অরোরার আঙুল – ০১

কাজী রাফি

কথাশিল্পী

ঘুম থেকে জেগে জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাল অরিত্র। মাত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠা ভোরের আলোয় প্রশস্ত নির্জন রাস্তাটার মাথায় একটা কুকুর নিজের দুই পায়ের ভেতর মুখ গুঁজিয়ে চুপ করে শুয়ে আছে। রাস্তাটি সোজা চলে গিয়েছে আটলান্টিক সাগরের তট বরাবর। প্রতিদিন ভোরে এই রাস্তার পানে দৃষ্টি রেখে আনমনা হওয়া অরিত্রের প্রতিদিনের অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। বলা যায় কোনো কারণে এই অভ্যাস চর্চিত না হলে অরিত্রের, কী যেন করা হয় নি –এমন অনুভূতিতে দিনটাই খারাপ যায়।

জাতিসংঘের পশ্চিম আফ্রিকায় অর্থ-বিভাগে চাকরির কারণে তাকে যেদিন প্রথম মাতৃভূমি, বাবা-মা, প্রিয়জন ছেড়ে অজানার উদ্দেশে বিমানে উঠে বসতে হলো সেদিন অরিত্রের কেমন কান্না পাচ্ছিল। ভোরের জেগে ওঠার সাথে মাত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠা উদার নীলাকাশের নিচে এই নীরব আর শান্ত রাস্তাটি যেন তার আপনভূমি ছেড়ে আসার যে কষ্ট তার ভাষাটুকু জানে। রাস্তাটির দুই পাশের প্রতিটি একতলা বাড়ি দুই একরেরও অধিক জমিতে এক একটি আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেই বাসাগুলোরই থোকা থোকা, গুচ্ছ-গুচ্ছ আর রাশি রাশি বিচিত্র বর্ণের সব ফুল মোহনীয় অনন্যতায় ভরে রেখেছে রাস্তার চারপাশ।
ভোরেরর এই প্রকৃতি, ফুল, অবারিত নীলাকাশ আর কুকুরের শুয়ে থাকার অলস ভঙ্গিমা অরিত্রের জীবনস্মৃতিকে ধারণ করে তার মনোলোকের রূপকাহিনীর বাটে আছড়ে পড়ছে আটলান্টিক ঢেউ তরঙ্গের ছন্দ হয়ে। গাছের পাতায় পাতায় শিশিরবিন্দু জড়িয়ে আছে পরম মমতায়। এই মনোলোভা দৃশ্যের পানে তাকিয়ে জীবনের গভীরতর অর্থ খুঁজে ফিরছিল সে। কিন্তু জীবনের অর্থ কিছুই পরিস্কার না হলেও অরোরার একটা কথা স্পষ্টভাবে ওর কানে ভাসছে। পাতায় পাতায় শিশিরবিন্দু দেখিয়ে অরোরা একদিন অরিত্রকে বলেছিল, “ইউ নো অরিত্র, ডিউ অ্যান্ড দ্য মর্ণিং … অলওয়েজ গিভস মি অ্যা ফ্রেস ফিলিংস। দ্য বিউটি অব লাইফ।“
অরিত্র অরোরার কথায় স্মিত হেসেছিল। আনমনা স্বরে বলেছিল, “ অলসো দ্য ট্রুথ অব লাইফ।“

“ওরা ক্ষণিক জীবন আর মিথ্যা মায়ার কথা বলে। মানুষের জীবন আসলে গোধূলীবেলার ছায়ার মতো, অন্তহীন গহীন এক আঁধারে হারিয়ে যাওয়ার জন্যই সে এই মায়াগুলোর ভেতরে আশ্রয় খুঁজে ফেরে।

অরিত্র আমার মতো করে ভাবো। জীবনের যেটুকু সময় তা কত মহান। এই মহান আটলান্টিকের দিকে তাকিয়ে একটা বিকেল কাটানোর মতো সৌভাগ্য দিয়েছেন যে স্রষ্টা –তার প্রতি কৃতজ্ঞ হও।“

