কবি, সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক ও ছোটগল্পকার-
সূক্ষ্মভাবে দেখলে চেনা ছকের বাইরে উত্তরাধুনিক স্টাইলে একই সঙ্গে সামাজিক ও রাজনৈতিক উপন্যাস
আশির দশকের বাংলা ভাষার শক্তিশালী কবি মজিদ মাহমুদ বহুমুখী সাহিত্য প্রতিভা! মাত্র মাত্র বাইশ- তেইশ বছর বয়সে লেখা ‘মাহফুজামঙ্গল’ কাব্যগ্রন্থ গত তিরিশ বছর ধরে জনপ্রিয়তার নিরিখে বাংলা কাব্য গ্রন্থের জগতের প্রায় মিথ্যে পরিণত হয়েছে! তার ফলে বহুমাত্রিক লেখক মজিদ মাহমুদ কে তাঁর পাঠক চিহ্নিতকরণ করেন মাহফুজামঙ্গল এর কবি হিসেবে! একজন কবিকে তাঁর কাব্যগ্রন্থ দিয়ে চিহ্নিত করণ এটি লেখকের জন্যে নিশ্চিৎভাবে গৌরবের! কিন্তু লেখক মজিদ মাহমুদের জন্য এটি যথেষ্ট বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে! তাঁর প্রবল কবিসত্ত্বার নিচে ঢাকা পড়ে গিয়েছে বিদগ্ধ প্রাবন্ধিক এবং বলিষ্ঠ কথা সাহিত্যিক সত্ত্বা!তাঁর ‘সাহিত্যচিন্তা ও বিকল্প ভাবনা’ কিংবা ‘নজরুল তৃতীয় বিশ্বের মুখপাত্র’ নামক প্রবন্ধ গ্রন্থ গুলি বাংলা সাহিত্যের গবেষকদের নতুন চিন্তা ভাবনার খোরাক জুগিয়েছে! নজরুল জীবন ভিত্তিক ধারাবাহিক উপন্যাস ‘তুমি শুনিতে চেওনা ‘কেবল নজরুল অনুরাগীদের নয়, নজরুল বোদ্ধাদের ও আলোড়িত করেছে! সবচেয়ে মজার বিষয় হলো তিনি গল্প দিয়েই লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেছিলেন!সম্প্রতি মজিদ মাহমুদের ‘মেমোরিয়াল ক্লাব’ নামে একটি উপন্যাস পুস্তক আকারে প্রকাশিত হওয়ার পর বিদগ্ধ পাঠকমহলে তা দারুণভাবে প্রশংসিত হচ্ছে! যা কবি ও প্রাবন্ধিক মজিদ মাহমুদের কথা সাহিত্যিক সত্ত্বাকে পাঠক নতুনভাবে আবিষ্কার করে চমকৃত ও আপ্লুত হয়েছেন!চৈতন্য প্রবাহ রীতিতে লিখিত মেমোরিয়াল ক্লাব উপন্যাসের কাহিনীকে মজিদ মাহমুদ বহু কৌণিক এবং বহুমাত্রিক স্তরে ছড়িয়ে দিয়েছেন! উপন্যাসের মূল চরিত্র হাসান এবং বিলকিস বেগম ওরফে বিলু ছাড়াও উপ কাহিনীর ইয়াসিন এবং মৌলভী আব্দুল কাদের এই দুটি চরিত্রও উপন্যাসে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ! এছাড়া মেমোরিয়াল ক্লাব উপন্যাসের লেখক মজিদ মাহমুদ বিভিন্ন চরিত্রের মধ্য দিয়ে উপস্থাপন করেছেন সামাজিক কুসংস্কার এবং ধর্মীয় মিথ নিয়ে মানসিক টানাপোড়েনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গুলি! একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দেওয়া ভালো সাহিত্যিক মজিদ মাহমুদ দীক্ষিত পাঠকদের জন্যই মূলত লেখালেখি করেন! তাঁর লেখার ভাষা এবং স্টাইল অত্যাধুনিক! মেমোরিয়াল ক্লাব উপন্যাসটি তিনি অত্যাধুনিক স্টাইলে অত্যন্ত সফলভাবে লিখতে সমর্থ হয়েছেন, যা এই উপন্যাসটিকে বাংলা ভাষায় প্রকৃত উত্তরাধুনিক উপন্যাসে উন্নীত করেছে!মজিদ মাহমুদ তাঁর মেমোরিয়াল ক্লাব উপন্যাসটি লেখার ক্ষেত্রে চৈতন্য প্রবাহরীতির স্টাইল কে গ্রহণ করলেও তিনি চেনা ছকের বাইরে গিয়ে বাংলা ভাষায় একেবারে নতুন ধারার উত্তরাধুনিক উপন্যাস লেখার চেষ্টা করেছেন! মূল কাহিনীর সঙ্গে লেখক অসংখ্য উপ-কাহিনী বর্ণনা করার ফলে পাঠক এই উপন্যাস পড়তে পড়তে নষ্টালজিক হয়ে পড়েন এবং সেইসঙ্গে আধুনিক নাগরিক জীবনের বিভিন্ন সংকট বিষয়ে লেখককে বক্তব্য পাঠকের মস্তিষ্ককে আক্রান্ত করে!লেখক কিশোরীদের পিরিয়ড শুরু হওয়ার মধ্য দিয়ে নারীত্বে উপনীত হওয়ার স্পর্শকাতর’ বিষয়টি অত্যন্ত কুশলী ভাবে এই উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র বিলকিস বেগম ওরফে বিলুর মুখ দিয়ে তুলে ধরেছেন! মজিদ মাহমুদের বলিষ্ঠ কবিসত্ত্বার কারণে তাঁর গদ্যে যেমন কবিতার মায়াবী ঝংকার অনুরণিত হয় সেইসঙ্গে ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে মাত্রা জ্ঞান ও উপন্যাসটির চরিত্রগুলি নির্মাণে বিশেষ সহায়ক হয়েছে! উপন্যাসের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে বেথেলহেমের পথে পথে পর্বে কিশোরীদের প্রথম