মজিদ মাহমুদ
কবি, লেখক, গবেষক
কাজী নজরুল ইসলাম ও জীবনানন্দ দাশ একই বছরে জন্ম গ্রহণ করলেও তাদের দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে বলে স্পষ্ট প্রমাণ নেই। জীবনানন্দ দাশ দূর থেকে দেখেছেন বললেও তাদের মধ্যে সরাসারি আলাপ পরিচয় ছিল না। জীবনানন্দ দাশ ১৯৪৪ সালে বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত কবিতা পত্রিকায় নজরুলকে নিয়ে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন। পরেও দুএকটি লিখেছিলেন। সে-সব লেখা নজরুলের কবি অবস্থানের প্রতি সব সময়ে মানানসই ছিল না। প্রশংসার বাইরে তাঁর ধারণা ছিল উচ্চকিত সময়ের প্রয়োজনে। এমনকি কোলকাতার এক পত্রিকায় নজরুল-সাহিত্য নিয়ে কটূ সমালোচনার দায়ে জীবনানন্দ দাশ চাকুরিচ্যুৎ হয়েছিলেন। নজরুল-উত্তর বাংলা সাহিত্যে জীবনানন্দ দাশও কবি হিসাবে খ্যাতির শীর্ষে উঠেছেন। তবু দক্ষ দুই মহান কবি একই বছরে জন্মগ্রহণ করলেও একজন হয়েছেন অন্যজনের উত্তর-সাধক।
কাজী নজরুল ইসলাম এবং জীবনানন্দ দাশ উভয়েরই জন্ম-সাল ১৮৯৯। কবি হিসাবে নজরুল ইসলাম জীবনানন্দ দাশের এক দশক পূর্বে নিজের অবস্থান সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই প্রতিষ্ঠার মধ্যে কোন সন্দেহ কিংবা দ্ব্যর্থতা ছিল না। নজরুল ইসলাম কবিতা লিখতে যেদিনই শুরু করুন না কেন– ১৯১৯ সালের আগে উল্লেখযোগ্য কোন পত্র-পত্রিকায় তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়নি। এ সময়ে তাঁর বয়স ছিল মাত্র বিশ বছর আর তখনো তিনি ৪৯ নং বাঙালি পল্টনের একজন হাবিলদার। পরের বছর বেঙ্গলি রেজিমেন্ট ভেঙ্গে দেয়া হলে নজরুল কোলকাতায় এসে স্থানীয়ভাবে বসবাস শুরু করেন। এর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই নজরুল ইসলাম কবি হিসাবে নিজেকে সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেন।
১৯১৯ সালে জীবনানন্দ দাশেরও প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। ‘বর্ষ আবাহন’ নামে এই কবিতাটি তাঁর পিতা সত্যানন্দ দাশ সম্পাদিত ‘ব্রহ্মবাদী’ পত্রিকায় ছাপা হয়। কিন্তু নজরুল আসলেন দেখলেন আর জয় করলেন। এটি ছিল বাংলা সাহিত্যে একটি অভূতপূর্ব ঘটনা। প্রথম কবিতা মুদ্রণের বছর থেকে মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই তিনি এসব ঘটিয়েছিলেন। এই সময়কালের মধ্যেই তাঁর সব ভালো কবিতা প্রায় লেখা হয়ে গেছে। এদিকে জীবনানন্দ দাশ নজরুলের জন্ম-সালে জন্মগ্রহণ করলেও ১৯২৭ সালের আগে তাঁর কোন কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি। আর ‘ঝরাপালক’ (১৯২৭) প্রকাশিত হলেও তা ছিল সর্বৈব নজরুল বলয়বদ্ধ। অথচ এ সময় পর্যন্ত নজরুলের এক ডজন কাব্যগ্রন্থ এবং একটি নির্বাচিত কাব্যসংকলন (সঞ্চিতা) প্রকাশিত হয়েছে। ‘ঝরাপালক’ প্রকাশের সাল পর্যন্ত নজরুলের যে কাব্যগ্রন্থগুলি প্রকাশিত হয়েছে নিচে তার তালিকা দেয়া হল :
‘অগ্নি-বীণা’ (১৯২২); ‘দোলন-চাঁপা’ (১৯২৩); ‘বিষের বাঁশী’; ‘ভাঙার গান’ (১৯২৪); ‘ছায়ানট’ (১৯২৫); ‘পুবের হাওয়া’ (১৯২৫); ‘সাম্যবাদী’ (১৯২৫); ‘চিত্তনামা’ (১৯২৫); ‘সর্বহারা’ (১৯২৬); ‘ফণি-মনসা’ (১৯২৭); ‘সিন্ধু-হিন্দোল’ (১৯২৭); ‘জিঞ্জির’ (১৯২৮); ‘সঞ্চিতা’ (১৯২৮)। এ সময়ের মধ্যে ঈর্ষণীয়ভাবে কবি স্বীকৃতির সবকিছুই জুটেছে নজরুলের ভাগ্যে। আর সেটি অনেকটা বাংলা সাহিত্যে` অনেকটা ‘রবীন্দ্র-সাম্রাজ্যে’র সীমানার বাইরে স্বতন্ত্র কদরহীন নজরুলীয় রাষ্ট্র। সে রাষ্ট্র যতই ছোট হোক না কেন তাকে বিচিত্র সমাহারে এবং স্বীয় ব্যবস্থায় আলাদা করে ফেলেছিলেন নজরুল। তাই নজরুলকে স্বীকৃতিদানে কবি-সম্রাটের কোন কার্পণ্য ছিল না। ১৯২২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ‘ধূমকেতু’র পূজা সংখ্যায় নজরুলের ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটি প্রকাশের অপরাধে বৃটিশ-রাজ তাঁকে গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করে। নজরুল আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে থাকাকালে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বসন্ত’ নাটিকাটি বিদ্রোহী তরুণ কবির নামে উৎসর্গ করেন। উৎসর্গ পত্রে লেখা ছিল “শ্রীমান কবি নজরুল ইসলাম স্নেহভাজনেষু ১০ ফাল্গুন ১৩২৬।” এটি ছিল রবীন্দ্র জীবনের একটি ব্যতিক্রম ঘটনা। কেননা কবি পরিবারের বাইরে উল্লেখযোগ্য খুব কম কবির ভাগ্যে রবীন্দ্র-উৎসর্গের প্রসাদ জুটেছে। নজরুল যখন হুগলী জেলে অনশন-ব্রত পালন করছিলেন এবং নজরুলের জীবন যখন আশঙ্কাজনক হয়ে উঠেছিল রবীন্দ্রনাথ তখন নজরুলকে টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন ‘গিভ আপ হাংগার স্টাইক আওয়ার লিটারেচার ক্লেইমস ইউ।’ আমাদের সাহিত্য যে নজরুলকে চায়– তা কবিগুরু শুরুতেই স্বীকার করেছিলেন। যদিও ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার ঘেরাটোপে সে আহ্বান নজরুলের হাত পর্যন্ত পৌঁছেনি।
[hfe_template id=’81’]
