প্রাণ উজ্জ্বীবক দ্বিজেন শর্মা

আবদুল্লাহ আল মোহন

সহকারী অধ্যাপক, গবেষক–

দ্বিজেন শর্মা নামটি উচ্চারণ করলেই প্রাণে সমীহ জাগে, ভালোবাসার আলোকরেখা মনকে ভেদ করে জীবনানন্দে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। আলোকের ঝর্ণাধারা প্রবাহিত হয় তাঁর স্মৃতি মনের ক্যানভাসে ভাসলেই। এমন মনের মানুষ, প্রকৃতিপ্রাণ ব্যক্তিত্ব খুঁজে পাওয়া বিরলই বটে। প্রকৃতি সাধনায়, অসাধারণ প্রাণ প্রীতির কারণেই আমাদের প্রাণের এই মানুষ ‘নিসর্গ সখা’ হয়ে উঠেছিলেন নিজেই একটি আলোকিত প্রতিষ্ঠান। প্রাণের আলোয় ভুবন ভরা ছিলো তাঁর সারাটি জীবন। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে কাজের সুবাদে, ইমপ্রেস টেলিফিল্মে চাকুরিকালে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের সাথে শিক্ষামূলক তথ্যচিত্র ‘সোনালী দরোজা’ তৈরিকালে প্রাণ-প্রকৃতি, জীববৈচিত্য সাধনায় তাঁকে পেয়েছিলাম নানা প্রয়োজনে, সময়ে-অসময়ে জ্বালাতন করতে দ্বিধা করিনি। রমনার ‘নাগলিঙ্গম’ ফুলের বৈচিত্র অনুসন্ধানে কিংবা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পাঠচক্রে তিনি আমাদের মাঝে পথপ্রদর্শৃক হিসেবে পৌরহিত্য করেছেন। সরল ও সাবলীল ভাষায় তাঁর মিষ্টিভাষী উপস্থাপনা, কথকতা আমদের প্রাণকে ছুয়ে যেতো কঁচি পাতাদের মতোন স্পর্শৃ করতো। আমাদের অনেকেরই খুউব প্রিয় একজন মানুষ, লেখক, প্রকৃতি ও নিসর্গ প্রেমিক ছিলেন, আছেন, থাকবেনও। সেটা তাঁর অনন্য জীবন সাধনার গুণেই। সরলপ্রাণ অনুকরণীয় ‘মানুষ’ হয়ে আছেন দ্বিজেন শর্মা। জীবনে অনেকটা পথ পেরিয়ে দ্বিজেন শর্মা আমাদের কাছে হয়ে উঠেছিলেন জীবন্ত কিংবদন্তি, প্রকৃতির বরপুত্র। প্রকৃতিকে কীভাবে ভালোবাসতে হয়, কীভাবে তার কথা বুঝতে হয় তা তিনি সবসময় ছড়িয়ে দিয়েছেন সকলের মাঝে। তিনি আমাদের অনেক অজ্ঞতা দূর করেছেন। আমরা জানি, প্রকৃতি আমাদের জীবনধারণের ধরন ঠিক করে দেয়। পাহাড়ে বাস করলে আমরা কেমন জীবনযাপন করব, সমতলের মানুষ কীভাবে থাকবে আর বনের মানুষের জীবনই বা কী হবে, তা প্রকৃতিই নির্ধারণ করে। তাই প্রকৃতিকে উপেক্ষা করলে স্বাভাবিক জীবন উপেক্ষিত হবে। এই জীবন যেন উপেক্ষিত না হয় সেই সচেতনতা সৃষ্টিরই প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন দ্বিজেন শর্মা। নিভৃতিপ্রিয়, প্রচারবিমুখ উদ্ভিদবিদ, নিসর্গী, বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষাবিদ দ্বিজেন শর্মা সেই প্রজন্মের মানুষ যাঁরা এই উপমহাদেশের বৈপ্লবিক সব পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ সাক্ষী। কিন্তু এসব রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মধ্যেই তিনি তাঁর প্রকৃতিপ্রেমকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছেন। উদ্ভিদ বিজ্ঞানের ওপর পড়াশোনা থাকলেও তাঁর মধ্যে ছিল শিল্পবোধ আর দেখার চোখ, সুন্দরকে অন্বেষণের আকাক্ষা। মানবজাতির জন্য তাঁর মনে সব সময় এক অনিঃশেষ আশাবাদ ও শুভকামনা কাজ করে। লেখালেখির মধ্যেই তাঁর সৃষ্টিশীলতা ফুটে ওঠে বার বার। প্রকৃতি রাজ্যের পথপ্রদর্শক চিরতরুণ এই মানুষটির আজো প্রকৃতির প্রতি অফুরান প্রেম-ভালোবাসা সত্যি সবাইকে মুগ্ধ করে। তাঁর শিক্ষা, তাঁর দীক্ষা আমাদের চলার পথের পাথেয়। অন্ধকারে আলোর দ্যুতি ছড়ানো এই মানুষটির স্মৃতি বেঁচে থাকুক আমাদের মাঝে অনন্তকাল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দ্বিজেন শর্মা স্যারের প্রিয় মানুষ। রবি ঠাকুরের প্রকৃতি প্রেম নিয়ে অনেক কথাই শুনেছি তাঁর মুখে। একটি উদাহরণ তুলে ধরার লোভ সামাতে পারছি না, যেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলছেন, ‘এই যে বাংলাদেশ ইহার মৃত্তিকা, ইহার জল, ইহার বায়ু, ইহার আকাশ, ইহার বন, ইহার শস্যক্ষেত্র লইয়া আমাদিগকে সর্বতোভাবে বেষ্টন করিয়া আছে…আমরা যেন ভালোবাসিয়া তাহার মৃত্তিকাকে উর্বর করি, তাহার জলকে নির্মল করি, তাহার বায়ুকে নিরাময় করি, তাহার বনস্থলীকে ফলপুষ্পবতী করিয়া তুলি, তাহার নরনারীকে মনুষ্যত্ব লাভে সাহায্য করি।’

২.

