কাজী রাফি
কথাশিল্পী,
ইয়ামাসুক্রো বিমানবন্দর হয়ে পশ্চিম আফ্রিকার এই দেশটিতে প্রবেশের দিনে প্রকৃতির মাঝে এমনকি শহর অথবা গঞ্জে, রাস্তার পাশে বসা ক্ষণিক এক বাজারে, আকাশে-বাতাসে, বনের মাঝে মুখ লুকিয়ে থাকা কোনো খাল অথবা নদীতে -সর্বত্র ‘নির্জন’ আর ‘ক্ষণিক’ শব্দ দুটি অরিত্রের সমগ্র সত্তা কাঁপিয়ে দিয়েছিল। বাবা-মা’কে খুব মনে পড়ছিল। বিস্তৃত ফাঁকা রাস্তা জুড়ে তাদের বহনকারী কোস্টারটি চলার পথে জনপদ কমই পেল। রাস্তার দুপাশের নির্জন বনানির ভেতর প্রাচীনত্ব পেরিয়ে দৃষ্টি আটকে যায় দূর আকাশের প্রান্তে। প্রায় মেঘের কাছে ভেসে থাকা সারি সারি পাহাড়ের অসীম নির্জনতায়। কোস্টারের ভেতর ভিন্ন ভিন্ন দেশের মানুষগুলোর মুখেও কুলুপ আঁটা। যেন তারা কোনো তীর্থযাত্রী। মেধাবী অথচ নীরিহ ধাঁচের অরিত্র আগ্রহভরে রাস্তার পাশে বসা কাঁচা বাজারে চোখ রেখে প্রাণস্পন্দন ফিরে পেতে চাইলেও তার প্রাণ-পিঞ্জিরায় বেঁধে রাখা এক স্বপ্ন-পাখি যেন পাখা ঝাপটিয়ে উড়তে গিয়েও থেমে গেল। অরিত্র তার হৃৎস্পন্দনের দু একটা বিট মাঝ মাঝেই হারিয়ে ফেলল।
রাস্তার পাশে বাজারে বিপননের যেসব সামগ্রি তার বেশীর ভাগই শিকড়-জাত। অপেক্ষাকৃত উঁচু স্থানের গাছ-ঘাস পুড়িয়ে তারপর পরিস্কার করে বসা বাজারে মোজাম্বি, কমলা –এই ধরণের লেবুজাতীয় ফলের সাথে দুই/তিন ফুট লম্বা পাউরুটি দেখে অরিত্রের বিস্ময়ের সীমা থাকে না। বাদাম-সীম আর বীজ জাতীয় খাবারের ব্যাপারে এই জাতীটি যে দুর্বল – বাজারে বিক্রির জন্য আনা খাবারগুলোতে দৃষ্টিতে রেখে তা উপলব্ধ হয়। বাজার করতে আসা নারীদের শরীরে ঝোলানো কোনো নবজাতক, তাদের অনেকেরই প্যাচানো কাপড় দিয়ে বুক আর নাভি হতে হাঁটু পর্যন্ত ঢাকা। নারীদের পরনের কাপড়ে এমনকি তাদের জীবনাচরণে ‘ক্ষণিক’ শব্দটির অস্তিত্ব অরিত্রকে পশ্চিম আফ্রিকায় পদার্পণের প্রথম দিনেই অস্থির করে তুলেছিল। বাজারের এই ক্ষণিক দৃশ্যগুলো অরিত্রকে ‘ক্ষণিক’ জীবনের কথা মনে করিয়ে দেয়। যাত্রারত কোস্টারটিকে তখনই উল্টা ঘুরিয়ে নিয়ে তার দেশে ফিরে যেতে ইচ্ছা করেছিল। ভেতর থেকে কে যেন তাকে প্রশ্ন করেছিল, ‘ছোট্ট এই জীবনে তাহলে তোমার প্রিয় চেনা জগত আর বাবা মা-কে কয়দিনই বা পাওয়া হবে?’ বাসা থেকে বের হওয়ার সময় মা’র ক্রন্দনরত দৃষ্টিটা এখনো তার চোখে ভাসছে। ‘ভালো চাকরি অথবা ভালো জীবনের নামে অরিত্র ‘ক্ষণিক’ এই জীবনটাকে অর্থহীন করতে যাচ্ছে তাহলে?’ -তার ভেতরে এমন প্রশ্নগুলো আনাগোনা করে ।