মাসিক শুরু হওয়ার বিষয়টি লেখক বিলুর জীবনের নিজস্ব অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন অতন্ত মার্জিত ভাষায়-‘আজ বিলু ওরফে বিলকিসের দুনিয়া কাঁপানো ভয়ঙ্কর সেইদিন। ভয়ে ভয়ে ছিল, বেইজিংয়েই বুঝি হয়ে যাবে। এখন যদিও কষ্ট হয় না তবু বড্ড বিরক্ত লাগে। এই অদ্ভুত নিয়মটি কেবল মানুষের মেয়েদের জন্য। বিলু ভাবে সৃষ্টির কী অসীম খামখেয়ালি। মানুষের জন্য সবকিছুতেই প্রকৃতি একটু কঠিন করে দিয়েছে। আর কোন প্রাণীকে প্রকৃতি এমন দুর্বল করে সৃষ্টি করেনি। চার পায়ের পরিবর্তে তাকে কিভাবে সতর্কতার সঙ্গে দু‘পয়ের ওপর ভর দিয়ে চলতে হয়।যে খাদ্য নিয়ে পৃথিবীব্যাপী এত অনাসৃষ্টি, মানুষ কত কষ্ট করে সেই খাদ্য গ্রহণ করে! অন্য সব প্রাণীর জন্য পৃথিবীতে থালার মত করে প্রকৃতি খাদ্য বিছিয়ে দিয়েছে! প্রকৃতি যেভাবে উপেক্ষা করেছে মানুষকে, এমন একটি প্রাণী পৃথিবীতে কিভাবে যেটিকে গেল ভাবলে অবাক হতে হয়! এই যে আজ তার যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে,জন্মদানের জন্য পৃথিবীর আর কোন মেয়ে প্রাণীর এমন বেহাল অবস্থার সৃষ্টি হয়? কই অন্যদের জন্ম দিতে কোন অসুবিধা হচ্ছে না! শ্রেষ্ঠ বলে কি মানুষের সবকিছুকেই এমন গ্লোরিফাই করতে হবে! এমনকি শরীর থেকে গড়িয়ে পড়া এই বিন্দু বিন্দু রক্তের কুৎসিত ফোটাকেও! বিলুর জীবনে এই ঘটনাটির শুরু একটু অন্যভাবে! প্রথম শুরুটা ছিল খুবই আকস্মিক! কিছু বুঝে ওঠার আগেই মা-খালা কিংবা মুরুব্বী গোছের কোন বয়স্ক মহিলা সতর্ক করে দেওয়ার আগেই, বয়:সন্ধিক্ষনের ভেদরেখা অতিক্রম করে তার শৈশব যৌবনে প্রবেশ করেছিল! একটি লিঙ্গ রেখার বাইরেও যে নারী শরীর আলাদা তখন থেকে বিলু তা বুঝতে শিখে ছিল! সে এও বুঝেছিলো যে সব ছেলেবন্ধুর সঙ্গে সে এতদিন বেড়ে উঠেছিল তারা একই সঙ্গে তার আনন্দের ও বেদনার কারণ!
তবে প্রথম দিনের ঘটনার আকস্মিকতায় বিলু বেশ মুষড়ে পড়েছিল সে ভেবেছিল সে আর বাঁচবে না! তার মূত্রনালীর ছিদ্রপথ দিয়ে একটি জোঁক পেটের মধ্যে প্রবেশ করে নাড়িভুঁড়ি সব কেটে ফেলছে আর সেখান থেকেই তার উরুসন্ধি আর হাঁটু গেড়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে! এভাবে চলতে থাকলে শরীরের রক্ত নিঃশেষ হয়ে সে মারা যাবে! কিন্তু একথা সে কাউকে বলতেও পারছিল না! বিলুর বয়স তখন এগারো বছর ছয় মাস! প্রাইমারি স্কুলের গণ্ডি ছেড়ে কেবলই মাধ্যমিকে ভর্তি হয়েছে! বিলু মেয়েদের এই পিরিয়ডকে চাঁদের কলার সঙ্গে তুলনা করে থাকে! চাঁদকে যেমন নতুন করে পূর্ণ হবার জন্য ক্ষয়ে যেতে হয়, মেয়েদের শরীর ও ঠিক তেমনি! নারী শরীরে এমন একটা ঝঞ্ঝাট, এমন একটা শ্লেষ, আসতে-যেতে উভয়দিকে কাটতে থাকে! এই অপ্রয়োজনীয় রক্তকণিকা গুলো, মরা কোষগুলো নিজের জন্য প্রয়োজন নেই! আবার না হলে জীবন শুকিয়ে যায়! মরা নদীর মত কেউ আর তাতে অবগাহন করে না! মৃত সমুদ্রের মতো জোছনার স্পর্শে সেখানে আর জোয়ার আসে না! শরীরে এ এক বাঞ্ছিত অত্যাচার! যতদিন শরীরে জোয়ার ভাটা আছে শরীর ততদিন জীবিত! শরীর ততদিন অন্য শরীরকে ধারণ করতে সক্ষম! এই পানির মধ্যে জন্ম নেয় মানুষের বাচ্চারা! যেদিন নারী যোনি পরিপক্ক হয়নি, সেদিন পানি থেকেই প্রথম মানুষের বীজ জেগে উঠেছিল! জলের যোনি থেকে উৎপন্ন হয়েছিল প্রথম মানুষ!তাই আজও জল জীবন থেকে মানুষের উত্তরণ হয়নি! মানুষের শরীরের মধ্যে রয়ে গেছে সমুদ্রের গুনাগুন! জোয়ার ও ভাটার মতো সেও কুল থেকে উপকূলে আছড়ে পড়তে চাই! শুষ্ক মরুভূমি কে আলিঙ্গনে সিক্ত করার জন্য বাতাসে ভর করে ছুটে আসে! বিলু ভাবে মানুষের জন্ম প্রক্রিয়া কি অদ্ভুত! এই যে মানুষ সে আসলে একজন নয়, সে আসলে দুইজন! দুজন মানুষ ইচ্ছে করলেই কেবল একজন মানুষ বানাতে পারে! এসব কথা ভাবতে গিয়ে বিলুর হাসি পায়! সত্যিই মানুষ বানাতে কি আজ দুজন মানুষের প্রয়োজন আছে? বিশেষ করে জন্মের ক্ষেত্রে পুরুষ প্রজাতির ভূমিকা গৌণ হয়ে যাচ্ছে!’