বহুমুখী কৌতূহল, প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি, পরিবেশ সুরক্ষা ও সৌন্দর্যায়নের নিরলস কর্মী দ্বিজেন শর্মা আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনের একজন বর্ণাঢ্য মানুষ ছিলেন। শিক্ষক, লেখক, অনুবাদক-সর্বত্রই স্বনামখ্যাত দ্বিজেন শর্মা। দ্বিজেন শর্মা নিসর্গ ও পরিবেশ সংরক্ষণে জীবনের প্রায় পুরোটা ব্যয় করেছেন। শিক্ষকতা করেছেন বরিশাল বিএম কলেজ ও নটরডেম কলেজে। মস্কোর প্রগতি প্রকাশনে করেছেন অনুবাদকের কাজ। দেশে ফিরে যোগ দিয়েছেন বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিতে। ‘একুশে পদক’, ‘বাংলা একাডেমি পদক’সহ বিভিন্ন জাতীয় সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা প্রায় বিশটিরও অধিক। প্রকৃতির অমর পূজারি দ্বিজেন শর্মার ‘সমাজতন্ত্রে বসবাস’, ‘শ্যামলী নিসর্গ’, ‘সতীর্থ বলয়ে ডারইউন’ আমার প্রিয় বইগুলোর অন্যতম। আজ মনে পড়ছে অনেক স্মৃতি, দ্বিজেন শর্মা স্যারের লেখালেখি ও জীবন দর্শন নিয়ে একাধিকবার আমরা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে পাঠ আলোচনার আয়োজন করেছিলাম, স্যারের বলা কথাগুলো সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনেছিলাম। আবার তাঁর সাথে রমনা পার্কসহ বিভিন্ন উদ্যানে গিয়ে গাছ চেনার-দেখার সুযোগও হয়েছে অনেকবার। অনন্য কথক দ্বিজেন শর্মাকে খুঁজে পাওয়া যায় ঘরোয়া আলাপনে, প্রাতিষ্ঠানীকতহাহীন-প্রথাহীন কথোপকথনের মাঝে। শৈশবের আলোকিত স্মৃতিচারণে বলেছিলেন, “পাঠশালার স্মৃতিচারণা, দীর্ঘবিস্মৃতির আবরণ উন্মোচন, কঠিন হলেও দুঃসাধ্য নয়। আজকাল অনেক ছেলেমেয়েরই বাড়ির চেয়ে স্কুলের প্রতি অধিক পপাত দেখি। আমাদের সময় কিন্তু এমনটি একেবারেই ছিল না। অভিভাবকরা ছেলেদের শিকের হাতে সঁপে দিয়ে বলতেন- প্রাণটা আমার, শরীরটা আপনার। এমন বন্দোবস্ত যেখানে, সেখানে কার যেতে ইচ্ছে হবে! তাই স্কুল ফাঁকি দেওয়ার নানা অজুহাত খুঁজতাম আর মোম ছিল পেটব্যথা ও জ্বর-জ্বর ভাব। এগুলো শনাক্তির কোনো নির্ভরযোগ্য উপায় না থাকায় রেহাইও মিলত, কিন্তু পরিণতি সর্বদা শুভ হতো না। এমনটি একাধিকবার ঘটেছে- মা সামান্য পরীক্ষা করে স্কুলে না যাওয়ার আর্জি মঞ্জুর করেছেন, এক সময় পালিয়ে বাড়ির পেছনের জঙ্গলে খেলায় বিভোর, তখনই মায়ের হাঁকডাক, একান্ত অনিচ্ছায় ঘরে ফিরে দেখি উঠোনে জনাতিনেক গাট্টাগোট্টা ছাত্র, যথার্থ যমদূত, স্কুলে নাকি ‘বাবু’ অর্থাৎ পরিদর্শক আসবেন, তাই হাজিরা একান্ত আবশ্যক। নিদয়া মা অসুখের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে প্যান্ট-জামা পরিয়ে ওদের হাতেই যখন তুলে দিতেন, মরে যেতে ইচ্ছে হতো।”

৩.