কিন্তু অরিত্রের এই কষ্টকর অনুভূতিতে ভালো লাগার প্রলেপ হয়ে তাকে এই বিদেশ-বিভূঁইয়ে টিকে থাকার জন্য প্রেরণা হয়ে প্রথম দিনেই হাজির হয়েছিল অরোরা। কোস্টার থেকে নামার পর অরিত্রকে বহনকারী জিপটা যখন নির্জনতর এক মহাসাগরের লেগুনে গড়ে ওঠা বাণিজ্যিক এক রাজধানীর বুকের যত ভেতরে প্রবেশ করছে অরিত্রের কাছে বহমান এই জনতাকে, আকাশের দিকে মুখ তোলা এই দালান-কোঠা আর তার ফাঁকে ফাঁকে টলটল জলের খালের সাথে সবুজ গাছ-পালাকে তত অচেনা মনে হচ্ছে। জিপটা একতলা এক ভবনের সামনে থামলে অরিত্রের সামনে এই প্রথম কোনো মানুষ এসে মিষ্টি করে হাসল। সেই মানবি তার হাসির সাথে তার দিকে একগুচ্ছ গোলাপ, অর্কিড আর বিচিত্র বর্ণের সব ফুলের বড় তোড়া এগিয়ে দিয়ে বলল, “স্বাগতম। আমি অরোরা।“
অরিত্র ঠিক শুনেছে কি না বুঝল না। অরোরা! মেইলে সে শুধু মি. মাতোমার সাথে যোগাযোগ করেছে। সে ধরেই নিয়েছিল এই দেশটায় আসার পর যার সাথে তার প্রথম দেখা হবে তিনি মি. মাতোমা। সে কি তার সামনে দাঁড়ানো বিষন্ন আর ভেজা ভেজা পাপড়ি দিয়ে মোড়ানো বিস্ময়কর সৌন্দর্যের কাজল আঁকানো চোখের এই নারীর মুখ থেকে উচ্চারিত ‘অরোরা‘ শব্দটি শুনল? বিমান থেকে নামার পর ভিনগ্রহের এক প্রাণীর মতো তার আত্মা চুপসে গিয়েছিল। কিন্তু তার নামের পাশে খুব যুঁতসই একটি নাম এই ভিনগ্রহে এসে শোনার পর তার চুপসে থাকা আত্মা কৌতূহল মুখরিত হয়ে উঠল। সে তার স্বভাবজাত নীরিহ মুখে স্মিত হেসে ফুটিয়ে কৃতজ্ঞতাভরে ফুলের তোড়া গ্রহণ করে বলল, “ধন্যবাদ ম্যাম। আমি অরিত্র, অর্থ সম্পদ বিভাগে… “
অরোরা তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল, “ইয়াহ, আই নো। আমার পাশের অফিসটাতে তুমি বসবে। গ্লাড টু গেট ইউ ইন মাইন ডিপার্টমেন্ট।“ অরোরা তাকে তার আবাসস্থল দেখিয়ে, তার ঘরে নিয়ে গিয়ে অরিত্রকে একটা ল্যান্ডফোন দেখিয়ে বলল, “হ্যান্ডসেটে আমাদের বিভাগের সকলের ফোন নাম্বার সেঁটে দেয়া আছে। তুমি ফ্রেশ হয়ে আমাকে ফোন করো। মি. মাতোমা একজন রাষ্ট্রদূতের নিমন্ত্রণে আছেন। সুতরাং আমরা দুজন একসাথে ডিনার করব।“
একই ধাঁচে গড়া পাশের আবাস্থলটিতে অরোরা বাস করে। কিন্তু অরোরার আবাসটা আটলান্টিকের লেগুনের সাথে লাগোয়া। অরিত্রের মনে হলো, যে কারণে অরোরার আবাসটি অনন্য তা হলো তার ছাদ-ঘর। বাঁকানো সিঁড়ি বেয়ে অরোরা অরিত্রকে নিয়ে তার ছাদ ঘরে গিয়ে বসল। এখানেই ডিনারের জন্য পরিচারক টেবিলে বিভিন্ন পদের খাবার সাজিয়েছে। মৃদু আলোয় খাবার টেবিলে দুজন মুখোমুখি বসলেও অরিত্র কেন যেন অরোরার কাজল আঁকানো চোখ দুটির নীরিহ মায়ায় তাকাতে গিয়ে নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হলো। অরোরার শরীরে প্রাচ্যের পোষাক। কিছুটা রক্ষণশীল এই পোষাকের জন্যই অরোরাকে তার খুব চেনা মনে হয়েও তার পাশ্চাত্যের ধাঁচের শারিরীক গড়নের কারণে সাথে সাথে আবার তাকে অচেনা মনে হচ্ছে।