সঠিক সময়ে গুরুজন স্থানীয়রা কোনো মহিলা কিশোরীকে সমুচিতভাবে সচেতন না করলে বয়ঃসন্ধিক্ষণের এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়াটি তার শরীরে ও মনে কী আলোড়ন ও ভীতির সৃষ্টি করে, এবং সেই ভীতি অশিক্ষিত নিরক্ষর মননে কী ভয়াবহ কুসংস্কারের জন্ম দেয় আর সেই পরিস্থিতির সুযোগে ততোধিক অজ্ঞানী গুণিন ওঝারা শরীরে অসৎ ভূত প্রেতের অবস্থানের কথা বলে উপার্জন করে অনৈতিক উপায়ে, যার ফলে কিশোরীর চরম ক্ষতি হতে পারে, পাঠককে সচেতন করেছেন সেদিকটিও লেখক বিশ্বাসযোগ্য ভাবে তুলে ধরেছেন।মেনস্ট্রেশনের শুরুর দিকে বিলু প্রচণ্ড মানসিক ও শারীরিক চাপে ভোগে! মেয়েদের জীবনে এমন একটা প্রক্রিয়া যা খুব সুখের নয়, খুব সুন্দর নয়! কিন্তু যা না থাকলে জীবনে হতাশা নেমে আসে! শৈশবে খুব স্বল্প পরিমাণ মূর্ছা যাওয়ার অসুখ ছিল তার! ঠিক মৃগী বা হিস্টিরিয়া বলা যাবে না! বিষয়টি অবশ্য জনসম্মুখে খুব একটা প্রকাশ পায়নি! কেবল বিলুর নিকট সম্পর্কের লোকজন বিষয়টি জানতো! প্রথমে একটু ঘুম ঘুম ভাবের মধ্য দিয়ে এই যাত্রা শুরু হতো! এই সময় বিলু নিজেকে একটি তাল গাছের নিচে আবিষ্কার করতে থাকে! তারপর তালগাছটি মাটি থেকে শূন্যে বিলুকে সঙ্গে নিয়ে উড়ে যেতে শুরু করে! শুরুতে তালগাছটি উল্লম্ব হয়ে আকাশে উড়লেও অল্পক্ষণেই একটা বিরাট পাখিতে রূপ নেয়! মূর্ছা থেকে একটি বেদনার আতঙ্ক নিয়ে ঘুম ভাঙতো বিলুর! কান্না ও গোঙানীর শব্দে তার গলা খসখসে হয়ে যেত! মাকে ডাকতে চাইতো, কিন্তু কণ্ঠ দিয়ে কোন আওয়াজ বের হতো না! বিলুর এই মূর্ছার অসুখ তার বাড়ির লোকজনের মধ্যে রীতিমতো ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল! ডাক্তারী চিকিৎসায় এই উপসর্গের তেমন কোন উপশম হয়নি! বিলুর দাদির দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে ওকে জ্বীনে ধরেছে! বিলু যেহেতু ছোটবেলা থেকেই দেখতে সুন্দর! ডাক্তার কবিরাজিতে বিশেষ কোনো ফল না পাওয়ায় শেষপর্যন্ত জ্বীন চিকিৎসার ফকিরের কাছে বিলুকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে!তাকে দেখার আগেই ফকির মানিকচাঁদ বলেছিল এই মেয়েকে উদ্ধার করা সহজ হবে না! জ্বীনের বাদশার ছেলে স্বয়ং যুবরাজের চোখ পড়েছে এ মেয়ের উপর! ফকিরের কথা শোনার পরে, বিলুর রোগের লক্ষণ স্মরণ করার পর, দাদির মনে হল ফকির যা বলছে এটি সে আগেই জানত! অতএব ভয়ের কারণ নেই, জ্বীনের রাজকুমার মানুষের বেশ ধরে এসে বিলুকে বিয়ে করে একদিন নিয়ে যাবে! বিলুর দাদি শেষ বয়সে নাতনির সাথে জ্বীনের দেশে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর হলেও এ খবর শুনে বিলুর মা কিছুটা মুষড়ে পরেছিল! বিলুর বাবা এক ডাক্তার বন্ধুর পরামর্শে জিনের যুবরাজের বিষয়টি আর ধর্তব্যের মধ্যে আনেননি! ডাক্তার তাকে বলেছিলেন এই সমস্যা এমনিতেই চলে যাবে! স্নায়ু দুর্বলতার কারণ এটি হয়ে থাকে! কিছু ভিটামিন আর কিছু নির্দেশিকা পালন করার মাধ্যমে বিলুর এই রোগের মোটামুটি অবসান হয়! কিন্তু বিলুকে নিয়ে তার বন্ধুদের কৌতুহল শেষ পর্যন্ত থেকে গিয়েছিল! বিশেষ করে তার কিশোরী বান্ধবীরা তার কাছে বহুবার জানতে চেষ্টা করেছে জিনের ইয়ে কেমন! ইয়ে মানে কি বিলু ঠিক জানতো না! একই ক্লাসে পড়লেও গ্রামের অধিকাংশ বান্ধবীর চেয়ে বয়সে কিছুটা ছোট ছিল! তাছাড়া অসুস্থতাজনিত কারণে কিছুটা বেখেয়ালি ছিল! তবে অনেক পরে এক বান্ধবী তাকে দেখে বলেছিলো তুই এত সুন্দর হয়েছিস কারন তোর জ্বীনের ছোঁয়া লেগে ছিল! সে এখন বুঝতে পারে মানুষের সকল জ্ঞান তার অনুভূতি, অঙ্গের ভেতর দিয়ে তার মর্মে পৌঁছে!মানুষের যে অদৃশ্য অবিনশ্বর চেতনালোক তার সবটা হয়তো আমরা ব্যাখ্যা করতে পারিনা! আমাদের সকল জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার কেন্দ্রে যৌনতা একটা চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে, তা হয়তো আমরা জানি অথবা জানিনা! আমাদের ভাষার জগতটিও ঠিক আমাদের কাছে একই প্রক্রিয়া ও অনুভূতির মাধ্যমে এসেছে বলে বিলু মনে করে! শুধু যৌনাঙ্গকে কেন্দ্র করে ভাষার যে বিকাশ হয়েছে, যদিও তার অতিরিক্ত অর্থ দান আমাদের প্রেম ও প্রার্থনার পথে, কর্ম ও নিষ্ফলতার দিকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে, তবু প্রতিটি প্রাণের মতো প্রতিটি শব্দ উত্থিত হয়েছে নারী পুরুষের মিলনকে কেন্দ্র করে! তাই অধিকাংশ ভাষায় অধিকাংশ শব্দ নারী এবং পুরুষ বাচক! যদিও বাংলা ভাষা এক্ষেত্রে অনেক বেশি ক্লীবতা আক্রান্ত, তবু সোনা-দানা, ধন-দৌলত, আকাশ-মাটি, কাম-কাজ,কর্ষণ-বপন,উত্থান-পতন, লম্বা-ভোঁতা,গর্ত-উঁচু,পাহাড়-নদী,নিষ্কাম-ফল,দেয়া-নেয়া,ধরা-মারা, ঢোকানো-বেরকরা,কাঠি-বাটি,মিনার-মাস্তুল,নাট-বল্টু- ভাষায় ব্যবহৃত এ ধরনের সকল ক্রিয়াপদের সঙ্গে নারী-পুরুষের যৌন মিলনের একটি সম্পর্ক রয়েছে!
