শ্রদ্ধাঞ্জলি
সহকারী অধ্যাপক, গবেষক
১.
আমাদের ভাষা-সংস্কৃতিসহ সকল গণতান্ত্রিক-মানব মুক্তির আন্দোলন-সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ তেজোদীপ্ত সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী। আমাদের সকলের পরম শ্রদ্ধার ভাষাসংগ্রামী ও কিংবদন্তিতুল্য ব্যক্তিত্ব ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী। কামাল লোহানী নামেই তিনি সুপরিচিত হলেও তাঁর পারিবারিক নাম আবু নঈম মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল খান লোহানী। বৃহত্তর পাবনা জেলার বিখ্যাত লোহানী পরিবারের সুসন্তান তিনি। কিশোর বয়সেই জড়িয়েছেন ভাষা আন্দোলনে। ঢাকায় এসে বামপন্থী রাজনীতি, সাংবাদিকতার পাশাপাশি যুক্ত হয়েছিলেন সাংস্কৃতিক আন্দোলনে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় একাত্তরে তিনি ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বার্তা সম্পাদক। তাঁর কণ্ঠেই বিশ্ববাসী বিজয়বার্তা প্রথম জানতে পারে। প্রখ্যাত সাংবাদিক কামাল লোহানী সাংবাদিকতায় ২০১৫ সালে একুশে পদকসহ লাভ করেছেন বহু সম্মাননা। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সাংবাদিক কামাল লোহানী ১৯৩৪ সালের ২৬ জুন জন্মগ্রহণ করেন। উল্লেখ্য, করোনায় আক্রান্ত গত বছর- ২০২০ সালের ২০ জুন শনিবার সকাল ১০টার পরে রাজধানীর বেসরকারি একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৮৬ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। প্রয়াণ দিনে তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা। লাল সবুজের এই মহান শব্দ সৈনিকের সাথে নানা সময়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের কিংবা ঘরোয়া আয়োজনের আলাপনের অনেক স্মৃতি মনে পড়ছে আজ।
২.
নিবেদিত প্রাণ সাংবাদিক, মননশীল বাঙালি সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানীর বর্ণাঢ্য জীবনে অনেক পরিচয় তাঁর। কামাল লোহানীর দীর্ঘজীবনে ছয় দশক সাংবাদিকতা ও সাংবাদিক ইউনিয়ন আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন। দেশের গণসাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব অশীতিপর কামাল লোহানী ছায়ানট, ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠী, গণশিল্পী সংস্থা এবং উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত থেকে, পাকিস্তান আমলে তো বটেই মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশেও গণসংস্কৃতি আন্দোলনে নিবেদিতপ্রাণ কর্মী হিসেবে আজও সক্রিয় রয়েছেন। মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে দীর্ঘ রাজনীতি সম্পৃক্ততার কারণে তাকে বারবার কারাবরণ ও নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে। এ ছাড়া এই দীর্ঘ জীবনে তিনি ধারাভাষ্যকার, আবৃত্তিশিল্পী, উপস্থাপক এবং নৃত্যশিল্পী হিসেবেও লড়াই সংগ্রামে ভূমিকা রেখেছেন। তাঁর লেখা ১৫টি বই প্রকাশ পেয়েছে, যার মধ্যে ২টি কাব্যগ্রন্থ। পরিণত বয়সেও তারুণ্যদীপ্ত কামাল লোহানী ছায়ানট, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন। সত্যভাষণ এবং মতাদর্শিক কারণেই তিনি প্রায় সময়ই শাসক শ্রেণীর প্রতিপক্ষরূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ভাষাসংগ্রামী ও একাত্তরের শব্দ সৈনিক, সাংবাদিক কামাল লোহানী দৃঢ়ভাবে মনে করতেন, ‘বর্তমান পৃথিবীতে মেধার মূল্য কম অপকৌশলের মূল্য বেশি।’ কামাল লোহানীর ত্যাগ, নিষ্ঠা, দেশপ্রেম এবং মতাদর্শিক অবিচল অবস্থানের ক্ষেত্রে তাঁর চরম শত্রুও প্রশ্ন তুলতে পারবে না। মধ্যবিত্ত জীবন-যাপনেও মধ্যবিত্ত শ্রেণী আকাঙ্ক্ষা তাঁকে আপ্লুত করেনি বলেই আদর্শ বিচ্যুত হননি। শাসক শ্রেণীর সঙ্গে তাঁর সখ্য আমৃত্যু ছিল না। সাংবাদিকতার পেশার পাশাপাশি তিনি একজন সমাজ সচেতন লেখকও ছিলেন। সহজ কথা সরাসরি বলতে তিনি কখনো দ্বিধা-সংশয়ে ভোগেননি। তাঁর রচিত ও প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘আমাদের সংস্কৃতি ও সংগ্রাম’, ‘আমরা হারবো না’, ‘লড়াইয়ের গান’, ‘সত্যিকথা বলতে কি’, ‘দ্রোহে-প্রেমে কবিতার মত’, ‘সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও নৃত্যশিল্পের বিস্তার’, ‘রাজনীতি-মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীন বাংলাদেশ বেতার’, ‘শত্রু বধের উৎসবে’, ‘যেন ভুলে না যাই’ ইতাদি। তিনি স্মৃতিকথাও লিখেছেন।
৩.
আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান অসামান্য। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দ সৈনিক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ভূমিকা অপরিসীম। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত বিজয়ের প্রথম বার্তাটি তিনিই লিখেছিলেন এবং বিজয়ের সেই বার্তাটি তিনি পাঠও করেছিলেন। তাঁর লিখিত ও পঠিত বার্তায়ই বিশ্ববাসী জেনেছিল পাকিস্তানিদের পরাজয় এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম লাভের সংবাদ। স্বাধীনতা ঘোষণার খবরের সেই স্মৃতিচারণ করে বলেছিলেন, ‘অরোরা-নিয়াজির মধ্যে আলোচনা হতে হতে ১৬ তারিখ বিকেল ৪টা ৩০ মিনিটে রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তান আর্মি সারেন্ডার করল। আমরা হইহই করে উঠলাম। নিউজটি কিভাবে যাবে আলোচনায় বসলাম। ৪টা ৩০-এ কোনো অধিবেশন নেই, স্পেশাল অধিবেশন তৈরি করে স্পেশাল নিউজ বুলেটিন প্রচারিত হলো। নিউজ এডিটর হিসেবে বুলেটিনটি লিখতে বসলাম। মনে আছে, পাকিস্তানিদের গালাগাল করে পৃথিবীকে জানানোর জন্য দুটি মেসেজ লিখেছিলাম- পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে এবং বাংলাদেশ আজ মুক্ত, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে। ব্যস, এটুকু। রুটিন অনুসারে সংবাদ পাঠক বাবুল আক্তারের পড়ার কথা ছিল। কিন্তু সৈয়দ হাসান ইমাম এসে বললেন, ‘যেহেতু প্রথম বাংলা বুলেটিনটি পড়েছি, শেষটিও আমি পড়ব।’ বললাম, দেখেন, রুটিন অনুযায়ী বাবুলের পড়ার কথা। ওকে বঞ্চিত করা ঠিক হবে না। রাগ করে তিনি চলে গেলেন। কিন্তু যখন বাবুলকে পড়তে দেওয়া হলো, সে পড়তে পারছে না। সংবাদ পাঠকরা তো নরমাল ভয়েসে পড়ে। এটি সে ভয়েসে পড়লে হবে না। মনে ক্রোধ থাকতে হবে, সেটি প্রকাশ করতে হবে। পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের আত্মতৃপ্তিও প্রকাশ করতে হবে। সবাই বললেন, লোহানী ভাই, আপনি পড়েন, বাবুলও বলল। আগে থেকে ধারাবিবরণীর অভ্যাস ছিল। নিউজটি পড়ে, রেকর্ড করে পাঠিয়ে দিলাম। বিশ্ববাসী আমারই কণ্ঠে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়বার্তা সর্বপ্রথম জানতে পারল। আমার মতো তৃপ্ত, গৌরবান্বিত মানুষ আর কে হতে পারে? এটাই জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।’
৪.
কামাল লোহানীর জন্ম আমাদের বৃহত্তর পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহাকুমার উল্লাপাড়া থানার সনতলা গ্রামে। বাবা আবু ইউসুফ মোহাম্মদ মুসা খান লোহানী। মা রোকেয়া খান লোহানী। ১৯৬০ সালে কামাল লোহানীর বিয়ে হয় দীপ্তি লোহানীর সঙ্গে। দীপ্তি লোহানী বেশ কয়েক বছর আগে প্রয়াত হয়েছেন। তাদের তিন সন্তানের মধ্যে দুই মেয়ে- বন্যা লোহানী ও ঊর্মি লোহানী, আর একমাত্র ছেলে সাগর লোহানী। কামাল লোহানী তাঁর জীবনের সকল কাজের অনুপ্রেরণার নিত্য সাথী হিসেবে স্ত্রীর কথা কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করে থাকেন। শৈশবে মাতৃহীন কামাল লোহানী বেড়ে ওঠেন কলকাতায় নিঃসন্তান ফুফুর তত্ত্বাবধানে। কামাল লোহানী প্রথমে কলকাতার শিশু বিদ্যাপীঠে পড়াশুনা শুরু করেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের দামামা, মন্বন্তর, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, রক্তাক্ত দেশভাগ প্রত্যক্ষ করেছেন তীক্ষ্ম সন্ধানী চোখে। দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালে ফিরে আসেন পাবনায়। ভর্তি হলেন পাবনা জিলা স্কুলে। ১৯৫২ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন। মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী কামাল লোহানী জড়িয়ে পড়েন ভাষা আন্দোলন এবং ছাত্র রাজনীতিতে। এরপর ভর্তি হন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে। এই কলেজ থেকেই উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। আর উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পরই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ইতি টানেন তিনি। পাবনার এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্র কামাল লোহানী রাজনৈতিক কারণে একাধিকবার গ্রেফতার হন এবং কারাভোগ করেন। অতীত স্মৃতিচারণ করে তাঁর রাজনৈতিক চেতনার জন্ম বিষয়ে বলছেন, ‘১৯৪৮ সালে চলে এসে পাবনা জেলা স্কুলে ক্লাস সেভেনে ভর্তি হলাম। ছোট চাচার (তাসাদ্দুক লোহানী) বাসায় থাকতাম। তিনি পাবনা জেলা স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। ১৯৫২ সালের ১০ মার্চ ছিল ম্যাট্রিক পরীক্ষা। তার আগে ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় গুলি চলল। ছাত্র মারা গেল। খবরটা পুলিশের রেডিওগ্রামের মাধ্যমে গেল। পাবনা টাউনহলে সমাবেশ ও মিছিল হলো। চাচার নজরদারিতে থাকি। কারো সঙ্গে পরিচয়, খুব যোগাযোগও নেই। ফজলে হাসান আবেদ, কুতুবুদ্দিন, আবদুস সামাদ, আবু হেনা মোস্তফা কামাল- এরা আমার ক্লাসফ্রেন্ড। কিন্তু এরা কে কোথায় কী করছে কোনো আইডিয়া নেই। চাচার চোখ ফাঁকি দিয়ে টাউনহলে গেলাম। মিছিল হচ্ছে, জয়েন করলাম। স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিবাদের চেতনা জন্ম নিল। নিজের অজান্তেই রাজনীতির পাঠ গ্রহণ করলাম।’
৫.