চেনা-অচেনার ঘোর না কাটতেই সাগর ঢেউয়ের গর্জন তার কাছে নতুন নস্টালজিয়া হয়ে অরিত্রকে আনমনা করে ফেলল। তার মনে হলো, সে যেন এক স্বপ্ন দেখছে। কৈশোরে স্বপ্নে দেখা সেই পরী আজ তাকে এমন এক স্থানে এনেছে যার অস্তিত্ব বাস্তব পৃথিবীতে হয়তো নেই। এই মায়াবী আলোর নিচে, উঁচুতে সুরক্ষিত কোনো স্থান থেকে এভাবে এক মহাসাগরের অবারিত জলরাশির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে তার ফেনিল গর্জনের মাঝে সারারাত কাটিয়ে দেয়ার স্বপ্ন-কল্পনায় সে ভেসেছে। আর তার কৈশোর-স্বপ্নে দেখা পরীসহ সেই কল্পনা এত বাস্তব হয়ে তাকে স্বপ্নাচ্ছন্নতায় ডুবিয়ে দিয়েছে যে, অরিত্রের বার বার এটাকেও এক স্বপ্ন বলে ভুল হচ্ছিল। তাই সে সন্তর্পণে অরোরার দিকে এমন করে তাকাচ্ছিল যেন তার দিকে ভালো করে তাকালেই সে হারিয়ে যাবে!
প্রথম রাতে যাত্রাক্লান্ত অরিত্রের সাথে খাবারের বাইরে শুধু তাদের ব্যক্তিগত আর পারিবারিক পরিচয় পর্ব সমাপ্তি শেষে অরোরা বলল, “আজ লম্বা একটা ঘুম দাও। কাল আটটা ত্রিশে তোমাকে নিয়ে অফিসের উদ্দেশে বের হব। আগামিকাল তোমাকে অফিসের কাজের পরিবেশ, ধরণ আর পারিপার্শ্বিক অবস্থা ইত্যাদি বিষয় ছাড়াও স্টাফদের সাথে পরিচয় করানো আমার দায়িত্ব।“
অরোরার কথা শুনে অরিত্র ভেতর থেকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। এই অচেনা পরিবেশে একদল প্রতিভাধর মানুষদের সামনে তার সাথে খুব অচেনা তবু কেন যেন খুব চেনা অরোরা থাকবে ভাবতেই এই স্বস্তিবোধ। সে তার ভেতরের অনুভূতির কিছুই প্রকাশ না করলেও তার কৃতজ্ঞতায়ভরা দু চোখের ভাষা অরোরা পড়ে ফেলল। অরিত্র তাকে প্রায় অস্ফুট স্বরে শুধু বলল, “ধন্যবাদ। অনেক ধন্যবাদ…“
নতুন কাজের পরিবেশ আর এতগুলো নতুন মুখকে সামলানোর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় সারারাত অরিত্র প্রায় ঘুমাতে পারল না। সকালে অরোরার এসে পৌঁছানোর এক ঘণ্টা আগেই সে সাদা-কালো ডোরার শার্ট, কালো প্যান্ট-বেল্ট আর পালিশ করা কালো জুতা পরে বসে ছিল। অরোরা জিপ চালিয়ে তাকে তার পাশের আসনে বসিয়ে অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “ কী হয়েছে অরিত্র? অ্যানি বাড নিউজ? অরিত্র দ্রুত স্বাভাবিক হওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “ন… নোপ। ইটস ওকে।“