জীবনানন্দ দাশসহ তিরিশের অন্যান্য প্রধান কাব্যকারের আগমনের পূর্বেই নজরুল হয়ে উঠেছেন তাদের পূর্বসুরী। সুতরাং রবীন্দ্র-বলয় থেকে পৃথক হবার যে প্রবণতায় তিরিশের কবিরা সক্রিয় ছিলেন সেই একই লড়াই তাঁদের নজরুলের সঙ্গেও করতে হয়েছে। সদর্থে বলা চলে রবীন্দ্রনাথ থেকে পৃথক হওয়ার যত না তাগিদ ছিল নজরুল থেকে পৃথক হওয়ার প্রয়োজনীয়তা তারচেয়ে কম ছিল না। কিন্তু বিভিন্ন কারণে তিরিশের কাব্যকাররা মুখে সে কথা স্বীকার করেন নি। আর না করার হয়তো অন্যতম কারণ ছিল নজরুল ছিলেন তাদের সম-বয়স্ক এবং বর্গের দিক থেকে ভিন্ন। আর বয়সের অহংকার মানুষের প্রবৃত্তিগত। তাছাড়া এতে পাণ্ডিত্যের অভিমানও তাদের কম ছিল না। নজরুল প্রতিভা যে ঈর্ষণীয় ছিল সে কথা তিরিশের একজন প্রধান নির্মাতা বুদ্ধদেব বসু কোন না কোনভাবে স্বীকার করেছেন। ‘কালের পুতুলে’ নজরুল বিষয়ক প্রবন্ধটি ছাড়াও ‘গোলাপ কেন কালো’ উপন্যাসে বুদ্ধদেব বসু নজরুলের আদলে গড়ে তুলেছেন তাঁর বিখ্যাত ‘দিল-দা-নওরোজ’ চরিত্রের মাধ্যমে। কেননা উপন্যাসে বর্ণিত চরিত্র অনেক বেশি মননে এবং সততায় পুষ্ট। আর নীরব নিঃশব্দে নজরুল থেকে পৃথক হবার আরেকটি প্রবণতা হতে পারে ব্রিটিশ উপনিবেশের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিজাত। তিরিশের প্রধান কবিদের মুখ্যাংশ ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র এবং অধ্যাপক হওয়ায় তাদের মানসগঠন ঔপনিবেশিক সংস্কৃতি নির্ভর হয়েছিল কিনা তা ভেবে দেখার বিষয়। তবে অন্তত এ কথা বলা যায় রবীন্দ্রনাথ থেকে পৃথক হবার তেমন ইচ্ছা বা তাগিদ সুধীন্দ্রনাথের (১৯০১-১৯৬০) ছিল না। এ প্রসঙ্গে জীবনানন্দ দাশের একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য– “সুধীন্দ্রনাথের কবিতা পড়লে মনে হয় রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে অন্তর্যামী শিষ্যের লেখা কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে জোর করে এড়িয়ে যাবার কোন তাগিদ নেই সুধীন্দ্রনাথের; তাঁর কবিতা এত সহজভাবে বাংলা কবিতার ঐতিহ্যপথে চলেছে যে খুব স্বাভাবিকভাবেই তা কবি-সার্বভৌমের পরিধি অতিক্রম করে সুধীন্দ্রীয় কাব্য নৈর্ব্যক্তিক ও ব্যক্তি কেন্দ্রিক। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘তন্বী’ (১৯৩৭) প্রকাশিত হলে তিনি সেটি কবিগুরুকে উৎসর্গ করে লেখেন– ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্রীচরণে তথা ঋণস্বীকারের জন্য।’ সুতরাং রবীন্দ্রনাথের সংগে বিলীন হবার প্রবণতা তাঁর ছিল।
সুধীন্দ্রনাথের মতো অমিয় চক্রবর্তীও ছিলেন রবীন্দ্রনাথের কাছের মানুষ। ব্যক্তিগত যোগাযোগের ক্ষেত্রে আরেকটি অধিকতর বই কী? কবিগুরুর ব্যক্তিগত সেক্রেটারি হবার সৌভাগ্য তাঁরও হয়েছিল। ১৯২৯ সালের দিকে অমিয় চক্রবর্তী কবিগুরুর সঙ্গে প্রায় বছরাধিককাল আমেরিকা-জাপান-পারস্য প্রভৃতি স্থানে ভ্রমণের সুযোগ পেয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ‘ঘরে ফেরার দিন’ (১৯৬৮) নামক কাব্যগ্রন্থটি অমিয় চক্রবর্তী গুরুর উদ্দেশ্যে নিবেদন করেন। সেখানে তিনি বলেন– ‘জ্যোতির আহ্বানে পৃথিবীতে তার এই কাব্য দীপ্তিধারাময়।’ তেমনি ‘পারাপার’ (১৩৬০) কাব্যগ্রন্থের ‘রবীন্দ্রনাথ’ নামক কবিতায় তিনি বলেন` ‘হে জাগ্রহ ধ্যান/ উদিত কল্যাণ/ দহনচিত্তের মধ্যে দৃষ্টি জ্বালালেম/ এ-রাত্রি উজ্জ্বল হোলো। সূর্যদিনের প্রত্যাভাস। নি প্রদীপ ঘরে-ঘরে জ্বলে।” আর বিষ্ণু দে যদিও বলেছিলেন ‘রবীন্দ্র ব্যবসা বলে কিছু শিখিনি’ তবু রবীন্দ্র-ব্যবসা থেকে তিনি বিচ্ছিন্ন ছিলেন না। নিজের কাব্যগ্রন্থ রাবীন্দ্রিক নামে বিখ্যাত হয়ে আছে। ‘নাম রেখেছি কোমল গান্ধার’, ‘তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ’,‘রবিকরোজ্বল নিজ দেশে’ এসবই তার প্রমাণ। প্রকৃতার্থে রবীন্দ্র-বিদ্রোহের যৌক্তিক কোন কারণ ছিল না। যা ছিল যুগুপ্সাপরায়ণতা কিংবা বুদ্ধদেব বসু যেমনটি বলেছেন– ‘আমাদের নিন্দুকেরা যতই সংখ্যায় ও তেজে বর্ধিষ্ণু হতে লাগল আমাদের আনন্দও ততই যেন উজ্জ্বল হলো– লোক নিন্দা করলেও আনন্দ হয় এতই ছেলে মানুষ তখন ছিলাম আমরা।” তাছাড়া কালের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে চেতনাগত কিছু পার্থক্য স্বাভাবিকভাবে ঘটে যাচ্ছিল। সেটা কিছুতেই ইচ্ছাকৃত বিদ্রোহ বলা যায় না। কেননা রবীন্দ্রনাথের অটল বিশ্বাসের ভূমিতে নোঙ্গর করবার কোন সুবিধে অনুজদের ছিল না। নিখিলনাস্তি নৈরাশ্য আর বিশ্বব্যাপী ঘটে যাওয়া মার্কসবাদী বিপ্লব তরুণ-মনে বিশ্বাসের নব্যভূমি অন্বেষণে তৎপর ছিল। সেদিক দিয়ে তিরিশের কবিরা নজরুল-মানসের অধিকতর নিকটতম। যদিও রাবীন্দ্রিক ইতিবাচকতা নজরুল সর্বাংশে অতিক্রম করতে পারেন নি; তবু রাবীন্দ্রিক অধ্যাত্মবাদ পরিত্যাগ করে বিদ্রোহী কবি সাম্য তথা ভোগবাদে আস্থা স্থাপন করতে পেরেছিলেন। সুতরাং তিরিশের প্রধান কবিরা যখন কবিতা রচনায় মনোনিবেশ করছেন তখন নানাদিক দিয়ে নজরুল মানসিকতার সঙ্গে তাদের একটি ঐক্য আবিষ্কার করা যাচ্ছে। তাছাড়া নজরুল প্রতিভা এমনই দু’কূল প্লাবী ছিল যে রাবীন্দ্রিক বিশিষ্টতাকেও সাময়িক প্রশ্নের সম্মুখীন করে। এমনকি মোহিতলাল মজুমদারের মতো একজন পণ্ডিত ও শুদ্ধতম কবিও; যিনি নজরুলকে ভালোবেসে তাঁকে পরিশুদ্ধ করার ব্রত নিয়েছিলেন; তিনিও