১৯৫৩ সালে পাবনার জিন্নাহ পার্কে (এখন স্টেডিয়াম) মুসলীম লীগের অনুষ্ঠিতব্য কাউন্সিলে ভাষা আন্দোলনের গুলির হুকুমদাতা খুনী মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীনসহ কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সর্দার আব্দুর রব নিশতার, কেন্দ্রীয় নেতা খান আব্দুল কাইয়ুম খান প্রমুখ নেতাদের আগমনে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে পাবনার ছাত্র সমাজ। প্রকাশ্যে বিক্ষোভ ও কাউন্সিল প্রতিহতে সংঘটিত আন্দোলনের অভিযোগে সেদিনই প্রথম গ্রেফতার ও সাতদিন কারারুদ্ধ হন কামাল লোহানী। ১৯৫৪ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি উদ্যাপনের অভিযোগে পুনরায় গ্রেফতার হন তিনি। যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের পর মুক্তি লাভ করেন। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মদদপুষ্ট পাকিস্তানি শাসকেরা যুক্তফ্রন্টের বিজয় সহ্য করতে পারে নি এবং মেনেও নিতে পারে নি। ১৯৫৪ সালের ২৯ মে ৯২-(ক) ধারায় পূর্ববাংলার নির্বাচিত প্রাদেশিক সরকার ভেঙ্গে গভর্নরের শাসন জারি করে। মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্যা (যিনি বাংলার ইতিহাসে বিশ্বাসঘাতক মীর জাফরের গ্রেট গ্র্যান্ড সন) পূর্ব বাংলার গভর্নর হয়ে আসেন। যুক্তফ্রন্টের নেতা-কর্মীদের গণগ্রেফতারসহ নির্যাতন নিপীড়নের খড়গ জারি করে। কামাল লোহানী যুক্তফ্রন্টে সংশিষ্ট ছিলেন। কলেজ ছুটিতে নিজ গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। সেখানে হানা দিয়ে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। রাজশাহী জেল থেকে ১৯৫৫ সালের জুলাই মাসে তিনি মুক্তি লাভ করেন। জেল মুক্তির পর অবিভক্ত ন্যাপে যোগদান করে জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনে আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হন।
[hfe_template id=’81’]
৬.
তাঁর আপন দুই চাচাতো ভাই- ফতেহ লোহানী, ফজলে লোহানী। ফতেহ লোহানী তাঁর চেয়ে ছয় বছরের বড়, ফজলে লোহানী তিন-চার। সেই চাচাতো ভাই ফজলে লোহানীর অনুপ্রেরণায় এবং সহযোগিতায় যোগ দেন দৈনিক মিল্লাত পত্রিকায়। এখানেই তাঁর সাংবাদিকতার হাতেখড়ি। তাঁর স্মৃতিতে, ‘ফজলে লোহানী দৈনিক মিল্লাতে নিয়ে গেলেন। সম্পাদক সিকান্দার আবু জাফর জিজ্ঞেস করলেন, ‘অভিজ্ঞতা কী?’ বললাম, পশ্চিমবঙ্গের ‘সত্যযুগ’ পত্রিকায় খবর পাঠাতাম। জেলখানায় কৃষক-শ্রমিক-কমরেডদের সন্ধ্যার পর ইংরেজি পত্রিকা অনুবাদ করে শোনাতাম। ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। বার্তা সম্পাদক নুরুল ইসলাম পাটোয়ারীর কাছে পাঠালেন। তিনি বললেন, ‘কী পাস?’ ইন্টারমিডিয়েট। ‘তাহলে তো হবে না। এমএতে একজন ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট এখানে আছে।’ বললাম, অন্তত কাজ শিখি। তিন-চার দিন পরে বললেন, ‘খাতায় সই করো।’ বললাম অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার? বেতন? ‘বেতন ৭৫ টাকা। অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেওয়ার রেওয়াজ নেই।’ ১৯৫৫ সালের আগস্টে শুরু করলাম। নানা পত্রিকায় কাজ করেছি- মিল্লাত ছেড়ে অর্ধসাপ্তাহিক পাকিস্তান, আজাদ, সংবাদ।’ তবে সাংবাদিকতার সীমায় নিজেকে সীমাবদ্ধ না রেখে যোগ দিয়েছিলেন রাজনৈতিক সংগঠন অবিভক্ত ন্যাপে। বাম রাজনীতির সংশিষ্টতায় মাকর্সবাদী মতাদর্শে নিজেকে সম্পৃক্ত করে তোলেন। পাকিস্তানি শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে সংঘটিত সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামে যুক্ত থেকে বন্দী হয়েছেন। করেছেন আত্মগোপন এবং ছিলেন ফেরারিও। কিন্তু আত্মসমপর্ণের দৃষ্টান্ত রাখেন নি।আমাদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পাশাপাশি সমাজ ও রাষ্ট্র বদলের অঙ্গীকারে অবিচল কামাল লোহানী মতাদর্শিক আদর্শ বিচ্যুত হন নি।
৭.
