপ্রু ও তাঁর অনুগত কয়েক হাজার তেলেইংকে বন্দী করে আরাকানের রাজধানী ম্রোহং-এ নিয়ে আসেন। রাজকুমারের তেলেইংরা সৈনিক ছিলো। আরাকানরাজের পেগু অভিযানের সেনাপতি ছিলেন আরাকান অধিকৃত দক্ষিণ চট্টগ্রামের শাসনকর্তা মহাজ্ঞানী পণ্ডিত ব্যক্তি মহাপিন্নাগী। পেগু থেকে প্রত্যাবর্তনকালে তিনি পথিমধ্যে মৃত্যুবরণ করেন। মিনয়াজাগীর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র মেংখামৌং (রাজত্বকাল ১৬১২-১৬২২) আরাকানের রাজা হন। তাঁর রাজত্বকালে চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর নদী সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় পর্তুগিজ এলাকার দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি পায়। ১৬২০ সালে আরাকানরাজ বন্দী তেলেইং রাজকুমারকে চট্টগ্রামের শাসনকর্তা হিসেবে নিযুক্ত করে প্রেরণ করেন। তেলেইং রাজকুমার মেংশোয়েপ্রু তাঁর অনুগত তেলেইং বাহিনীসহ চট্টগ্রামে এসে সেখানকার পর্তুগিজদেরকে পরাজিত করে আরাকানরাজের প্রশংসা অর্জন করেন। আরাকানরাজ তাঁর কাজে সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে ‘বোমাং’ উপাধী প্রদান করেন। পরবর্তীকালে তাঁর উত্তরসূরীগণ রাজ্য পরিচালনা করেন। কিন্তু মোগল শাসকগণের আক্রমণে বোমাং রাজা কোংলাপ্রুর পর্যায়ক্রমে দক্ষিণ চট্টগ্রাম থেকে চিরদিনের জন্য আরাকানি শাসনের অবসান ঘটে এবং আরাকানের শাসন সুবে বাংলার মুসলমান শাসনভুক্ত হয়। পরবর্তীতে কোলাংপ্রু তাঁর বাহিনীসহ মোগল আনুগত্য স্বীকার করে বান্দরবানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ১৭৬১ সালে চট্টগ্রাম অঞ্চল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধিকারভুক্ত হলে কোংলাপ্রু মগ বা মারমা জাতিগোষ্ঠীর দলপতি হিসেবে বান্দরবান এলাকার করগ্রাহক হিসেবে নিযুক্ত হন।
[hfe_template id=’81’]
মারমাদের দ্বিতীয় দলের চট্টগ্রামে আগমন ও বসতি স্থাপন সম্পর্কে জানা যায় ১৭৮৫ সালে ব্রহ্মদেশে রাজা বোধপায়া ত্রিশ হাজার সুদক্ষ সৈন্য নিয়ে আরাকান আক্রমণ করেন। এতে আরাকান বর্মীদের অধিকারে আসে এবং তারা আরাকানের কুড়ি হাজার সৈন্যসহ রাজা তামাডাকে বন্দী করে। বর্মীরা রাজাসহ কুড়ি হাজার সৈন্যকে একে একে হত্যা করে আরাকানের নিরীহ গ্রামবাসীদের উপর অত্যাচার চালায়। এতে আরাকানের দুই-তৃতীয়াংশ অধিবাসী প্রাণ রক্ষার্থে চট্টগ্রামের কক্সবাজার মহকুমায় আশ্রয় গ্রহণ করে। আর ১৭৮৫ সাল হতে ১৮০০ পর্যন্ত আরাকানি শরণার্থীদের চট্টগ্রামে আগমন অব্যাহত ছিলো। ইংরেজ সরকার শরণার্থীদেরকে আরাকানে ফিরে যেতে বললে তারা অস্বীকৃতি জানায়। পরে ইংরেজ সরকার তাদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বোমাং সার্কেল, কক্সবাজার মহকুমা ও পটুয়াখালীতে পুনর্বাসন করে। কিন্তু পরবর্তীকালে কক্সবাজার মহকুমার আরাকানিরা সেখান থেকে ফিরে এসে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড পর্বতমালায় আশ্রয় গ্রহণ করেও তারা সেখানে স্থিত না হতে পেরে উনিশ শতকের গোড়ার দিকে মং সার্কেলে গিয়ে বসতি স্থাপন করে। ১৭৮৭ সালের ২৪ জুন তারিখে চট্টগ্রামের তৎকালীন ইংরেজ শাসনকর্তার নিকটে লেখা ব্রহ্মরাজের লেখা একটি চিঠির বিশদ বিবরণ অনুযায়ী জানা যায়, আরাকানের