“সারারাত মনে হয় ঘুমুতে পারো নি। চোখের কোণে দুশ্চিন্তার ছাপ পড়েছে…“
[hfe_template id=’81’]
“আসলে এই প্রথম দেশের বাইরে এসেছি তো!“ কথাটা বলামাত্র অরিত্রের হার্টের একটা স্পন্দন যেন হারিয়ে গেল। তার মনে হলো, নতুন এই কর্মস্থলের মুখোমুখি হওয়ার চেয়ে দেশে ফিরে গেলেই ভালো হয়। অরোরা এমন শান্ত ভঙ্গিতে কথা বলা এত নীরিহ তরুণ কোনোদিন দেখে নি। যে বলার চেয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে শোনে। অরোরা অফিসে পৌঁছাতে পৌছাতে তার আরো একটি বৈশিষ্ট্যে লক্ষ্য করল। অরোরা খেয়াল করল, অরিত্র তার কথা শোনার সময় চোখের অক্ষিগোলককে চোখের এক কোণে নিয়ে এমন করে তাকায় যা তার নীরিহ আর নির্মলতার প্রতি যে কারো মনোযোগ আকর্ষণ করে। অরিত্রের এমন আবিষ্ট হয়ে কথা শোনার ধরনে অরোরার কিসের যেন এক মায়া জন্মাল।
অরোরাই তার পরবর্তী উর্ধ্বতন কর্তা – অফিসে গিয়ে এই তথ্য জানার পর অরিত্র আনন্দিত হয়ে উঠল। আর এই ভেবে অবাক হলো যে, সেই অরোরাই তাকে আপ্যায়নই শুধু নয় তার কাজগুলো নিঁখুতভাবে বুঝতে সাহায্য করেছে। এরপর নয়টা-পাঁচটা অফিসের কাজের পরম্পরা নিয়ে সংস্থাটিতে নতুন আগত অফিসারদের সাথে প্রশিক্ষণ নিতে নিতে কখন কেটে গেল একটা সপ্তাহ। অরোরা এমন এক প্রশিক্ষণার্থিকে পেল যে তার প্রশিক্ষকের প্রতিটি নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। এক সপ্তাহ পর একটা কাজের আবর্তে ফেলে অরিত্রের প্রাপ্ত প্রশিক্ষণের মান যাচাই করার পর অরোরা বলল, “প্রতিভাবানদের চোখে এক ধরণের বিনয় থাকে। নিজেকে প্রকাশে অথবা তাদের অভিব্যক্তিতে তারা নীরবতা ধারণ করে রাখে সেই বিনয়টুকুকে হয়তো হারিয়ে না ফেলার জন্য। ইউ আর রিয়েলি ট্যালেন্ট! ইউ ডিড দ্য বেস্ট।“
এবং সফলভাবে প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করায় প্রশিক্ষক খুশি হয়ে তার প্রশিক্ষণার্থিকে পুনরায় নৈশভোজে নিমন্ত্রণ করল। অরোরা মনে মনে পরিকল্পনা করল, তার ছাদ-ঘরে নৈশ-ভোজের সময় সে আজ অরিত্রকে অনেক কথা বলিয়ে নিবে। যেন প্রতিভাবান এই তরুণ তার সাথে বলায় এবং চলায় আরো সহজ হয়। তার সাথে আড্ডায় অথবা কথা বলায় হয়ে ওঠে অবারিত।