আড়মোড়া ভাঙল অরিত্র। অরোরার মাঝে কী এক যাদুশক্তি আছে যে ওর কথা মনে হলে সে একটু প্রাণশক্তি ফিরে পায়। আবিদজান ছাড়া আইভরি কোস্টের কোনো শহরকেই প্রকৃতি শহুরে স্বাধীনতা দেয় নি। নির্জন শহরের মাঝে প্রকৃতির বিলাসী প্রাচীনত্ব আর আর সদর্ভ অস্তিত্ব দেখে অরিত্রের ছোটবেলায় দেখা বিটিভিতে ‘মুভি অব দ্য উইক’ অনুষ্ঠানে দেখা সাদা-কালো কোনো এক সিনেমার কথা মনে পড়ে –
এক সুন্দরী তরুণী দাঁড়িয়ে আছে। দরজার চৌকাঠে হেলান দিয়ে। দরজার বাইরে বিস্তৃত বাসাটায় অনেকগুলো প্রাচীন বৃক্ষ। বাসাটার সীমারেখার দেওয়ালগুলো ফুলে ফুলে ঢাকা। প্রিয়জনকে বিদায় জানানোর বেদনা তার সমগ্র অভিব্যক্তিতে, সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে। একটা কার পাতা মাড়িয়ে অতিক্রম করছে বাড়ির মূল দরজা। ছিমছাম, পাতাঝরা বাড়িটার দরজার লোহার গ্রিলগুলো খোলা। তরুণীটি তখনো তেমনি ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। তার হাতের লম্বা আঙুলগুলোতে যেন প্রিয়জনকে বিদায় জানানোর অদ্ভুত এক কষ্টের ভাষা। ক্রমশ ক্যামেরা সরে যাচ্ছে লম্বা লম্বা গাছে। নির্জন শহরের গলিতে…। পাতাগুলো ঝরছেই।

[hfe_template id=’81’]

নির্জন এই ভোরে নিভৃত এই পথটার পানে তাকালে অরোরার কথা কেন মনে পড়ে – তা ভেবে আকুল হয় অরিত্র। অরোরার সাথে ছোট্টবেলায় দেখা সেই তরুণী নায়িকার ওমন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্যকল্পের কোথায় সাদৃশ্য তা খুঁজে না পেয়েও কেন অরিত্রের বার বার অরোরাকে সেই নায়িকা ভেবে ভুল হয় তা সে অনেক ভেবেও আবিস্কার করতে পারে নি।

পাশের বাসাতেই থাকে অরোরা। পশ্চিম আফ্রিকার এই দেশটিতে অরোরা গ্রেড-২ লেভেলের (পি-২) কর্মকর্ত। তারই বিভাগে পি-৩ স্তরের অফিসার হয়ে আসার পর অরিত্র অবাক হয়েছিল। দেশ ছেড়ে এই আটলান্টিকের পাড়ে এসে সে যেন ছোটবেলায় ‘মুভি অব দ্য উইকে’র সেই ছলছলে গড়নের নায়িকাকে খুঁজে পেয়েছে। তার চেয়েও অরিত্র বেশি অবাক হয় এই ভেবে যে, অরোরার আঙুলগুলোতেও সেই নায়িকার মতো ‘অপেক্ষা’ নামের শব্দটির এত অস্তিত্বময়তা! যতবার সে অরোরার লম্বা সুন্দর আঙুলগুলোতে দৃষ্টি ফেলে ততবার ছোটবেলায় নাসারন্ধ্রে লেগে থাকা এক গন্ধ, হৃদয়ের মাঝে লুকানো গহিন-গোপন এক অনুভব আর স্বপ্নলোকে ফেরি করা কল্পনাগুলো জেগে জেগে ওঠে। কিন্তু অরোরার আঙুলগুলো নিয়ে অরিত্র এত কৌতূহলী হয়ে উঠত না, যদি না স্রষ্টার সুনিপুণ দক্ষতায় গড়া দশটি আঙুলের মধ্যে তার ডানহাতের মধ্যমায় লম্বা করে গভীর এক আঁচড় না থাকত।