পশ্চিমবঙ্গের সরকারি স্কুলগুলিতে কয়েক বছর ধরে জীবনশৈলী নামে একটি বিষয় মাধ্যমিকের সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে! জীবনশৈলী নামক বিষয়টিতে ছেলেমেয়েদের বয়:সন্ধিকালের সময় যে সমস্ত শারীরবৃত্তীয় যৌন পরিবর্তন স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়মে দেখা যায়,তা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে! শারীরিক এই পরিবর্তন বিষয়ে পূর্ব কোনো অভিজ্ঞতা না থাকার ফলে কৈশোর থেকে যৌবনে উত্তীর্ণ হওয়া ছেলেমেয়েরা মানসিকভাবে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে! স্কুলপড়ুয়াদের নরনারীর যৌনতা বিষয়ে প্রাথমিক পাঠ দিতেই জীবনশৈলীকে সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে! এখানে মেয়েদের প্রথম পিরিয়ড শুরু হওয়ার পর শারীরবৃত্তীয় যে সমস্ত পরিবর্তন সংঘটিত হয় সে সম্পর্কেও বিস্তারিত বলা হয়েছে! জীবনশৈলী যখন প্রথম সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তখন স্কুলের শিক্ষকরা সদ্য যৌবনে উত্তীর্ণ হওয়া স্কুলপড়ুয়াদের সামনে কিভাবে বিষয়টি আলোচনা করবেন, তা নিয়ে প্রথমদিকে খুবই বিড়ম্বনায় পড়েছিলেন! এ নিয়ে যথেষ্টও বিতর্ক তৈরি হয়েছিল! মজিদ মাহমুদের মেমোরিয়াল ক্লাব উপন্যাসে মেয়েদের প্রথম পিরিয়ডের বিপন্নতা বিষয়ে উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র বিলুর যে অভিজ্ঞতা বর্ণনা করা হয়েছে, আমি নিশ্চিত কয়েক বছর আগে এই উপন্যাসটি লেখা হলে পশ্চিমবঙ্গের স্কুল শিক্ষকরা মেয়েদের মাসিক শুরু হওয়ার বিষয়টি পড়ুয়াদের সামনে সরাসরি আলোচনার বিড়ম্বনা থেকে বাঁচতে, উপন্যাসের এই অংশটি পাঠ করে পড়ুয়াদের সচেতন করতে পারতেন! বাংলাদেশের সরকারি স্কুলগুলোতে যদি কোনদিন জীবনশৈলী বিষয়টি সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত হয়, তবে মজিদ মাহমুদের মেমোরিয়াল ক্লাব উপন্যাসটির এই অংশটি অন্তর্ভুক্তি করা উচিত! বয়সন্ধিকালের এ ধরনের সমস্যা নিয়ে যে সামাজিক কুসংস্কার রয়েছে তা থেকে স্কুল পড়ুয়া ছেলে মেয়েরা সহজেই সচেতন হতে পারবে!
এই উপন্যাসের পাঠক যদি লেখক মসজিদ মাহমুদকে ফেমিনিস্ট লেখক হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন তাহলে তাদের খুব একটা দোষ দেওয়া যাবে না! কারণ মেয়েদের জীবনের জটিল এবং কঠিন সামাজিক সংকট গুলি লেখক মজিদ মাহমুদ যে মমত্ববোধ নিয়ে বিলুর চরিত্রের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন তা পাঠককে ভাবতে বাধ্য করে এবং অন্য এক সামাজিক উত্তরণের পথে নিয়ে যায়! তুলনায় উপন্যাসের নায়ক হাসানের চরিত্র অনেকটাই ভঙ্গুর, মানসিক দৃঢ়তাহীন! পুলিশ লকাপের জীবন ঠিক কেমন এই কৌতুহল নিরসন করতে গিয়ে হাসানের যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল, তা তাকে পরবর্তীতে মানসিক রোগীতে পরিণত করেছিল!তাছাড়া গর্ভপাত, অবৈধ গর্ভধারণ, মেয়েদের প্রথম পিরিয়ডের সময় মানসিক বিপন্নতা, সুন্দরী মেয়েদের জীনে ধরা,সমকামিতা, ধর্ষণ এর মতো আধুনিক সমাজের জটিল ও কঠিন সমস্যাগুলি তিনি যেভাবে উপন্যাসের চরিত্র গুলির মুখ দিয়ে বলিষ্ঠভাবে তুলে এনেছেন এবং ধর্মীয় উদাহরণ দিয়েছেন, তাতে বিতর্কেরও যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে!
বিলু স্মার্ট শিক্ষিত এবং সুন্দরী! বাঙালি শিক্ষিত মুসলিম মহিলা বললে যে চিত্রটি আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে বিলু কে সেই তালিকায় ফেলা যায় না! সে প্রকাশ্যে সিগারেট খায়! মদ হজম করতে পারে না বলে পার্টিতে অন্যরা মদ খেয়ে হৈ-হুল্লোড় করলেও সে বসে বসে কোক খায়! সে একটি পেপার হাউসে কাজ করে!ইউনিভার্সিটি তে পড়াকালীন ইন্টার্নশীপ করতে সে এখানে ঢুকেছিলো!নারী ঐশ্চর্য ব্যাবহার করে কিভাবে সম্পাদকের প্ৰিয় হতে হয়, চাকরি পাকা করতে হয়,এসব কৌশল বিলুর ভালোই জানে!ফলে প্রধানমন্ত্রী বিদেশ যাত্রার সফর সঙ্গী হওয়া থেকে শুরু করে ভালো ভালো এসাইনমেন্ট গুলো সে খুব সহজেই পেয়ে যায়!এসব নিয়ে সে কোনো মানসিক দ্বন্দে ভোগে না!বদলে যাওয়া নাগরিক নাগরিক সভ্যতায় ক্রমবর্ধমান ধর্ষণ, অবৈধ গর্ভধারণ, সমকামিতা, গর্ভপাত,বাল্য বিবাহ এইসব জটিল ও কঠিন সামাজিক সংকট মিলুকে গভীরভাবে ভাবিত ও পীড়িত করে! মেয়েদের নিয়ে যে সামাজিক ট্যাবু দীর্ঘদিন ধরে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ চাপিয়ে রেখেছে সেসব সে পাত্তা দেয় না! তার পরেও লেখকের পক্ষপাতিত্ব বিলুর প্রতি স্পষ্ট! বিলুর মধ্যে অদ্ভুত এক মানবিকতা এবং মমত্ববোধের কারণে পাঠকও বিলুকে অপছন্দ করতে পারে না!