সকল নৃগোষ্ঠী সাধারণভাবে মগ নামে খ্যাত ছিলো। ব্রহ্মদেশের অধিবাসীরাও আরাকানের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী অধিবাসীদেরকে মগ নামে খ্যাত করে। এরাই মং সার্কেলের মগ বা মারমা নৃগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিতি পায়। উল্লেখ্য যে, স্বাধীন আরাকানি রাজ্য বিলুপ্তিকালের আরাকানের শরণার্থীদের যে অংশটি কক্সবাজারে পুনর্বাসিত হয়েছিলো তারা নিজেদেরকে রাখাইন নামে খ্যাত করে। সুরেন্দ্রলাল ত্রিপুরার ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিচিতি’ (১৯৭৯) গ্রন্থানুসারে পার্বত্য চট্টগ্রামের দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ মগ বা মারমা নৃগোষ্ঠীর সংখ্যা ১,১৬,৪৭৭ এবং তাদের অধিকাংশই বোমাং ও মং সার্কেলে বসবাস করে। কয়েক হাজার মারমা চাকমা সার্কেলের অধিবাসী। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী মারমাদের জনসংখ্যা ছিলো ১,৫৭,৩০১ জন। ২০১১ সালের শুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে মারমা জনসংখ্যা ২,০২,৯৭৪ জন এবং চাকমাদের পরেই দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী হলো মারমা।
মারমা নৃগোষ্ঠী কতগুলো দল বা গোত্রে বিভক্ত। এসব দলের পূর্বপুরুষরা প্রথমে যে স্থানে এসে বসতি স্থাপন করেছে সে জায়গার নামানুসারেই দলগুলোর নামকরণ করা হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। মারমা দলগুলো কার্যত এক একটি পূর্ণশক্তিসম্পন্ন দল হিসেবেই পরিচিত। সমাজে দলগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম। মারমাদের বংশ পরিচয় পিতৃতান্ত্রিক। পূর্বে এদের জ্ঞাতি সম্পর্ক যেমন আন্তরিকতাপূর্ণ ছিলো, বর্তমানেও তা প্রচলিত আছে। এদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বিরল। পার্বত্য আদিবাসীদের সমাজ প্রধান হলেন চীফ অথবা হেডম্যান বা রোয়াজা বা দেওয়ান। তিনি গ্রামের বা নির্দিষ্ট একটি এলাকার বাসিন্দাদের দ্বারা মনোনীত হন। চীফের ক্ষমতা তাদের নিজ গ্রামের আকারের উপর নির্ভরশীল। পাহাড়ে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সমাজে বড় কোনো সমস্যা দেখা দিলে তারা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রিক সহযোগিতা গ্রহণ করে।
মারমা জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক জীবন মূলত জুম চাষকেন্দ্রিক। তরকারিতে তারা শুঁটকির ঙাপ্পি (নাপ্পি বা সিঁদোল) ও মরিচের চাটনি ব্যবহার করে। এটি তাদের প্রিয় খাদ্য। এরা ধূমপানে শুকনো তামাক পাতার চুরুট বা পাইপ টানে এবং তা নেশাদ্রব্য হিসেবে চিঁবিয়ে রস খায়। চাল থেকে নিজেদের ব্যবহারের জন্য তারা চোলাই বা ধেনো মদ তৈরি করে। মারমা পুরুষ-নারী সকলেই মদ পান করে। যদিও বৌদ্ধ ধর্মীয় শিষ্টাচারে মদ পান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তবে আধুনিক কালে মারমাদের মধ্যে অনেকেই মদ খাওয়ার দিকে কম ঝুকছে। মারমা সমাজে পুরুষদের চেয়ে নারীই বেশি কর্মঠ। নারীদের হাট-বাজারে জিনিসপত্র বেচা-কেনা করতেও দেখা যায়। এরা সারা বছরের খাবার নিজেরাই উৎপাদন করে।
তিন