নজরুল দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন বই কি? সুকুমার সেন ঠিকই লক্ষ করেছেন ‘মোহিতলাল এক সময় সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের প্রভাবচ্ছায়া থেকে চলে এসেছিলেন নজরুলের প্রভাবচক্রের মধ্যে।” মোহিতলালের শক্তি বিদ্রোহ ঘোষণা নজরুল-কাব্য থেকেও অংশত উদ্বোধিত হয়েছিল। কবি হিসেবে বোধ করি প্রেমেন্দ্র মিত্র (১৯০৪) নজরুল মানসের সবচেয়ে কাছাকাছি ছিলেন। প্রকৃতার্থে রবীন্দ্রনাথের আকাশটি এতো বিশাল ছিল তা থেকে বহির্গমনের আকাঙ্ক্ষার সততা থাকলেও তার সঙ্গে একটি সম্পর্ক নির্ণায়ক সূত্র আবিষ্কার দুরূহ নয়। সমকালে সাহিত্যের পরিবর্তনের সূত্র ও তথ্য সবই তিনি প্রমাণ করবার চেষ্টা করেছেন। এমনকি মিল ছাড়া কবিতা লিখেও তিনি তরুণদের একক কৃতিত্বের অধিকার খর্ব করেছেন। বন্দরে পৌঁছতে সব ঘাটেই তিনি নোঙ্গর করেছেন। কুড়িয়েছেন নাম না জানা অসংখ্য মণিমুক্তা। অথচ বিষয়টি এমন ছিল তরুণ কাব্যকাররা যেখানেই তরী ভেড়ানোর চেষ্টা করেছেন তার অধিকাংশ ঘাটের কথা তিনি জানেন।
জীবনানন্দ দাশের ক্ষেত্রেও রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে ওই একই ধরনের প্রতীতি জন্মেছে পাঠকের। আবদুল মান্নান সৈয়দ বলেছেন– ‘জীবনানন্দের শক্তি এখানে যেন আপাতবিদ্রোহের বদলে রবীন্দ্রনাথের ঐতিহ্যকে তিনি এগিয়ে নিয়ে গেছেন তার কালের আত্মা ও উচ্চারণের সঙ্গে মিলিয়ে।” অবশ্য জীবনানন্দ দাশ নিজে বলেছেন“আধুনিক কবির কবিতা এমন প্রগাঢ়ভাবে আজকের জন্য যে সাময়িক কালকে যদি অতীত ও অনন্তের থেকে খানিকটা বিচ্ছিন্ন করে ঈষৎ নিরাসক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখি তাহলে সেই সময়ের জন্য অন্তত দ্বিধাহীনভাবে স্বীকার করতে হবে যে আধুনিক যুগের আবশ্যিক বাঙালি কবি এরাই রবীন্দ্রনাথ বা তাঁর ঐতিহ্যপথিক শিষ্যেরা নন।” রবীন্দ্র পরিমণ্ডল থেকে যিনি বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন– তিনি কাজী নজরুল ইসলাম। সে বেরিয়ে আসা ছিল স্বতঃস্ফূর্ত স্বভাবজাত। সুতরাং রবীন্দ্রনাথের বাইরে এত অল্প সময়ের মধ্যে ঘটে যাওয়া বিদ্রোহ থেকে তিরিশের কবিদের নূতন আবিষ্কার করতে আরও খানিকটা বেগ পেতে হয়েছিল। আর এমনটিই ঘটনোর জন্য তাঁরা বাংলা কাব্যের ঐতিহ্যপথ থেকে নিজেদের খানিকটা প্রত্যাহার করে ভিনদেশী সাহিত্যিক অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর চেষ্টা করতে লাগলেন। কেননা রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর উত্তরসুরিরা এ পথ এমনভাবে আগলে রেখেছিলেন যে তাদের জন্য নূতন পথ খুঁজে নেয়া সত্যিই দুষ্কর ছিল। তবে এ কথা বলা যায় তিরিশের কবিরা যা করতে চেয়েছিলেন তা বেশ খানিকটা সফলতার সঙ্গেই করেছিলেন।
বক্ষ্যমাণ আলোচনায় উল্লেখ হয়েছে তিরিশের কবিরা যত না রবীন্দ্রনাথ থেকে আলাদা হবার প্রয়াস পেয়েছিলেন তার চেয়ে নজরুল থেকে পৃথক হবার প্রাবল্য ছিল বেশি। কিন্তু নজরুল তিরিশের কবিদের খুব বেশি সমকালীন হওয়ায় তার উল্লেখ ছিল নিস্প্রয়োজন। আরও একটি কথা উল্লেখ হয়েছে, তা হলো ইংরেজি পঠন এবং সাহিত্য তাদের নূতন পথ খুঁজে নিতে সহায়তা করেছিল। আর সেদিক দিয়ে নজরুল ইসলামই ছিলেন বাংলা কাব্যে বাংলাদেশের শেষ স্বায়ত্ত সন্তান। জীবনানন্দ দাশ ঠিকই আবিষ্কার করেছিলেন ‘আধুনিক বাংলাদেশে তিনি (নজরুল) বাংলার মাটিরই বিশেষ স্বায়ত্ত সন্তান’।
নজরুলের মতো জীবনানন্দ দাশও একটি ধর্মীয় উদার নৈতিক পরিবেশের মধ্যে বেড়ে উঠেছিলেন। জীবনানন্দ দাশের বাবা সত্যানন্দ দাশ (১৮৬৩-১৯৪২) ছিলেন বরিশাল ব্রজমোহন স্কুলের প্রধান শিক্ষক এবং ব্রাহ্ম সমাজের মুখপত্র ‘ব্রহ্মবাদী’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। জীবনানন্দ দাশের পিতামহ সর্বানন্দ হিন্দুধর্ম পরিত্যাগ করে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন। তখন থেকেই তারা হিন্দু ধর্মের উপাধি দাশগুপ্ত পরিত্যাগ করে নামের শেষে দাশ লিখতে শুরু করেন। অবশ্য জীবনানন্দ দাশ প্রথম জীবনে নামের সঙ্গে দাশগুপ্ত লিখতেন। গুপ্তকে পরিত্যাগ করা প্রচলিত ধর্মের মধ্যে এক ধরনের বিদ্রোহ বই কি। যে বিদ্রোহ বাংলাকাব্যের প্রধান নির্মাতাদের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য। বাংলা-কাব্যের আধুনিক-স্থপতি মধুসূদন দত্ত হিন্দু ধর্ম পরিত্যাগ করে নামের সঙ্গে মাইকেল সংযুক্ত করলেন। রবীন্দ্রনাথও হিন্দু ছিলেন না। তাঁর বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন ব্রাহ্মধর্মের অন্যতম প্রধান প্রবর্তক। মাইকেলরবীন্দ্রনাথ