বিলু ভাবে মেয়েরা কত বছর বয়স থেকে যৌবন প্রাপ্ত হয়! কখন থেকে পুরুষকে সে কাছে নিতে পারে! এ প্রশ্নের সদুত্তর সে কোথাও পায়নি! দাদি বলতো, মেয়েরা ঘরের ডোয়া ধরে দাড়াতে পারলেই হল! স্ত্রী লিঙ্গের কোন বয়স নাই! বিলু ভাবে এ এক অদ্ভুত ট্যাবু! মেয়েদের শরীরের মালিকানা মেয়েদের নয়! অর্থ উপার্জনে যেহেতু মেয়েদের ভূমিকা ছিল না, সেহেতু পণ্যমূল্যে মেয়েদের সন্তুষ্ট থাকতে হতো! আর বাকিটা সবই মানবিকতার গল্প, পুরুষদের ভালো মানসিকতা আর গ্লোরিফাই করবার ক্ষমতা! তাই শিশু বেলা থেকেই শিশু পুরুষদের শেখানো হয় মেয়েদের সম্মান করতে হবে! মেয়েরা মায়ের জাতি, মেয়েদের সম্মান করলে ঈশ্বর খুশি হন! মেয়েদের শরীর ভার সইতে পারে কি পারেনা তা নির্ধারণ করে দিয়েছে পুরুষেরা! সাত বছরের গৌরীদানের পুণ্য অতিক্রম করে উনিশ শতকের রেনেসাঁস হয়ে তা আঠারো বছরে দাঁড়িয়েছিল! বিলুর মনে হল রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত বছরের কথা! রবীন্দ্রনাথ যখন বিয়ে করেন তখন কনের বয়স ছিল দশ, আর বর বিলাতফেরত পূর্ণ যৌবনবান ত্রয়োবিংশতিতম যুবক! এর আগে কম ঘাটের পানি খাননি তো তিনি! তার বিস্তারিত বর্ণনা কবিগুরুর রচনা মধ্যেই রয়ে গেছে!বিলু ভাবল ভবতারিণীর বয়সে যদি তার বিয়ে হতো, তাহলে এতদিনে তাকে নাতির মুখ দেখতে হতো! রবীন্দ্রনাথের স্ত্রীর নাম ছিল ভবতারিণী! কবি এ নামে সন্তুষ্ট ছিলেন না, তার নাম দিয়েছিলেন মৃণালিনী! মাত্র তেরো বছর বয়সে ভবতারিণী মা হয়েছিলেন! বিলু ভাবে এখনকার সময় হলে তো কবিকে নাবালিকা ধর্ষণে অভিযুক্ত হতে হতো! রবীন্দ্রনাথ কন্যাদের বিয়ে দিয়েছিলেন অল্প বয়সে! এর জন্য অবশ্য রবীন্দ্রনাথকে দায়ী করা যায় না! বিয়ে যৌনতা ও সন্তান উৎপাদন কর্মটি ব্যক্তি এককভাবে সম্পাদন করলেও সমাজের নিয়ন্ত্রণ ষোলআনা! ব্যক্তি মানুষের অধিকার আলাদাভাবে সমাজে স্বীকৃতি মেলেনি!
লেখক ধর্ষণের একটি বাস্তব ব্যাখ্যা দিয়েছেন দাদিমার জীবন দর্শন থেকে! বিলু তার দাদির কাছে জানতে চেয়েছিল, দাদি ধর্ষণ কী? দাদি বলেছিল, সাপের বিষথলির মতো পুরুষের মাথায় বিষথলি থাকে; বিষথলি পূর্ণ হয়ে গেলে সেটি খালি না করা পর্যন্ত সাপ পাগলের মতো ঘুরতে থাকে, কোনো মানুষ দেখলে সাপের রক্ত গরম হয়ে ওঠে, মানুষের শরীরে বিষদাঁতের ফাঁক দিয়ে তা ফেলে দিতে চেষ্টা করে। পুরুষ মানুষও ঠিক একই রকম একা অপরিচিত মেয়ে মানুষকে ঘোরাঘুরি করতে দেখলে, অসতর্ক মুহূর্তে তার শরীরে বিষ দাঁত ঢুকিয়ে বিষ ফেলে দিতে চেষ্টা করে।
এই উপন্যাসের একটি উপ কাহিনীর গুরুত্ব পূর্ন চরিত্র মৌলভী আব্দুল কাদের!উপন্যাসের নায়ক হাসানের ছোটবেলার সহপাঠী মর্জিনা দের বাড়িতে গৃহ শিক্ষক হিসাবে থাকতেন মৌলভী আব্দুল কাদের! মর্জিনাদের বৈঠকখানার একটি ঘরে এসে স্থায়ী আশ্রয় করে নিয়েছিলেন! গ্রামের আরবি স্কুলের হেড মৌলভী ছিলেন আবদুল কাদের! গ্রামের মসজিদের ইমামতি করতেন! ধর্মীয় বিষয়ে গ্রামে তিনি ছিলেন মহা ক্ষমতাবান! ধর্মীয় বিষয়ে কোনো সালিশি বিচার হলে তিনি যাকে যা শাস্তি দিতেন সকলকে তা মাথা পেতে নিতে হতো! মর্জিনা বিবির বৈঠকখানা ঘরটি হঠাৎ আগুনে পুড়ে যাবার আগে পর্যন্ত এবং মর্জিনার অগ্নিদগ্ধ হওয়ার আগে পর্যন্ত মৌলানা আব্দুল কাদের সেখানেই থাকতেন!
মর্জিনার জীবনে আসলে কি ঘটেছিল, এসব ভাবনা হাসানের জীবনে এসেছে অনেক পরে! নতুবা সেদিন কেন মৌলভী আব্দুল কাদের মজিনাকে একা একা পড়াচ্ছিলেন! কেন কেরোসিনের হারিকেনটা মর্জিনার পায়ের আঘাতে উল্টে গেল! কেন তার পাজামা কামিজে আগুন ধরার আগে ঘরের চাল দিয়ে দাও দাও করে সবকিছু গ্রাস করে ফেলল! মর্জিনার শরীর থার্ড ডিগ্রী বার্ণ হলেও কিভাবে আব্দুল কাদের অক্ষত রয়ে গেল? কেন প্রকৃতির ডাকে আবদুল কাদেরকে তখনই বাইরে যেতে হল! মর্জিনা কেন নিজে নিজে মরতে চাইবে? মর্জিনার তো কোন বিয়ের কথা হয়নি! মর্জিনার নানি তো বলেছিল তোদের দুটিতে জুটি হলে ভালো মানাবে! বলেছিল মর্জিনার মাথা খুব ভালো ওর বাবা বলেছে ওকে ডাক্তার বানাবে! মর্জিনার অগ্নিদগ্ধ শরীর কলার পাতার উপর শুইয়ে রাখা হয়েছিল! চার দিনের মাথায় মর্জিনার সকল যন্ত্রনার অবসান হয়ে গেল! তবে আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন! হয়তো মনে মনে অভিভাবকরা তার মৃত্যুই চাচ্ছিলেন! কারণ এই মেয়ে বেঁচে থাকলে শেষ পর্যন্ত কুচকানো বিকৃত চামড়া নিয়ে বেঁচে থাকবে! তাকে বিয়ে করার কোন লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না! যে মেয়ের সৌন্দর্য একদিন গ্রামে ঈর্ষার কারণ ছিল! সেই মেয়ের ক্ষমাহীন কদর্যতা মানুষ সযত্নে এড়িয়ে চলবে!