কামাল লোহানীর সাংবাদিকতার শুরু হয়েছিল দৈনিক মিল্লাত দিয়ে। এরপর কামাল লোহানী ‘দৈনিক আজাদ’, ‘দৈনিক সংবাদ’, ‘দৈনিক পূর্বদেশ’, ‘দৈনিক বার্তা’সহ বিভিন্ন পত্রিকার কর্মরত ছিলেন। তিনি সাংবাদিক ইউনিয়নে দুদফায় যুগ্ম-সম্পাদক এবং ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি হন। সাংবাদিকতা তাঁর পেশা ছিল কিন্তু সাংবাদিক কামাল লোহানী পেশার ক্ষেত্রেও মতাদর্শে ছিলেন অবিচল। সাংবাদিক ইউনিয়ন তখন ছিল একটি। তিনি দুবার যুগ্ম সম্পাদক এবং ১৯৭০ সালে সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৭৪ সালে সভাপতিও নির্বাচিত হয়েছিলেন। সাংবাদিক ইউনিয়ন তখন সাংবাদিকদের স্বার্থরক্ষার একমাত্র সংগঠনরূপে ছিল সক্রিয়। শাসক দলের লেজুড়বৃত্তিতে নিজেদের বিকিয়ে দেবার ন্যায় ঘৃণিত অপর্কীতি থেকে সাংবাদিক ইউনিয়ন ছিল যোজন-যোজন দূরে। মতাদর্শিক ভিন্নতা থাকলেও সাংবাদিক ইউনিয়ন ছিল সকল সাংবাদিকদের মিলন ক্ষেত্র। স্বার্থরক্ষার একমাত্র আশ্রয়স্থল।
৮.
এরই মধ্যেই তাঁর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডও চলেছে। তাঁর ভাষায়, ‘১৯৬২ সালে জেল থেকে বেরিয়ে ওয়াহিদুল হককে জিজ্ঞেস করলাম, ছায়ানটের কী অবস্থা? বললেন, খুব ভালো না, নন-অ্যাকটিভ, তুমি যদি আসো তাহলে অ্যাকটিভিটি শুরু করতে পারি। সেক্রেটারি হিসেবে যোগ দিলাম। ১৯৬২-৬৫—এই সময়ে বসন্ত উৎসব, শারদ উৎসব, বর্ষা মঙ্গল করেছি। ছায়ানট সংগীত বিদ্যানিকেতনের ব্যাপারেও ভূমিকা ছিল। এটি তো এখন বিশাল আকার ধারণ করেছে। আমি থাকতেই সিদ্ধান্ত হলো, বিদ্যানিকেতনের পরীক্ষার রেজাল্ট পহেলা বৈশাখে দেওয়া হয়, তাতে ফল প্রকাশের দিনে বর্ষবরণ ঠিকভাবে হয় না। সিদ্ধান্ত নিলাম, আলাদাভাবে বর্ষবরণ করব। পরীক্ষার রেজাল্ট অন্য সময় দেব। ফলে ১৯৬৭ সালের এপ্রিলে রমনা বটমূলে বর্ষবরণ শুরু হলো। তার আগেই ১৯৬৬ সালের শেষদিকে ছায়ানট ছেড়ে গেলাম। সংগঠনের সঙ্গে রাজনৈতিক মতবিরোধ দেখা দিল। ছায়ানট কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু আমি চীনাপন্থী, ওরা মস্কো। ফলে আলাদা হয়ে গেলাম।’ ১৯৬৭ সালের ২১-২৩ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানে তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠীর জন্ম হলো। এই সংগঠন মার্ক্সবাদী গণসাংস্কৃতিক ফ্রন্ট। ব্যারিস্টার হাসান পারভেজ প্রেসিডেন্ট হলেন আর তিনি সেক্রেটারি। ১৯৬২ সালে স্বল্পকাল কারাবাসের পর কামাল লোহানী ‘ছায়ানট’ সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সাড়ে চার বছর এই দায়িত্ব পালন করেন। এরপর মার্কসবাদী আদর্শে ১৯৬৭ সালে গড়ে তোলেন ‘ক্রান্তি’।
৯.