সন্ধ্যার পর অরিত্র অরোরার ছাদ-ঘরে এল। আজ এখানে কোনো কৃত্রিম আলো নেই। অরোরা এসে বাতিগুলো জ্বালাল না। অরিত্রকে সাগরের মুখপানে একটা চেয়ার দেখিয়ে সেখানে বসতে বলে নিজেও তার পাশের চেয়ারে বসল। অরিত্র জোছনায় ভেসে যাওয়া আটলান্টিকের জলতরঙ্গের দিকে এত বুঁদ হয়ে তাকিয়ে থাকল যে সে ভুলেই গেল, তার পাশে অরোরা নামের এক নারী বসে আছে যার জন্য যে কোনো তরুণ এই সাগর তরঙ্গের মতো এত উতলা হতে পারে। অরোরা নামের কোনো দেবীর ইশারায় চাঁদের রূপালি আস্তরণ বুকে মেখে গর্জনরত এই ঢেউগুলো একে অন্যকে অতিক্রমের খেলায় আজ এত আস্তরিত। আকাশ আর এক মহাসাগরের সাথে চাঁদের এই রহস্যময় কথোপকথনের মাঝে অরিত্র নিজেকে হারিয়ে ফেলছিল। তাকে অমন মগ্ন হয়ে সাগরপানে তাকিয়ে থাকতে দেখে অরোরা বলল, “মনে হচ্ছে, তুমি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতি বিশেষভাবে দুর্বল। কিন্তু প্রকৃতি বলতে শুধু সাগর জলের সাথে জোছনার মাখামাখিকেই বোঝায় না, প্রকৃতির মাঝে যে নারী থাকে সে-ই আসলে প্রকৃতির বড় একটা অংশ। আর নারীটা সুন্দরী হলে প্রকৃতি হয়ে ওঠে আরো রহস্যময়,বুঝেছ বুদ্ধু!“
অরিত্র লাজুক হয়ে উঠল। এমন কথার প্রত্যুত্তর কী হতে পারে তা খুঁজে না পেয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া ভঙ্গিতে আবছা আলোয় তবু স্পষ্ট অরোরার চোখের দিকে সে তাকিয়ে থাকল। ভাগ্যিস এখানে আধো আলো-অন্ধকার! না হলে অরোরার বিষন্ন আর ভেজা ভেজা পাপড়ি দিয়ে মোড়ানো বিস্ময়কর সৌন্দর্যের কাজল আঁকানো চোখ দুটিতে সে হয়তো এতক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারত না। সে ভাবছিল, অরোরা কী করে এত নিঁখুতভাবে তার মনের ভেতরের অনুভূতিটাকে ধরতে পেরেছে? নাকি সব নারীই এমন? প্রকৃতির মতো নৈসর্গিক ক্ষমতাসম্পন্ন। ভাষাহীন অরিত্রের মুখে ভাষাকে প্রবাহমান করতেই অরোরা বলল, “কী ভাবছিলে?“
[hfe_template id=’81’]
অরোরার প্রশ্ন অরিত্রকে সত্যিই শুধু স্বাভাবিকই করল না, তার ভাবনাকে প্রকাশের জন্য প্রেরণাও জোগাল। কিন্তু সে নিজেকে লুকাতেই বলল, “ভাবছিলাম, মহাবিশ্বে স্থল আর জলের পরিধি বদলে গেলেও মহাকাল এভাবেই চাঁদের আলো নিয়ে এই সগরজলে খেলতেই থাকবে, অনাদিকাল ধরে -তার রহস্যময় খেলা!“
অরোরা অরিত্রের কথায় এবার ভাষা হারিয়ে ফেলল। অরিত্রের এই কথাগুলো কেন যেন তাকে আনমনা করে ফেলল। তার অতীত জীবনের ভয়াবহ এক স্মৃতি ভেতরে ভেতরে তাকে অস্থির করে তুলল। নিজেকে শান্ত করার পথ হিসাবে সে অরিত্রের কাছ থেকে এমন নৈসর্গিক কথা আরো শুনতে চাইল। তাকে সে প্রশ্ন করল, “আর কী ভাবছিলে?“
অরোরার প্রশ্নে দীর্ঘ এক শ্বাস নিয়ে অরিত্র বলল, “এই প্রকৃতি আমাকে বলছিল, শুধু পয়সা উপার্জন, ক্ষমতার জন্য ছুটে চলা অথবা জৈবিক আর জাগতিক চাহিদার কাছে জীবনকে সঁপে দেয়া কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। স্রষ্টা মানুষকে আর তার মননকে মহাকালের মাঝে লুকানো সব রহস্যময়তা দিয়ে অনন্য করে সৃষ্টি করেছেন এই জন্য যে, মানুষ প্রাণিগুলো যেন তার অনুসন্ধান করতে গিয়ে উপলব্ধি করে, স্রষ্টা কী অনন্য নৈসর্গিক ক্ষমতার এক মহামান্বিত জীবন তাকে দান করেছেন!“
