নজরুলের গানে মানসমুক্তির পথ

আরিফুল হাসান

সমকালীন শব্দ-যোদ্ধা

জীবন চলার পথে মানবমানসে আঘাত লাগে, দুঃখে আনন্দে ভাসে মানব মন। আপাত আনন্দে মন থেকে কালোমেঘ সরে গেলেও, মনের গহীণে সেসব ক্ষত কালিমার আস্তরণ তৈরি করে। তাই নিজের অজান্তে কখনো কখনো হুহু করে কেঁদে উঠে মন। এই যে হৃদয়ের বিলাপ, এর কোনো কারন খুঁজে পাওয়া যায় না। এই যে অন্তর্দাহ সংলাপ, এর কোনো সঠিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। যেনো কাঁদার জন্যেই কাঁদা, কোনো কারন ছাড়া কাঁদা, এমনি এমনি কাঁদা। এই কান্নার ভেতরে রোনাজারি, গোপন কোনো অভিপ্সার ক্ষত হৃদয়পটে মুছে যাওয়া স্মৃতির বিস্মৃতি হতে হতেও মুছে যায় না। একপশলা দাগ টেনে যায়। সেই দাগ যখন ব্যাঞ্জনবর্ণে, স্বরবর্ণে আমাদের সামনে প্রতিস্থাপিত হয় তখন আমরা তাকে গান বলি, গীত বলি কিংবা গীতিকবিতা বলি। কবি কীটস মনে করতেন, “যন্ত্রণাকাতর মনের জন্য সংগীত ঔষধের কাজ করে।”

কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যের এক অনুপম প্রতিভা। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ উপন্যাস কি না লিখেছেন তিনি। সাহিত্যের সাঙ্গীতিক ভাষাকে তিনি ঋদ্ধ করেছেন বহুতর সংগীতের মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে নজরুল শুধু বাংলা ভাষাতেই নয়, পৃথিবীর অপরাপর ভাষার কোনো কবিই একজীবনে একহাতে এতো বেশি গানের পশরা সাজাতে পারেন নি। তার এক হাতে রণতূর্যের সাথে আরেক হাতে বাঁকা বাঁশের বাশরির দোলা। এই দোলা হৃদয়জ, এই দোলা গীতিবাগিচার বুলবুলস্বর, যা থাকে চিরায়তপথের প্রতিটি ধূলার গোপন প্রাণে। কাজী নজরুল ইসলাম সেই অন্তরকাহনের বিচিত্র চোরাপথ তৈরি করে দিয়েছেন অবারিতভাবে। আর তাই এই প্রাণের রোদন দেশ-কাল-পাত্রভেদে চিরায়ত, চিরকালের মুকুটশোভিত করে কবিকে। কবিও যেনো তার সীমাহীন প্রেমের নিবিড় ভক্তি প্রকাশিতে চান সুরের সাথে সাথে। তাই তাঁর ভাষায়, “অঞ্জলী লহ মোর সংগীতে/ প্রদীপ-শিখা সম কাঁপিছে প্রাণ মম/ তোমার সুন্দর, বন্দিতে সঙ্গীতে।”

কর্মক্ষম জীবনের সীমাবদ্ধতায় কাজী নজরুল ইসলাম ৫৬০০-এরও বেশি গান রচনা করেছেন। এসবের বেশিরভাগের আবার তিনি নিজেই সুরারোপ করেছেন। তিনি ছিলেন সুরের সাধক। নিবিড় রাগরাগিনীকে তিনি ধ্বনিবন্ধে নিজের করে নিয়েছেন একান্ত পারঙ্গমতায়। আর তা কবিহৃদয় ছাপিয়ে সাধারণ্যের ভেতর বাহির আলোড়িত করে চলছে আজও। কাজী নজরুল ইসলাম কলকাতা বেতার কেন্দ্রের সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত হন ১৯৩৮ সালে। সেসময় তিনি ‘হারামণি’,‘নবরাগমালিকা’, ও ‘গীতিবিচিত্রা’ র জন্য প্রচুর গান লিখেছেন। ‘হারামণি’ অনুষ্ঠানে কাজী নজরুল ইসলাম কম প্রচলিত ও বিলুপ্ত রাগ-রাগিণীর গান পরিবেশন করতেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে তিনি হারিয়ে যাওয়া রাগের উল্লেখ করে সে রাগে নিজের লেখা নতুন গানটি পরিবেশন করতেন। এসব লুপ্তপ্রায় রাগের উপর তিনি চল্লিশটিরও বেশি গান করেছিলেন।