মংসানু চৌধুরী এবং উ ক্য জেন রচিত ‘মারমা ইতিহাস ও সংস্কৃতি’ বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ড মারমাদের সংস্কৃতি বিষয়ক। সাধারণভাবে প্রশ্ন জাগে, বাংলাদেশের বান্দরবান জেলায় বসবাসকারী মারমাদের বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি কীরূপ? কীভাবে তারা তাদের ধর্মীয় ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে? বা তাদের জীবনে স্বতন্ত্র এই ধর্মীয় ঐতিহ্য কীভাবে এবং কতোটা প্রভাব ফেলেছে? অন্য কোনো অনুষঙ্গ এদেরকে প্রভাবিত করে কি না প্রভৃতি। হীনযানপন্থী বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মারমা নৃগোষ্ঠী মঙ্গোলয়েড রক্তধারার মানুষ হলেও অবিকল মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য এদের মাঝে দেখা যায় না। মারমাদের গায়ের রং পীতাভ হলেও তা উজ্জ্বল নয়। তাদের রং হলুদ-পীতাভ, মোটা নাক ও থ্যাবড়া। কিন্তু নাকের গোড়া অক্ষিকোটর থেকে যথেষ্ট উন্নত নয়। চোখ মাঝারি আকারের, রং ধূসর বা গাঢ় ধূসর এবং চোখের উপরের পল্লব সামনের দিকে ঝুলে থাকে। দেহের গড়ন অন্যান্য এশীয়দের মতো মাঝারি এবং তা শক্ত, সমর্থ ও মজবুত। মাথার গড়ন সাধারণত গোল। পায়ে হাঁটুর নিচের অংশ মোটা ও মাংসল। শরীর লোমশ নয়। কপোলতলের হাড় প্রশস্ত ও উন্নত বলে মুখমণ্ডল সমতল দেখায়। এদের মধ্যমাকৃতির লম্বাটে মুখমণ্ডল, অতি স্বল্প দাঁড়ি-গোঁফ। চুল কালো, খাড়া এবং শক্ত। ঠোঁট মাঝারি।
অরণ্য, পাহাড়, ঝর্ণা, হ্রদ, নদীর সমন্বয়ে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচিত্র প্রকৃতিতে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর বাসস্থলের নাম অবস্থানভেদে সুস্পষ্টভাবে ‘টংথা’ ও ‘খ্যাংথা’ নামের দুইটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়েছে। আরাকানী ভাষায় ‘টং’ মানে পাহাড় এবং ‘খ্যাং’ মানে নদী; এবং ‘থা’ বা ‘সা’ মানে সন্তান। সে অনুসারে টংথা ও খ্যাংথা শব্দ দুটির অর্থ যথাক্রমে পাহাড়ের সন্তান ও নদীর সন্তান। টংথা বা পাহাড়ের সন্তান মারমারা তাদের বংশানুক্রমিক সুপ্রাচীন ঐতিহ্য অনুসারেই পাহাড়শীর্ষে তাদের বসতবাড়ি নির্মাণ করে থাকে। পাহাড়শীর্ষে খুঁটি দিয়ে চার থেকে ছয় ফুট উঁচু করে তৈরি ঘরকে সাধারণত মাচাংঘর বলে। মারমাদের নিকট মাচাংঘর মায়ের তুল্য। মারমা জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস পূর্বমুখী ঘরবাড়ি সর্বোত্তম। এবিষয়ে তাদের বিশ্বাস হলো, যেহেতু তারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী, সেহেতু মহামতী গৌতম বুদ্ধ কর্তৃক আসন গ্রহণ করার রীতির অনুকরণে বসতবাড়ি পূর্বমুখী করে নির্মাণ করা হয়। নতুন গৃহে প্রবেশের পূর্বে মারমা সম্প্রদায় বেশ কিছু আচরিত পদ্ধতির মাধ্যমে গৃহপ্রবেশ অনুষ্ঠানসম্পন্ন করে থাকে।
[hfe_template id=’81’]