মৌলভী আব্দুল কাদেরের খুন হওয়ার ব্যাপারটা ছিল আকস্মিক! আব্দুল কাদের এই গ্রামের লোক নয়! নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় ওয়াজ করতেন! ধর্মের অনেক কিচ্ছা-কাহিনী তার জানা ছিল! তার বর্ণিত বিষয় ছিল নারী-পুরুষের যৌন সম্পর্ক! বিশেষ করে সদোম ও গোমরাহী নগর কিভাবে ধ্বংস করা হয়েছিল! সেখানকার লোকেরা কিভাবে মেয়ে মানুষের চেয়ে পুরুষ মানুষের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিল! তাছাড়া তার আরেকটি গল্প ছিল এমন- কাল কেয়ামতের আগে এমন একটা জামানা আসবে যখন পুরুষ মানুষের চেয়ে মেয়ে মানুষের সংখ্যা বেশি হয়ে যাবে! মেয়েদের ভয়ে পুরুষরা গাছে চড়ে থাকবে! পুরুষরা গাছ থেকে পেচ্ছাপ করে দিলে সেই পেচ্ছাব খেয়ে মেয়েরা গর্ভবতী হয়ে পড়বে! হাসান আবদুল কাদেরকে সন্দেহ করতো! প্রত্যেককেই ব্যস্ত ছিল মর্জিনার দাফন নিয়ে! একে একে সবাই উপুড় হয়ে মর্জিনার কবরে তিন মুঠো মাটি ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন! একটা আর্তনাদ করে মর্জিনার কবরের ওপর আব্দুল কাদের ঢলে পড়লেন! সকলের অজান্তেই মর্জিনার চাচাতো ভাই আলমগীর গরু জবাইয়ের একটি ধারালো ছুরি মৌলভী আব্দুল কাদেরের গলার নিচে পিঠের দিক থেকে হৃদপিণ্ড বরাবর বসিয়ে দিয়েছে! গল গল করে রক্তের ধারা মর্জিনার কবর রক্তে রঞ্জিত করে দিল! আব্দুল কাদেরের হত্যা গ্রামের মানুষের কাছে রহস্যময় থেকে গেল! তবে অনেকেই বলতে চেষ্টা করলো আব্দুল কাদেরই মর্জিনার গায়ে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল! কারণ কোনো একদিন একা পেয়ে মর্জিনাকে তার সঙ্গে শুতে বাধ্য করেছিল! এতেই মর্জিনা হামেলা হয়ে পড়েছিল! আর এই অপবাদ থেকে বাঁচার জন্য সে এই মহা অপকর্ম করে বসে! এই ঘটনা মর্জিনার বড় চাচার ছেলে আলমগীর দেখে ফেলেছিল! বোনের এই মৃত্যু সে সহ্য করতে পারেনি! পাপ বাপকে ছাড়ে না! একথা যারা বিশ্বাস করেছিল তারা আলমগীরের এই হত্যাকান্ডকে বাহবা দিয়েছিল!তিনি তিন চার মাস ছাড়া ছাড়া বাড়ি যেতেন! ধর্মীয় জলসায় মানুষকে ভাল ভাল কথা বলতেন! কিন্তু তার মনের মধ্যে বাসা বেঁধে থাকা অবৈধ কামের আগুনে বলি হতে হয়েছিল কিশোরী সুন্দরী মর্জিনাকে! লেখক মৌলভী আব্দুল কাদেরের খুন হয়ে যাওয়াকে এমন বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করেছেন, যেখানে পাঠকের কোনোভাবেই মনে হয়নি একজন ধর্মীয় শিক্ষক যিনি একাধারে মসজিদের ইমাম এবং মৌলভী তাকে কেবল সন্দেহের বশে দিতে হয়েছে! মৌলভী আব্দুল কাদেরের যৌন লালসার বলি হয়ে কিশোরী মর্জিনার এভাবে মর্মান্তিক মৃত্যু পাঠকও কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না! মর্জিনার চাচাতো ভাইয়ের হাতে মৌলভী আব্দুল কাদেরের নির্মমভাবে মৃত্যু হওয়া পাঠককে বরং স্বস্তি দিয়েছে! এখানেই লেখক কাহিনী বর্ণনার ক্ষেত্রে গভীর মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন!
এই মৌলভী আব্দুল কাদেরের একপেশে বিচারের কারণে গ্রামের সরল সাদাসিধে হাসিখুশি ছেলে ইয়াসিনকে আত্মহত্যা করতে হয়েছিল! যে ইয়াসিন তার চাচিকে মায়ের মত মনে করত! সেই ইয়াসিনের সঙ্গে তার চাচির অবৈধ সম্পর্কের রটনা রটিয়ে দেয়া হয়েছিল যার সঙ্গে সত্যতার সামান্যতম কোন যোগ ছিলনা! ইয়াসিনের সমবয়সী রওশন আসলে শত্রুতা করে তার বিরুদ্ধে বিচার দিয়েছিল ! সত্যতা যাচাই না করে মৌলভী আব্দুল কাদের ইয়াসিনকে দোষী সাব্যস্ত করে মাথা ন্যাড়া করে মহিষের পিঠে চড়িয়ে বিশেষভাবে সজ্জিত করে গ্রাম প্রদক্ষিণের শাস্তি দিয়েছিলো! এই অপমান সহ্য করতে না পেরে ইয়াসিন গ্রামের তেতুল গাছে ঝুলে আত্মহত্যা করেছিল! ইয়াসিন ছিল নির্দোষ, গ্রামের সবচেয়ে ভালো ছেলে! পরে গ্রামের তরুণীর ইয়াসিনের নামে একটি ক্লাব তৈরি করেছিল নাম দিয়েছিল ‘ইয়াছিন মেমোরিয়াল ক্লাব’! 1971 সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় এই ক্লাবের একটি গৌরবজনক ভূমিকা ছিল!