দ্বিজেন শর্মা ১৯২৯ সালের ২৯ মে জন্মগ্রহণ করেন। উল্লেখ্য যে, ২০১৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর প্রয়াত হন তিনি। মহান এই মানুষটির স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। সিলেট বিভাগের বড়লেখা থানার শিমুলিয়া গ্রামে কবিরাজ চন্দ্রকান্ড শর্মা ও সমাজসেবী মগ্নময়ী দেবীর ঘরে জন্ম নেন দ্বিজেন শর্মা। প্রকৃতি প্রেমিক দ্বিজেন শর্মার বাবা চন্দ্রকান্ড শর্মা ছিলেন ভিষক। গ্রাম্যভাষায় যাকে বলে কবিরাজ। আর মা মগ্নময়ী দেবী ছিলেন সমাজসেবী। কিন্তু দ্বিজেন শর্মা হয়েছেন প্রকৃতি প্রেমিক। শৈশবে পাথারিয়া পাহাড়ের জঙ্গলে ঘুরে বেড়িয়েছেন অনেক। সেখান থেকেই গাছপালার প্রতি জন্মে তার অসীম ভালোবাসা। কবিরাজ বাড়ির সন্তান বলেই হয়তো শৈশবে মনের অজান্তে প্রকৃতির প্রেমে পড়েন। বাবা ভিষক বা গ্রাম্য ভাষায় কবিরাজ ছিলেন বলে বাড়িতেই দেখেছেন নানা লতাপাতা আর বৃরে সমাহার। প্রজাপতির ডানা মেলা দিনগুলোয় পাথারিয়া পাহাড়ের আরণ্যক নিসর্গে ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। সেখান থেকেই হয়তো গাছপালার প্রতি তার এ ভালোবাসার জন্ম। দ্বিজেন শর্মার কাছে জানতে পারি, শৈশবেই গ্রামের পাঠশালায় তার হাতেখড়ি হয়। তারপর করিমগঞ্জ পাবলিক হাইস্কুলে পড়াশোনা। মায়ের ইচ্ছে ছিল ছেলে ডাক্তার হবে। কিন্তু প্রকৃতিপ্রেম তাকে উদ্ভিদবিজ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট করল। আর তাই কলকাতা সিটি কলেজে স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্ভিদবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর (১৯৫৮) ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৮ সালে বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬২ সাল পর্যন্ত সেখানেই কর্মরত ছিলেন। তারপর শিক্ষকতা শুরু করেন ঢাকার নটর ডেম কলেজে। ১৯৭৪ সালে সোভিয়েত প্রকাশনা সংস্থা প্রগতি প্রকাশনের অনুবাদকের চাকরি নিয়ে চলে যান মস্কো। তিনি চল্লিশটিরও বেশি বই অনুবাদ করেছেন। মস্কোর মাটিতে প্রথম পা রেখেই মস্কোকে ভালোবেসে ফেলেছিলেন। ১৯৯১ সালের এপ্রিল মাসে অনুবাদ বন্ধ করার নির্দেশ পাওয়ার পর ওই দেশের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সব সম্পর্ক চুকে গিয়েছিল। কিন্তু ১৭ বছরের ভালোবাসা তাকে সেখানকার মাটির সঙ্গে যেভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধেছে, সেগুলো সম্পূর্ণ উপড়ে ফেলা পরবর্তী সময়ে আর সম্ভব হয়নি। বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে পরো সংযোগের কারণে কিছুকাল আত্মগোপন, এমনকি কারাবাসেরও অভিজ্ঞতা হয়েছে, যাকে তিনি দুর্লভ সৌভাগ্য মনে করেন। সত্তরের জলোচ্ছ্বাসে দুর্গত মানুষের সেবাকার্যে যোগ দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের অধিকাংশ সময়ই কাটিয়েছেন বাংলাদেশে। দ্বিজেন শর্মার ভাষায়, ‘তখনই স্বদেশ আত্মার জ্যোতির্ময় রূপের ণিক উদ্ভাস প্রত্য করেছি।’ ভ্রমণ করতে ভালোবাসেন, প্রবাসপূর্ব জীবনে ঘুরে বেড়িয়েছেন সারা বাংলাদেশ। শৈবাল ও অন্যান্য উদ্ভিদের নমুনা সংগ্রহের জন্য চষে ফিরেছেন বাংলাদেশের যত খাল-বিল হাওর-বাঁওড়। সেই তো আমাদের জানাত ‘ওরে ভাই ফাগুন লেগেছে বনে বনে।’ সাতাত্তরের বৃক্ষনিধনে বেইলি রোডে নাগলিঙ্গম, রমনা পার্কের লাগোয়া সেগুন বীথি, নিউমার্কেটের পাশের বটগাছের সারির সঙ্গে আমাদের যৌবন দিনের স্মারণিক ওই বাগানবিলাসটিও নিহত হয়। এ নিহত হওয়ার দৃশ্য তাকে শোকাহত করেছে। গাছের প্রাণের সঙ্গে নিজের প্রাণের অস্তিত্ব যিনি অনুভব করেন তার পইে নিজের সন্তানের মতো বুকে আপন করে নেওয়া সম্ভব। আর দ্বিজেন শর্মা তার জীবনভর সেই কাজটিই করেছেন। নিভৃতচারী ও প্রচারবিমুখ এই উদ্ভিদবিদ, বিজ্ঞান মনস্ক শিক্ষাবিদ তার নিসর্গ প্রেমকে ধারণ করেছিলেন নিজস্ব আধারে। গাছের সঙ্গে কথা বলা আর তাদের ভালোবাসা আদান-প্রদানের মাঝেই কেটে গেছে তার জীবনের অনেকটা পথ।

৪.