মারমা পুরুষরা তাঁতে বোনা ধূতি (দেয়াহ্) বা লুঙ্গি এবং ফতুয়া বা শার্ট পরিধান করে এবং মাথায় ‘গবং’ বা পাগড়ি ব্যবহার করে। এরা ধূতির সঙ্গে এক ধরনের জ্যাকেট (বারিস্টা আঁঙ্গি) পরিধান করে। মেয়েরা নিম্নাঙ্গে বিশেষ নকশাকৃত থবিং বা থামি পরে এবং বেদাই আঁঙ্গি নামক এক ধরনের ব্লাউজ পরিধান করে। মেয়েরা যে কাপড় দিয়ে বুক ঢাকে তাকে রাংকাই বলে। বর্তমানে মেয়েরা ক্রোদাইং আঁঙ্গি বা এক প্রকার ব্রা পরিধান করে। তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ুয়া নারী শিক্ষার্থী সালোয়ার-কামিজ পরিধান করে থাকে। মারমা নারী যেমন কঠোর পরিশ্রমী তেমনি সৌখিন। তারা সাজগোজ এবং অলংকারপ্রিয়। তারা সোনা-রূপার নানা ধরনের অলংকার ও প্রসাধনী সামগ্রী ব্যবহার করে। এরা নানাভাবে চুল বাঁধা এবং খোপায় নানা ধরনের ফুল গুঁজে রাখতে পছন্দ করে। তবে অঞ্চলভেদে পোশাকের ভিন্নতা এবং কাপড়ের রং পছন্দের বিষয়ে মহিলা ও তরুণীর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। তাদের আচরণ সহজ-সরল ও স্বভাব নিরীহ।
বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ভাষার সংখ্যা ২৬টি। ভাষাতাত্ত্বিকদের মতে মারমাদের ভাষা ভোটবর্মী বা টিবেটো-বর্মন শাখার বর্মী দলভুক্ত একটি ভাষা। তাদের ভাষা বেশ প্রাচীন ও জটিল। মারমা লিপি মারমাজা বা ম্রাইমাচা বাম থেকে ডানে লেখার রীতি অনুযায়ী বর্ণমালা উপমহাদেশীয় প্রাচীন ব্রাহ্মী লিপি হতে উদ্ভূত। তাদের ভাষা পর্যায়ক্রমে পরিবর্তিত হয়ে ষষ্ঠ স্তরে বা ধাপে উন্নীত হয়েছে। এই ভাষার আদিরূপ মোন বা মোয়ে। বহুকাল পূর্ব থেকেই মারমারা তাদের বর্ণমালা রাজকার্য, ধর্মবিষয়ক গ্রন্থাদি ও তন্ত্রমন্ত্র লেখার কাজে ব্যবহার করে আসছে। মারমাদের জন্য নিজস্ব মাতৃভাষায় আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। জানা যায়, খ্রিস্টপূর্ব ২৭৩ অব্দ হতে ৩২ অব্দে প্রচলিত উত্তরাঞ্চলের ব্রাহ্মী লিপি হচ্ছে বর্তমান ম্রাইমা বা মারমা বর্ণের উৎস। তবে বর্তমানে বান্দরবানস্থ ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট’ এখানকার জনগোষ্ঠীদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি বিভিন্ন দিক চর্চায় বিশেষ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। মারমাদের সভ্যতার ইতিহাস কয়েক হাজার বছরের পুরাতন। তাদের সভ্যতার নানা নিদর্শনও আবিষ্কার হয়েছে।
মারমারা হীনযানপন্থী বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। মঙ্গোলীয় মারমা নৃগোষ্ঠী বর্মী পরিবারভুক্ত এবং এরা প্রকৃতি পূজায় বিশ্বাসী হলেও পূর্বে এদের অধিকাংশই ছিলো বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী এবং কিছু সংখ্যক খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। বিভিন্ন দেবদেবী পূজা ও বিভিন্ন উৎসবের পাশাপাশি এরা এমন কিছু ধর্মানুষ্ঠান পালন করে যা প্রকৃতি-পূজার পর্যায়ভুক্ত। বিশেষভাবে অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মতো পাহাড়ি জাতি মারমারা তাদের পালিত নিজস্ব বিভিন্ন উৎসব, নৃত্য ও সঙ্গীত পরিবেশনায় যে স্বতন্ত্র ধর্মসংস্কৃতি বহন করে থাকে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য তার প্রমাণ। এদের সমাজ কাঠামোও নিজেদের ধর্ম, সামাজিক উৎসব ও আচার-অনুষ্ঠানের উপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল। তাদের ধর্মাচরণ, আচার-অনুষ্ঠান, উৎসব প্রভৃতির মধ্যে এ মন্তব্যের প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। মারমাদের বৈচিত্র্যমণ্ডিত ধর্ম ও উৎসবগুলো অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এদের জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রতিটি