নজরুল এবং জীবনানন্দ আধুনিক বাংলাকাব্যের এই চার প্রধান নির্মাতা প্রত্যেকেই প্রচলিত ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতাকে অতিক্রম করতে পেরেছিলেন। তাছাড়া জীবনানন্দ দাশের মাতা কুসুম কুমারী দাশ (১৮৮২-১৯৪৮) ছিলেন তৎকালে উল্লেখযোগ্য নারী কবি। যার কবিতার দু’টি চরণ বাঙালি পাঠক এখনো মনে রেখেছেন– ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/ কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে।’ জীবনানন্দ দাশ নিজেই বলেছেন` তার মা যে কোন তুচ্ছ মানুষকে শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস করতে বলেছিলেন। জীবনের নানা প্রতিঘাতে জীবনানন্দ দাশ শেষ পর্যন্ত এ বিশ্বাস হারান নি। যদিও তিনি এমন সত্য আবিষ্কার করেছিলেন যে ‘অনেক সময়ে আমাদের মনও আমাদের নিজের নয়।’ এ ধরনের অকাট্য সত্য আবিষ্কারের পর কোন কিছুই নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবু জীবনানন্দ দাশের সার্বিক সৃষ্টিকর্ম বিশ্লেষণ করে এ সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব যে শেষ পর্যন্তও তিনি মানববন্ধ রচনা করতে চেয়েছেন। মৃত্যুর পরেও তিনি ‘একটি হিম কমলালেবুর করুণ মাংস’ নিয়ে কোন এক পরিচিত মুমূর্ষুর বিছানার কিনারে ফিরে আসার সাধ ব্যক্ত করেছেন।
[hfe_template id=’81’]
নজরুল ইসলামের সঙ্গে জীবনানন্দ দাশের নানা সাজুয্য লক্ষ করা যায়। তার একটি প্রত্যক্ষ যেখানে বিষয় এবং আঙ্গিকে সর্বৈব নজরুল সমৃদ্ধ; অন্যটি পরোক্ষ যেখানে আঙ্গিক দূরান্বয় কিন্তু চেতনার ঐক্য নিকটতর। আর পরিচিত ক্ষেত্রে বৈপরিত্য তো বটেই। ১৯২৭ সালে জীবনানন্দ দাশের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরাপালক’ প্রকাশিত হয় সে সময়ে তাঁর বয়স ছিল ঊনত্রিশ বছর। এ সময় পর্যন্ত তাঁর মানসিক গঠন পর্যবেক্ষণ করলে অন্তত অনুধাবন করা সম্ভব জীবনানন্দের মৌল প্রবণতা কোনটি। আমরা যে জীবনানন্দকে চিনি ‘ঝরাপালকে’ সেই জীবনানন্দকে পাওয়া যাবে না ঠিক কিন্তু দ্রোহের আগুনে সেঁকে পরবর্তীকালে তিনি যে রান্না প্রস্তুত করেছেন তার প্রথম পর্বের মধ্যেই সে সত্য নিহিত রয়েছে। জীবনানন্দের জীবনবাদিতা সরাসরি এ কাব্যে উদ্বোধিত হয়েছে। এই কাব্যে ‘জয় মানবের জয়’ বলে তিনি যে যাত্রা শুরু করেছিলেন জীবনের বহু ঘাটে নোঙ্গর করে শেষ পর্যন্ত তিনি ‘তিমির হননের গান’ গেয়েছেন। আসলে মানস গঠনের মৌল প্রবণতা থেকে সরে আসা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না। ঊনত্রিশ বছর পর্যন্ত তিনি যে জীবনবেদ রচনা করলেন তা কি মেকি? না প্রতিভাবান কবিপুরুষ অতি সহজেই আবিষ্কার করলেন এ পথ ধরে হেঁটে গেছে সতীর্থ অগ্রজ। রবার্ট ফ্রস্টের মতো এই অরণ্যে অধিকতর কম পরিচিত পথ ধরে পরবর্তীকালে তিনি যাত্রারম্ভ করলেন। কিন্তু উদ্দেশ্য সেই একই– গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়া। মাঝখানে নতুন পথ আবিষ্কারের কৃতিত্ব চাইলেন। জীবনানন্দ সেই কৃতিত্ব পেয়েছিলেন। ওই যে উদ্দেশ্যের কথা– সেই উদ্দেশ্য কিন্তু এক। তিনি নির্জনতা কিংবা ধূসরতার কবি ছিলেন না। শৈশবের শিক্ষা এবং মানস গঠন যে খুব একটা পাল্টায় না সে কথা জীবনানন্দ দাশ একটি লেখায় বলেছেন– “কার কাছে শিক্ষা পেয়েছিলাম আমরা? আমি অন্তত? তিনজন মানুষের কাছে। একজন বাবা, একজন মা আর একজন ব্রজমোহন স্কুলের হেডমাস্টার আচার্য জগদীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। বরিশাল স্কুল থেকে পাস করে অনেক বড় বড় কলেজে পড়েছি, ইউনিভার্সিটিতে পড়েছি কিন্তু আজ জীবনের মাঝামাঝি এসে প্রতিনিয়তই টের পাচ্ছি যে আমার জীবনের শিক্ষার ভিত্তি এঁদের হাতে গড়া। এক এক সময় মনে হয় মহাভারতের রচনাকর্তা বেদব্যাসের মতো দৃষ্টি নিয়ে এঁরা সবই শিখিয়েছিলেন আমাকে, আমার জীবনে সে শিক্ষা যদি ব্যবহারিকভাবে ফলপ্রসূ না হয়ে থাকে তাহলে তাদের কোন দোষ নেই। যদি মনোলোক কিছু সার্থক হয়ে থাকে তাহলে এদেরই প্রকাণ্ড দানের ফলে।”
‘ঝরাপালক’ কাব্যগ্রন্থে কবিতার সংখ্যা ছিল পঁয়ত্রিশ। কবিতার শিরোনামগুলি এখানে উল্লেখ করছি: আমি কবি সেই কবি; নীলিমা; নব নবীনের লাগি; কিশোরের প্রতি; মরীচিকার পিছে; জীবন মরণ দুয়ারে আমার; বেদিয়া; নাবিক; বনের চাতক মনের চাতক; সাগর বলাকা; চলছি উধাও; একদিন খুঁজেছিনু যারে; আলেয়া; অস্তচাঁদে; ছয়া প্রিয়া; ডাকিয়া কহিল মোরে রাজার দুলাল; কবি; সিন্ধু দেশবন্ধু; বিবেকানন্দ; হিন্দু-মুসলমান; নিখিল আমার ভাই; পতিতা; ডাহুকী; শ্মশান; মিশর; পিরামিড; মরুবালু; চাঁদনীতে; দক্ষিণা; যে কামনা নিয়ে; স্মৃতি; সেদিন এ ধরনীর; ওগো দরদিয়া; সারাটি রাতি তারাটির সাথে তারাটিই কথা কয়।’
উপর্যুক্ত কাব্যের শিরোনামগুলি লক্ষ্য করলেই নজরুল ইসলামের কাব্য শিরোনামের কথা মনে পড়ে। যেমন– নব নবীনের লাগি; কিশোরের প্রতি, চলেছি উঠাও; আলেয়া; অস্তচাঁদে ছায়াপ্রিয়া, সিন্ধু, দেশবন্ধু, বিবেকানন্দ, হিন্দু মুসলমান; নিখিল আমার ভাই, পতিতা, মরুবালু প্রভৃতি কবিতাগুলি সরাসরিই নজরুলের কবিতার নাম কিংবা নজরুলীয় শব্দবন্ধ কিংবা বিষয়।
নজরুল ইসলাম ‘সন্ধ্যা’ কাব্যগ্রন্থের ‘চল্ চল্ চল্’ কবিতায় বলেছেন‘নব নবীনের গাহিয়া গান সজীব করিব মহাশ্মশান।’ জীবনানন্দ দাশ ‘ঝরাপালক’ কাব্যগ্রন্থের কবিতা ‘নব নবীনের লাগি’তে বলেছেন
‘নব নবীনের লাগি/ প্রদীপ ধরিয়া আঁধারের বুকে আমরা রয়েছি জাগি।’ একই কবিতায়–
‘গাহি মানবের জয়
কোটি কোটি বুকে কোটি ভগবান আঁখি মেলে জেগে রয়।
সবার প্রাণের অশ্রু-বেদনা মোদের বক্ষে লাগে,
কোটি বুকে কোটি দেউটি জ্বলিছেকোটি কোটি শিখা জাগে, প্রদীপ নিভায়ে মানবদেবের দেউল যাহারা ভাঙে আমরা তাদের শত্রু
মাসন` কবির ক্ষয়।
— জয় মানবের জয়!