উপন্যাসের আরেকটি উপ কাহিনীর উল্লেখযোগ্য চরিত্র অসম সাহসী যুবক আব্দুল খালেক!আব্দুল খালেক গাছ বাইতে ওস্তাদ! যে গাছে উঠতে অন্যরা ভয় পায় আব্দুল খালেক তরতর করে সেই গাছে উঠে পড়ে! গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে বৃদ্ধ ফতেবিবি ভবিষ্যৎবাণী করেছে আব্দুল খালেক একদিন গাছ থেকে পড়ে মারা যাবে! তার এই বাণীর অকাট্য যুক্তি সাপের ওঝা সাপের কামড়ে মারা যায়! তাই আব্দুল খালেক গাছে উঠলে সবাই ফতেবিবির ভবিষ্যৎবাণী ফলে যাওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে! ফতেবিবির ভবিষ্যৎবাণী একদিন ফলে গিয়েছিল! সে দৃশ্য হাসান কল্পনা করতে পারে না! আব্দুল খালেক রসের ভান্ড নিয়ে অনেকখানি নেমে এসেছিল! হাসানের মেজভাই ওমর ফারুক মামা সফিউদ্দিন কাঁধে বেটাগান ঝুলিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে খবর দিল, মিলিটারিরা গ্রামের মধ্যে ঢুকে পড়েছে! ওদের ঠেকাতে পারিনি আমরা! তোমরা যেভাবে আছ সেভাবেই সরে পড়ো! এ খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গে আব্দুল খালেকের হাত থেকে রসের ভান্ড ছিটকে পড়ল হাসানের মাথার উপর! প্রচন্ড শব্দে রস সমেত হাঁড়িটি হাসানের মাথায় ভেঙে গেল! কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই বিমূঢ় হয়ে পড়েছে! হাসানের মাথার উপরে এই হাড়ি ভাঙ্গার ঘটনা কেউ আলাদা করে বুঝতে পারল না! এমনকি হাসানও পারল না!হাসান বুঝতে পারেনা স্বপ্ন আর স্মৃতির তফাৎ কিসে? ফাল্গুনের এই পড়ন্ত বিকালে কোনটি যে স্বপ্ন, আর কোনটি যে বাস্তব সেটি হাসান আলাদা করতে পারে না!আব্দুল খালেককে প্রথম আবিষ্কার করেছিল এই গ্রামেরই আবু তালেব! মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই গ্রাম থেকে গায়েব হয়ে গিয়েছিল সে! সবাই বলতো আবু তালেব রাজাকার বাহিনীতে নাম লিখিয়েছে! চরবিলকাদা গ্রামে পাক অপারেশনের সময় মিলিটারিরা তাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিল! ওই প্রথমে আব্দুল খালেককে নির্দেশ দিয়েছিল এলাকার সবচেয়ে উঁচু খেজুর গাছে উঠে পাক সাহেবদের একটু আনন্দ দিতে! গাছে পুরোটা ওঠার পরে জওয়ানেরা সবাই তাকে হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানিয়ে ছিল! আর তারই সাফল্যের পুরস্কারস্বরূপ আব্দুল খালেকের পিঠের দিকে রাইফেলের একটি গুলি চালিয়ে তাদের সেদিনের মৃগয়া উদযাপন করেছিল!আব্দুল খালেকের দিল ছিল ভয়ের ধারণা শূন্য!যার দিলে ভয় নাই সে ইহকাল ও পরকালে নিজেকে রক্ষা করতে পারবে না! আব্দুল খালেক ও পারেনাই! আব্দুল খালেকের নির্বুদ্ধিতা সে মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি শহীদ হয় নাই! কিংবা ভারত হত্যা এক নম্বর তালিকায় তার নাম পাওয়া যায় নাই! ফলে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের তালিকা আব্দুল খালেকের সঠিক অবস্থান নির্ণয় করা সম্ভব নয়!
এই উপন্যাসের নায়ক হাসান যেন এক গ্রিক ট্র্যাজেডির নায়ক! নিয়তি-নির্ধারিত তার পরিণতি! যে অপরাধের জন্য সে নিজে দায়ী নয় অথচ সেই অপরাধের গ্যাড়াকল তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে! কিছুতেই গাঁট খুলতে পারছে না! গভীর রাতে সংবাদপত্রের অফিসের কাজ শেষ করে পায়ে হেঁটে বাসায় ফেরার পথে দুই বালিকা দেহপসারিণীর সঙ্গে তার দেখা হয়ে যাওয়া! তাদের সঙ্গে বসে কথা বলার অপরাধে রাতের টহলদারি পুলিশ তাকে থানায় ধরে নিয়ে যাওয়া! তারপর একের পর এক অনভিপ্রেত ঘটনা, নানা সামাজিক জটিলতা তার সামাজিক এবং ব্যক্তিগত জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে! এই সংকটকালে তার চেতনাপ্রবাহে ধরা দেয় ফেলে আসা জীবনের সব ঘটনাবলী!
এই উপমহাদেশ দীর্ঘ আড়াই’শ বছর ধরে ব্রিটিশের শাসনে ছিল! উপমহাদেশের দেশগুলি দীর্ঘদিন ধরে স্বাধীন হলেও ব্রিটিশের তৈরি শাসকের সুবিধার্থে মানুষ নিপীড়নের আইনগুলি এখনও বহাল তবীয়তে বহাল রয়েছে! যখন যে দল শাসন ক্ষমতায় থাকে না তখন তারা প্রতিশ্রুতি দেয় তারা ক্ষমতায় এলে জনস্বার্থবিরোধী এইসব আইনের বদল ঘটাবেন! কিন্তু তারা আবার শাসন ক্ষমতায় ফিরে এলে মানুষকে জব্দ করার জন্য জনবিরোধী আইন গুলি আরো প্রবলভাবে প্রয়োগ করতে থাকেন!এটাকে মেনে নিয়েই বেঁচে থাকা আমাদের এখন ভবিতব্য!ইংরেজ জাতি যা কিছু মন্দ তা তৈরি করে উপনিবেশ কিংবা অন্য জাতি সমূহের জন্য! আর যা ভালো, যা কল্যাণকর তা তৈরি করে নিজেদের জন্য! তারা যখন অন্য জাতির ইতিহাস তৈরি করে তখন সেই জাতির যা কিছু গর্বের, যা কিছু বীরত্বের তা ক্ষুদ্র করা এবং তাতে কালিমালিপ্ত’ করতে তাদের বাধে না!নিজেদের তস্কর কেও হিরো বানিয়ে দেন!হাসান মনে করে বিশ শতকে আমাদের সকল দুর্গতি উনিশ শতকে আমাদের যাবতীয় জাগরণের পথ ধরে চলে এসেছে!পুলিশের পক্ষে কিছুতেই বোঝা সম্ভব নয় এই যে এখানকার এই কয়েদি যাদের একদিনের হাজতবাসের জন্য আনা হয়েছে, তাদের ভিতরের কোন এক সত্তা কষ্ট পাচ্ছে, যে কষ্টের নাম মানবিক কষ্ট! যে কষ্ট সমস্ত মানুষের সত্তার গভীরে প্রবিষ্ট আছে! সেই যে উপনিবেশবাদীরা স্বদেশীদের উপরে অত্যাচার চালাবার জন্য তাদের শাসন সুসংহত রাখার জন্য এই মানুষগুলোর সেই তার ছিন্ন করে দিয়েছিল! আজও সেই তার জোড়া লাগানো সম্ভব হয়নি!আর জোড়া লাগেনি বলেই তাদের নাম হয়েছে পুলিশ!দশ দিন পরে হাসানের হাজতবাসের সমাপ্তি ঘটলো! বিনা বিচারে যে কোনো নাগরিক আটকে রাখার ক্ষমতা মহান সংবিধান পুলিশকে দিয়েছে! নাগরিকদের নিরাপত্তার স্বার্থেই এই আইনের প্রয়োগ! এই আইনে সরকার ও পুলিশের দ্বৈরথের শিকার হতে পারে যে কেউ! নাগরিক হিসাবে হাসান নিজেকে এর ব্যতিক্রম ভাবতে পারেনা! আর এই না পারার খেসারত তাকে হাড়ে হাড়ে দিতে হলো!কৌতুহলের বশবর্তী হয়েই হঠকারিতার শিকার হয়েছিল হাসান! তবু বাস্তবতার কঠিন আঘাত তার চিন্তা চেতনার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে শুরু করে! এভাবে কেউ জীবনের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে না! জীবনের সেই অভিজ্ঞতাগুলোই দামি যেগুলো জীবনে চলার পথে অনিবার্যভাবে অর্জিত হয়!স্ত্রীর মুখ মনে পড়ল, সন্তান প্রসবের খুব একটা দেরি নেই!বিয়ের কিছুদিন পরে হাসান বুঝতে পেরেছিল তার স্ত্রী ফারিয়া মূলত মানসিক মর্ষকামে আক্রান্ত! কাউকে কষ্ট দিতে চাইলে সে নিজের উপরে কঠিন আঘাত দিয়ে থাকে! জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর হাসান গিয়েছিল শ্বশুরবাড়িতে স্ত্রী রিয়ার সঙ্গে দেখা করতে! ওখানে গিয়ে হাসান বুঝতে পেরেছিল তার স্ত্রী ঘটনাটি জেনে গিয়েছে!সে জানে এই মেয়েটির মধ্যে একটি উন্মাদগ্রস্থতা আছে, আত্মহত্যার প্রবণতা আছে! যখন সে ভাল থাকে তখন তার মত স্ত্রী পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার! আর যখন কোন ব্যাপারে তার মন বিগড়ে যায় তখন তার চেয়ে কুৎসিত রমণী দ্বিতীয়টি নেই! এসব ভেবে অনেকবার হাসান সিদ্ধান্ত নিতে চেয়েছে তার উচিত বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া! কিন্তু রিয়ার উন্মাদগ্রস্থতা তাকে তার থেকে দূরে যেতে বাধা দিয়েছে!বাথরুমে পড়ে গিয়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে ডাক্তারের আশ্রয় যেতে দেরী হওয়ায় হাসপাতালে মৃত বাচ্চা প্রসব করেছে তার স্ত্রী ফারিয়া! প্রসূতির বাঁচার কথা ছিল না!জেল হাজত থেকে ছাড়া পাওয়ার পর এক মাস দশ দিন পরে শ্যামলী গোধূলি মানসিক নিরাময় কেন্দ্রে হাসানকে আবিষ্কার করল বিলু!