উৎসবে ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীত ও নৃত্যের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। পৌষে জঙ্গল কাটা থেকে শুরু করে, চৈত্রে জুম পোড়ানো, বৈশাখ-জৈষ্ঠে বীজ বোনা, আষাঢ়-শ্রাবণে নিড়ানি, ভাদ্র-আশ্বিনে ফসল সংগ্রহ, কার্তিক-অগ্রায়ণে তিল ও কার্পাস সংগ্রহের কাজে এদেরকে ব্যস্ত থাকতে হয়। এসময় মারমারা যেমন জুম নৃত্য ও গান পরিবেশন করে, তেমনি তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন উৎসবেও নৃত্য অবধারিত থাকে। মারমারা সামাজিক উৎসবগুলোর মধ্যে যে উৎসবগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে তাহলো বিবাহ উৎসব, জন্ম উৎসব, শিশুর নামকরণ উৎসব, মৃত্যু উৎসব, সাংগ্রাই উৎসব প্রভৃতি। অপরদিকে ঋতু উৎসব, বর্ষবরণ, বর্ষবিদায়, নবান্ন প্রভৃতি উৎসব তারা পালন করে থাকে। এদের রয়েছে ঐতিহ্যবহ খেলাধূলা, আছে উন্নত লোকসাহিত্য।
[hfe_template id=’81’]
মারমাদের পালিত বিভিন্ন দেবদেবীর পূজাগুলো অন্যতম। উৎসব ও পূজা পালনে তারা বেশ কিছু নিয়মকানুন মেনে চলে যা তাদের নিজস্ব ঐতিহ্যকেই তুলে ধরে। উৎসবগুলোতে জড়িয়ে থাকে তাদের নিজস্ব পরিচিতি, নিজস্ব ধর্মসংস্কৃতি, নিজস্ব নৃত্যসংস্কৃতি ও তন্ত্রমন্ত্র। মারমা জনগোষ্ঠী আত্মার স্থানান্তর ধারণায় বিশ্বাসী। তাদের মতে আত্মা একটি উনুনের মতো যেখান থেকে আত্মা ধাপে ধাপে উপরে উঠে তা নির্বাণ লাভের মাধ্যমে পূর্ণতা পায়। এদের সমাজে এখনো আছে নানা সংস্কার ও লোকবিশ্বাস। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে আজও অটুট আছে অপদেবতাদের অস্তিত্বের বিশ্বাস ও পূজা অর্চনার রীতি। পূর্বপুরুষের নিয়মানুসারে তারা অন্নসংস্থান, রোগমুক্তি, নিরাপদ জীবন, শত্রুনিধন বিভিন্ন উদ্দেশ্য সাধনের জন্য লোকদেবতার পূজা দিয়ে থাকে। পাহাড়, মাটি, নদী, জল, গাছ, গাছতলা তাদের নিকট বিশেষ মর্যাদা পেয়ে থাকে। এসবের প্রতি রয়েছে তাদের গভীর বিশ্বাস ও আস্থা। পূজায় পালিত আনুষঙ্গিক কর্মাদি তারা বৈদ্য দ্বারা সম্পন্ন করে থাকেন। ব্রিটিশরা পার্বত্য চট্টগ্রামে আধিপত্য বিস্তারের পর হীনযানপন্থী অল্প কিছু লোক খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করে থাকে। সংখ্যা কম হওয়ার কারণে এদের মধ্যে পারস্পরিক বিবাহে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেওয়ায় বর্তমানে খ্রিস্টান মারমা ছেলে-মেয়ে বৌদ্ধ মারমা ছেলে-মেয়েদের বিবাহ করে বৌদ্ধ হয়ে আসতে বাধ্য হয়। জুমচাষের ফসল উত্তোলন শেষে মারমারা নানা উৎসব পালনসহ প্রকৃতি সম্পর্কীয় দেবদেবীর পূজা করে থাকে। ধর্মীয় অনুষ্ঠানের দিন সন্ধ্যায় আমন্ত্রিত অতিথি, গোত্রের লোকজন, আত্মীয়স্বজন মিলে অনুষ্ঠান আয়োজন করে।
চার
নৈসর্গিক শোভায় ঘেরা পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত মারমাদের ইতিহাস ও সংস্কৃতি পর্যালোচনা করে মংসানু চৌধুরী এবং উ ক্য জেন মারমা জনজাতির প্রায় নির্ভুল একটি ইতিহাস বর্তমান গ্রন্থে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন। বিভিন্ন শাসকগোষ্ঠীর সংস্পর্শে এসে মারমাদের নানা পরিবর্তনের রূপরেখাও এখানে খুঁজে পাওয়া সম্ভব। মারমাদের জীবনে তাদের নিজস্ব ইতিহাস ও সংস্কৃতি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। প্রাচীনকাল থেকে এসব বংশপরম্পরায় নিজেদেরই তৈরি। প্রকৃতপক্ষে মারমারা প্রাচীনকাল থেকে প্রকৃতি পূজারি। তাদের নিত্য কার্যাবলিতেও সে ছাপ স্পষ্ট। বিভিন্ন উৎসব ও ধর্মপালনে নৃত্য ও গানের মাধ্যমে দেবতাকে স্মরণ করে এরা নিজেদের মধ্যে পরিবারে, আত্মীয়-স্বজন, গোত্র বা গোষ্ঠীর মধ্যে সুসম্পর্ক ও দৃঢ় বন্ধন অটুট রেখেছে–যা তাদের ঐতিহ্যিক ধারক ও বাহক।