প্রচারবিমুখ উদ্ভিদবিদ, নিসর্গী, নিভৃতিপ্রিয়, বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষাবিদ ছিলেন দ্বিজেন শর্মা। উদ্ভিদবিজ্ঞানের ওপর পড়াশোনা থাকলেও তার মধ্যে ছিল শিল্পবোধ আর দেখার চোখ, সুন্দরকে অন্বেষণের আকাঙ্ক্ষা। মানব জাতির জন্য তার মনে সব সময় এক অনিঃশেষ আশাবাদ ও শুভকামনা কাজ করে। লেখালেখির মধ্যেই তার সৃষ্টিশীলতা ফুটে ওঠে বারবার। জীবনে প্রথম যে লেখা ছাপার অরে বেরিয়েছিল সেটি ছিল একটি গল্প, ১৯৪৯ সালে আইএসসি কাসের শেষবর্ষের কলেজ বার্ষিকীতে। সেটি ছিল একটি আত্মজীবনীমূলক গল্প। এক দরিদ্র ছাত্রের শিালাভের কঠোর সংগ্রামের কাহিনি, এরপর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের একাধিক দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকীতে তার লেখা গল্প প্রকাশিত হয়েছিল। সেগুলোর বিষয়বস্তুও ছিল অভিন্ন, দারিদ্র্যের জীবনযুদ্ধ। সমাজতন্ত্র সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতাজাত যে দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছে, তা পুঁজিবাদী বিশ্বের সোভিয়েত গবেষক পণ্ডিতদের চেয়ে আলাদা। এসব বিষয় নিয়ে তিনি বেশ কিছু নিবন্ধ ও স্কেচধর্মী লেখা লিখেছেন। ব্যক্তিজীবনে দ্বিজেন শর্মা নিসর্গপ্রেমিক হলেও তার পরিবারকে দেখেছেন জীবনে অন্যতম অংশ হিসেবে। তার ভালোবাসার খণ্ড খণ্ড রূপেই প্রকাশ পেয়েছে তার নির্সগ ও পরিজনরা। ১৯৬০ সালে বরিশালে দেবী চক্রবর্তীর সঙ্গে বিবাহ হয়। এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে তার স্বপ্নের জীবন শুরু। পরিবারের অনেকটা সময় কেটেছে মস্কোতেই। মস্কোর দণি-পশ্চিম কোণে আকাদেমিকা আনোখিনা সড়কে এক বহুতল ভবনের নবম তলায়। পুত্র ডা. সুমিত শর্মা ও কন্যা শ্রেয়সী শর্মা। কর্মেক্ষেত্রে অবদানের জন্য বিভিন্ন সংস্থা থেকে দ্বিজেন শর্মা বিভিন্ন সময় সংবর্ধিত হয়েছেন। তার সৃষ্টির জন্য পেয়েছেন অনেক সম্মাননা। ড. কুদরত-এ খুদা স্বর্ণপদক চট্টগ্রাম বিজ্ঞান সমিতি ১৯৮৬। বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, বাংলা একাডেমি ১৯৮৭। এম নুরুল কাদের শিশু-সাহিত্য পুরস্কার ২০০০। মানবসেবায় নিবেদিত সংগঠন ‘সিলেট বিবেক’ তাকে ২০১২ সালে সংবর্ধনা দিয়েছে। এছাড়া তিনি এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত বাংলাপিডিয়া গ্রন্থাবলির জীববিদ্যা বিভাগের অনুবাদ ও সম্পাদক (২০০১- ২০০৩) এবং বাংলা একাডেমির সম্মানিত ফেলো।

৫.

কথক হিসেবেও তিনি যেমন সাবলীল ছিলেন তেমনি গদ্যশিল্পী হিসেবেও ভাষার ব্যবহারে ছিলেন অনন্য। এবার দ্বিজেন শর্মা স্যারের নিজের লেখা থেকেই সেই প্রমাণ অভিজ্ঞতা ছোঁয়া যাক। বন্যা আহমেদের বিবর্তনের পথ ধরে এবং অভিজিৎ রায় ও ফরিদ আহমেদ রচিত/সম্পাদিত মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে, এই দু’টি বইয়ের উপর আলোচনা করে লিখেছিলেন ‘ডারউইন : বিশ্বে ও মহাবিশ্বে’ শীর্ষক রচনায়। দ্বিজেন শর্মা লিখছেন, ‘আমি অনেক দিন থেকেই প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে লিখছি। যখন শুরু করেছিলাম তখন একা ছিলাম। এখন অনেকেই লিখছেন। কেউ কেউ আমার লেখায় অনুপ্রাণিত হয়ে থাকবেন এবং তাতে আমি আনন্দিত। কেননা সবাই নিজের কাজের ফল দেখতে চান। একসময় ডারউইন ও বিবর্তনবাদ নিয়েও অনেক লিখেছি; শুরু বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রজীবন থেকে। আমরা সেখানে পড়েছি বিবর্তনবাদের ঢাউস সব বই এবং ইংরেজিতে। পরে কর্মজীবনে কলেজে ডারউইন ও তাঁর তত্ত্ব পড়িয়েছি এবং আশা করেছি, আমার পাঠদান বা বই পড়ে কেউ উদ্বুদ্ধ হয়ে এ বিষয়ে প্রবন্ধ ও বইপত্র লিখবেন। কেননা বিষয়টির পরিসর বিজ্ঞানের ক্ষেত্র অতিক্রম করে দর্শন, সমাজতত্ত্ব, রাজনীতি, সাহিত্যসহ মানববিদ্যার প্রায় সব শাখায়ই বিস্তৃত। কিন্তু আমার সেই আশা পূরণ হয়নি। ইদানীং উচ্চ মাধ্যমিক থেকে ডারউইনবাদ বাদ পড়েছে, বদলি হিসেবে এসেছে জীবপ্রযুক্তিবিদ্যা। কেন এই পরিবর্তন জানি না, তবে ডারউইনবাদের প্রতি আদ্যিকালের অনীহা যদি কারণ হয়ে থাকে, তবে বলতেই হয়, পরিকল্পকেরা ভুল করেছেন। কেননা জীবপ্রযুক্তি আসলে ডারউইনবাদেরই সম্প্রসারণ, খোদার ওপর খোদকারির জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। আমার কর্মজীবনের গোড়ার দিকের ছাত্ররা এখন অবসর নিয়েছেন, তাঁরা আমাকে জানিয়েছেন, কলেজে জীববিদ্যার অনেক শিক্ষক নাকি ডারউইনবাদ পড়াতে চান না, কিংবা পড়ালেও শুরুতেই ছাত্রদের এই তত্ত্বটি বিশ্বাস না করতে বলেন। অথচ পাকিস্তানি জামানায় আমরা ডারউইনবাদ পড়েছি। আমাদের কোনো শিক্ষক এমন কথা বলেননি। বরং তাঁরা এই তত্ত্বের যথার্থতা প্রমাণের চেষ্টাই করেছেন। তাঁরা কেউ নাস্তিক ছিলেন না। ডারউইনের সহযোগী সমর্থকেরাও (লায়েল, হুকার, ওয়ালেস প্রমুখ) প্রায় সবাই ছিলেন ধার্মিক। তাহলে আমাদের এই পশ্চাদ্গতি কেন? উত্তরটি আমাদের শিক্ষাপরিকল্পকেরা জানতে পারেন।