আলোচ্য লেখায় নজরুল ইসলামের রচনার ব্যাপ্তি আলোচনা করা অভিপ্রায় নয়। কিংবা তার সব্যসাচী প্রতিভাকে মূল্যায়ন করাও লক্ষ্য নয়। আলোচনায় আমরা জানার চেষ্টা করবো কাজী নজরুল ইসলামের গানে কীভাবে মানব-মানসের মুক্তির পথ নিহিত আছে। কীভাবে তিনি চিরায়ত দুঃখবোধকে ধারণ করার নান্দনিক সৌন্দর্য প্রকটিত করেছেন সেগুলো আমরা দেখার চেষ্টা করবো। কাজী নজরুল ইসলাম মূলত ব্যাক্তিজীবনেও ছিলেন দুঃখের ফেরিওয়ালা, তাই অন্তরের রোদন তিনি স্বযত্নে আঁখিজলে সাজিয়েছেন। আমরা সেই অশ্রুর বর্নমালাগুলো পড়বো এবং বোঝার চেষ্টা করবো তার উত্তরণজাত পথের কনট্যুর ম্যাপ।

‘বুলবুল’ সঙ্গীত গ্রন্থে কবি দুই নং গানে লেখেন :“আমারে চোখ ইশারায় ডাক দিলে হায় কে গো দরদী/ খুলে দাও রঙ-মহলার তিমির দুয়ার ডাকিলে যদি।” এই যে অন্তরপর্বের ডাক, এই চিরায়ত মনের আহ্বান, সেই আহ্বানে কবি বিভোর হয়ে যান। খুঁজে পেতে চান তিমির বিনাশী আলোর পথ। কবির সাথে সাথে সেই আকাঙ্ক্ষা হয়ে উঠে চিরন্তন ও চিরমানুষের অভিপ্সার সম্পদ। কবির মতো আমরাও যেনো হৃদয়ের তিমির পথে আলোর বাসনা নিয়ে আকুতি জানাই। আবার আরেকটি গানে কবি লেখেন,

কেন কাঁদে পরান কী বেদনায় কারে কহি?
সদা কাঁপে ভীরু হিয়া রহি রহি।।
সে থাকে নীল নভে আমি নয়ন-জল-সায়রে
সাতাশ তারার সতিন-সাথে সে যে ঘুরে মরে,
কেমনে ধরি সে চাঁদে রাহু নহি।।
কাজল করে যারে রাখি গো আঁখি-পাতে
স্বপনে যায় সে ধুয়ে গোপন অশ্রু-সাথে!

এভাবেই কবি তার চিরবিরহী মনের, মনের মানুষের গোপন কান্নার কথা তুলে ধরেছেন। তিনি প্রেমের মাঝে এক অতিপ্রাকৃত প্রেমের সুর গেঁথে দিয়েছেন শব্দ সুষমায়। আর তাই এ রোদন-সংগীতে বিরহী মানেই, প্রেমিক মানেই তার নিজের ভেতরের যন্ত্রণার সাক্ষাৎ খুঁজে পেতে পারে। যেমনিভাবে কবি তার গোপন অশ্রুর সাথে কাজল করে রাখা প্রেমিক প্রবরের স্মৃতিচিহ্ন ধুয়ে যেতে দেখে, তেমনি আমরাও দেখি আরাধনার অভীষ্ট কীভাবে স্থিতপ্রজ্ঞ হয়েও আমাদের থেকে দূরে দূরে সরে যায়, বহুদূরে লীন হয়ে যায়।

“এতো জল ও কাজল-চোখে/ পাষাণী, আনলে বলো কে/ টলমল জল-মোতির মালা/ দুলিছে ঝালর-পলকে।” এমনি কোনো বিষাদের সোপান আমাদের চোখে যখন অশ্রুর বন্যা বইয়ে দিয়ে যায় কবি তখন বলেন, এতো জলের রহস্য কী? পাষাণ-পাথর চোখে যখন অশ্রুর বন্যা বয়ে যায় তখন যুগপৎ বিস্মিত কবি ও পাঠক। এই অশ্রুজলই কিন্তু হৃদয় দহনের মুক্তির শিরোনামা। এই চোখের জল দিয়েই ধুয়ে দেয়া যায় অন্তঃকরণের দুঃখ-কালিমা আর চোখ হয়ে উঠে হননকারী কিংবা বাঁচানোর মল্লিক। তাই কবি অন্য একটি গানে লেখেন,

চেয়ো না সুনয়না
আর চেয়ো না এ নয়ন পানে।
জানিতে নাইকো বাকি
সই ও আঁখি কী জাদু জানে।।
একে ঐ চাউনি বাঁকা
সুরমা-আঁকা, তার ডাগর আঁখি
বধিতে তায় কেন সাধ
যে মরেছে ঐ আঁখি-বাণে।।