‘মারমা ইতিহাস ও সংস্কৃতি’ বইটির ভাষা খুব প্রাঞ্জল। তবে বইটিতে বেশকিছু বানান ভুলও লক্ষ করা যায়। গত শতকের শেষে জাতিসংঘ বিভিন্ন জনজাতিকে নিয়ে যে ‘বিশ^ আদিবাসী জনগোষ্ঠীর আন্তর্জাতিক দিবস’ ঘোষণা করে, তারই ধারাবাহিকতায় ‘মারমা ইতিহাস ও সংস্কৃতি’ বইটি রচিত হয়েছে বললে ভুল হবে না। তবে বাংলাদেশে বসবাসকারী বহু জনগোষ্ঠীর এখনো নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি সংরক্ষিত নেই। তারা এই গ্রন্থটিকে নমুনা গ্রন্থ হিসেবে গ্রহণ করে স্ব স্ব জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণের বিষয়ে উদ্যোগ নিতে পারেন। এতে নিজেদের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে ঐসব জনগোষ্ঠী আরো বেশি সচেতন হবে।
মংসানু চৌধুরী এবং উ ক্য জেন। মারমা ইতিহাস ও সংস্কৃতি। খাগড়াছড়ি : মারমা উন্নয়ন সংসদ, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা, ২০১৮।

কাজল কাপালিক
কাজল কাপালিক নামের আড়ালের মানুষটির পুরো নাম জি এম মনিরুজ্জামান। বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান মনিরুজ্জামান ১৯৭৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর তারিখে খুলনার রুপসা থানায় জন্মগ্রহণ করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক উপন্যাস : ইতিহাসের সাহিত্যিক পূণনির্মাণ’ শিরোনামে পিএইচডি সম্পন্ন করেছেন। বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে চাকরি করেছেন। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রতিষ্ঠাকালীন চেয়ারম্যান। বর্তমানে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। গবেষণা হচ্ছে তার নেশা। বাংলাদেশের আদিবাসী সম্প্রদায় তার আগ্রহের কেন্দ্র। আছে প্রায় অর্ধশত প্রবন্ধ। এছাড়া কবিতা ও সাহিত্য-সমালোচনা বিষয়ে লেখালেখি করেন। প্রকাশিত গ্রন্থ : ‘কবি ও কবিতা’ (২০১৫), ‘যদি একতারাটি বেজে ওঠে কোথাও’ (২০১৭), ‘ভূমিপুত্রের শীতনিদ্রা’ (২০১৭), ‘মধুসূদন দত্ত ও দীনবন্ধু মিত্রের প্রহসনে সেকালের সমাজ’ (২০২১)। পেয়েছেন বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র থেকে সম্মাননা (১৯৯০)। এছাড়াও ‘কৃতি গবেষক ও গুণীজন সম্মাননা (২০১০), ‘কথা বিশ্লেষক’ উপাধি (২০১৩), সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ‘দাগ সাহিত্য পুরস্কার’ (২০১৬)।
COMMENT
বাংলাদেশে অনেক জাতির বাস।তার মধ্যে মারমা একটি জাতি। তাদের ধর্ম ও সংস্কৃতি নিয়ে গবেষক যা লিখেছেন অত্যন্ত প্রাণবন্ত হৃদয় স্পর্শ কারার মতো। ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করতে চাই না,তবে ভবিষ্যতে আরও মনোমুগ্ধকর বিষয় নিয়ে আমাদের সবার অতৃপ্ত হৃদয় কে তৃপ্ত করবে। এই আশা করছি।