“বাহ, তুমি এত সুন্দর করে অনুভব করো, অরিত্র! কিন্তু দ্যাখো এই আমরা, এই পদ-পদবি, অর্থ আর ক্ষমতার কাছে হন্যে হয়ে ছুটতে গিয়ে জীবনের এই ‘প্রেরণা‘ নামের নিগূঢ় আনন্দটুকু পায়ে ঠেলি।“
“ইয়েস ম্যাম, প্রেরণার এই পালে ভর করেছিলেন বলে আইনস্টাইন E= MC², নিউটন গতিবিদ্যার সূত্র আবিস্কার করেছিলেন অথবা মার্কেজ ‘শত বছরের নির্জনতা’ নামের উপন্যাসের সৃষ্টি করেছিলেন। আমার বিবেচনায়, সৃজনীশক্তির অধিকারী প্রতিভাবান মানুষ তারাই যাদের নাম মনে হওয়ামাত্র সাথে সাথে তাদের কোনো এক মহান কর্মের কথা মনে পড়ে।“
অরোরা চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল। চেয়ারটা টেনে অরিত্রের সামনে নিয়ে তার মুখোমুখি বসে বলল, “অফিসে আমাদের পেশাগত একটা সম্পর্ক বজায় থাকবে। তবে, অফিসের বাইরে তুমি আমাকে একজন ম্যাডাম না ভেবে বন্ধু ভাবলেই আমি খুশি হব। আমি একজন অন্তর্লোকের বন্ধু চাই, যার সাথে ভাবনা বিনিময় করা যায়। এই পরবাসে আমার নির্জনতর নিসঃঙ্গতা তাহলেই অর্থবহ হয়ে উঠবে।“
অস্ফুট স্বরের চেয়ে চোখের জোরালো ভাষায় অরিত্র তার কথায় সায় দিল।
বেশ রাত করেই মেয়ে পরিচারক খাবার নিয়ে বক্রাকার সিঁড়ি বেয়ে অরোরার ছাদ ঘরে এল। খাবার টেবিলে গুছিয়ে রেখে সে চলে যাবার পর স্যুপের চামচে আলতো চুমুক দিয়ে অরোরা বলল, “তোমাদের দক্ষিণ এশিয়ার মানুষগুলোর চেহারা আর বৈশিষ্ট্যে এত বৈচিত্র কেন, বলো তো?“
এমন প্রশ্নের উত্তর কী হওয়া উচিৎ তা ভেবেই অরিত্র হঠাৎ বলে বসল, “নদী একটা কারণ হয়তো।“
“নদী!“
“হ্যা, নদী শুধু সভ্যতারই সৃষ্টি করে না, নদীর কারণে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য আর নদীর দ্বারা বয়ে আনা পলিসমৃদ্ধ ভূমি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের বিচিত্র মানুষকে সেই ভূমিতে টেনে আনে। তুমি হয়তো জানো না, ইংরেজি বর্ণমালা সৃষ্টির অনেক আগেই আমাদের সভ্যতায় মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। পৃথিবীর শান্তিপ্রিয় জাতিদের প্রথম সারিতে বাঙালিদের নাম থাকবে।“