বিশিষ্ট নৃত্যগুরু জি.এ মান্নানের একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণের মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতায় নাচ শিখতে আগ্রহী হন এবং জি.এ মান্নানের কাছে নাচের তালিম নেন। জি.এ মান্নানের পরিচালনায় বুলবুল একাডেমির “নকশি কাঁথার মাঠ” নৃত্যনাট্যে অংশগ্রহণের মাধ্যমে নিজেকে নৃত্য শিল্পী হিসেবে গড়ে তোলেন। এই নৃত্যনাট্যের দলের সাথে পশ্চিম পাকিস্তান সফর করেন। ১৯৬১ সালে সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দলের সদস্যরূপে সফর করেন ইরাক ও ইরান। প্রবল রাষ্ট্রীয় বিরোধীতার পরও ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালনে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কর্মীদের নিয়ে সাংগঠনিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। রবীন্দ্র শতবর্ষ পালনে শ্যাম নৃত্যনাট্যে তিনি বজ্রসেনের ভূমিকায় অংশ নিয়ে অগণিত দর্শক প্রশংসা পেয়েছিলেন। আপন চাচাতো ভাই ফতেহ লোহানীর “আসিয়া” চলচ্চিত্রে কামাল লোহানী নাচের দৃশ্যে অংশ নিয়েছিলেন। সে ছবির নায়কের কিশোর বয়সের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। ষাটের দশকে পণ্ডিত বারীণ মজুমদার প্রতিষ্ঠা করেন “মিউজিক কলেজ”। এই মিউজিক কলেজ প্রতিষ্ঠার পেছনে কামাল লোহানী সক্রিয় অংশ গ্রহণ ছিল কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক কোন পদে তিনি ছিলেন না। পণ্ডিত বারীণ মজুমদারের একক প্রচেষ্টায় ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটে প্রথম পাকিস্তান সঙ্গীত সম্মেলনেও কামাল লোহানী সম্পৃক্ত ছিলেন। ঢাকা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ওস্তাদ আলাউদ্দিন সঙ্গীত সম্মেলনে কামাল লোহানী অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা, শিল্পী সংগ্রহ, উপস্থাপনাসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯৬২ সালে ছাত্রদের সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন দাবানলের ন্যায় দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল। সামরিক শাসক শক্ত হাতে আন্দোলন ঠেকাতে গণগ্রেফতার শুরু করে। দৈনিক আজাদে কর্মরত অবস্থায় পত্রিকা অফিস থেকে ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬২ গ্রেফতার করা হয় কামাল লোহানীকে।
[hfe_template id=’81’]
১০.
পাবনা জেলা স্কুলে শেষ বর্ষের ছাত্র থাকা অবস্থায় ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে কামাল লোহানীর রাজনীতিতে হাতেখড়ি। ১৯৫৩ সালে নুরুল আমিনসহ মুসলিম লীগ নেতাদের পাবনা আগমন প্রতিরোধ করতে গিয়ে তাকে জেলেও যেতে হয়। মুক্ত হতে না হতেই আবার ১৯৫৪ সালে গ্রেফতার হন কামাল লোহানী। সেই সময় তিনি কমিউনিস্ট ভাবাদর্শে দীক্ষিত হন। পরের বছর আবার গ্রেফতার হয়ে কারাগারে যাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে একই কারাকক্ষে তার বন্দিজীবন কাটে। ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের ২৬ নম্বর সেলে বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন আহমদ, আবুল মনসুর আহমেদ, রণেশ দাশগুপ্ত, তফাজ্জল হোসেন (মানিক মিয়া), কফিল উদ্দিন চৌধুরী, অধ্যাপক রফিকুল ইসলামসহ ছাত্রনেতাদের মধ্যে শাহ মোয়াজ্জেম, শেখ ফজলুল হক মণি, হায়দার আকবর খান রনো, শ্রমিক নেতা নাসিম আলী প্রমুখ বন্দীদের সাথে কামাল লোহানী একত্রে ছিলেন। প্রায় চারমাস কারাভোগের পর তিনি মুক্তি পান। যোগ দেন দৈনিক সংবাদে। এরপর ১৯৬৬ সালে পাকিস্তান ফিচার সিন্ডিকেট এবং ১৯৬৯ সালে দৈনিক পয়গাম-এ যোগ দিয়ে কয়েকমাস পরে দৈনিক পূর্বদেশে যোগ দেন। ১৯৭০-নির্বাচন পরবর্তী যোগ দেন ফয়েজ আহমদ সম্পাদিত সাপ্তাহিক স্বরাজ-এ। ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্টে বাঙালি সৈনিকদের বিদ্রোহ প্রসঙ্গে তাঁর রচিত সাহসী প্রতিবেদন “বিদ্রোহ ন্যায় সঙ্গত” প্রকাশের পর চারদিকে হৈ চৈ পড়েছিল। সাংস্কৃতিক শিল্পী, কর্মী, সংগঠকদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সংঘবদ্ধ করে “বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ” গঠনেও তাঁর অগ্রণী ভূমিকা ছিল। ২৫ মার্চ পাকিস্তানিদের গণহত্যা শুরু হলে তিনি আগরতলা যান এবং সেখান থেকে ফুটবলার প্রতাপ শঙ্কর হাজরাসহ একত্রে কলকতায় গমন করেন। কলকাতা থেকে প্রকাশিত জয় বাংলা পত্রিকায় যুক্ত হলেও; আমিনুল হক বাদশার অনুপ্রেরণায় স্বাধীন বাংলা বেতারে যোগ দিয়েছিলেন। স্বাধীন বাংলা বেতারের সংবাদ বিভাগের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি আবৃত্তি, সংবাদ পাঠ, কথিকা রচনা-পাঠ, ঘোষণা ইত্যাদি প্রচারে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
১১.