(নব নবীনের লাগি; ঝরাপালক : জীবনানন্দ দাশ) কিংবা
‘চলছি উধাও’ কবিতায়–
চলছি উধাও বল্গাহারা– ঝড়ের বেগে ছুটি;
শিকল কে সে বাঁধছে পায়ে।
কোন সে ডাকাত ধরেছে চেপে টুটি!
জীবনানন্দ দাশের ‘নব জীবনের লাগি; চলছি উধাও; কিশোরের প্রতি’ এ ধরনের কবিতায় নজরুলের সর্বহারা কৃষাণের গান, শ্রমিকের গান, ধীবরদের গান, ছাত্রদের গান, ফরিয়াদ এ ধরনের কবিতায় সরাসরি ছায়া পড়েছে। আবার জীবনানন্দ দাশ দেশবন্ধুকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন। সেখানে নজরুল ইসলাম দেশবন্ধুকে নিয়ে ‘চিত্তনামা’ নামে একটি কাব্য পুস্তিকা রচনা করেছেন। নজরুল বিবেকানন্দকে নিয়ে গান রচনা করেছেন– ‘জয় বিবেকানন্দ বীর সন্যাসী চীর গৈরিকধারী’ (নজরুল রচনাবলী ৩য় খণ্ড-পৃ. ৪১২)। জীবনানন্দ দাশও বিবেকানন্দকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন। বিবেকানন্দ কবিতায় জীবনানন্দ দাশ বলেছেন–
জয়-তরুণের জয়।
জয় পুরোহিত অহিতাগ্নিক জয়, জয় চিন্ময়!
স্পর্শে তোমার নিশা টুটে দিল– উষা উঠেছিল জেগে
পূর্ব তোরণে বাংলা-আকাশে অরুণ-রঙিন মেঘে;
আলোকে তোমার
ভারত এশিয়া-জগৎ সে দিল রেঙে।
জীবনানন্দ দাশের উপর্যুক্ত ‘দেশবন্ধু’ ও ‘বিবেকানন্দ’ কবিতায় নজরুলের চিত্তনামা, গোকুল নাগ, মিসেস এম রহমান, খালেদ, চিরঞ্জীব জগলুল, আমানুল্লাহ, উমর ফারুক, সত্য প্রয়াণ শরৎচন্দ্র এমনি অসংখ্য নামবাচক কবিতার আনুকূল্য পেয়েছিল। তেমনি ‘হিন্দু-মুসলিম’ শিরোনামে জীবনানন্দ দাশ কবিতা লিখেছেন। যে কবিতায় জীবনানন্দ দাশ বলেছেন —
‘কে বলে হিন্দু বসিয়া রয়েছে একাকী ভারত জাঁকি
মুসলমানের হস্তে হিন্দু বেঁধেছে মিলন-রাখি,
উপর্যুক্ত কবিতা নজরুলের ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ কিংবা ‘হিন্দু-মুসলিম যুদ্ধ’ এ ধরনের বহু কবিতার সঙ্গে সম্পর্ক নির্ণয় করেছে। নজরুল ‘কাণ্ডারী হুশিয়ার’ কবিতায় বলেছেন–
‘হিন্দু না ওরা মুসলিম? জিজ্ঞাসে কোন জন?
কাণ্ডারী! বলো ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা’র!
‘হিন্দু’ মুসলিম যুদ্ধ’ কবিতায়–
‘খালেদ’ আবার ধরিয়াছে অসি‘অর্জুন’ ছোড়ে বাণ।
জেগেছে ভারত, ধরিয়াছে লাঠি হিন্দু-মুসলমান।’
জীবনানন্দ দাশের ‘নিখিল আমার ভাই’ এবং ‘পতিতা’ কবিতা নজরুলের সাম্যবাদী, মানুষ, পাপ, সাম্য, রাজাপ্রজা, নারী, মিথ্যাবাদী, চোর ডাকাত, বারাঙ্গনা, কুলি মজুর প্রভৃতি কবিতা দ্রষ্টব্য।
‘নিখিল আমার ভাই’ কবিতায় জীবনানন্দ দাশ বলেছেন —
নিখিল আমার ভাই
— কীটের বুকেতে সেই ব্যথা জাগে আমি সেই বেদনা পাই
যে প্রাণ গুমরি কাঁদিছে নিরালা শুনি যেন তার ধ্বনি
কোন ফণি যেন আকাশ বাতাসে তোলে বিষ গরজানি!
আমার শস্য-স্বর্ণপসরা নিমেষে হয় যে ছাই
— সবার বুকের বেদনা আমার নিখিল আমার ভাই।
‘পতিতা’ কবিতায়–
‘সে যে মন্বন্তর — মৃত্যুর দূত-অপাঘাত — মহামারী —
মানুষ তবু সে — তার চেয়ে বড়ো — সে যে নারী।
[hfe_template id=’81’]
জীবনানন্দ দাশের এ কবিতার সাপেক্ষে নজরুলের কবিতার উদ্ধৃতি নি®প্রয়োজন। কেননা এ কবিতাগুলির অধিকাংশই ছিল নজরুলীয় সম্প্রসারণ।
ঝরাপালকে ‘সিন্ধু’ নামে কবিতা রয়েছে। নজরুলের একটি কবিতা গ্রন্থের নাম ‘সিন্ধু-হিন্দোল’। এই গ্রন্থে সিন্ধু (প্রথম তরঙ্গ), সিন্ধু (দ্বিতীয় তরঙ্গ), সিন্ধু (তৃতীয় তরঙ্গ) নামে তিনটি কবিতা রয়েছে।
জীবনানন্দ দাশের এ ধরনের কবিতার সঙ্গে নজরুলের বিষয় এবং আঙ্গিকের ছিল প্রত্যক্ষ যোগাযোগ। ‘ঝরাপালক’ এ প্রচলিত অর্থে প্রেমের কবিতা না থাকলেও ‘ছায়া প্রিয়া’ ‘অস্ত চাঁদে’ ‘যে কামনা নিয়ে’, ‘ওগো দরদিয়া’,‘মরীচিকার পিছে’ প্রভৃতি কবিতায় নজরুলের প্রেমের কাব্য ‘দোলন-চাঁপা’,‘ছায়ানট’গ্রন্থের আঙ্গিকের ছাপ রয়েছে। যেমন :
জীবনানন্দ দাশ :
দুপুর রাতে ও কার আওয়াজ!
গান কে গাহে — গান না!
কপোত-বধূ ঘুমিয়ে আছে
নিঝুম ঝিঁঝির বুকের কাছে;
অস্তচাঁদের আলোর তলে
এ কার তবে কান্না
গান কে গাছে, গান না।
[ছায়াপ্রিয় : ঝরাপালক]
নজরুল :
গাইতে বসে কণ্ঠ ছিড়ে আসবে যখন কান্না,
বলবে সবাই ‘সেই যে পথিক তার শেখানো গান না?’
আসবে ভেঙে কান্না!