অচেনা, অজানা এক নারীর হাতের ক্ষত তাকে এত কৌতূহলী করতে পারে ভেবে অরিত্র নিজের ওপর খুব বিরক্ত হয়ে ওঠে। তবু বিরক্ত হলেও তার অন্তর্লোক অরোরার আঙুলের এই আঁচড়ের মাঝেই গোপন আর রহস্যময় এক জীবন-ইতিহাস আর স্মৃতিময় কিছুর ইঙ্গিত খুঁজে ফেরে। নস্টালজিয়া কাকে বলে অরোরা তার সংজ্ঞা যেন অরিত্রকে ক্ষণে ক্ষণে শেখায়। ভাগ্যিস অরোরার মতো এক নস্টালজিয়ার ঘোরে সে ডুবে থাকে। না হলে কবে এই চাকরি ছেড়ে সে দেশে পালিয়ে যেত!

অরিত্র কাজের প্রয়োজনে অরোরার অফিসে এলে আনমনে বারবার তার আঙুলের দিকে তাকায় –‘অপেক্ষা’ নামের এক বেদনার ভাষাকে শনাক্ত করার জন্য। নিজেকেই তার পাগল মনে হয় আর কৈশোরে দেখা সিনেমার স্রষ্টার সাথে নায়িকাটিকে মনে হয় এক জন্মগত জাত-শিল্পী। তার কিশোর মানসলোকে এই শিল্পীরা এমন এক দৃশ্যকল্প ঢুকিয়ে দিয়েছে যে, তার মনন খুব গভীর আর তীক্ষ্মভাবে প্রকৃতি আর তার মাঝে একজন নারীর ‘অপেক্ষা’ করার মানবিক আর্তিকে শনাক্ত করতে শিখেছে তার অজান্তেই।

রিত্রের হৃদয় এখনকার দিনের নাচ সর্বস্ব সিনেমা আর শরীর-সর্বস্ব নায়িকাদের (এমনকি নায়কদের) কথা ভেবে আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। সিনেমার প্রসঙ্গ ওঠায় একদিন সে অরোরাকে বলল, “সিনেমার মতো এক মহান শিল্প মাধ্যমকেও ব্যবসায়িক মনোবৃত্তির কারণে পৃথিবীর মানুষগুলো কোথায় নামিয়েছে, দ্যাখো। চলচ্চিত্র মানে জীবনের এক চিলতে মুহূর্তকে অমলিন করে রাখা, মানবিক আর্তির চিত্রকে দৃশ্যকল্প দিয়ে হৃদয়ে প্রোথিত করা যেন এক কিশোর সে দৃশ্যকে ভালো বাসতে বাসতে একদিন তার নিজের জীবনকেই ভালোবাসে। তারপর একদিন আকুল মগ্নতায় ভালোবাসতে শিখে তার সেই মানবিক দৃশ্য আর কল্পিত নারীকে।“

অরোরা তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে মুগ্ধ হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। যেন প্রত্যুত্তোরের কোনো ভাষা সে খুঁজে পাচ্ছে না। তারপর বলল, “কোনো সিনেমা কি তোমাকে এমন কোনো দৃশ্য উপহার দিয়েছে যা ভালোবাসতে-বাসতে তুমি এই জীবনকেই ভালোবাসতে শিখেছ? শিখেছ আকুল মগ্নতায় তোমার প্রিয় নারীকে ভালোবাসতে?“