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে জড়িত হওয়ার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এই শব্দসৈনিক বলেছিলেন, ‘আমহার্স স্ট্রিটে উঠেছি। ছেলের ১০৩-৪ ডিগ্রি জ্বর। ওকে রেখেই বেরিয়ে গেলাম। পার্ক সার্কাস স্ট্রিটের ফুটপাতে আমিনুল হক বাদশার সঙ্গে দেখা। ‘কামাল ভাই এসেছেন? চলেন এক জায়গায় যাই’—বলে বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে নিয়ে গেলেন। আপেল মাহমুদ, আব্দুল জব্বার তো দেখেই দুই নম্বর স্টুডিওতে বসে বাপ-মা তুলে গাল দিয়ে বলল, ‘সই কর’।২৫ মে বিদ্রোহী কবির জন্মদিনে বেতারের অধিবেশন শুরু হলো। যেহেতু নিউজের দায়িত্বে ছিলাম, ইংরেজি-বাংলা নিউজ লিখতে হতো। প্রথম বাংলা নিউজটি পাঠ করলেন সালেহ আহমেদ (সৈয়দ হাসান ইমাম)। ইংরেজিটি আবু নঈম (আসল নাম আবু নঈম মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল খান লোহানী) নামে আমি। নিউজ ছাড়াও বঙ্গবন্ধুর ভাষণের অংশ নিয়ে ‘বজ্র কণ্ঠ’ পাঠ হতো, স্লোগান, গান, কথিকা থাকত। কল্যাণ মিত্রের লেখা ধারাবাহিক নাটক ছিল ‘জল্লাদের দরবার’। এম আর আখতার মুকুলের ‘চরমপত্র’ খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। তিনি বিক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলতেন, নানা অঞ্চলের ভাষা ব্যবহার করতেন। লিখতেনও খুব সুন্দর। এটি বেতারের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রোগ্রাম ছিল। জুলাই-আগস্টে বেতারের শিল্পী-কলাকুশলী, যন্ত্রীরা সিদ্ধান্ত নিল পদমর্যাদা, বেতনের হারের দাবি করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দেবে। এ নিয়ে আমাদের সঙ্গে তাদের বিরোধ হলো। রাজনীতিসচেতন আমরা দুই-একজন জানতাম, মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া মানে কাজ করব, থাকব, খাব; এখানে বেতনের ব্যাপার নেই, অফিশিয়াল মর্যাদার কিছু নেই। আমরা সবাই এক। জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ—সব করতে হবে। কিন্তু যাঁরা রাজনৈতিকভাবে চিন্তাভাবনা করেননি, তাঁরা পদমর্যাদা ও বেতন দাবি করে বসলেন। এ জন্য তিন দিন কর্মবিরতিও পালন করলেন। যেহেতু সমর্থন করলাম না, ফলে তিন দিন পরে বেতার চালু হলো। এই তিন দিন কিন্তু সংবাদ, কোরআন তেলাওয়াত, বজ্র কণ্ঠ, গান সব প্রচার হয়েছে। পরে অবশ্য বেতন কাঠামো ঠিক হয়েছিল। রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধারা ক্লান্তিবোধ করলে মাঝেমধ্যে কলকাতা আসতেন। আলাপ-দেখা হতো, অনেকেই তো বন্ধু ছিল। তাদের কাছ থেকে খবর সংগ্রহ করতাম। ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর হেড কোয়ার্টার ফোর্ট উইলিয়াম থেকে নির্দেশ এলো—জোরালো গান বাজাও, স্লোগান বাজাও। বাজানো শুরু হলো। মনে হলো, তাহলে কি আলোচনা শুরু হয়েছে? তাদের ওয়্যারলেস কথোপকথন ধরার জন্য কয়েকজন মিলে রেডিও মনিটরিং শুরু করলাম। টানা চেষ্টার পর চার দিনের দিন একটি বেতার তরঙ্গের মাধ্যমে ধরে ফেললাম, জেনারেল অরোরা আর নিয়াজির মধ্যে আলোচনা চলছে। এর মধ্যেই ইংরেজি লিফলেট দিয়ে বলা হলো, এটি বাংলা, উর্দু করে দেবে। লিফলেটের মূল কথা—অস্ত্র সমর্পণ করো। তৈরি করে দিলাম। হেলিকপ্টারে পুরো পূর্ব পাকিস্তানে ছড়াল।’
১২.
স্বাধীনতার পর দ্রুত ফিরে আসেন ঢাকায়। মুজিবনগর সরকারের ঢাকা প্রত্যাবর্তনের রেডিও’র ধারাবিবরণী এবং ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ধারাবিবরণীও কামাল লোহানী এবং আশফাকুর রহমান খান দিয়েছিলেন। বাংলাদেশ বেতারে যোগ দিয়েছিলেন কিন্তু বিগত আমলের প্রশাসনিক পরিবর্তন না হওয়ার প্রতিবাদে বেতার ছেড়ে পুনরায় সাংবাদিকতায় ফিরে আসেন। যোগ দেন দৈনিক জনপদে। ১৯৭৪ সালে সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হন। জনপদ ছেড়ে দৈনিক বঙ্গবার্তায় যোগ দেন। সাংবাদিক ইউনিয়ন আয়োজিত সাংবাদিক আবেদ খান রচিত “জ্বালামুখ” নাটকের নির্দেশনা-অভিনয়ও করেছিলেন তিনি। ঐ বছরই দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য পূর্ব জার্মান, হাঙ্গেরি এবং চেকোশ্লোভাকিয়া সফর করেন। ১৯৭৫-এর ১৬ জুন সংবাদপত্র অ্যানালমেন্ট অধ্যাদেশ জারি করে মাত্র চারটি পত্রিকা বাদে অন্য সকল পত্রিকা প্রকাশ বন্ধ করে দেয়া হয়। নির্মল সেন এবং কামাল লোহানী বাকশালে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানায়। চাকরিহারা অবস্থায় অত্যন্ত দৈন্য দশায় তাকে পড়তে হয়েছিল। ১৯৭৭ সালে রাজশাহী থেকে প্রকাশিত দৈনিক বার্তা-র নির্বাহী সম্পাদকের চাকুরী নিয়ে ঢাকা ত্যাগ করেন। ১৯৭৮ সালে দৈনিক বার্তার সম্পাদক নিযুক্ত হন। জাম্বিয়ার রাজধানী লুসাকাতে অনুষ্ঠিতব্য কমনওয়েলথ রাষ্ট্রপ্রধান সম্মেলনে অংশগ্রহণে মনোনীত হলেও; জেনারেল জিয়ার সামরিক সচিবের প্রস্তাবানুযায়ী চিরন্তন পরিধেয় পায়জামা-পাঞ্জাবি পরিহার করে স্যুট-কোট, টাই পরতে অস্বীকার করেন। সামরিক সচিবের সঙ্গে তুমুল বিতর্কের পর স্বইচ্ছায় বিদেশ যাওয়া পরিত্যাগ করেন।
১৩.