“হ্যা, তোমাদের শান্তিপ্রিয়তা প্রশংসিত হতেই পারে। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার শান্তিপ্রিয়তায় বর্বর আরবদের রক্ত মিশে সব গণ্ডগোল পাকিয়ে ফেলেছে! প্রাচীন আফগান আর ভারতবর্ষের মানুষের অভিপ্রয়াণ সম্পর্কে আমার জানা সম্পূর্ণ নয়। তবু এটুকু জানি, প্রিন্স ফিলিপ ম্যাসিডিনিয়া আক্রমন করলে প্রথমে গ্রিকরা তুরস্ক আর ইরানের ভূমি হয়ে উত্তর ভারতে তাদের আবাস গড়ে। এরপর ভারতবর্ষের মানুষের ডিএনএ-এর মাঝে আরবের বণিক, পারস্য, তুর্কি এবং পরিশেষে সুলতান, চেঙ্গিস-হালাকু খান এবং মোগলদের বংশস্রোত মিশে গিয়েছে। যাই-ই বলো, পৃথিবীর জটিলতম ডিএনএ তন্তু দিয়ে তোমাদের বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রিত। এই বিষয়গুলো নিয়ে আরো জানতে আমার খুব ইচ্ছা করে।“
[hfe_template id=’81’]
অরোরার কথায় অরিত্র চমকে তার দিকে তাকিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল। নারী হৃদয় কি তার সামনে উপবিষ্ট মানুষের ভাবনালোকেও ঢুকে যেতে পারে? অরোরা কীভাবে তার মনের কথা পড়ে ফেলতে পারল? তার অমন করে তাকিয়ে থাকা দেখে অরোরার নিজেকে অপরাধি মনে হলো। এমন কথায় অরিত্র কি অসম্মানিত বোধ করল? এসব ভেবে অরোরাই আবার বলল, “দেখো, কাবুল তথা খাইবার গিরিপথের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত সিল্করোডের মানুষগুলো এককালে কত উদার আর অতিথিপরায়ণ ছিল। সেই অনন্য জাতির রক্তের ভেতর আরবদের অন্ধকার যুগের রক্ত এসে তালেবান এক জাতিসত্তা তৈরি করেছে। আশা করি, তুমি ভুল বুঝবে না।“
অরোরা কি এই প্রসঙ্গ তুলেছে এই জন্য যে, অরিত্র এইসব অঞ্চলেরই পাশের একটি দেশের বাসিন্দা? নাকি এই অঞ্চলের সাথে অরোরার কোনো স্মৃতি জড়িয়ে আছে? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে না পেলেও অরিত্র তার ভাবনার সাথে অরোরার ভাবনার মিল খুঁজে পাওয়ায় অনেকটাই স্বস্তি বোধ করল। বলল, “আমি ভাবছিলাম অন্য কথা।“
“কী?“
“একজন ইউরোপিয়ান হয়ে তুমি কত সহজভাবে সত্যিটা উপলব্ধি করেছ…“
“‘অন্ধকার-যুগে’ আরবরা কন্যা সন্তানকে জীবন্ত পুঁতে ফেলত। এখনো এরা নারীদের প্রতি সহৃদয় তো নয়ই, বরং সাদা বোরখায় ঢাকা তাদের কালো আত্মাগুলো নারী দেখলেই তাকে কাঁচা খেয়ে ফেলার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। আরব বংশোদ্ভূত রাজা-বাদশাহ এমনকি তোমাদের ভারতবর্ষের, সম্রাট, রাজা-জমিদাররাও অসংখ্য স্ত্রী দিয়েও তাদের লালসা পূর্ণ না হওয়ায় ‘হারেম’ শব্দের আড়ালে বস্তুত নারী-সম্ভোগের পতিতালয় চালিয়েছে।“
অরিত্র দীর্ঘশ্বাস ফেলল, অথচ এদের হেদায়েতের জন্য এত নবী ও রসুলকে আল্লাহতায়ালা শুধু এই ভূমিতেই পাঠিয়েছেন।