প্রশ্নটা শোনার পর থেকে আনমনা অরিত্রের চোখের সামনে পরিবারের সবাইকে বিদায় দেবার পূর্ব-মুহূর্তে মায়ের অশ্রুসজল ঝাপসা দৃষ্টির ভেতর দিয়ে এক দৃশ্য ভেসে উঠল:
ঝুপ ঝুপ বৃষ্টির এক রাত। কিশোর অরিত্রের পড়ার টেবিলের সামনে জানালার পর্দাগুলো উড়ছে পতপত। জানালার অপর প্রান্তে তাদের অন্ধকার বাগানটায় গাছগুলোর পাতা বেয়ে বড় বড় বৃষ্টির ফোটা ঝরছেই। বৃষ্টির রাতে এই শীত শীত আবেশ আর নিসঃঙ্গ প্রকৃতি কিশোর অরিত্রের মননে সারাজীবন প্রভাব ফেলেছে। বৃষ্টিমুখর দিন অথবা রাত তাই তার ভাবনালোকে এক রহস্যময়তা।
কিন্তু এই দৃশ্যের ছাপিয়ে যা তার স্পষ্ট মনে হলো তা হলো, ঐ কিশোর বয়সে সে কী এক স্বপ্নপরীর ভাবনায় তলিয়ে গিয়েছিল। যে পরীটার ডানা সাদা। কল্পলোকের সেই স্বপ্নপরী ঘুমিয়ে গেলে তার স্বপ্ন হয়ে যায়। এক রাতে সেই পরী তার হাত ধরে তাকে তার স্বপ্নঘোরে আকাশের সব প্রান্তে, বৃষ্টি ঝরা নিভৃত পৃথিবীর নিমগ্ন প্রকৃতির অনবদ্যতায় উষ্ণতা খুঁজে বেড়াল। তারপর প্রায়ান্ধকার এক মাচার কাছে এসে অরিত্রের পাশে বসে পা দুটা ঝুলিয়ে দিয়ে তা দোলাতে দোলাতে শুধু অরিত্রের মুখপানে চেয়ে মিষ্টি করে হাসল।

[hfe_template id=’81’]

সেই অমলিন হাসি আজো জেগে আছে তার হৃদয়ে। অরিত্র বিমূঢ় ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ অরোরার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “হ্যা, আমি সেই পরীটাকে ভালো বাসতে বাসতে এই জীবনকে বড় নিবিড়ভাবে ভালোবেসেছি।“
অরিত্রের কথায় অরোরা ফিক করে হেসে দিল, “পরী!“

অরোরাকে সে বলতে চাইল, ‘সেই পরীটা ঠিক তোমার মতো।‘

বলা হলো না। তবে, রাতে বসে বসে সে তার এইসব অনুভূতি নিয়ে ভরিয়ে ফেলল তার দিনলিপির পাতা। কিন্তু এই দিনলিপিতে নতুন এই দেশটির কোনো কথা-ই এলো না। অরিত্র যেন নিজ দেশে, মায়ের কাছে বাস করা এখনো এক কিশোর যে আজো খুঁজে ফিরছে সেই স্বপ্ন পরী আর বৃষ্টিমুখরিত দিন অথবা রাতের মাঝে লুকানো রহস্যময়তা।


কাজী রাফি

মানুষ ও তাদের যাপিত জীবন এবং প্রকৃতি দেখার প্রয়োজনে ঘুরেছেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। চাকরির প্রয়োজনে আফ্রিকায় বাস করেছেন দুই বছরের অধিক সময় এবং আফ্রিকার প্রকৃতি-সংস্কৃতি, তাদের প্রান্তিক মানুষের যাপিত জীবনকে দেখেছেন খুবই কাছ থেকে।  আফ্রিকার পটভূমিতে লেখা ‘ধূসর স্বপ্নের সাসান্দ্রা’ তাঁর প্রথম উপন্যাস। এই উপন্যাসেই কালি ও কলম পুরস্কার লাভ করেছেন তিনি; তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ, ১১ টি উপন্যাস এবং ৬ টি ছোট গল্পগ্রন্থ সবই পাঠক প্রিয়তায় প্রথম সারিতে। তাঁর লেখা ‘ত্রিমোহিনী’ উপন্যাসকে মহাকাব্যিক অ্যাখ্যা দিয়েছেন কিংবদন্তী ছোট গল্পকার হাসান আজিজুল হক ।

পুরস্কার,  এইচএসবিসি কালি ও কলম পুরস্কার -২০১০, এমএস ক্রিয়েশন সম্মাননা -২০১০, নির্ণয় স্বর্ণপদক-২০১৩, এসএম রাহী পদক ২০১৯

কাজীরাফি ডট কম

Please Post Your Comments & Reviews

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected!!
Share via
Copy link
Powered by Social Snap