৬.

তিনি জানাচ্ছেন, ডারউইনবিষয়ক আমার প্রথম বই ‘ডারউইন: পিতামহ সুহৃদ সহযাত্রী’ বেরোয় ১৯৭৫ সালে। তারপর আরও দুটি। আমার বন্ধু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ম. আখতারুজ্জামান যিনি বিবর্তনবিদ্যা (১৯৯৮) নামের একটি মৌলিক পাঠ্যবইয়ের লেখক ও ডারউইনের অরিজিন অব স্পেসিজ (প্রজাতির উৎপত্তি, ২০০০) গ্রন্থের অনুবাদক। তিনি এক সভায় দুঃখ করে বলেছিলেন, গোটা কর্মজীবনটাই ছাত্রছাত্রীদের বিবর্তনবাদ পড়িয়ে কাটালেন, অথচ আজও তারা বলে, প্রজাতি সৃষ্টি হয়েছে, উৎপন্ন হয়নি। আমি অতঃপর ধরেই নিয়েছিলাম, আমাদের সব চেষ্টাই ব্যর্থ, দেশ উল্টো পথে চলছে। ভুলটি ভাঙল অকস্নাৎ, মার্কিন মুলুকের তিন বাঙালির লেখা বিবর্তনবিষয়ক দুটি বই হাতে এলে। আরও বিস্নয়ের ব্যাপার, তাঁদের দুজন প্রকৌশলী, একজন সমাজবিজ্ঞানী। আমি অভিভুত ও আনন্দিত। তাঁরা কেউই আমার বই পড়েননি, আমার প্রভাববলয়ের মানুষও নন, কিন্তু তাঁরা নিশ্চিত আমার উত্তরসুরি। তাঁরা বাংলাদেশে পড়াশোনা করেছেন; দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। তবে তাঁদের জন্য সম্ভবত আমেরিকায় একটি ‘শক’ অপেক্ষিত ছিল, আর তা হলো, জ্ঞানেবিজ্ঞানে অত্যুন্নত একটি দেশে বিদ্যমান পশ্চাৎমুখিনতা, সমাজের একটি অগ্রসর অংশের বিবর্তনবাদ তথা ডারউইনবিরোধিতা। ব্যাপারটা আসলে ওই দেশের পুরোনো ব্যাধি। অনেক বছর আগে স্কুলে বিবর্তনবাদ পড়ানো নিয়ে এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা হয়, শাস্তি হয়। শেষে তিনি মুক্তিও পান এবং এ নিয়ে নাটক লেখা ও চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। কিন্তু সবই এখন ইতিহাস। পশ্চিমে বিখ্যাত বিজ্ঞানীরা পাঠ্যবই ও জনপ্রিয় বিজ্ঞানের বই লেখেন। আমাদের দেশ তথা ভারতেও এমন দৃষ্টান্ত দুর্লভ। একটি গ্রন্থ একজন মানুষকে অবশ্যই বদলে দিতে পারে; একজন তরুণকে জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করে দিতে পারে। তবে এটুকুই যথেষ্ট নয়, চাই অনুকুল পরিবেশ, যা আমাদের নেই। বন্যা, অভিজিৎ, ফরিদ কি দেশে থাকলে এসব বই লিখতেন? আমি ৯৯ ভাগ নিশ্চিত যে লিখতেন না। প্রাণ যেহেতু পদার্থের শুষ্কক কাঠখড় দিয়ে তৈরি, হয়তো সে জন্য লেখকেরা তাঁদের বইটি শুরু করেছেন মৃত্যুর সজ্ঞার্থ ও নানা কৌতুহলজনক কাহিনী দিয়ে এবং পরে এসেছেন জড় থেকে জীবনে, জীবনের ধর্ম ব্যাখ্যা এবং শেষ পর্যন্ত পদার্থবিজ্ঞানী ও কেলাসবিদ জেডি বার্নালের সজ্ঞার্থে: “‘জীবন হচ্ছে একটি অতিজটিল ভৌত-রাসায়নিক তন্ত্র যা একগুচ্ছ সুসংহত বা একীভুত ও স্বনিয়ন্ত্রিত রাসায়নিক ও ভৌত বিক্রিয়ার মাধ্যমে তার পরিপার্শ্বের বস্তু ও শক্তিকে স্বীয় বৃদ্ধির কাছে ব্যবহার করে।’” এই পঙ্ক্তিমালা একটু জটিল বটে, তবে গোটা অধ্যায়টি এতটাই সহজ ও সরলভাবে লেখা যে বিজ্ঞানের দশম শ্রেণীর ছাত্রের পক্ষেও বোঝা কঠিন হবে না। শুধু একটি কেন, গোটা বইটি এভাবে লেখা। … পরিশেষে সেই পুরোনো প্রসঙ্গ: বইগুলোর প্রভাব কি ঈপ্সিত ফল ফলাবে, আমাদের ক্ষেত্রে যা ঘটেনি, অন্তত দৃশ্যত, সেটা কি ওদের ক্ষেত্রে ঘটবে? বইগুলো কি নতুন প্রজন্ন লুফে নেবে? আমি নিশ্চিত নই, কেননা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা অবক্ষয়ের চরম সীমায় পৌঁছেছে। শিক্ষকেরা বাইরের বইয়ের খোঁজ রাখেন না, ছাত্ররা কোচিংয়ের ঘুর্ণাবর্তে দিশেহারা। এই তরুণ লেখকদের তবু আশা না হারাতে বলি। তাঁদের যেতে হবে অনেক দুর, মাইলস টু গো… এবং বিঘ্নসংকুল পথে।