[অভিশাপ : দোলন-চাঁপা]
তাছাড়া ঝরাপালকে নজরুরুলীয় শব্দ-শব্দাংশ চরণ, উপমা-উৎপেক্ষা ব্যবহৃত হয়েছে প্রচুর এমনি কি আরবি ফারসি শব্দ পর্যন্ত। যেমন :
আনমনা, দাদুরী কাঁদানো, স্বপ্ন-দুয়ার, দিওয়ানা, পেয়ালা, তরবারি, সরাইখানা, দিলদারদের দরাজ গলায়, বেহুশ হওয়ার, দিলওয়ার, বাতায়ন, সুদূর মরুদ্যান, মাস্তানা, বেদুঈন, খুন্নরোজী মুসাফের, জিঞ্জীর, তুরানী প্রিয়া, রোজা, ঈদরাত, প্রলয়ধ্বনি, যুবানবীনের, সফেন সুবার, মজলুম, সুরা, ফেনার বৌয়ের নোনতা মৌয়ের– মদের গেলাস লুটে। অবশ্য এ ক্ষেত্রে কেবল নজরুল নন সত্যেন্দ্রনাথ এবং মোহিতলাল ও জীবনানন্দ আকৃষ্ট করেছিলেন। তবে সব ছাপিয়ে ‘ঝরাপালকে’ও নিজস্বতার স্বাক্ষর রেখেছেন;– গভীরভাবে না দেখলে প্রথমে ঠাওর করা যায় না।
জীবনানন্দ দাশ বলেছেন, তার শিক্ষা এবং মানসগঠনের তার মা-বাবা এবং ব্রজমোহন স্কুলের হেডমাস্টার যে ভূমিকা রেখেছিলেন, তেমনটি আর কেউ পারে নি। তাঁদের উদারনৈতিক মানসিকতা জীবনানন্দের ওপর ফেলেছিল গভীর ছাপ। আর তাঁর ‘ঝরাপালক’ কাব্যগ্রন্থ বিশ্লেষণ করলে প্রতীয়মান হয় তাঁর কাব্য জীবনের প্রথম পর্যায়টা অধিকার করেছিলেন নজরুল। বোধ করি জীবনানন্দ পারিবারিক শিক্ষা জীবনের শুভবোধের সঙ্গে নজরুল কাব্যের অন্বয় খুঁজে পেয়েছিলেন। তিনি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বুঝেছিলেন– “পরমপরতার চেয়ে স্বার্থ সন্ধান ঢের হেয় জিনিস” স্বার্থসাধন কিছুই নয়; কিন্তু কোটি মানুষের আত্মোপকার প্রতিভাই তাকে নির্মাতার উপরে ভূমিকায় ওঠাতে সাহায্য করে কবিতাকে তার অন্তিম সংগতির পথে নিয়ে যায়। তিরিশের প্রধান কবিদের মধ্যে বুদ্ধদেব বসু ভিন্ন তিনিই নজরুলকে নিয়ে প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। সে প্রবন্ধ তাঁর সে সময়ের অধীতবিদ্যা এবং উপলব্ধিজাত হলেও নজরুলকে মূল্যায়নের একটি নিরপেক্ষ মনোভঙ্গি কাজ করেছিল।
‘ঝরাপালক’ প্রকাশের ন’বছর পরে জীবনানন্দ দাশের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ (১৯৩৬) প্রকাশিত হয়। জীবনানন্দ দাশ এই গ্রন্থে নজরুলীয় অনুশাসন থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন। দু’একটি ব্যতিক্রম ক্ষেত্র ছাড়া কবি কণ্ঠস্বরে জীবনানন্দ দাশ এ গ্রন্থে নিজের জন্য একটি স্বার্বভৌম স্বাতন্ত্র্য গড়ে তুলতে পারলেন। রবীন্দ্র-নজরুলোত্তর আধুনিক বাংলা কাব্যে তিনি ভিন্ন আর কেউ এতখানি স্বাতন্ত্র্য নিয়ে তখনো দাঁড়ান নি। অবশ্য নজরুলের সঙ্গে একটি দূরান্বয় সম্পর্ক তখন পর্যন্ত আবিষ্কার করা কষ্টসাধ্য হলেও অসম্ভব নয়। যেমন ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র প্রথম কবিতা ‘নির্জন স্বাক্ষর’ কবিতাটি নজরুলের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘দোলন চাঁপা’ (১৯২৩)’র ‘বেলাশেষে’র কবিতাটি কয়েকটি চরণ মিলিয়ে পাঠ করা যেতে পারে।
নজরুল :
ধরণী দিয়াছে তার
গাঢ় বেদনার
রাঙা মাটি-রাঙা স্নান ধূসর আঁচলখানি
দিগন্তের কোলে কোলে টানি।
পাখি উড়ে যায় যেন কোন` মেঘ-লোক হ’তে
সন্ধ্যা-দীপ-জ্বালা গৃহ-পানে ঘর-ডাকা পথে।
আকাশের অস্ত-বাতায়নে
অনন্ত দিনের কোন বিরহিনী কনে
জ্বালাইয়া কনক-প্রদীপখানি
উদয়-পথের পানে যায় তার অশ্রু-চোখ হানি।
হেমন্তের এমনই সন্ধ্যায় যুগযুগ ধরি বুঝি হারায় চেতনা।
উপুড় হইয়া সেই স্তূপীকৃত বেদনার ভার
মুখ গুঁজে পড়ে তাকে; ব্যথা গন্ধ তার
গুমরিয়া গুমরিয়া কেঁদে কেঁদে যায়
এমনি নীরবে শান্ত এমনি সন্ধ্যায়।…
ক্রমে নিশীথিনী আসে ছড়াইয়া ধূলায় মলিন এলোচুল–
সন্ধ্যা-তারা নিবে যায় হারা হয় দিবসের কূল।…
[বেলা শেষে : দোলন চাঁপা]
জীবনানন্দ দাশ :
তুমি তা জান না কিছু না জানিলে —
আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে!