১৯৮১ সনে তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে মতবিরোধে দৈনিক বার্তার সম্পাদক পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে যোগ দেন বাংলাদেশ প্রেস ইন্সটিটিউট-এর প্রকাশনা পরিচালক ও ডেপথ নিউজ বাংলাদেশ-এর সম্পাদক হিসেবে। এর ক’মাস পর পিআইবির অ্যাসোসিয়েট এডিটর পদে নিযুক্ত হন। ১৯৯১ সালে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক রূপে ১৬ মাস অতিবাহিতের পর বিএনপি সরকারের তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে মতবিরোধে তিনি শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের পদ ছেড়ে পিআইবিতে ফিরে আসেন। কিন্তু সরকারের ইঙ্গিতে পিআইবির মহাপরিচালক তাকে জোরপূর্বক অবসরে পাঠিয়ে চাকুরীচ্যুত করে। রাজনৈতিক অভিযাত্রার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকায় বরাবর অবতীর্ণ ছিলেন। ২০০৮ সালে দুই বছরের চুক্তিভিত্তিক শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন।
১৪.
এক সাক্ষাৎকারে অকপটে কামাল লোহানী নিজের কথা বলেছিলেন এভাবে-
নিজের সম্পর্কে আমার যে বিশ্বাসটি খুব প্রবল :
-কাজ। সেই বংশাল মসজিদের এক রুমে কাঠের চৌকিতে দৈনিক মিল্লাত দিয়ে সাংবাদিকতা জীবন শুরু। এখনও কাজ করছি। কাজই আমার জীবন।
শৈশবে যে মানুষটিকে নায়ক মনে হতো :
-এমন কাউকে তো মনে পড়ছে না। তবে ফজলে লোহানীকে খুব ভালো লাগত।
ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য যে জিনিসটি খুব বেশি প্রয়োজন :
-সততা। তবে বর্তমান সময়ে সৎভাবে বাঁচাটা একটু কঠিন, অসম্ভব নয়। বর্তমান পৃথিবীতে সততা ও মেধার মূল্য কম। অসততা, অপকৌশলের মূল্য বেশি।
[hfe_template id=’81’]
যে অপ্রাপ্তিটা মাঝেমধ্যে বিষণ্ন করে :
-কই, কোনো অপ্রাপ্তি তো দেখি না। যা হতে চেয়েছিলাম, হয়েছি।
আমার সাফল্যের পেছনে প্রধান তিনটি কারণ :
-এমন কিছু ভাবিনি। তবে অধ্যবসায় ও সততা সাফল্যের আসল কথা।
যে উপদেশটি সবসময় মেনে চলার চেষ্টা করি :
-সাংবাদিকতায়, লেখনীতে, কথনে মানবসেবা।
আনমনে যে গানটি গুনগুন করে গাই :
-গান তো কতই মনে আসে। মনে মনে গাইও। এখন মনে পড়ছে না। তবে বেশিরভাগ সময়ে মান্না আর ভূপেন হাজারীকার গান মনে পড়ে।
আমার যে গুণটির কথা অনেকেই জানে না :
-গুণ নয়, এটাকে বদ অভ্যাস বলা যায়। আমি ঘরে ম্যানিব্যাগ রেখে আর খুঁজে পাই না। পরে ঘরের কেউ খুঁজে দেয়।
সুযোগ পেলে যে অভ্যাসটি বদলাতে চাই :
-বদলানো নয়। তবে অতীতে ফিরে যেতে পারলে সবকিছু আরও মসৃণভাবে করতাম।
প্রায়ই খুব ইচ্ছে করে :
-সেই সাংবাদিকতার শুরুর দিনগুলোর কথা। সেখানে যদি ফিরে যাওয়া যেত। হোটেলে খাওয়া, মনের হরষে রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো, অবশেষে কাঠের চৌকিতে হাত-পা ছড়িয়ে দেওয়া।
যে স্মৃতিটা কখনও ভোলা যায় না :
-আমার ছেলে সাগর লোহানীর জন্মদিনের কেক কেনার টাকা নেই। ১৯৬৬ সাল তখন, পাকিস্তান ফিচার সিন্ডিকেটে চাকরি করি। ৩০ জানুয়ারি আমার ছেলে সাগর লোহানীর জন্মদিন। বেকারিতে কেকের অর্ডার দিয়েছি। বাড়িতে মেহমানরা সব চলে এসেছে। আমি কেক নিয়ে বাড়ি ফিরলে কেক কাটা হবে। কিন্তু তখনও আমার টাকা জোগাড় হয়নি। অবশেষে টাকা জোগাড় করতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল।
সারাদিনের ক্লান্তি শেষে ঘুমানোর আগে যে কথাটি মনে হয় :
-আরও একটি দিন জীবন থেকে চলে গেল।
১৫.