উপন্যাসের নায়ক হাসানের শৈশব কৈশোরে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন করুন ঘটনার শিকার হতভাগ্যরা কেউ তাদের পরিণতির জন্য দায়ী ছিল না! কিন্তু একটা সিস্টেম তাদের এমন ভাবে বেঁধে ফেলেছে, যা তাদেরকে এই অজানা পরিণতির দিকে টেনে নিয়ে গিয়েছে!এই উপন্যাসে বর্ণিত চরিত্র ইয়াসিন, মর্জিনা ,আকলিমা, আব্দুল খালেক ও মৌলভী আব্দুল কাদের এর করুণ পরিণতি, কেন্দ্রীয় চরিত্র হাসানের মনোজগতে অবিচ্ছেদ্য সংশ্লেষ তৈরি করেছে! সেই সঙ্গে হাসান ও বিলকিস বেগম ওরফে বিলুর প্রচ্ছন্ন প্রেম পরিণতি উপন্যাসের শেষ পর্বে এসে এক নতুন মাত্রায় ধরা পড়ে! ‘হাসানকে মানসিক অ্যাসাইলামে ভর্তি করা হয়েছে, এতসব কিছু জানতো না বিলু! বিলু আসলে হাসানের বোন দুলাভাইয়ের ফোন পেয়ে এখানে এসেছে! মাত্র কয়েকটা দিনের ব্যবধানে এত কিছু ঘটে গেছে, তা ভাবা যায় না! হাসান লোহার একটি খাটের উপর শুয়ে আছে পা দুটি গুটি করে বুকের কাছে এনে! হাসান দেওয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে ছিল, মুখভর্তি দাড়ি গোঁফে চেনা যাচ্ছে না! ওর দিকে কিছুটা ঝুঁকে পড়ে বিলু বলল চিনতে পারছনা, তুমি নাকি পাগল হয়ে গেছো! হাসান ওর দিকে ঘুরে একটু বিষণ্ণ মুচকি হাসলো! রাউন্ড ডাক্তারের সঙ্গে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে বিলু অনেক কিছু জানার চেষ্টা করল! ডাক্তারের কথা অনুসারে বোঝা গেল এ ধরনের মানসিক সিমটম হয়তো অনেক আগে থেকেই কিছু পরিমাণ ছিল ওর ভেতর! যা অধিকাংশ লোকের থেকে থাকে, কিন্তু আকস্মিক কোন দুর্ঘটনা বা মানসিক চাপ থেকে প্রকাশ হয়ে পড়ে! তবে ঠিকমতো চিকিৎসা হলে এ ধরনের রোগী সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যায়! ডাক্তার চলে যাওয়ার পরে ওয়ার্ডে ডিউটিরত নার্স জানতে চাইল বিয়ের আগে এই সমস্যার কথা সে জানতো কিনা? বিলু বলল জানতো!তারপর নার্সের দিকে এক বিষণ্ন রহস্যময় হাসি ছুঁড়ে দিল!’
পরিবর্তিত সময়ে যাপিত জীবনের নানা জটিলতায় উপন্যাসের নায়ক হাসান যখন নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া সমস্যাগুলির মুখোমুখি হয়ে মোকাবেলা না করতে পেরে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন, সেখানে সমস্যা মোকাবেলায় বিলুর মানসিক দৃঢ়তা এবং হাসানের প্রতি তার মমত্ববোধ উপন্যাসটিকে একটি ভিন্নতর মানবিক উত্তরণের পথে নিয়ে যায়! নানা ঘটনা ও চরিত্র বর্ণনা মধ্য দিয়ে উপন্যাসটির মধ্যে উঠে এসেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-উত্তর পঞ্চাশ বছরের আর্থসামাজিক ইতিহাসের যাপন চিত্র!সূক্ষ্মভাবে দেখলে এই উপন্যাসটি চেনা ছকের বাইরে উত্তরাধুনিক স্টাইলে লেখা একই সঙ্গে সামাজিক ও রাজনৈতিক উপন্যাস!লেখক মজিদ মাহমুদ দীর্ঘ বাইশ বছর ধরে এই উপন্যাসটি নির্মাণ করেছেন! লেখক এই উপন্যাসটি লেখা শুরু করেছিলেন নিজের মধ্যে যৌবনে! আর শেষ করেছেন নিজের জীবনের পৌঢ়ত্বে এসে! যার ফলে একটি নতুন গড়ে ওঠা দেশের গ্রামীণ জীবন থেকে নাগরিক জীবনে ধারাবাহিকভাবে বদলে যাওয়ার চালচিত্র অত্যন্ত বলিষ্ঠতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গে এই উপন্যাসে তুলে ধরতে সফল হয়েছেন! আমি নিশ্চিত আগামী দিনে বাংলা উপন্যাসের ক্ষেত্রে মজিদ মাহমুদের ‘মেমোরিয়াল ক্লাব’ নামক এই উত্তরাধুনিক উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যে একটি মাইলস্টোন হয়ে থাকবে!