যখন ঝরিয়া যাব হেমন্তের ঝড়ে
পথের পাতার মতো তুমিও তখন
আমার বুকের পরে শুয়ে রবে?…
হেমন্তের ঝড়ে আমি ঝরিব যখন —
পথের পাতার মতো তুমিও তখন
আমার বুকের পরে শুয়ে রবে?…
আমার বুকের পরে সেই রাতে জমেছে যে শিশিরের জল
তুমিও কি চেয়েছিলে শুধু তাই! শুধু তার স্বাদ।”
[নির্জন স্বাক্ষর : ধূসর পাণ্ডুলিপি]
উপর্যুক্ত দুর্বল ধরনের মিল খুঁজে বের করা বক্ষ্যমাণ আলোচনার লক্ষ্য নয়। একথা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে হয় ‘ধূসর পাণ্ডলিপি’তে এসে জীবনানন্দ দাশ বিষয়ে এবং আঙ্গিকে নজরুল-বলয় মুক্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু ‘জয় মানবের জয়’ বলে জীবনানন্দ দাশ যে শুভ উদ্বোধনীর ঘোষণা দিয়েছিলেন অভিজ্ঞতা ও অর্জনের পথ পরিক্রমার অতলচক্র পেরিয়ে তিনি সেই বোধের কাছে স্থির হয়েছিলেন। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরা পালক’ প্রকাশিত হয় ১৯২৭ সালে। তাঁর মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হলো ‘রূপসী বাংলা’ (১৯৫৭) ও ‘বেলা অবেলা কালবেলা’ (১৯৬১)। সবগুলি গ্রন্থ মিলে জীবনানন্দ দাশ একটি কাব্য-শৃঙ্খল তৈরি করেছিলেন। তাঁর কবিতার বিষয়-বৈচিত্র্য একটি ছক ও বৃত্তের সাহায্যে দেখানো সম্ভব। জীবনানন্দ দাশ এ পর্যায়ে নজরুলীয় বিষয় এবং আঙ্গিক থেকে মুক্ত হলেও চেতনাগত ঐক্যে সংযুক্ত থাকেন। সে চেতনা মানবীয় কল্যাণবোধ, যে শুভ উদ্বোধনের অংশীদারিত্বে উভয়ই সক্রিয় ছিলেন। ‘মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়/ অতীতের থেকে উঠে আজকের মানুষের কাছে/ প্রথমত চেতনার পরিমাপ নিতে আসে।’ প্রকৃতার্থে জীবনানন্দ দাশ কখনোই ব্যক্তিগত জীবনে কিংবা কবিতায় নির্জন কিংবা জনবিমুখ ছিলেন না। যেখানে যতখানি প্রতিবাদ কিংবা গ্রাহ্য প্রয়োজন হয়েছে ততখানি তিনি করেছেন। — ‘জীবনানন্দ দাশের আত্মঘাতী ক্লান্তি থেকে তিনি মুক্ত।’ এর জবাবে জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন– ‘আত্মঘাতী ক্লান্তি’ আমার কবিতার প্রধান আবহাওয়া নয়` কোনদিন ছিল বলে মনে পড়ে না। ‘আত্মঘাতী ক্লান্তি’র অভিযোগ প্রতিষ্ঠা করার জন্য তিনি লাশ কাটা ঘরের কবিতাটি বেছে বের করেছেন! কবিতাটি Subjective নয়, একটা Dramatic representation মাত্র! কবিতাটির Subjective শেষের দিকে ফুটেছে;কিন্তু সে তো লাশ-কাটা ঘরের ক্লান্তির বাইরে– অনেক-দূরে প্রকৃতির প্রাচুর্য ও ইতিহাসের প্রাণশক্তির সঙ্গে একাত্ম করে আনন্দিত করে রেখেছে কবিকে। তবু নীরেনবাবু লাশকাটা ঘরের নায়ককে নায়কের স্রষ্টার সঙ্গে ওতপ্রোত করে না জড়িয়ে কবিতাটি আস্বাদন করতে পারেন নি মনে হয়। এ ধরনের উদাহরণ জীবনানন্দ দাশের জীবনে প্রচুর। কেবল কবিতা লিখেই তিনি জীবনের সকল দায় মেটাতে চান নি। সমাজের বিবিধ বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনা করেছেন, লিখেছেন সংখ্যাতীত গদ্য রচনা। এমন কি ভারতবর্ষে শিক্ষার সঙ্কট নিয়ে তিনি প্রবন্ধ লিখেছেন। ইংরেজির অধ্যাপক হিসাবে ছাত্রদের অধ্যয়ন নিয়েও তিনি ভাবিত হয়েছেন। বাজারে নোট সম্পর্কেও তিনি বলেছেন– “পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগে ইস্কুলের ছেলেদের ইংরেজি টেক্সটই পড়তে হত; তখন বাজারে নোটের চল ছিল না। আজকালকার ছেলেদের এত বেশি নোট পড়তে হয় (যেমন হেরিকের একটা ছোট দুই স্ট্যামুডা মাত্রা কবিতার জন্য প্রায় পনেরো পৃষ্ঠা নোট– ইংরেজ টীকাকাররা যা চার-পাঁচ লাইনেই শেষ করে দিতেন) যে টেক্সট পড়বার কোনো সময়ই থাকে না তাদের।
‘ঝরাপালক’-এ বোধের যে বিন্দু থেকে জীবনানন্দ দাশ যাত্রা শুরু করেছিলেন, যে যাত্রা ছিল বিশেষ থেকে নির্বিশেষের দিকে, সমকাল থেকে মহাকালের দিকে, দৈশিক অনুভাবনা থেকে বৈশ্বিক বিভাবনায়। এ পর্যায়ে তিনি জীবন আর মৃত্যুকে একাকার করে ফেলেছিলেন। বেহুলার সঙ্গে মৃত দয়িতের সঙ্গে গাঙুর পেরিয়ে ছিন্ন খঞ্জনীর (অর্ফিয়ুসের বাঁশরি) মতো ইন্দ্রের কাছে জীবন ভিক্ষা চেয়েছিলেন। সান্টাক্রুজ থেকে অপরাহ্নের জুহুর সমুদ্র পড়ে কিছুটা স্তব্ধতা কামনা করেছিলেন। মালাবার পাহাড়ের কোল ছেড়ে দেখেছিলেন ‘কাঞ্চী বিদিশার মুখশ্রী এখনো মাছির মতো ওড়ে।’ সিংহল সমুদ্র থেকে মালয় সাগর ঘুরে এই দুর্ধর্ষ ক্লান্ত নাবিক আবার প্রত্যাবর্তন করেছেন মাটির পৃথিবীতে। ‘ঝরাপালকে’ (১৯২৭) এ তাঁর কাব্য বৃত্তের যে চাপ ঘূর্ণায়মান ছিল সেই চাপ ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ (১৯৩৬) এবং ‘বনলতা সেন’ (১৯৪২) পেরিয়ে ‘মহাপৃথিবী’ (১৯৪৫)তে এসে ব্যাসের প্রান্তবিন্দু স্পর্শ করেছিল। যার গঠন পূর্ণ অর্ধবৃত্তের মতো। বাকি অর্ধবৃত্ত গঠন করেছিল ‘সাতটি তারার তিমির’ (১৯৪৮) ‘বেলা অবেলা কালবেলা’ (১৯৬১)-এ এসে। জীবনানন্দ দাশের কাব্যবৃত্তের এই পরিধি সবসময় দৃষ্টিগ্রাহ্য। দ্বিতীয় পর্যায়ে এসে তিনি বুঝেছিলেন` ‘সময়ের কাছে সাক্ষ্য দিয়ে চলে যেতে হয়। কী কাজ করেছিল আর কী কথা ভেবেছি।’ তাছাড়া তিনি যে জীবন সত্য আবিষ্কার করেছিলেন, তা হলো জীবনের সব জটিলতা এবং অন্ধকার দূরীভূত করে মানুষ আলোর দিকে যেতে চায়। কিন্তু মানুষের মজ্জার গভীরে রয়েছে তিমির বিলাস। তবু ‘সৎ কবিতা বলতে শোষিত মানব জীবনের কবিতা, সেই জীবনের বিগ্রহ এবং তৎপরবর্তী শ্রেষ্ঠতম সময়ের কবিতা।
আধুনিক বাংলা কবিদের মধ্যে নজরুল ভিন্ন যিনি সাধারণ জনগণের কাতারে নেমে এসেছিলেন, তাঁর নাম জীবনানন্দ দাশ। একমাত্র জীবনানন্দ দাশই সাধারণ মানুষের জীবনাচরণ রপ্ত করেছিলেন, যে জীবন কবির নয় কিংবা কবির জীবনই সাধারণ মানুষের। এখানে আচরণের দিক দিয়ে নজরুল এবং জীবনানন্দ দাশ বিপরীতমুখী কিন্তু অভিযাত্রা একই লক্ষ্যে; একজন মানুষের যাবতীয় প্রয়োজনে, এমন কি হারমোনিয়াম কাঁধে নিয়ে দুঃস্থ মানবতার সাহায্যার্থে পুরবাসীদের কাছে ভিক্ষা মেগেছেন। আর অন্যজন নিজের জীবনকেই করে তুলেছেন সাধারণ মানুষের জীবন। এর চেয়ে বড় প্রতিবাদ আর বিপ্লব কী আর হতে পারে। ইংরেজি শিক্ষিত একজন মানুষ, পৃথিবীর আধুনিকতম কবিতার সঙ্গে যার বসবাস সেই জীবনানন্দ দাশ জীবনাচরণে সাধারণ মানুষের মত মিতবাক একরোখা আক্ষেপহীন। কবিতাতেও কিন্তু তিনি ‘তালতলা মুচিপাড়ার’ কথা ভোলেন নি। কখনো ভোলেন নি: ‘হাতে তুলে দেখি নি কি চাষার লাঙল? / বালতিতে টানিনি কি জল? / কাস্তে হাতে কতোবার যাই নি কি মাঠে? / মেছোদের মতো আমি কতো নদী ঘাটে / ঘুরিয়াছি’
[hfe_template id=’81’]
সমকালীন সমস্যা একজন প্রধান কবিকে স্পর্শ করবে না তা কি করে হয়। যতই ঔপনিবেশিক শিক্ষা এবং সুবিধার মধ্যে আমাদের উত্তরসুরী বেড়ে উঠুন না কেন` তারাই ঔপনিবেশিক শাসনের দুষ্ট-ক্ষত চিহ্নিত করে দিয়ে গেছেন আমাদের কাছে। নজরুল ইসলাম সারা জীবনভর প্রধানত একটাই কবিতা লিখেন; সেই কবিতার নাম ঔপনিবেশিক ভূতকে ভাগিয়ে দাও। সাদা মানুষ যাদের ঔপনিবেশিক বর্বরতার ফলশ্রুতিতে আজকের পৃথিবীর সত্তুর শতাংশ লোক ক্ষুধার মধ্যে বসবাস করছে। আমরা ভারতবর্ষের কথা জানি; যে দেশটি তার অর্থনীতিতে ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ, সে আজ ‘দিকদার কাধে ঝুলি ভিক্ষার?’ কিন্তু জীবনানন্দ দাশের কবিতায় সেই দুঃশাসনের চিত্র অনুপস্থিত ছিল না। দু’একটি উদ্ধৃতি দেয়া যাক :
১. বাংলার লক্ষ নিরাশায় আলোহীনতায় ডুবে নিস্তব্ধ নিস্তেজ
সূর্য অস্তে চলে গেলে কেমন সুকেশী অন্ধকার
খোপা বেঁধে নিতে আসে– কিন্তু কার হাতে?