তেমনি আবার ‘পরাণ-প্রিয়! কেন এলে অবেলায়/ শীতল হিমেল কায়ে ফুল ঝরে যায়।’ – এমনি দুঃখের পঙক্তি দিয়ে সাজিয়েছেন গানের পশরা। কবি তার নিবিড় মনোঘরের সবটুকু সুষমা, সবটুকু অনুরাগ যেনো ঢেলে দিয়েছেন তার সঙ্গীতের মধ্যে। তিনি গানকে করেছেন রোদনের ভাষা, ব্যাথার দান। আর এ ঐশ্বর্যে সমৃদ্ধ করে গেছেন আমাদের সুরের ভূবন। শুধু সুরের ভূবনই নয়, এর বাসিন্দাদেরকেও দেখিয়েছেন আলোর খোরাক, হৃদয় দহনের মুক্তির পথ।

সাধক মনোমোহন দত্ত বলেছিলেন, ‘চোখের জল আর প্রাণেরি টান/ তাই বিনে কী মন্ত্র গো আছে?/ প্রাণের প্রাণ কাছে…/ একবার আঁখিনীরে টাইনা গো আনো/ প্রাণের প্রাণ কাছে।’ সেই চোখের জলের ব্যাকরণ কবি কাজী নজরুল ইসলাম অত্যন্ত প্রাণময় ভাষায়, হৃদয় কাঁপানো সুরে তার সঙ্গীতের ভুবনে রেখে গেছেন। তিনি মনে করেন, একমাত্র অশ্রুপাতের মাধ্যমেই তার পরমকে পাওয়া সম্ভব, যা থেকে মানস যন্ত্রনার লাঘব হয়ে মনোমুক্তির পথ উন্মোচিত হতে পারে।

গানের মালা গ্রন্থে নজরুল ৯৫ টি গান সংযুক্ত করেছেন। এটি প্রকাশ হয় ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে। এর উল্লেখযোগ্য গানগুলো হলো ‘প্রিয় এমন রাত যেনো যায় না বৃথায়’, ‘চম্পা পারুল যুথী টগর চামেলা’, ‘দূর দ্বীপ-বাসিনী’, ‘আধখানা চাঁদ হাসিছে আকাশে’ ইত্যাদি। ‘গীতি শতদল’ বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৩৪ সালের এপ্রিলে। এই গ্রন্থে সর্বমোট ১০১টি গান ছিলো। জনপ্রিয় গানগুলো হলো, ‘শুকনো পাতার নূপুর পায়ে’, ‘চমকে চমকে ধীর ভীরু পায়’, ‘জাগো জাগো রে মুসাফির’ ইত্যাদি। ‘বুলবুল’ প্রকাশ হয় ১৯২৮ সালে, এতে ৪৯টি গান স্থান পায়। এছাড়া বুলবুল দ্বিতীয় খণ্ড, গুলবাগিচা, চন্দ্রবিন্দু, চোখের চাতক, মহুয়ার গান, রাঙা-জবা, সুরমুকুর, সুরসাকী, নজরুল গীতিকা, সন্ধ্যা ও বনগীতি তার অমর সঙ্গীতগ্রন্থ। নজরুলের গানে আমাদের মানসমুক্তির পথ উন্মোচিত হোক। একশো বাইশ তম জন্মবার্ষিকীতে কবির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।


মো. আরিফুল হাসান

মো. আরিফুল হাসান এর মৌলিক সত্ত্বা একজন স্বতঃস্ফূর্ত লেখক। সাহিত্যের সকল শাখাতেই তার বিচরণ পাখির ডানার মতো মুক্ত ও অবাধ। কবিতা, গদ্যে তার চর্চাজীবন এক ধ্রুব সাধনার মতো নিবিড় ও নিবিষ্ট। বাংলা কবিতার বাঁক বদলের প্রয়াসী অথচ চিরায়ত পঙক্তি-ঝংকার তার শেকড়ের শুভানুবাদ করে। কবিতায় তার যাত্রা শৈশব থেকেই। জন্ম বাংলাদেশের কুমিল্লায়, নজরুলের নার্গিস উত্তরের জানালা খুলে দেখতে পেতো মো. আরিফুল হাসানের জন্মগ্রাম। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। তার সম্পাদিত সাহিত্যের ছোট কাগজ দর্পন, হরফ, নহর ও জানালা । লিখছেন দুই বাংলার প্রিন্ট ও ভার্চুয়াল সাহিত্য ক্যানভাসে। তথাকথিত জীবিতজীবন উপেক্ষা করে অমৃতের নিগূঢ়তম পরিজীবনের ভাষা বিনির্মাণে মো. আরিফুল হাসান একজন সমকালীন শব্দ-যোদ্ধা।

Please Post Your Comments & Reviews

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected!!
Share via
Copy link
Powered by Social Snap