৭.

ঢাকার নিসর্গ নিয়ে তার ভাবনার প্রকাশ ঘটতে দেখি নানা সময়ে। তেমনই একটি রচনা ‘অসমাপ্ত এক সংলাপ’-এ দ্বিজেন শর্মা লিখছেন, ‘ঢাকা শহরের গাছপালা সম্পর্কে জানতে আগ্রহী ফিল্ম ইনস্টিটিউটের কিছু তরুণের সঙ্গে কথা বলতে দিন কয়েক আগে পুরোনো পাবলিক লাইব্রেরির পেছনের চত্বরে হাজির হই এবং সেখানকার বিশাল এক রেইনট্রির তলায় তাদের খুঁজে পাই। বহুদিন এদিকে আসিনি, তাই সবই বড় অচেনা লাগে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ছাত্র ছিলাম (১৯৫৬-৫৮) তখন এই লাইব্রেরির নির্মাণ সবে শুরু হয়েছে এবং চারুকলা ইনস্টিটিউট ছাড়া শাহবাগ পর্যন্ত কোনো দালানকোঠা ছিল না। সম্ভবত এলাকাটি ছিল গাছগাছালি ভরা। গোটা দৃশ্যপট এখন পাল্টে গেছে, ছেলেমেয়েরা ঘুরে বেড়াচ্ছে, অথচ আমাদের সময় কার্জন হলের চত্বরই দিনমান প্রায় শূন্য থাকত। গাছের নিচে রাখা একটি বেঞ্চিতে বসলাম, সামনে স্ট্যান্ডে বসান ঢাউস ক্যামেরা আমার দিকে তাক করা। তার দিয়ে আমাকে একটি মাইক্রোফোনের সঙ্গে যুক্ত করে সেটি আমার পকেটে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। আকাশে মেঘের ঘনঘটা। তাড়া দিলাম এবং একটি ছেলে এসে আমার পাশে বসল। শুরু হলো সংলাপ।

৮.