“মানুষের ডিএনএ-এর প্যাঁচানো তন্তুকে লম্বা করলে নাকি তার দৈর্ঘ সাড়ে চার হাজার কি.মি. থেকে ছয় হাজার কি.মি. পর্যন্ত লম্বা হবে। এই ডিএনএ-ই মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণ করে। নবী-রসুল, কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমনকি কোনো মহান গ্রন্থ জন্মগতভাবে পাওয়া এত বিস্তৃত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কীভাবে নিয়ন্ত্রন করবে, বলো?“
[hfe_template id=’81’]
অরিত্র মনোযোগ দিয়ে অরোরার কথা শুনছিল। সে বলল, “হ্যা, এখনো কারণে-অকারণে শিশু-নির্যাতনে এদের জুড়ি নেই। পিতার হাতে বিশেষত কন্যা শিশু মৃত্যুর ঘটনা এখনো এরা লুকিয়ে ফেলে। কিন্তু ম্যাম, পুত্রসন্তান আমাদের দেশের বাবাদের অনেক কাঙ্খিত হলেও, কন্য-সন্তানের প্রতিও তারা অনেক দুর্বল।“
“আমাকে ম্যাম ডাকবে না। ম্যাম শব্দের চেয়ে অরোরা আমার কাছে শ্রুতিমধুর। আর হ্যা, আমি তোমার সাথে এক ছুটিতে তোমার দেশ এবং ভারতের ঐতিহাসিক স্থানগুলোকে ঘুরে দেখতে চাই।“
অরিত্রের চোখে মুখে আনন্দময় হাসির রেখা স্পষ্ট হলো। সে তার কণ্ঠস্বরে আনন্দ মেখে বলল, “অবশ্যই।“
শব্দটা বলার পর তার মুখে প্রায় ‘ম্যাম‘ উচ্চারিত হতে যাচ্ছিল। কিন্তু সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলেও অরোরা তা বুঝে ফেলে, মিষ্টি করে হাসল।
হাজার হোক অরিত্র শান্তিপ্রিয় আর নীরিহ রক্তের এক বাঙালি সন্তান, যার সাথে অরোরা নিরিবিলি এই রাতেও নিরাপদ। যার সাথে অরোরা এক মহাদেশ পেরিয়ে আরেক মহাদেশ বেড়াতেও মানসিকভাবে তার অবারিত আনন্দরাশিতে অন্য কোনো ভাবনায় দ্বিধান্বিত নয়।

কাজী রাফি
কথাশিল্পী।
জন্ম – ২২ নভেম্বর, ১৯৭৫, বগুড়ায়।
মানুষ ও তাদের যাপিত জীবন এবং প্রকৃতি দেখার প্রয়োজনে ঘুরেছেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। চাকরির প্রয়োজনে আফ্রিকায় বাস করেছেন দুই বছরের অধিক সময় এবং আফ্রিকার প্রকৃতি-সংস্কৃতি, তাদের প্রান্তিক মানুষের যাপিত জীবনকে দেখেছেন খুবই কাছ থেকে। আফ্রিকার পটভূমিতে লেখা ‘ধূসর স্বপ্নের সাসান্দ্রা’ তাঁর প্রথম উপন্যাস। এই উপন্যাসেই কালি ও কলম পুরস্কার লাভ করেছেন তিনি; তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ, ১১ টি উপন্যাস এবং ৬ টি ছোট গল্পগ্রন্থ সবই পাঠক প্রিয়তায় প্রথম সারিতে। তাঁর লেখা ‘ত্রিমোহিনী’ উপন্যাসকে মহাকাব্যিক অ্যাখ্যা দিয়েছেন কিংবদন্তী ছোট গল্পকার হাসান আজিজুল হক ।
পুরস্কার, এইচএসবিসি কালি ও কলম পুরস্কার -২০১০, এমএস ক্রিয়েশন সম্মাননা -২০১০, নির্ণয় স্বর্ণপদক-২০১৩, এসএম রাহী পদক ২০১৯