আলুলায়িত হয়ে চেয়ে থাকে– কিন্তু কার তরে?
হাত নেই– কোথাও মানুষ নেই; নিভে গেছে সব।’
২. যদি ডাকি রক্তের নদীর থেকে কল্লোলিত হয়ে
বলে যাবে কাছে এসে, ইয়াসিন আমি,
হানিফ মহম্মদ মকবুল করিম আজিজ–
আর তুমি? আমার বুকের পরে রেখে মৃত মুখ থেকে
চোখ তুলে সুধাবে যে-রক্ত নদী উদ্বোলিত হয়ে
বলে যাবে। গগন বিপিন শশী পাথারঘাটার;
মানিকতলার শ্যামবাজারের গ্যালিফ স্টিটের এন্টানীর
১৯৪৬-৪৭ : শ্রেষ্ঠ কবিতা
এসব কবিতা জীবনানন্দ দাশের পরিণত জীবনের কবিতা` যখন জীবনানন্দ দাশের কবিতা তিমির বিনাশের লক্ষ্য সক্রিয়। জীবনানন্দ দাশ তাদের পক্ষ নিয়েছেন — ‘যাদের ঘর টাকা তল্পিতল্পা নেই। হাসপাতালের বেড হয়তো তাদের তরে নয়।’
কবিতা এক লক্ষ্যহীন শৈল্পিক অবস্থানের দিকে এগিয়ে চলেছে`– এই অভিযোগ মহৎ কবিতা এবং কবির জন্য কখনো যথার্থ নয়। নজরুলোত্তর মনোজগতের দিকে ধূসর এবং নির্জনতার দিকে; কিন্তু জীবনানন্দের কবিতা নির্জনতা নয় জনতার দিকে অগ্রসর হয়েছে। যে জনতার প্রতি নজরুলের নিবেদন ছিল সমগ্র জীবন, সেই জীবনের অভিজ্ঞতা এবং আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করেছেন জীবনানন্দ দাশ। তাদের বাচনভঙ্গি ছিল স্বতন্ত্র্য, চেতনার গভীরতার পার্থক্য স্পষ্ট কিন্তু উদ্বোধনের সংগীত রচনা উভয়েরই লক্ষ্য। এ প্রসঙ্গে জীবনানন্দ দাশের একটি বিখ্যাত কবিতার কথায় আসা যাক। আমরা প্রায়শ মননের জটিলতা ভাবি ‘আমাদের মনও আমাদের নিজের নয়’, এসব প্রসঙ্গে আলোচনায় জীবনানন্দ দাশের ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতাকে ক্লান্তিকর আত্মহননের অনুষঙ্গ বলে উল্লেখ করি —
নারীর হৃদয়– প্রেম-শিশু-গৃহ-নয় সবখানি;
অর্থ নয় কীর্তি নয় স্বচ্ছলতা নয় —
আরো এক বিপন্ন বিস্ময় —
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে;
আমাদের ক্লান্ত করে
ক্লান্ত-ক্লান্ত করে;
লাশ কাটা ঘরে
সেই ক্লান্তি নাই।
অথচ ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতাটি আদৌ পরাজিত মানবের ইতিহাস নয়। এটি স্রষ্টার বিপন্ন বিস্ময়। একজন জীবনবাদী এবং অপরাজেয় মানবের বহুমাত্রিক চেতনার অন্যতম অনুষঙ্গ এই কবিতার মধ্যে গ্রন্থতা করা হয়েছে। আট বছর আগে একজন মানুষের মধ্যে এ রকম একটি ক্লান্তিকর মুহূর্তের আবির্ভাব ঘটেছিল, যে এক গাছা দড়ি হাতে নিয়ে অশ্বত্থের তলে গিয়েছিল কিন্তু জীবনের তুমুল গাঢ় সমাচার তাঁকে মৃত্যুর চেয়ে জীবনের প্রতি আশান্বিত করে তুলেছিলেন।
নজরুল ও জীবনানন্দ এই দুই মহান কবি পরুষ দুই বিপরীত ভঙ্গি ও বিবেচনার মধ্য দিয়ে নানা বাঁক ও বৃত্ত অতিক্রম করে এক শুভ ও চৈতন্যের বিন্দুতে মিলিত হয়েছেন। আর এই মিলনই বাংলা কবিতার আদি মধ্য অন্ত বিন্দু।

মজিদ মাহমুদ
কবি, লেখক, গবেষক
জন্ম ১৬ এপ্রিল ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে পাবনা জেলায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা সাহিত্যে প্রথম শ্রেণীতে স্নাতকোত্তর। সাংবাদিকতা তাঁর মূল পেশা, নজরুল ইনসটিটিউট, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অধীনে তিনি কাজ করেছেন; কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর। কবিতা তাঁর নিজস্ব ভুবন হলেও মননশীল গবেষণাকর্মে খ্যাতি রয়েছে। প্রথম বই প্রকাশিত হয় ১৯৮৫ সালে।
উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ : মাহফুজামঙ্গল, বল উপাখ্যান, আপেল কাহিনী, সিংহ ও গর্দভের কবিতা, দেওয়ান-ই-মজিদ। উল্লেখযোগ্য গবেষণা গ্রন্থ : নজরুল তৃতীয় বিশ্বের মুখপাত্র, কেন কবি কেন কবি নয়, ভাষার আধিপত্য ও বিবিধ প্রবন্ধ, উত্তর-উপনিবেশ সাহিত্য ও অন্যান্য, রবীন্দ্রনাথের ভ্রমণসাহিত্য।