প্রকৃতিপাঠে ইতিহাসকেও তিনি ভোলেন না। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের গাছপালা সম্পর্কে আমাদেরকে তিনি জানাচ্ছেন, আমাদের তাহলে ফিরতে হবে ১৯০৫ সালে, যখন পূর্ববঙ্গ ও আসাম একত্র করে ঢাকায় নবগঠিত এই প্রদেশের রাজধানী নির্মাণ হতে চলেছে রমনা এলাকায়, আর তাতে ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর গোটা রমনা গ্রিন, বর্তমান সচিবালয় ও নীলক্ষেত। ১৯১১ সালে নতুন এই প্রদেশ গঠনের পরিকল্পনা পরিত্যক্ত হয় এবং পরিকল্পিত রাজধানীতে প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯২১)। মন্ত্রীদের যে বাড়িগুলো দেখ, সেগুলোতে একসময় থাকতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। গোটা রাজধানী হস্তান্তরিত হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে। রাজধানীর বৃক্ষসজ্জার দায়িত্ব পান লন্ডনের কিউ বোটানিক গার্ডেনের এক কর্মকর্তা আর. এল প্রাউডলক। তিনি ১৯০৮ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত এখানে কর্মরত ছিলেন। তিনি দেশি-বিদেশি গাছপালা দিয়ে শহরের পথগুলো সাজান, যার সামান্য অবশিষ্টই শুধু আজ টিকে আছে মিন্টো রোড ও হেয়ার রোডে। তাই এই এলাকার বড় বড় গাছগুলোর বয়স জানার জন্য তাঁর থাকাকালীন সময়কে ভিত্তি হিসেবে ধরা যেতে পারে, যদিও তার আগেও এখানে কিছু গাছ ছিল এবং পরেও অনেক গাছ লাগানো হয়েছে। রমনা পার্কের গাছগুলো অনেক পরে লাগানো একমাত্র কুসুমগাছের সারি এবং একটি মহুয়া ও দু–তিনটি রেইনট্রি ছাড়া। ১৯১৮ সালে প্রাউডলক দেশে ফেরেন, আমাদের জন্য রেখে যান উদ্যান-নগর নির্মাণের একটি প্রত্নকাঠামো বা আর্কিটাইপ।
—বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকা নির্মাণের সময় কি গাছপালা কাটা পড়েছিল?
—আমি তখন ঢাকায় ছিলাম না। অবশ্যই কাটা পড়েছে, শুনেছি একমাত্র বাওবাব গাছটিও রেহাই পায়নি।
—বিশ্ববিদ্যালয় ও সংলগ্ন এলাকায় গাছের সঙ্গে আপনার ব্যক্তিগত স্মৃতি জড়িত থাকলে সেগুলোর কথা বলুন।
—এদের কোনোটিই আর নেই। ঢাকা হলের তৃতীয় তলায় পূর্ব দিকের শেষ কক্ষে থাকতাম। কোনো কোনো রাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে মেডিকেল কলেজের সামনের গগন-শিরীষগাছের সারিগুলো দেখতাম। নিঃশব্দ চরাচর। মনে হতো ওরা গাছ নয়, অনৈসর্গিক কোনো সত্তা ক্ষণিকের জন্য সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে, উড়ে যাবে যেকেনো মুহূর্তে। ওদের থেকে চোখ ফেরাতে পারতাম না। কার্জন হল চত্বরে উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের বোটানিক গার্ডেনের সীমানায় ছিল দুটি গ্লিরিসিডিয়ার গাছ, সেগুলো বসন্তের শুরুতে হালকা বেগুনি সাদা ফুলে ভরে উঠত। একটি কোকিল গাছে বসে সারা দিন অবিরাম ডেকে চলত। আমি ও আমার এক সহপাঠী প্রায়ই বিকেলে ওই গাছের নিচে বসে গল্প করতাম। একসময় গোটা এলাকা নির্জন হতো, সন্ধ্যা নামত, আমরা বসেই থাকতাম। হঠাৎ করেই মনে হতো কার্জন হলের বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন এক মোগল রাজকন্যা, অপরূপ সজ্জা, পিঠে দীর্ঘ বেণি, যেন এখনই নেমে আসবেন নিচের সবুজ তৃণাঙ্গনে। প্রেসক্লাবের সামনের রাস্তার সামান্য পশ্চিমে গোলচত্বরে ছিল একটি পাকুড়গাছ, তাতে পেঁচিয়ে উঠেছিল স্পেক্টাবিলিস জাতের একটি বাগানবিলাস, বেগুনি রঙের ফুলে ভরে উঠে আমাদের বসন্তের আগমনী বার্তা জানাত। এক আশ্চর্য দৃশ্য। তখন এত যানজট, মানুষজন ছিল না। লোকে দাঁড়িয়ে থেকে সেই অপূর্ব শোভা দেখত। মিন্টো ও হেয়ার রোডের মিলনস্থলের গোলচত্বরের সুগন্ধি ফুলের বিশাল নাগলিঙ্গমগাছটিও আর নেই। পার্কে বেড়াতে আসা সবাই ওই গাছটি অন্তত একবার দেখে যেতেন। ঢাকা এখন কংক্রিটের শহর, হারিয়ে ফেলেছে বাসযোগ্যতা। কীভাবে এই শহরের পুনরুদ্ধার সম্ভব?- এমনতর প্রশ্নের জবাবে অকপটে বলেছিলেন- আমার জানা নেই। টিভির টক শোতে নাগরিকদের বিষণ্ন² আলাপন শুনি। মনে পড়ে ছাত্রজীবনের কথা। আমরা প্রায়ই বেড়াতে যেতাম বুড়িগঙ্গার পাড়ে এবং স্বপ্ন দেখতাম ঢাকা একদিন উদ্যান-নগর হবে। নদীর দুই পাড়ে থাকবে রয়েল পামের সারি ও নিওন বাতিশোভিত বুলেভার, জিঞ্জিরার মাঠ হবে খোলা ময়দান, সারা শহরে থাকবে প্রাউডলকের রমনা গ্রিন আদলের বৃক্ষসজ্জা—ছায়াময় মায়াময়। বর্তমান ঢাকা আজ আমাদের দুঃস্বপ্নের অতীত। ষাটের দশকের গোড়া থেকে আমি ঢাকার উন্নয়নের ধারা লক্ষ করে আসছি। যেসব উপাত্ত একটি মানবিক শহর নির্মাণকে পরাস্ত করে, সেগুলো ক্রমান্নয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে, শক্তিধর হয়ে উঠেছে। এগুলো থামানো আমাদের সাধ্যাতীত।

তাহলে আমাদের কোনো আশা নেই?
মাথা নাড়ি, কোনো সদুত্তর খুঁজে পাই না। তখনই বৃষ্টি নামে এবং আশ্রয়ের খোঁজে ছোটাছুটি শুরু হয়। বাড়ি ফেরার পথে এই আলাপন আমাকেও বিষন্ন করে। ভাবি, বলা উচিত ছিল—আশা আছে একটিই এবং সেটি তোমরা, দেশের নতুন প্রজন্ম।’

৯.