আরেক সাক্ষাৎকারে তিনি অকপটে স্বীকার করেছেন জীবনের না বলা কথাগুলো, এভাবে –
কবে প্রথম টাকা উপার্জন করেছেন ?
-১৯৫৬ সালের সেপ্টেম্বরের ১৫ তারিখ। আগস্ট মাসের বেতন পেয়েছিলাম।
কত টাকা?
-৮০ টাকা। দৈনিক মিল্লাতে কাজের বেতন।
প্রথম উপার্জিত টাকা দিয়ে কী কিনেছেন?
-সাড়ে ৩ টাকা দিয়ে একটা চৌকি কিনেছিলাম। বংশালে একটা মসজিদে থাকতাম। তার ভাড়া আর নিয়মিত খাওয়ার হোটেলে কিছু টাকা দিয়েছিলাম।
দিনের শুরুতে কত টাকা সঙ্গে রাখেন?
-এই ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা।
হাইজ্যাকারের মুখোমুখি হয়েছেন কখনও?
-কয়েকবার। ধানমণ্ডি লেকের পাশে একদিন ৮ নাম্বার ব্রিজের পাশ দিয়ে আসছিলাম। এক লোক রাস্তা আগলে হাতে থাকা একটা আংটি আর আমার পকেটে থাকা ৩৭৫ টাকা নিয়ে ৭৫ টাকা ফেরত দিয়ে বলল, এটা আপনার রিকশা ভাড়া। আংটিটা খুব স্মৃতিবিজড়িত ছিল। আমার স্ত্রী দীপ্তি লোহানীর বাবা তাকে ১৯৩০ সালের দিকে একটা আংটি বানিয়ে দিয়েছিলেন। সেই আংটিটা আবার আমাদের কলেজ জীবনে যখন পরিচয় হয়, পরিচয়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে আংটিটা নিজের হাত থেকে খুলে দীপ্তি আমার হাতে পরিয়ে দিয়েছিল।
এ পর্যন্ত আপনার সেরা অপচয় কোনটি?
-আমি তো অপচয় করি না। তবে গিন্নি বেঁচে থাকলে ভালো বলতে পারত।
কত টাকার নোট আপনার প্রিয়?
-৫০০ টাকার। জিনিসপত্রের দাম যা বেড়েছে, ৫০০ টাকার কমে তো কিছুই হয় না।
সম্প্রতি সবচেয়ে বেশি টাকা দিয়ে কী কিনেছেন?
-৩৫ হাজার টাকা দিয়ে দুটি বইয়ের সেলফ কিনেছি।
কী পরিমাণ টাকা থাকলে আপনি স্বস্তিবোধ করেন?
-নির্দিষ্ট পরিমাণ বলাটা মুশকিল। কারণ পকেটে কত টাকা থাকবে তা অবস্থার ওপর নির্ভর করে। তবে স্বাধীনভাবে খরচ করার মতো টাকা পকেটে থাকলে স্বস্তিবোধ করি।
টাকা নিয়ে কোনো মজার ঘটনা বলুন-
-টাকা নিয়ে গিন্নির সঙ্গে প্রায় খুনসুটি লাগত। বেতন পেয়ে টাকা আমার কাছেই রাখতাম। সেটা আবার কখনও বিছানার তোশকের নিচে, সোফার গদির নিচে কিংবা বালিশের নিচে। টাকা পাচ্ছি না বললে সে প্রথমে খুঁজে বের করত। তার পর রেগে যেত।
[hfe_template id=’81’]
টাকা ধার করার স্মৃতি বলুন-
-আমার জীবনে অনেক টাকা ধার করার স্মৃতি আছে। অনেক বন্ধু-বান্ধবের কাছে টাকা ধার করেছি। কারোটা ফেরত দিয়েছি, কারোটা আবার দেইনি। প্রথম সংসার পাতার পর টাকার খুব টানাটানি চলত। যদিও আমরা দু’জনেই চাকরি করতাম, তারপরও হতো না। বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে ধার করতে হতো।
কোন জিনিসটি দেখলেই মনে হয় কিনি ?
-বই। বই। বই। বিশেষ করে স্মৃতিকথা ও রাজনৈতিক বই।
প্রথম জমিয়েছিলেন কত টাকা কীভাবে ?
-টাকা জমানোর অভ্যাস ছিল না কোনো কালেই।
টাকার জন্য দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে কী করেন?
-টাকা নিয়ে জীবনে একবারই দুশ্চিন্তায় পড়েছিলাম। ১৯৬০ সালের দিকে বিয়ের পর পর। তবে উতরে গেছি।
প্রচুর উপার্জনে আপনার পরামর্শ কী?
-প্রচুর উপার্জনে আমার কোনো পরামর্শ নেই। কারণ দুর্নীতি ছাড়া প্রচুর উপার্জন সম্ভব নয়। এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলি, বর্তমান পৃথিবীতে মেধার মূল্য কম। অপকৌশলের মূল্য বেশি।
১৬.
বরেণ্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধা, আলোকিত এই মহান মানুষের স্মৃতির প্রতি আবারো জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
(তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, দৈনিক প্রথম আলো, দৈনিক সমকাল, দৈনিক আজাদী : মযহারুল ইসলাম বাবলা, দৈনিক কালের কণ্ঠ, ইন্টারনেট)