দ্বিজেন শর্মা অনেকদিন সোভিয়েত ইউনিয়নে বসবাস করেছেন। সেদেশের সমাজ ব্যবস্থাকে দেখেছেন। ছোটবেলা থেকেই তাঁর প্রিয় মানুষ হয়ে উঠেছিলো মহামতি মার্কস। দ্বিজেন শর্মা স্যারের অনেকদিনের মনের ইচ্ছাটা পূরণ হলে সে কথা তিনি ফিরে দেখা রচনায় জানাচ্ছেন ‘কার্ল মার্ক্সের সমাধিতে হৃদয়বাসনা পূর্ণ হলো’। তিনি জানাচ্ছেন, ‘অনেকবার ইংল্যান্ড গিয়েছি, কিন্তু কার্ল মার্ক্সের কবর দেখার হৃদয়বাসনা পূর্ণ হয়নি। শেষ পর্যন্ত কোনো না কোনো ঝামেলা বাধত, সবকিছু ভেস্তে যেত। এবার আটঘাট বেঁধে লন্ডনপ্রবাসী প্রকৃতিবিদ কানন পুরকায়স্থর দ্বারস্থ হলাম, তিনি সানন্দে সম্মতি দিলেন এবং আমরা ৯ অক্টোবর সকালে হাইগেট কবরস্থানের উদ্দেশে রওনা হলাম। জায়গাটা পাতাল রেলস্টেশন থেকে অন্তত দুই কিলোমিটার দূরে, হেঁটেই গেলাম দুজনে। অভ্যর্থনাকক্ষ থেকে কানন হাইগেট সিমেট্রি বইয়ের দুই কপি কিনে একটি আমাকে দিলেন। কাছেই মার্ক্সের কবর, একটি চৌকো স্তম্ভের ওপর তাঁর আবক্ষ মস্তক, আশপাশে আরও কিছু কবর, পেছনে অ্যাশ গাছের বন। আমরা নতমস্তকে শ্রদ্ধা জানালাম এই মনীষীকে।’ তাঁর কাছ থেকে আরো জানতে পারি, ‘আমরা গোরস্তানে কিছুক্ষণ ঘুরেফিরে আবার মার্ক্সের কাছে এলাম, আর তখনই চোখে পড়ে মার্ক্সের পাশের কবরটি, সদ্য খোঁড়া, জনৈক মুসলিম নারীর। বড়ই অবাক হই। নব্বইয়ের দশকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রপুঞ্জ ভেঙে পড়লে মার্ক্সবাদের বিরুদ্ধে সারা বিশ্বে যখন নিন্দা ও ক্ষোভ উথলে উঠেছিল, যা আজও প্রশমিত হয়নি, তখন এই দৃঢ়চিত্ত নারী মার্ক্সের পাশেই তাঁর শেষ আশ্রয় খুঁজে নিয়েছেন। দুর্ভাগ্য, তাঁর নামটি তখন লিখে আনিনি এবং পরে ভুলে গেছি। বাড়ি ফিরে লন্ডনের বন্ধুদের ফোন করলে তাঁরাও নামটি বলতে পারলেন না, তবে জানালেন তিনি জাতিতে ইরানি। আশা করি, কবরটি একদিন বাঁধাই হবে, তাতে থাকবে তাঁর স্মৃতিফলক আর তখন জানা যাবে বিস্তারিত।’

১০.

জীবিকার তাড়না জীবনকে যেখানেই নিয়ে যাক, দ্বিজেন শর্মা নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন প্রাণ ও প্রকৃতির রূপের সন্ধানে। উদ্ভিদ জগৎ, প্রকৃতি বিজ্ঞান আর বিজ্ঞান ভাবনা নিয়ে লিখে গেছেন বই। দ্বিজেন শর্মা রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় নানা প্রজাতির গাছ লাগিয়েছেন, তৈরি করেছেন উদ্যান ও বাগান। গাছের পরিচর্যা ও সংরক্ষণ এবং প্রকৃতিবান্ধব শহর গড়ার জন্য আজীবন প্রচার চালিয়ে গেছেন। এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, “আমি একদিন থাকব না, কিন্তু গাছগুলো থাকবে। মানুষকে অক্সিজেন বিলাবে। জীবনে এর চেয়ে আনন্দ আর কিছুতে নেই।” নিসর্গের সঙ্গে গড়ে তুলেছিলেন নিবিড় সখ্য। আমৃত্যু ভালবেসেছিলেন বৃক্ষের সবুজ সজীবতা। চেয়েছিলেন প্রকৃতির সঙ্গে গড়ে উঠুক মানুষের সহাবস্থান। সে প্রত্যাশায় উচ্চারণ করেছিলেন, ‘মানুষ, বৃক্ষের মতো আনত হও, হও সবুজ’। ‘প্রকৃতিপুত্র’ কিংবা ‘নিসর্গসখা’ বৃক্ষপ্রেমী মানুষটি প্রিয় পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিয়েছেন বটে তবে দ্বিজেন শর্মা বেঁচে থাকবেন তাঁর অমর সৃষ্টির মধ্যে, স্মৃতির মালিকা গেঁথে।

(তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া, দৈনিক প্রথম আলো, দৈনিক সমকাল, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক ইত্তেফাক, ইন্টারনেট)

COMMENT

  • অনেক তথ্যসমৃদ্ধ লেখা।
    অনেক কিছু জানতে পারলাম।
    লেখককে অনেক ধন্যবাদ।

  • Please Post Your Comments & Reviews

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    error: Content is protected!!
    Share via
    Copy link
    Powered by Social Snap